লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পর্ব -০১+২+৩

থমথমে শিকদার বাড়ি। কারো মুখে কোন কথা নেই। এ বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ঠ কন্যা চৈতালীর আজ বিয়ে ছিলো। কিন্ত বর আসেনি। আজ থেকে ছয়মাস আগে মোর্শেদ মির্জার ছেলে আশরাফ মির্জার সাথে চৈতালীর আংটি বদল হয়েছিল। এতদিন তারা দেখা সাহ্মাৎ করেছে। ভালো একটা বোঝােপড়াও হয়েছিলো তাদের মধ্যে। বিয়ে ভাঙার হলে আগেই বলতে পাড়তো, আজ এরকম নাটক করে মান সম্মান খাওয়ার মানে কি?? রাগে দপদপ করছে শিকদার বাড়ির মানুষ। একহাত দেখে নিবে বলে শাসাচ্ছে মির্জাদের।
সকলের সম্মুখে মাথা নত করে আছে মোর্শেদ মির্জা। হ্মমা চাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। তবে শিকদার বাড়ির লোকজনের ভাব- গতিক ভাল লাগছে না। কি করে বসে বোঝা মুশকিল। হ্মুনাহ্মরেও তিনি ছেলের মনের কথা বুঝতে পারেন নি। গতকাল অবধি ছেলেকে দেখে মনে হয়েছে সে চৈতালী বিনে কিছু বুঝে না। সেই ছেলে যে পালিয়ে যাবে কে জানতো? একবার হাতের কাছে পাক ছেলেকে তার কি করা লাগে তার জানা আছে। তার আগে এখান থেকে বের হতে হবে। শিকদার দের মাথা এখন গরম। কি করতে কি করে ফেলে বলা যায় না। তবে চৈতালীর জন্য খারাপ লাগছে তার। কি সুন্দর মেয়েটা। নাটক সিনেমা বা উপন্যাসের মত তার যদি আর একটা ছেলে বা ভাতিজা থাকতো তাহলে চৈতালীকে আজ তার সাথে বিয়ে দিতো। আফসোস নেই। থাকার মধ্যে ঐ কুলাঙ্গার ছেলেই আছে।

বিছানায় স্তব্দ হয়ে বসে আছে চৈতালী। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত সে ভেবেছিলো আশরাফ মজা করছে। ঠিক চলে আসবে। তবে কয়েক মিনিট আগে আসা আশরাফের মেসেজে পুরো দুনিয়া উল্টে গেছে চৈতালীর। মেসেজে আশরাফ লিখেছে-
চৈতালী
তুমি হয়তো এতহ্মন খবর পেয়ে গেছো আমি পালিয়েছি। বিশ্বাস করতে পারছো না তাই না?? আমি জানি আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। গত ছয়মাস তোমার সাথে নাটক করেছি। তোমাকে মিথ্যা সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছি। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলো না। আমি মিতু নামে একটা মেয়েকে ভালবাসি। দু বছর আগে আমরা গোপনে বিয়েও করছি। মিতু আমার ক্লাসমেইট। আমরা সেইম এজের বলতে পারো। বাবাকে মিতুর কথা বলেছিলাম। বাবার ধারণা মিতুর বয়স বেশী। ছেলের বউ হবে কমবয়সী। তাই ২৫ বছরের আমার জন্য ১৭ বছরের তোমাকে পছন্দ করলেন। মিতুর সাথে আমার সম্পর্ক কলেজ থেকে৷ এই আমার জন্য ও জীবনে হাজার টা বিয়ে ভেঙেছে। ওর মনে কিভাবে কষ্ট দিতাম বলো? পারলে আমাকে মাফ করে দিও। তোমার মন ভাঙ্গার কোন ইচ্ছা আমার ছিলো না। কিন্তু আমি ও নিরউপায় ছিলাম। পর্ব ২
লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
সামিরা আক্তার
———
মেসেজটা পড়ে চৈতালী পাগলের মত আশরাফ কে ফোন করতে লাগলো। ওপাশে রিং হলো তবে কেউ ধরলো না ফোনটা। তার বদলে আশরাফের নাম্বার থেকে ভেসে আসলো আর একটা মেসেজ। মেসেজে না দেখে চৈতালী আবার ফোন করতে লাগলো। তার বিশ্বাস আশরাফ মজা করছে। কিন্তু এবার ফোন বন্ধ। চৈতালীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো।চোখের পানি মুছে আশরাফের দেওয়া দ্বিতীয় মেসেজ ওপেন করলো। আশরাফ লিখেছে- “চৈতালী ” আমাকে ফোন করে আমার পাপবোধ বাড়িয়ে দিও না প্লিজ। ভাবছো তো তোমার কি দোষ ছিলো? তোমার সাথে কেন এমন করলাম?? হ্যাঁ আমি মানছি তোমার দোষ নেই। এর মধ্যে তোমাকে না জড়ালেও পাড়তাম। কিংবা তোমাকে আগে থেকে সব জানাতে পারতাম। তোমার কাছে হেল্প চাইতে পারতাম। কিন্তু আমি সেসব কিছুই করি নাই। কারন তাহলে ব্যাপারটা কেমন খাপছাড়া লাগতো। আমি আমার বাবার কাছে বিশ্বাস যোগ্য হতে চেয়েছিলাম। আমার বাবা খুবই চালাক মানুষ। একবার যদি বুঝতো আমাদের সম্পর্কে ফাঁক আছে তাহলেই সন্দেহ করতো। মিতুর কথা বলার পর থেকেই বাবা আমাকে নজরে রাখতে শুরু করেছিলেন। তাই আমি এমন ভাব ধরে থাকতাম যেন তোমার সাথে সম্পর্কে আমি অনেক খুশি। জানই তো আমরা সন্তানেরা মা – বাবার কাছে বড় অসহায়। এরা আর কিছু না পারুক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল খুব ভালো পারে। তাছাড়া বাবার বিশ্বাস জেতার অন্যতম কারণ ছিলো টাকা।
তুমি আমাকে লোভী ভাবতে পারো কিছুই করার নেই। জীবন সিনেমা নয় বা আমি আলাদিনের চেরাগ পাই নি। মিতুকে নিয়ে ভাল থাকার জন্য আমার টাকার দরকার ছিলো। এই ছয়মাসে আমি বাবার কাছ থেকে অনেকবার টাকা নিছি। ঢাকা শহরে একটা ফ্ল্যাট কিনছি। আর বাকি টাকা দিয়ে ছোট খাট ব্যবসা শুরু করছি। তুমি এই মেসেজ পড়ছো আর আমি মিতুকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়েছি। তোমাকে সবই জানালাম। পারলে এই অধমকে হ্মমা করে দিও। মিতুকে গালাগালি করো না প্লিজ। ও এসবের কিছু জানে না। আমার সাথে বিয়ে হলে তুমি উল্টো কষ্ট পেতে কারণ তোমার স্বামীর মনে অন্য কেউ বাস করতো। তুমি এখনও অনেক ছোট চৈতালী। লেখাপড়া করো। জীবনকে আগাও। এমন কাউকে পাবা যে আজকের বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা তোমার কাছে আর্শীবাদ মনে হবে।
মেসেজে আর কিছু লেখা নেই। চৈতালী ধীরে ধীরে বেলকনিতে গিয়ে বেলকনির দরজা আটকে দিয়ে বেলকনিতে বসে পড়লো। না চাইতেও এতহ্মণ আটকে রাখা চোখের জল গাল বেয়ে পড়তে শুরু করলো। একটা ছেলে তার জীবনে এলো, তাকে ভালবাসতে বাধ্য করলো, সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখালো, তারপর বিয়ের দিন পালিয়ে গিয়ে জানালো এসব মিথ্যা ছিলো?
(ক্রমশ)পর্ব ৩
লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
সামিরা আক্তার
——
চৈতালীর দিনটা আজ চমক পাওয়ার জন্যই বোধ হয় শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বারের চমকে সে বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেললো। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো তার বাবা তাকে আজকে এই আসরেই বিয়ে দিবেন তাও আবার তার বড় চাচার ৩৩ বছর বয়সী ডিভোর্সি ছেলের সাথে। অতিরিক্ত কষ্টে তার কথা বন্ধ হয়ে গেলো। এমনকি চোখ দিয়ে একফোঁটা পানিও বের হলো না। বলে না বিপদে মানুষ বুূদ্ধিহারা হয়ে যায় চৈতালীর অবস্থা ও তাই হলো। কি করতে হবে ভুলে গেলো। মা বাবার প্রতি অভিমানে তার গলা বুঝে এলো। নিজেকে অতিরিক্ত সস্তা মনে হলো।
চৈতালীর ভাবনার মধ্যে তার বাবা আসলাম শিকদারও মা রেবেকা রুমে আসলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন তারা। বোঝাই যাচ্ছে মেয়ের মনের উপর ঝড় বয়ে গেছে। তার উপর এরকম একটা সিধান্ত তারা নিয়েছেন মেয়ের কাছে না শুনেই। কিভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। তাদের অবস্থা দেখে চৈতালী এগিয়ে আসলো। বললো কি বলতে এসছো বাবা? রাফসান ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে? আমি সুখী হবো তাকে বিয়ে করলে ইত্যাদি ইত্যাদি।
– দ্যাখ মা বয়স একটা সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই না। আর এবাড়িতে কখনো কারো বিয়ে এভাবে ভাঙে নাই। লোকজন ভাববে মেয়ের মধ্যেই সমস্যা। জানিসই তো, যাইহোক আমরা মেয়েদের দোষ ধরতে পছন্দ করি। এতহ্মণে মুখ খুললেন চৈতালীর বাবা।
-ব্যাপারটা কেমন হলো বলো তো বাবা? সেকেলে? না সিনেমাটিক? না কি উপন্যাসিক? কোনটা?
মেয়ের কথার মানে না বুঝতে পেরে মেয়ে দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। বাবার তাকিয়ে থাকা দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো চৈতালী। মেয়ের হাসি দেখে স্বামীর হাত খাঁমচে ধরলেন চৈতালীর মা। তার মেয়েটা কি অতি দুঃখে পাগল হয়ে গেলো??
হাঁসি থামিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো বুঝতে পারো নি তাই না??
দুপাশে মাথা নাড়ালেন আসলাম শিকদার। চৈতালী বললো আগের দিনে মানে ব্রিটিশ দের সময় আর কি, মেয়েদের বিয়ে ভাঙলে এরকম বাবার বয়সী, দ্বিগুণ বয়সী, দাদার বয়সী কাউকে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দিতো আর কি। আবার সিনেমা, নাটক, উপন্যাসেও এমন দেখা যায়। তাই বললাম। তা না হলে বিয়ে ভাঙার মত একটা লেইম কারণ দেখিয়ে আমাকে রাফসান ভাইয়ের গলায় ঝুলাতে চাইতে না।
মেয়ের কথার পিঠে কোন কথা খুজে পেলেন না আসলাম শিকদার। শুধু বললেন রাফসানের বয়স একটু বেশী মানছি, তবে ওকে দেখে কিন্তু কেউ বলতে পারবে না ওর বয়স ৩৩ হয়েছে। নিজেকে কি ফিট.
বাবাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিলো চৈতালী। বললো বিয়ের ব্যবস্হা কর। বিয়ে করে তোমাদের উদ্ধার করি।

রাত আটটার দিকে বিয়ে হয়ে গেলো চৈতালী আর রাফসানের। চৈতালির বাবা তার বড় ভাই আসমাত শিকদার কে বললেন ভাইজান চৈতালী কিছুদিন এখানেই থাক। ধীরে সুস্থে নিয়ে যেও। আসমাত শিকদার কিছু বলার আগেই বাধ সাধলো চৈতালী স্বয়ং। বললো আমার বিয়ে হয়ে গেছে আমি এখন শ্বশুর বাড়ি যাব বাবা।
মেয়ের কথায় মুখ শুকিয়ে গেল আসলাম শিকদারের। মেয়ে জিদ করে বিয়ে করছে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তবে এতটা সেটা বুঝতে পারেন নি। এই মুহুর্তে যে তার কিছু করার নেই সেটাও বুঝলেন। মেয়েটা তার বড় আদরের…
(ক্রমশ)
আশরাফ
# লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
সূচনা পর্ব
সামিরা আক্তার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here