শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব -১৮+১৯+২০

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (১৮)

সময় তার নিজের আপন গতিতে কেটে যায়।তেমনি কাটছে ধ্রুব আর শালুকের সময়। শালুক আজ এক সপ্তাহ ধরে বই নিয়ে বসছে। সারাদিন অখন্ড অবসর তার।এই অবসর শালুকের সহ্য হচ্ছে না।
দম বন্ধ লাগছে শালুকের। ধ্রুব সকালে রান্না করে বের হয়ে যায়, রাতে ফিরে।ঘন্টায় ঘন্টায় শালুককে কল দিয়ে কি করছে, কি লাগবে জিজ্ঞেস করে।
ধ্রুবর এরকম আন্তরিকতা শালুককে আরো বিব্রত করে।
কেনো জানি শালুকের মনে হয় ধ্রুব হয়তো শালুককে একটু একটু ভালোবাসে।
আবার পরক্ষণেই মনে হয় যে শালুক ভুল ভাবছে।হতেও তো পারে,ধ্রুব এমনিতেই শালুকের কেয়ার করছে।এটা তো ধ্রুবর পুরনো স্বভাব।

এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে শালুকের মনে পড়লো শালুক একটা কম্পোজিশন পড়তে বসেছে। পড়া বাদ দিয়ে এসব এলোমেলো ভাবনা ভাবছে।
ধ্রুব রাতে ফিরলে নিশ্চিত পড়া ধরবে।

কেনো জানি শালুকের লজ্জা লজ্জা লাগে ধ্রুবকে ঠিকঠাক পড়া দিতে না পারলে।
অথচ আগে এরকম লাগতো না।
একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মন মানসিকতা ও এভাবে বদলে যাবে তা কি শালুক কখনো ভেবেছে?

ধ্রুব একটা বড় শপে সেলসম্যানের চাকরি নিলো মাসিক ১৪ হাজার টাকা বেতনে।
সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত। চারটের সময় বের হয়ে টিউশনিতে যায়,সাতটায় টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে ধ্রুবর রাত সাড়ে আটটা বাজে।
রাতে এসে রাতের রান্না করে নেয়।

শালুক লজ্জিত হয়ে বসে রইলো বিছানার উপর। মেয়ে হয়েও সে কিছুই করতে পারছে না অথচ ধ্রুব সব কাজ করছে।ব্যাপারটা শালুককে যথেষ্ট লজ্জিত করছে।
অথচ ধ্রুবর দিকে তাকালে মনে হয় তার কোনো ক্লান্তি নেই।কেমন যেনো স্বতঃস্ফূর্ত থাকে ধ্রুব।

আজ রাতে ফেরার সময় শালুকের জন্য ছোট ছোট কতোগুলো হেয়ার ব্যান্ড, ক্লিপ,পাঞ্চক্লিপ,হেয়ার প্যাক,তেল নিয়ে এলো ধ্রুব।

শালুক আজকে ধ্রুব বাসায় ফেরার আগেই পেঁয়াজ, মরিচ কেটে রেখেছিলো যাতে ধ্রুবর কাজ কিছুটা সহজ হয়।

ধ্রুব কিচেনে বাটির মধ্যে এসব কেটে রাখা দেখে মুচকি হাসলো। তারপর শালুকের কাছে এসে বললো, “এসব ছোট খাটো কাজ আমি অনায়াসেই করতে পারি শালুক।আর কখনো তুই এসব করতে যাবি না।বিশেষ করে বাসায় যখন আমি থাকবো না সেই মুহুর্তে ভুল করেও তুই দা,বটি,ছু/রি,আগুন এসবের ধারেকাছেও যাবি না।
আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না তোকে নিয়ে।
খবরদার শালুক,আজকে নিষেধ করে দিয়েছি আমি।”

শালুকের ভীষণ অভিমান হলো।গাল ফুলিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, “আমার খুব খারাপ লাগে,আমি মেয়ে হয়েও কিছুই জানি না রান্নার অথচ তুমি ছেলে হয়ে সব কিছু রান্না করছো।”

ধ্রুব মাছ তেলে ভাজতে দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে শালুকের পাশে এসে বললো, “সংবিধানে কি লিখা আছে না-কি যে রান্না শুধু মেয়েদের কাজ,এটা শুধু মেয়েরাই করবে?ছেলেদের জন্য কি কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে না-কি? কাজের মধ্যে ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই।আসলে আমাদের সমাজের সিস্টেম হচ্ছে এরকম। যেহেতু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তাই পুরুষেরা মহিলাদের মাথায় এই ধারণা সেট করে দিয়েছে যে ঘরের কাজ,রান্নাবান্না, বাচ্চা সামলানো এসব কাজ নারীর। পুরুষ টাকা উপার্জন করছে যেহেতু সেহেতু নারীদের থাকতে হবে পুরুষের ইচ্ছেমতো। তারা যেভাবে চালাবে নারী সেভাবেই চলবে।
অনেক পুরুষ আছে শালুক,যারা শুধু অফিসটাই করে,তারপর বাসায় এসে হম্বিতম্বি শুরু করে দেয়। এক গ্লাস পানি ঢেলে খাবে তাও তার সম্মানে বাঁধে।স্ত্রী রান্না করছে হয়তো সেখান থেকে ডেকে নিয়ে এসে বলবে আমাকে এক গ্লাস পানি দাও।
অথচ তার স্ত্রী যে সারাদিন দু দন্ড বিশ্রাম নিতে পারে নি এটা তার মাথায় নেই।
সেই এক পুরনো প্রশ্ন,সে তো সারাদিন বাড়িতেই থাকে,কি কাজ করে?

তেমনি এখন নারীরাও আধুনিক হচ্ছে, পুরুষের দাসত্ব তারা মানতে চায় না। কেউ কাউকে স্পেস দিতে চায় না।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর মধুর সম্পর্ক। আমাদের রাসুল মুহাম্মদ (স.) তার স্ত্রীদের সাথে কি সুন্দর ব্যবহার করতেন শালুক,তার সেই আদর্শ যদি আমরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারতাম তবে দেশে বিবাহবিচ্ছেদ এতো বেড়ে যেতো না।

প্রথম কথা হচ্ছে, দুজনকেই দুজনের সমস্যা, অসুবিধা বুঝতে হবে।একে অন্যের প্রতি সদয় হতে হবে।সে আমার স্ত্রী/স্বামী শুধু এটা না ভেবে যেদিন আমরা ভাবতে পারবো সে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমরা দুই দেহ,এক প্রাণ। তার ব্যথা মানে আমার ব্যথা।তার কষ্ট আমার ও কষ্ট সেদিন আর দাম্পত্য জীবনে অশান্তি আসবে না।তাকে অন্য আলাদা কেউ না ভেবে নিজের দেহের অংশ ভাবতে হবে।

এই যে এখন তুই আমার দেহের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তোকে একা বাসায় রেখে যাই আমি, মনটা এখানেই পড়ে থাকে।
তুই এখনো অনেক ছোট, সংসার সামলানোর মতো বয়স,জ্ঞান কোনোটাই তোর হয় নি। একা বাসায় কাজ করতে গিয়ে যদি কোনো সমস্যা হয় তবে কে দেখবে তোকে?
তোকে এখন এসব কাজ নিয়ে ভাবতে হবে না। একান্তই যদি কাজ করতে ইচ্ছে করে তবে সেটা শুক্রবারে, আমি যখন বাসায় থাকবো। এখন তোর কাজ হচ্ছে পড়াশোনা করা।নয়তো আমি নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাবো শালুক তুই যদি ভালো রেজাল্ট করতে না পারিস।নিজেকে ব্যর্থ মনে হবে।”

শালুক চুপ করে রইলো। ধ্রুব দৌড়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে মাছ পুড়ে যাবে বলে। ধ্রুব চলে যেতেই শালুক মুচকি হাসলো। বিবাহ নামক বন্ধনটির এতো শক্তি তা শালুক আগে জানতো না।
ধ্রুবর মতো মানুষকে ও কেমন আবেগী করে দেয়।যাকে বিয়ের আগে শালুক লৌহ মানব ভাবতো তার ও একটা কোমল মন আছে।ভাবলেই চমকে উঠে শালুক। সারা শরীর, মন জুড়ে এক ভালো লাগার আবেশ কাজ করে।

শালুক নিজের পড়া শেষ করে রাখলো। ধ্রুব মাছ,ভাত,ডাল রান্না করে সব প্লেটে,বাটিতে করে বেড়ে নিয়ে এলো। দুজন মিলে খাওয়া শেষ করে ধ্রুব শালুকের পড়া ধরলো।
শালুকের পড়ায় উন্নতি হচ্ছে বুঝতে পেরে ধ্রুবর ভীষণ ভালো লাগলো।

পড়া শেষ হতেই ধ্রুব তেল নিয়ে শালুকের চুল বেঁধে দিলো,বেনি করে দিলো দুটো।
শালুকের তখন ভীষণ করে বড় চাচী,মেজো চাচীর কথা মনে পড়লো। ঢাকায় আসার পর শালুক একদিন ও চুলে চিরুনি লাগায় নি।আগে থেকেই অভ্যাস না থাকায় চুল বাঁধার ব্যাপার, চুলে তেল দেয়ার ব্যাপার শালুকের বিরক্ত লাগে।

রাতে শুতে গিয়ে ধ্রুবর মনে হলো বাসায় একটা ফ্রিজ লাগবে,শালুকের জন্য একটা পড়ার টেবিল লাগবে,একটা ড্রেসিং টেবিল লাগবে,একটা ওয়ারড্রব লাগবে।
২২ হাজার টাকা মাসিক ইনকাম যেখানে সেখানে নিজেদের সংসার খরচ বাসা ভাড়া মিলিয়ে হয়ে যায় কোনো মতে।
বাকিটা কিভাবে করবে ধ্রুব!
শালুকের নিশ্চয় ভীষণ অসুবিধা হয়।একটা ফ্রিজ হলে গরম লাগলে শালুক ঠান্ডা পানি খেতে পারতো। মাছ,মাংস ফ্রিজে রাখতে পারতো। এখন যা আনা হয় তা রাখার জায়গা নেই,চুলায় জ্বাল করে রাখতে হয়।

শালুকের জামাকাপড় সব শপিং ব্যাগ এ গুছিয়ে রাখে।শালুক কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থেকে ধ্রুবকে বললো, “আপনি দুটো প্যান্ট কিনছেন না কেনো?প্রতিদিন একটা জিন্স প্যান্ট পরেই বাহিরে বের হয়ে যান।”

ধ্রুব হাসলো। প্রতিদিন প্যান্ট পরতে গেলে ধ্রুবর নিজের ও মনে হয় আরেকটা প্যান্ট দরকার। কিন্তু তারপর আর কেনা হয়ে উঠে না।নানাদিক ভেবে নিজের জন্য কিছু কিনতে ও খারাপ লাগে।মনে হয় অযথাই টাকা নষ্ট।

শালুক কড়া গলায় বললো, “কাল যদি নতুন প্যান্ট ছাড়া বাসায় ফিরেন তবে মনে রাখবেন আমি আপনার এই প্যান্ট ও কেটে কুচিকুচি করে দিবো।লুঙ্গি পরে বের হবেন আপনি।”
ধ্রুবর ভীষণ ভালো লাগলো তার জন্য শালুকের এই তৎপরতা দেখে।

শালুক ঘুমিয়ে পড়লো খুব দ্রুত।শালুক ঘুমালে ধ্রুব শালুকের একটা হাত টেনে নিজের বুকের উপর চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো, ” কবে তোকে বলতে পারবো তুই আমার কেশবতী? আমার বোকা ফুল,আমার ভালোবাসা তুই।যাকে সবসময় সবার কাছ থেকে, বিশেষ করে আদনান ভাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছি।

কেউ জানে না,শুধু আমি জানি তোকে কতো যত্নে আদনান ভাইয়ের নাগাল থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি।শুধুমাত্র আদনান ভাইয়ের কুনজর তোর উপর পড়বে বলে হল বন্ধ না হওয়া সত্ত্বেও আমি বাড়িতে ছুটে গেছি আদনান ভাই যেদিন দেশে এসেছে তার পরদিন।আমি তো জানি আদনান ভাইয়ের যে গাছের ও খাবার, তলার ও কুড়াবার স্বভাব। সে তো স্কুল লাইফ থেকেই এরকম ছিলো।

তোর মনে আছে শালুক,আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়েছি আদনান ভাই বিদেশ যাবার দুদিন পর। তা না হলে আমিও বাড়িতেই থাকতাম,জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম যাতে করে তোকে চোখে চোখে রাখতে পারি।তুই শুধু আমার শালুক।”

ঘাপটি মেরে ঘুমের ভান করে শুয়ে থেকে শালুক সবটা শুনলো।তারপর শুনতেই শালুকের সারা শরীর যেনো কেঁপে উঠলো কেমন করে। তার মানে, ধ্রুব ভাই তাকে ভালোবাসতো! সেই ছোট বেলা থেকে ধ্রুব ভাই তাকে ভালোবাসে অথচ শালুক বুঝতে ও পারে নি?
আর ধ্রুব ভাই,সে নিজেও খুব সুন্দর করে লুকিয়ে গেছে এই ব্যাপারটা শালুকের থেকে!

শালুকের কেমন উসখুস লাগতে লাগলো। নিজের দুই কানকে অবিশ্বাস হলো কিছু সময়ের জন্য। হয়তো সে ভুল শুনেছে এসব।

ধ্রুব টের পেলো শালুক জেগে আছে।এবং সবটা শুনে এখন স্থির থাকতে পারছে না।ধ্রুবর কিছুটা লজ্জা লাগলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু সুরে বললো, “শালুক!”

বোকার মতো শালুক ও হ্যাঁ বলে দিলো।তারপর হ্যাঁ বলেই শালুক বুঝতে পারলো সে ভুল করে ফেলেছে। ধ্রুব এখন জেনে গেছে শালুক যে জেগে আছে।
ধ্রুব হেসে বললো, “আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি শালুক।আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা তুই শালুক।কতো কষ্টে নিজের ভালোবাসা, ভালোলাগা, আবেগ সবটা আমি লুকিয়ে রেখেছি তোর কাছ থেকে।আমার ভীষণ কষ্ট হতো লুকিয়ে রাখতে,তবুও উপায় ছিলো না। তুই কোনোভাবে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে দিস যদি এই ভয়ে কখনো তোকে বুঝতে দিই নি।
বুকের ভেতর ভালোবাসার এক ঘূর্ণিঝড় আমি সযত্নে চাপা দিয়ে রেখেছি।”

শালুক কথা বলতে পারলো না। সব কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। ধ্রুব ও শালুকের হাত ছাড়লো না। দুজন ঘুমিয়ে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে শালুক লজ্জায় ধ্রুবর দিকে তাকাতে পারছে না।না চাইতেই মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে শালুকের। কেমন যেনো ভয় ও লাগছে।সে তো ধ্রুবর কাছে বলে দিয়েছিলো সে যে আদনানকে ভালোবাসে।
ধ্রুব কি এখন সেটা ধরে রেখেছে মনে? ধ্রুব তাকে বুঝিয়ে বলার পর যে শালুক নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে,এক মুহুর্তের জন্যও তার মনে আদনানের চিন্তা আসে নি,সব অনুভূতি ফিকে হয়ে গেছে তা তো ধ্রুব জানে না।
ধ্রুবর একটু মন খারাপ হলেই যে শালুক অস্থির হয়ে যেতো তা কি ধ্রুব জানে?

সকালে উঠেই ধ্রুব রান্না বসিয়ে দেয়। সকালে আর নাশতা বানানোর সময় হয় না প্রতিদিন। বেশিরভাগ সময় ভাত খেয়ে নেয় দুজনেই।
আজও ধ্রুব চুলায় রান্না বসিয়ে শালুকের পাশে এসে বসলো। তারপর বললো, “আয়,তোর চুলে হেয়ারপ্যাক লাগিয়ে দিই।চুল বড় হতে হবে তোর।”

শালুক মাথানিচু করে বসে রইলো। ধ্রুব আপনাতেই বলতে লাগলো, “শালুক তুই কি জানিস,তুই যে ভীষণ বোকা একটা মেয়ে?কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা মোহ তা নিজেই বুঝতে পারিস নি।
তুই হয়তো ভয় পাচ্ছিস আমার কাছে আদনান ভাইয়ের ব্যাপারটা বলে দেয়াতে।আমি বলছি বিশ্বাস কর,আমি তো জানি তুই যে আদনান ভাইয়ের প্রেমে পড়িস নি আসলে।
তোর মনে আদনান ভাইয়ের জন্য কোনো ভালোবাসা জন্ম নেয় নি। নিজের মনকে তুই পড়তে পারিস নি।

আচ্ছা, বল তো।আমরা যখন ক্রিকেট খেলতাম তখন তুই কার দল সাপোর্ট করতি?”

শালুক চুপ করে রইলো। সে তো ধ্রুবদের দলকে সাপোর্ট করতো।ধ্রুব যখন আউট হয়ে যেতো শালুকের মন খারাপ হয়ে যেতো। ইচ্ছে করতো ধ্রুবকে যে আউট করেছে তার মাথা ফা/টিয়ে দিতে।

ধ্রুব একটু সময় চুপ থেকে বললো, “বাড়িতে ফিরতে দেরি হলে কার জন্য তোর চিন্তা হতো? ”

শালুক চুপ করে রইলো। সে ছোট ছিলো তখন।ভালোবাসা বুঝতো না সেভাবে হয়তো কিন্তু তবুও তার মন কেমন আনচান করতো ধ্রুবর জন্য। ধ্রুবর কিছু হলেই শালুকের মনে হতো ধ্রুব না জানি কতো কষ্ট পাচ্ছে।

সেদিন ও তো ধ্রুব রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর শালুকের মনে হয়েছে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে ধ্রুবকে না দেখলে।

ধ্রুব রাবার দিয়ে চুল বেঁধে দিয়ে বললো, “ভালোবাসা আর ভালো লাগা ব্যাপারটা তুই বুঝে উঠতে পারিস নি বলেই তো বুঝতে পারিস নি কাকে ভালোবাসিস।তবে তুই না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝেছি আমাকে তুই ভীষণ ভালোবাসিস।চুলে শ্যাম্পু করে নিস একটু পরে গোসল করে।আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

ধ্রুব চলে গেলো রান্নাঘরে। লজ্জায় পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলো শালুকের সমস্ত মুখমন্ডল।
ধ্রুবর সব কথাই ঠিক।শালুক বোকা বলেই নিজের ভালোবাসা কার জন্য তা বুঝতে পারে নি।

খাওয়ার পর ধ্রুব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শালুক দেখতে লাগলো হন্তদন্ত হয়ে ধ্রুব বের হয়ে যাচ্ছে বাসা থেকে। নিচে গিয়ে ধ্রুব উপরের দিকে তাকালো। শালুক লজ্জা পেয়ে গেলো আজ।প্রতিদিনই তো এভাবে শালুক দাঁড়ায়,ধ্রুব ও তাকায়।তবে আজ কেনো এমন লাগছে?

ধ্রুব মুচকি হেসে চলে গেলো। শালুকের সারা শরীর যেনো অবশ হয়ে গেলো ধ্রুবর এই তাকানোতে,এই মুচকি হাসিতে।
শালুক বুঝতে পারছে না আজ কেনো তার এরকম লাগছে।
ভালোবাসা কি তবে এরকমই হয়!
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (১৯)

আকাশ আজ অত্যধিক নীল লাগছে।বর্ষাকালের আকাশ হয় মেঘে ঢাকা, মুখ গোমড়া করে থাকে। কিন্তু আজকের আকাশ ভীষণ সুন্দর। মন ভালো করে দেওয়ার মতো সুন্দর লাগছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে।

আশা ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে।আজকে আশার বাবা মা আসবে বিয়ের কথা পাকা করতে।
আশার মন আজকে ভীষণ ভালো। ফুরফুরে মেজাজে হাটছে ছাদে।হাটতে হাটতে একবার শালুকের রাজ্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
কিছুটা মন খারাপ হলো আশার।
ধ্রুব আর শালুক বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে আজ ১৮ দিন হলো।
এরমধ্যে একবার ও আশা ধ্রুবর সাথে কন্টাক্ট করতে পারে নি। বার বার ধ্রুবর ফোন বন্ধ পেয়েছে।
ধ্রুব ও কোনো রকম যোগাযোগ করে নি।

অবশ্য ভালো করেছে যোগাযোগ না করে। সে তো আর এই বাড়িতে ফিরে আসবে না। এই বাড়ির মানুষদের যতো দ্রুত ভুলে যাওয়া সম্ভব ভুলে যাক ওরা।তাহলে নিজেরা ভালো থাকবে।

আদনান রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে সিগারেট টানছে।উদাসীন দেখাচ্ছে তাকে খুব।তবে মনের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম আনন্দের অনুভূতি সে টের পাচ্ছে। তাদের বিয়েটা হয়ে গেলে খুব দ্রুত আদনান ওখানকার সিটিজেনশিপ পেয়ে যাবে।একটা বিন্দাস লাইফ আদনানের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
আশা এগিয়ে গিয়ে আদনানের আধখাওয়া সিগারেট নিলো।তারপর নির্দ্বিধায় খেতে লাগলো।

তার মন একটু বেশি খুশি। কি কারণে এতো বেশি খুশি আশা এখনো ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। আদনানের সাথে বিয়ে ফাইনাল কথা হবে এটা একটা কারণ হতে পারে।
আশা পনিটেইল করে বাঁধা চুলগুলো খুলে দিলো। বাতাসে চুলগুলো আশার মুখমণ্ডল ঢেকে দিচ্ছে। চুল সরানোর চেষ্টা করছে না আশা।

আদনান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আশার দিকে। তার মনে হলো ওখানে যেনো শালুক দাঁড়িয়ে আছে। ওই যে শালুকের ঘাড় সমান ছোট করে কেটে ফেলা চুল।

আদনান নেমে এলো রেলিং থেকে। আশার মুখের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে গুঁজে দিলো কানের পেছনে। একটা ফুল গুঁজে দিলো কানের পেছনে। আশা পা সামান্য উঁচু করে আদনানকে একটা চুমু খেলো।

সেই মুহুর্তেই হঠাৎ করেই আবার মনে পড়ে গেলো এই আশা।শালুক নয়।শালুক নেই।হারিয়ে গেছে তার শালুক। কোথায় গেছে তা আদনান জানে না।
সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হচ্ছে বাকিটা জীবন শালুক হয়তো আদনানের সাথে কথা বলবে না যদি কখনো দেখা হয়ে যায়।

আদনানের বুকের ভেতর ভারী হয়ে গেলো। নিজের জীবনটা গুছিয়ে নেয়ার জন্য যেমন আশাকে দরকার ছিলো অপশন হিসেবে তেমনই আজীবন সংসার করতে শালুককে দরকার ছিলো।
শালুককে আর কোথায় পাবে আদনান!
সে তো কোহিনুর হিরার চাইতে ও দামী কিছু।কে জানে ধ্রুব তাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। ধ্রুবকে আদনান চেনে ভালো করে। আত্মসম্মানী ধ্রুব কিছুতেই এই বাড়ি ফিরে আসবে না যেখানে তাকে আর শালুককে অপমান করা হয়েছে। ছোট বেলা থেকেই ও তো ওর প্রবল আত্মসম্মানবোধ।

আদনান ঠিক করলো, আশাকে ছেড়ে দেওয়ার পর বিয়ে করবে শালুক নামের কাউকে।যেই আশার জন্য এতো কান্ড ঘটে গেলো তাকে আদনান নিজের স্বার্থ সিদ্ধির পর কিছুতেই জীবনে রাখবে না।আশার পশ্চাতে দুই লা/থি মেরে আদনান তাকে বের করে দিবে জীবন থেকে। লা/থি দেয়ার স্টাইল ও আদনান ভেবে রেখেছে।
তারপর খুঁজে বের করবে শালুক নামের একটা মেয়েকে।দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করবে আদনান।

এসব ভাবতেই আদনানের মন ভালো হয়ে গেলো।

আশা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, “আফিফারা চলে এসেছে, চলো আমরা নিচে যাই।”

আদনান দ্বিধান্বিত হলো। বিয়ের পর থেকে আফিফা তাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। সে যে আফিফার আপন বড় ভাই তা যেনো আফিফা ভুলেই গেছে।মানুষ শত্রুর সাথে ও দেখা হলে মুচকি হাসে।আফিফা তাও করছে না।কেমন চোখ মুখ শক্ত করে রাখে আদনান আশেপাশে গেলেই।

আফিফার স্বামীর সাথে হ্যান্ডশেক করলো আদনান। লোকটা আফিফার চাইতে একটু খাটো। মাথায় চুল ও কম।অথচ আফিফা সুন্দরী। দুজনকে যেনো মানাচ্ছে না।আশা কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আফিফার স্বামীর দিকে।আশাকে এভাবে তাকাতে দেখে লোকটা আশার দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষে।
আশার হঠাৎ করেই মনে হলো এই লোকটা আফিফাকে ভীষণ ভালো রাখবে।এদের বাহ্যিক দিক থেকে অমিল মনে হলেও মনের দিক থেকে যথেষ্ট মিল হবে।

আফিফা বিয়ের পর এই তৃতীয় বারের মতো বাবার বাড়ি এসেছে। অথচ তার মনে হচ্ছে যেনো যুগ যুগ ধরে বাবার বাড়ি আসে না সে।বুকের ভেতর কাঁপছে আফিফার।জহির ভাই নিশ্চয় আর বাড়িতে আসে নি।পুরো বাড়ি কেমন খাঁখাঁ করছে।
মা চাচীকে ধরে আফিফা কান্নায় ভেঙে পড়লো। কেমন দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে আফিফার।এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না তার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য কারো সাথে। এই অনুভূতি এতো বিশ্রী কেনো আফিফা জানে না।
গভীর রাতে যখন স্বামী স্ত্রী একান্তে সময় কাটাতে যায় সেই মুহুর্তে আফিফার মনে হয় একটা বিষাক্ত তীর তার হৃৎপিণ্ড এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে।

খুব যত্নে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখে আফিফা।এই দমবন্ধ করা কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে কবে?এই যন্ত্রণা ফিঁকে হবে কবে?
যদি পারতো তবে মন থেকে জহির ভাইয়ের নামটাই মুছে দিতো সে।

সবার সাথে কথা শেষ করে আফিফা চুপিচুপি জহিরের রুমে গেলো। একটা খাট,একটা টেবিল আর একটা আলমারি ছাড়া এই ঘরে আসবাবপত্র বলতে আর কিছুই নেই।দেয়ালে জহির,আদনান আর ধ্রুবর একটা ছবি আছে শুধু।
আফিফা ছবিটির দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকালো।লাজুক চোখে তাকিয়ে আছে জহির ভাই তার দিকে। ফিসফিস করে আফিফা বললো, “কেনো আমার হলে না তুমি? আমার আজীবনের আক্ষেপ রয়ে যাবে তোমাকে না পাওয়া। একটা জীবন শেষ হয়ে যাবে এই তুমি নামক যন্ত্রণা নিয়ে।জীবনের শেষ দিনে দাঁড়িয়ে ও আমার তোমার কাছে প্রশ্ন থাকবে কি এমন ক্ষতি হতো আমাকে আপন করে নিলে।তুমি আমার জীবনের এমন এক অপূর্ণতা যেই অপূর্ণতা পৃথিবীর সব কিছু দিয়ে ও পূর্ণ হবে না।আমি তোমায় সত্যি ভালোবেসেছি।”

আফিফা আসার খবর পেয়ে শাপলা ছুটে এলো। খুঁজতে খুঁজতে জহিরের রুমে পেয়ে গেলো আফিফাকে।এসেই আফিফার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো শাপলা।বহু বছর পর যেনো দুই বোনের দেখা হয়েছে। কান্নার জন্য কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারছে না।কথা বলছে তাদের দুজনের চোখের নোনাজল।

শাপলা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “শাড়িতে তোকে খুব সুন্দর লাগছে আপা।একেবারে বউ বউ লাগছে।”

আফিফা নিজের চোখ মুছে বললো, “কেমন আছিস তুই শাপলা?এতো শুকিয়ে গেছিস কেনো?”

শাপলা মুখ কালো করে বললো, “আমার কিছু ভালো লাগে না আপা।এই বাড়িতে থাকতে আমার মোটেও ইচ্ছে করে না।তুই নেই,শালুক নেই,ধ্রুব ভাই নেই,নয়না আপা নেই,জহির ভাই নেই।মনে হয় যেনো কোনো পোড়াবাড়িতে বাস করছি।এখন আর নাশতার টেবিলে গল্পের আসর জমে না আপা।সন্ধ্যায় চা,ঝালমুড়ির টেবিলটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে।কেউ হাতাহাতি করে না মুড়ির বড় ডিশ নিয়ে।
শেষের কয়েক মুঠো মুড়ি খাবার জন্য মুখ ফুলিয়ে,ঠোঁট বাঁকিয়ে কান্না করা সেই শালুক এখন আর নেই।জানিস আপা,এই কয়েকদিনে আমাদের বাড়িতে যতোবার মুরগি রান্না হয়েছে, লেগপিসগুলো অবহেলায় বাটিতে পড়ে রয়েছে। কেউ সাহস করে প্লেটে তুলে নেয় নি।কে খাবে বল?
কারো কি সাধ্য ছিলো না-কি এগুলোর দিকে চোখ তুলে তাকাবার? অথচ এখন পড়ে থাকে তাও কেউ খেতে পারে না।

পরশু শুঁটকি রান্না করতে গিয়ে মেজো চাচী কান্না করে দিয়েছে। বল তো, কি এক অবস্থা!
এই শুঁটকি রান্না নিয়ে সে কি ঝগড়া করতো শালুক।খাবার খেতোই না নিচে এসে সেদিন।মেজো চাচী কাঁদতে কাঁদতে আবার শুঁটকি তুলে রেখেছে। বড় চাচী বলে দিয়েছে এই বাড়িতে শুঁটকি রান্না একেবারে নিষিদ্ধ।

একটা মানুষ চলে গেলো, অথচ তার স্মৃতি এমনভাবে রেখে গেলো যে কেউ-ই ভুলতে পারছে না।
আমার ব্যাগে প্রায় ৫০০ টাকা জমেছে আপা।আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চেক করে দেখি কতো টাকা আছে।যখন দেখি সব টাকা ঠিকঠাক আছে আমার বুক ভেঙে যায় যন্ত্রণায়। কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়ে যায় কান্নায়।
কেনো ব্যাগে টাকা থাকে আপা বল তো!
শালুক কেনো আমার ব্যাগ থেকে টাকা নেয় না?আমি প্রতি রাতে ঘুমাতে গেলে বলি তুই সব টাকা নিয়ে নে শালুক,আমি টুঁ শব্দ ও করবো না।তবুও শালুক আসে না আপা।কতোদিন শালুক আমার সাথে ঘুমায় না।আমার ভীষণ একা লাগে,রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠি,মনে হয় শালুক যেনো ডেকে বলছে আপা উঠ না,টয়লেটে যেতে ভয় করছে।খাটের নিচে মনে হয় কেউ আছে।

আমি তাকিয়ে দেখি আমার বিছানা ফাঁকা।আমার ছোট বোনটা আমার পাশে নেই আপা।কোথায় গেলে শালুককে পাবো আপা?
কেনো এতো অন্তর পুড়ে যায় শালুকের জন্য?”

আফিফা কি জবাব দিবে জানে না।তার নিজেরই বুক কাঁপছে শালুকের জন্য।
শালুক একটা টুনটুনি পাখির মতো ছিলো। যে সারাদিন লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াতো। সবচেয়ে চঞ্চল আর দুষ্ট ছিলো।
কোথায় আছে সেই শালুক এখন?এখনো কি আগের মতো উড়া উড়ি করছে শালুক?
ধ্রুব কি শালুককে সামলাতে পারছে?
শালুককে ভালোবাসে না এরকম কেউ নেই এই বাড়িতে।

শাপলা একটু থেমে বললো, “জানিস আপা,কাল ভিক্ষা চাইবার জন্য এক মহিলা এলো।আমি গিয়ে চাল দিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করলো শালুক মা নাই বাড়িতে।আমি তো অবাক হয়ে গেলাম ওনার মুখে শালুকের নাম শুনে। উনি হেসে বললেন,শালুক না-কি সবার আড়ালে ওনাকে বড় মগে করে এক মগ মগ চাল দিতো।ওনার একটা ছোট নাতি আছে।নাতিকে রেখে ওনার মেয়ে মারা গেছে। সেই নাতির জন্য না-কি শালুক খেলনা কিনে দিতো।বাড়ি থেকে ফলমূল যা পেতো সব লুকিয়ে দিয়ে দিতো ওনাকে।
শুনে আমার এতো কান্না এলো। আমার বোনটা এতো ভালো ছিলো কেনো আপা?
এতোই যখন ভালো ছিলো ওর সাথে এরকম বাজে কাজ কেনো হলো আপা?আমি জীবনে ও আদনান ভাইকে ক্ষমা করবো না আমার ছোট্ট পরীর মতো বোনটির জীবন নষ্ট করার জন্য।”

আফিফা বললো, “করিস না ক্ষমা।আল্লাহর কাছে হাত তুলে নাম ধরে বদদোয়া দিবি ওকে।যেমন আমি দিই প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। ও আমার ভাই না।ও একটা জানোয়ার। বনের পশু ও ওর চাইতে ভালো আছে।”

আশার মা,বাবা,মামা,খালারা এলো দুপুরের সময়। খাওয়ার পর সবাই মিলে বসলো বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। আদনানের উপর রাগ থাকলেও আদনানের দুই চাচা চাচী ও উপস্থিত থাকলো এই আলোচনায়।বাড়ির সবাই উপস্থিত থাকলো।

আশার বাবা ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললেন,”খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চান তিনি।”

তাকে থামিয়ে দিয়ে আশার মা কথা বলতে লাগলো। আশা তখন সিতারা বেগমের রুমে গিয়ে একটা পান বানিয়ে নিয়ে এলো।সেই পান মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বসার ঘরের দিকে আসতেই শুনলো বিয়ের কথা হচ্ছে। আদনান একটা লাল পাঞ্জাবি পরে বরের মতো লাজুক ভঙ্গিতে বসে আছে। আশার ভীষণ হাসি পেলো।

আগেও কয়েকবার সিতারা বেগমের থেকে পান নিয়ে খেয়েছে আশা,কিন্তু এটার টেস্ট আসলে কেমন তা বুঝতে পারছে না। তাই আজ আবারও খাচ্ছে।
পানের রস পড়ে আশার হলুদ টি-শার্ট লাল হয়ে গেলো। আশা এগিয়ে এসে তার বাবার পাশে বসলো। তারপর বাবাকে ফিসফিস করে কিছু বললো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “সরি আন্টি।আমি আদনানকে বিয়ে করতে পারবো না। ”

আদনানের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো মুহুর্তেই।আশা কি বলছে এসব!

আশা আগের মতো স্বাভাবিক। আদনানের কাছে গিয়ে বললো, “আমাকে আরেকটু পান দিতে পারবে?আজকে দাদীর কৌটো থেকে চুন খেয়েছি পানের সাথে এখন মুখের ভেতর কোথাও লেগে গেছে মনে হচ্ছে। ”

আদনান কথা বলার শক্তি ও পাচ্ছে না। এই মেয়ে তাকে বিয়ের জন্য রিজেক্ট করে দিয়ে কি অবলীলায় কথা বলে যাচ্ছে তার সাথে!

আদনানের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “সমস্যা কোথায় আশা মা?”

আশা একটু ভেবে বললো, “আমি আদনান কে আমেরিকা থেকে অবজার্ভ করছি আংকেল। ওর চোখে আমি কখনো আমার জন্য ভালোবাসা বা সম্মান দেখি নি।দেখেছি লোভ।নিজের ভাইয়ের সাথে ও নিজে কি বাজে একটা কাজ করেছে।ও ভীষণ সেলফিশ মানুষ। নিজের চাওয়া পূরণ হলে আমাকে ছেড়ে দিতে ও এক মুহূর্ত ও দেরি করবে না।আমি জানি আমাদের কালচারে এসব ছাড়াছাড়ি কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে আমি জানি এই মানুষটা একটা সময় আমাকে ছেড়ে যাবে।সে যা করছে সব অভিনয়। আগে থেকেই যখন এটা বুঝতে পেরে যায় কেউ যে তার বিপরীতে থাকা মানুষটি তার সাথে অভিনয় করে যাচ্ছে, তখন তার পক্ষে আসলেও সম্ভব হয় না সেই মানুষের সাথে থাকা। তার আন্তরিকতা ও তখন মেকি মনে হয়। আমাদের কালচার আর যেমন হোক,ভান করতে জানে না।কারো ভান মেনে নিতেও পারি না আমরা জেনেশুনে। আর এখানে আমি জানি যখন ওর পুরোটা ভান তখন লাইফ পার্টনার করা অসম্ভব। ”

কেউ কিছু বলতে পারলো না আশার কথার জবাবে। কি বলবে?
আশা তো মিথ্যা কিছু বলে নি।

হঠাৎ করেই আশা ধরতে পারলো তার মন সকাল থেকে এতো ভালো কেনো।এই যে আদনানকে এভাবে রিজেক্ট করে দিবে তা তার অবচেতন মন আগেই জানতো।তাই তো এতো আনন্দিত লাগছিলো আশার।
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২০)
আশা বসে আছে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে। আদনানের পেটের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে।পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো আশার কথা শুনে। আদনান কল্পনাও করে নি তীরে এসে আশা এভাবে তরী ডুবিয়ে দিবে।
সকালে আশাকে যেভাবে পশ্চাৎদেশে লাথি দিবে ভেবেছিলো এখন দেখতে পাচ্ছে সেই লাথি যেনো তার নিজের পশ্চাৎদেশে দিয়েছে আশা।
দাবার চক এভাবে বদলে যাবে আদনানের ভাবনাতেও আসে নি।
এখনো আদনানের অবিশ্বাস্য লাগছে। একটু আগেই তো আশা ছাদে আদনানের গালে চুমু খেলো। তখন ও তো মনে হয় নি আশা এরকম কিছু করবে!
তবে হঠাৎ করে এরকম করলো কেনো?

আদনান উঠে গিয়ে আশার হাত চেপে ধরে বললো, “এভাবে আমার লাইফ নিয়ে তুমি খেলা করতে পারো না আশা।এই মুহূর্তে এসে তুমি কিছুতেই এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।”

আশা মুচকি হেসে আদনানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “লিসেন আদনান,আমাদের মধ্যে এরকম কোনো কমিটেমেন্ট ছিলো না যে আমরা বিয়ে করবোই।আমি তুমি দুজনেই এডাল্ট,দুজনের সম্মতিতে আমরা ঘনিষ্ঠ সময় কাটিয়েছি।তার মানে এই নয় যে আমার তোমাকে বিয়ে করতেই হবে।

আর যদি এরকম হয় যে বিয়ে করবো বলেছি বলে বিয়ে করাই লাগবে,তাহলে তো তোমার উচিত ছিলো তোমার কাজিন সিস্টার নয়না কে বিয়ে করা।আমি যতোদূর বুঝেছি তোমাদের মধ্যে লাভ রিলেশন ছিলো। আংকেল,আন্টির মৌন সম্মতি ও ছিলো তবে শেষ পর্যন্ত তুমি তাকে বিয়ে করো নি।সেখানে আমি কেনো তোমাকে বিয়ে করবো?
তুমি বয়ফ্রেন্ড হিসেবেই তো পারফেক্ট না।হাজব্যান্ড হলে তো অনেক রেসপনসেবলিটি,সেখানে তুমি জিরো আউট অব টেইন।”

আজাদ সাহেব উঠে আশার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,”এই সময়ে তুমি এরকম সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের মান সম্মান আর থাকবে না মা।”

আশা ভ্রুকুটি করে নিজের বাবার দিকে তাকালো। আশার বাবা ভাঙা ভাঙা বাংলা,ইংরেজি মিলিয়ে যা বললেন তার মানে হলো, “আমার মেয়ের যেহেতু এই বিয়েতে মত নেই,সেখানে তাকে জোর দেয়ার কোনো মানে হয় না। এই বিয়ে হবে না।”

বিদায় নেয়ার সময় আশা সবার থেকে বিদায় নিলো। আদনানের কাছ থেকে ও হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাবা মায়ের সাথে।
হতভম্ব হয়ে আদনান দাঁড়িয়ে আশার গমনপথ এর দিকে তাকিয়ে রইলো। যেমন করে সেদিন তাকিয়ে দেখেছে শালুকের চলে যাওয়া।

আদিবা বেগম ছেলের সামনে গিয়ে বললেন,”পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না।আজ আমার অন্তরের জ্বালা কিছুটা হলেও জুড়িয়েছে।এবার বুঝতে পেরেছিস তো লজ্জা জিনিসটা কি?
অবশ্য তুই বুঝবি না।তোকে আমি মানুষ বানাতে পারি নি।লজ্জা আমার হওয়া উচিত তোর মতো ছেলের মা হয়েছি বলে। ”

আদনান ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। একূল ওকূল দুই কূল হারিয়ে আদনানের নিজেকে রিক্ত শূন্য মনে হচ্ছে।
আশা যদি বিয়ে করবে না বলেই ভেবে রেখেছিলো কেনো আগে জানালো না তাকে?তাহলে তো আদনান শালুককে হাতছাড়া করতো না কিছুতেই।

নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে আদনানের।বিচিত্র এই জীবনের কতোটুকুই বা মানুষ জানে!
বুকের ভেতর একটা হাহাকার আজ আদনানকে ব্যথিত করছে।

শালুকের স্কুলে প্রিটেস্ট এক্সাম শুরু হবে আগামীকাল থেকে। ধ্রুবর নতুন চাকরি,নতুন টিউশনি। এই মুহূর্তে শালুককে নিয়ে ধ্রুব কিছুতেই গ্রামে যেতে পারছে না।

রাতে বাসায় ফিরে ধ্রুব স্কুলে কল দিলো। নিজেদের সব সমস্যার কথা স্কুলে খুলে বললো। তারপর জানালো শালুকের পক্ষে পরীক্ষায় হাজির হওয়া এই মুহুর্তে অসম্ভব।
স্যারকে অনেক রিকুয়েস্ট করে ধ্রুব শালুকের এক্সাম দেওয়া বাদ দেওয়ালো।তবে স্যারকে অনুরোধ করলো যাতে করে প্রতিদিনের এক্সামের প্রশ্নটা ধ্রুবকে মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়।

ভয়ে আধমরা হয়ে রইলো শালুক বাসায় ধ্রুবর সামনে বসে পরীক্ষা দিতে হবে শুনে।
পিঠ বেয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার।পরের কয়েকদিন গেলো শালুকের অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে।
প্রতিদিন রাতে ধ্রুব বাসায় এসে শালুকের এক্সাম নেয়।এই প্রথম শালুক অনুভব করলো আশেপাশে সাহায্য করার মতো যখন কেউ না থাকে তখন নিজের চরকায় নিজের তেল দেওয়া লাগে।
এই যেমন এখন,শালুকের কোনো উপায় নেই কারো থেকে হেল্প নেওয়ার।
মূর্তিমান বিপদের ন্যায় ধ্রুব শালুকের সামনে বসে রইলো,উপরন্তু পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সময়ের চাইতে ২০ মিনিট সময় শালুককে কম দিলো।
শালুক প্রশ্ন করায় ধ্রুব জবাব দিলো, মনে কর এটা তোর ফাইনাল এক্সাম।তখন খাতায় মার্জিন দিতে,রোল নাম্বার, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার এসব পূরণ করতে,সিগনেচার শিটে নিজের সিগনেচার দিতে,স্যারেরা খাতায় সিগনেচার দিতে,এক্সট্রা পেইজ আনতে আসা যাওয়া করতে,খাতায় পিন মারতে,প্রশ্ন ভালো করে পড়তে।এসব কাজে তোর মিনিমাম ২০ মিনিট নষ্ট হবে।
তাই তোকে মূল সময়ের চাইতে ২০ মিনিট সময় কম ধরেই পরীক্ষার জন্য মাইন্ড সেটআপ করতে হবে।এই সময়ের মধ্যেই ফুল মার্কস উত্তর দিতে হবে।

শালুকের বুক ফেটে কান্না এলো। কেনো এরকম শত্রুতা করছে ধ্রুব তার সাথে!
এই বুঝি তার ভালোবাসা শালুকের প্রতি?ভালোবাসা হলে তো আরো ২০ মিনিট বেশি সময় দিতো সে শালুককে।
বুক ভরা ব্যথা নিয়ে শালুক এক্সাম দিলো।পুরোটা সময় ধ্রুব শালুকের সামনে বসে রইলো।যেদিন যেই সবজেক্ট এক্সাম সেদিন এক্সামের সময় সব বই খাতা রান্নাঘরে রেখে আসতো ধ্রুব।

এরকম অথৈ জলে শালুক আগে কখনো পড়ে নি।প্রথম দিন পরীক্ষা দিয়েই শালুক বুঝতে পারলো শিক্ষক হিসেবে ধ্রুব ভীষণ কড়া।
এরপর থেকে নিজ দায়িত্বে সারাদিন ধরে মনোযোগ দিয়ে পড়েছে শালুক।
সেই সাথে ধ্রুবকে সমানে বকাবকি করে গেলো এক্সাম দিতে বসে।

এক্সাম শেষ হলে ধ্রুব শালুকের খাতা দেখলো।শালুক নিজ প্রচেষ্টায় পরীক্ষায় ৪.১৪ পেলো।
ধ্রুব যখন শালুককে তার রেজাল্টের কথা জানালো শালুকের মনে হলো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের কথা শুনছে সে।৪.১৪ তার পয়েন্ট!
এ তো অসম্ভব ব্যাপার। তাও সে একা এক্সাম দিয়ে এই পয়েন্ট পেয়েছে!
যেকজানে সে দেখাদেখি করে এক্সাম দিয়ে ও ৩.৫০ এর উপর উঠতে পারে না।
শালুকের বিশ্বাস হলো না। ধ্রুবর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি বলছেন আপনি? আমি সত্যি এতো ভালো রেজাল্ট করেছি?”

ধ্রুব হাসলো। তারপর হঠাৎ করেই শালুককে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার বোকা ফুল না তুই,আমি তোকে নিজ হাতে গড়ে নিবো শালুক।কেউ যেনো তোকে কখনো কথা শুনানোর সাহস না পায়।তুই আরো ভালো রেজাল্ট করবি শালুক।তুই শুধু একটু চেষ্টা করে যা।আমি তো আছি তোর পাশে।”

তারপর লজ্জা পেয়ে শালুককে ছেড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, রান্না বসাতে হবে আমি রান্নাঘরে যাই।

শালুকের কি যে ভালো লাগলো হঠাৎ করেই। এই যে হুট করে ধ্রুব তাকে জড়িয়ে ধরলো তাতেই শালুকের হৃদয় শান্ত হয়ে গেলো। আবার অপ্রস্তুত হয়ে যে ধ্রুব পালিয়ে গেলো শালুকের সামনে থেকে তাও শালুকের ভীষণ ভালো লাগলো।
এতো ভালো লাগছে কেনো শালুকের! ভেবে পেলো না শালুক।

রাতে খেতে বসে ধ্রুব শালুককে বললো, “আগামীকাল থেকে আমার আসতে আরেকটু দেরি হবে শালুক।নতুন আরেকটা টিউশনি পেয়েছি।”

শালুকের মন খারাপ হয়ে গেলো শুনে।সারাদিন সে চাতক পাখির মতো ধ্রুবর জন্য অপেক্ষা করে থাকে।এখন কি-না আরো দেরি করে আসবে ধ্রুব!

আস্তে করে শালুক বললো, “আমার জন্য আপনার অনেক কষ্ট করতে হয় তাই না ধ্রুব ভাই?আমি না থাকলে তো এতো ঝামেলা হতো না আপনার। একা থাকতেন।হলে থাকতেন,এতো চাপ থাকতো না আর।”

ধ্রুব হেসে বললো, “দুদিন আগে আর পরে,তোকে যখন ভালোবেসেছি, বিয়ে তো তোকেই করতাম।তোর দায়িত্ব তো আমি নিজেই নিতাম শালুক।হয়তো দু’দিন পরে নিতাম।এখন আগে নিচ্ছি,তাতে অসুবিধা কি?এই যে তুই আমার সাথে আছিস,আমার পাশে থাকিস,বাসায় ফিরলে তোর উদ্বিগ্ন মুখ দেখি এই পাওয়া কি কম পাওয়া তুই বল?এর চাইতে বেশি সুখ আমি কোথায় পেতাম?আমার সারাদিনের সব খাটুনি ভুলে যাই যখন বাসায় ফিরলে দেখি তুই আমার অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছিস।”

শালুক কিছু বলতে পারলো না। তার কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে।তাকেও কেউ এরকম পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে তা কি কখনো শালুক ভেবেছিলো!
নিজের সৌভাগ্য দেখে শালুক নিজেই অবাক হয়।

চলবে….

রাজিয়া রহমান
চলবে……..

রাজিয়া রহমান
চলবে……….

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here