শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব -১৮+১৯

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
১৮.

চারটা দিন কিভাবে যে কেটে গেছে কেউ টেরই পেলো না। আনন্দের সময় যেন দ্রুতই পালিয়ে যায় অথচ দুঃখ, যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো কচ্ছপের মত শ্লথ পায়ে এগোয়। সকালের কুয়াশামাখা যে ঝড় সোহার ভেতরে বয়ে গেছে তা তাকে আর বেশিক্ষণ থাকতে দিতে চাইছে না এ গ্রামে। পদ্মাদিঘি গ্রামটা তার যার জন্য এত প্রিয় হয়েছিলো সেই মানুষটির সামনে পড়ার ভয়েই এখন এ গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে তার। শরত মুখের ওপর বুঝিয়ে দিয়েছে তার জবাব। এখন খুব আফসোস হচ্ছে সোহার কেন সে বেহায়ার মত নিজের অনুভূতির প্রকাশ করলো! ওই লোকটা শুধু শান্ত আর নীরবই নয় দাম্ভিকও মনে হচ্ছে এখন তার। সকালে শরতের সাথে হওয়া কথার পর আর শিশিরদের ঘর থেকে বের হয়নি। দুপুরের দিকে অনু খুব জোর করলো একটু হাঁটতে বের হবে বলে। মাথাব্যথার বাহানা করে সোহা বের হয়নি। আলতা এসেছিলো একেবারে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর। আজ সে মায়ের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে করে দু পদের তরকারি আর ভাত রান্না করেছে। জীবনে প্রথমবার কোন রান্না করবে তা সে মামাকে খাওয়াবে না তা কি করে হয়! তাই সে যখন রান্নার পর তরকারি বাটিতে বাড়লো তখনই নকশি শিশিরকে ফোন করে বলল একটু আসতে। ইচ্ছে করেই আলতাকে দিয়ে পাঠায়নি নইলে আজ আর আলতার এ বাড়ি খাওয়া হতো না। ও বাড়িতে বড় মামী, শিফা মামী দুজনেই জোর করতো সেখানে খেতে। শিশির যখন নকশিদের বাড়ি এলো আলতা তখন সবে গোসল সেরে কলপাড় থেকে বেরিয়েছে। হাতে তার ভেজা কাপড়গুলো থাকায় সে শিশিরের দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ চিকন তারে কাপড় শুকানোর বাহানায় ব্যস্ত রইলো। শিশির উঠোনের কোণে দাঁড়িয়ে দেখলো সবটা। আবার দেখলো ফুপুআম্মা কোথায় আছে। তখনই চোখে পড়লো নকশির হাতে কাপড় সে কলপাড়ে ঢুকছে গোসল করবে বলে। শিশিরকে দেখেই বলল, “আব্বা ঘরে যেয়ে বসো একটু। আলতা রান্নাঘরে দ্যাখ তরকারির ঢাকনাওয়ালা বক্সটা আছে শিশিরকে দে। এখন তোর যাইতে হবে না ও বাড়ি নইলে ভাবীরা ওখানেই খাওয়াবে জোর করে।”

কথাটা বলতে বলতেই নকশি গোসলের জন্য কলপাড়ে ঢুকে টিনের দরজাটা লাগিয়ে দিলো। শিশির তখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে একমনে আলতাকে দেখে চলছে৷ প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সময় নিয়ে আলতা কাপড় মেলে দিলো। সত্যি বলতে তার কাল সন্ধ্যের পর থেকেই খুব অস্বস্তি লাগছে। শিশির ভাই কি বদলে গেছে খুব! কালকের আগ পর্যন্ত এতো বেশি উগ্র লাগেনি তার শিশির ভাইকে৷ হ্যাঁ জীবনে প্রথমবার শিশির ভাই তাকে ছুঁয়েছিল ভিন্ন কোন অনুভূতি নিয়ে সেদিন আলতা একদমই অপরিচিত ছিল এই স্পর্শ থেকে কিন্তু কালকের সেই আদেশপূর্ণ আচরণে মুঠো ভর্তি চুড়ি পরানো কিংবা পা ভর্তি আলতা মাখিয়ে দেওয়া সে স্পর্শে আদুরে এক অনুভূতি হয়েছে আলতার। যা তার কিশোরী মন বড় আবেগে গ্রহণ করেছিলো সেই সাথে পাহাড়সমান লজ্জায় রঙিন হয়েছিলো। আর সে কারণেই বোধহয় মানুষটার আজকের আগমন তাকে আড়ষ্ট করে তুলছিলো। মনে মনে সে আম্মার ওপর বিরক্ত হলো, তরকারির বক্সটা নিজেই তো পারতো শিশির ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে। আলতাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিশির এগিয়ে এলো তার সামনে।

“জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতেছিস নাকি! ফুপুআম্মা কি বলছে শুনিস নাই?”

আর দাঁড়ানো যাবে না ভেবে আলতা পা বাড়ালো ঘরের দিকে তখনই টান পড়লো বা হাতে। আলতা ভয়ে শিউরে উঠলো আর তা দেখে তৎক্ষনাৎ তার হাত ছেড়ে দিলো শিশির। সে খেয়াল করলো আলতার হাতের পশম দাঁড়িয়ে গেছে ভয়ে। সে ভড়কে গিয়েই প্রশ্ন করলো, কি হয়েছে আলতা তোর গা শিউরে উঠলো কেন?”

আলতা মুখ খুলল না তবে তার মুখ জুড়ে কেমন আতঙ্ক স্পষ্ট হলো। শিশির কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তরকারির বাটিটা নিয়ে আয়। আর বাসের টিকিট রাত দশটার নয়টায় তৈরি হয়ে থাকবি।”

শিশিরের কথা শেষ হতেই আলতা রান্নাঘরে গেল। তরকারির বক্সটা এনে শিশিরকে দিতেই সে চুপচাপ চলে গেল সেখান থেকে৷ সন্ধ্যের সময় আওলাদ এলো আলতার সাথে দেখা করতে। আওলাদ শিশিরদের বাড়িই এসেছে মেয়েকে দেখতে। নকশির শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার মত মন মানসিকতা তার নেই আর না নকশির মুখোমুখি হওয়ার। মন এখনও তার নকশির নামে চিনচিনিয়ে ব্যথায় মজে তাই ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলে এই সুযোগগুলো। আর তার উপস্থিতি জহিরেরও খারাপ লাগতে পারে ভেবেও সে আলতাকে ফোন করে বলেছে, তোর মামার বাড়ি আয় আমি সেইখানেই আছি।

আলতা এসে দেখলো তার আব্বা আহসান মামার সাথে ঘরের সামনে উঠোনের দক্ষিণে চেয়ারে বসে গল্প করছে। বাইরের রান্নাঘরে বসে শিফা মামী পুলি পিঠা আর বড় মামী ভাপা পিঠা বানাচ্ছেন। এখন বুঝতে পারলো আলতা মামী তাকে জরুরি তলবে কেন আসতে বলেছে এখানে। একে তো আব্বা আসছেন দ্বিতীয়ত আব্বার সেদিনের দেওয়া চালের, গুঁড়ো, গুড় সবই তো রয়ে গেছে সেগুলোর পিঠা পুলি বানিয়ে খাওয়াবে আজ। আলতা বাড়ির ভেতর আসার পরই সকলের দৃষ্টি তার দিকে ছিলো। সেও দেখলো শরত ভাই আর শিশির ভাই ছাড়া বাকি সবাই আছে এতে তার যেন স্বস্তি হলো। কি যে হলো কাল থেকে কে জানে, যখন তখন বুকের ভেতর ধুকপুকানি এক রোগ দেখা দেয়। শিশির ভাইকে দেখা তো পরের কথা নামটা শুনতেই তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। জয়তুনই প্রথমে ডাকলো, “উঠানে খাড়াইয়া আছোস ক্যান! এইহানে আয় পিডাগুলা গরম গরম খাইয়া নে। তোর লাইগা ওরাও কেউ খায় নাই অহনও।”

জয়তুন শেষের কথাটা সোহা, অনুকে দেখিয়ে বলেছেন। আলতা এগিয়ে এসে আব্বার সাথে কথা বলে রান্নাঘরে ঢুকলো। মোটামুটি রকম বড় হওয়ায় এই মাটির রান্নাঘরটিতে একপাশে তিন-চারজন বসতে পারে। কাঠের পিঁড়ি পেতে বসেছে আলতা, সোহা, অনু। আর চুলার সামনে বসা জয়তুন আর শিফা একের পর এক পিঠা চুলা থেকে নামিয়ে তাদের সামনে দিলো। একটু আধটু খাওয়া চলছে তাদের সাথে গল্প। আওলাদও মেয়েকে এটা সেটা বলছে আবার আহসানও কিছু বলছে। কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে শিশির এসে উপস্থিত হলো। সবার দিকে একবার তাকিয়ে শুধু বলল, “ভাই বাড়ি নাই?”

“ও কি এই সময় বাড়ি থাকে! দোকানে দেখে আসিস নাই?” আহসান জবাব দিলো। শিশির বলল, ” আমি বাজারের দিকে যাইনি। অপুর আম্মা ক্ষীর রান্না করছিলো বলল খেয়ে যা তাই ওদিকে ছিলাম।”

জয়তুন শুনে বলল, বন্ধুর বাড়ি ক্ষীর খাইতে যাওয়া লাগলো ক্যা। বাড়িতে কইতে পারোস নাই আমরা রাইন্ধা খাওয়াইতাম। আর শরতরে খুঁজলি ক্যা!”

জয়তুনের কণ্ঠ কেমন ঝাঁঝালো শোনালো। শিশির অবাক হয়ে গেল জেঠির আচরণে।

“ও বাড়ি খাওয়াতে কি হলো জেঠি। আগেও তো কত কি খাইতাম।”

“আগের হিসাব আলেদা আগে অপুর বইন ছোড আছিলো। অহন ওই ছেড়ি বড় হইছে পুরুষপোলা দেখলে মা, ঝি পাগল হইয়া উঠে।”

জয়তুনের কথায় কোন ঋণাত্মক ইঙ্গিত ছিলো তা কারোই বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই শিশির আর কোন কথা বলল না। সে জানে তার মায়ের মতোই জেঠিও তাকে খুব ভালোবাসে তাই কখনোই কোন ভুল কিছুতে সে জড়িয়ে পড়ুক এটা কিছুতেই চান না তিনি। সবাই গরম গরম পিঠা খেলেও শিশির বলল বক্সে ভরে দিতে সে বাজারে গিয়ে ভাইয়ের সাথে খাবে। তার কথাটা ভালো লেগেছে জয়তুনের। সেও চাইছিলো তার ছেলেকে গরম গরম পিঠা খাওয়াতে কিন্তু শরতকে ফোন করলে সে ভুলেও বাড়ি আসবে না৷ তাই শিশিরের কথাতে ভীষণ খুশি হয়ে দ্রুত উঠে দুই বক্স ভরে পিঠা দিলো৷ শিশির যেতে পা বাড়াতেই অনু বলল, আমরাও আসি একটু লাস্ট মোমেন্ট ঘোরাঘুরি আরকি!”

অনুর কথাটা শুনে মনে হলো সে অনুমতি চাইছে বড়দের কাছে। আহসান শিফার দিকে তাকালো যেন স্ত্রীর পক্ষ থেকেই জবাবটা চাচ্ছেন তিনি কিন্তু তাদের আর ভাবতে হয়নি জয়তুনই বললেন, যাক পোলাপানগুলা তো রাইতেই যাইবোগা।”

ব্যস, আর কারো ভাবার দরকার নেই। শিফা আর আহসান বরাবরই ভাবীর মতামতকে প্রাধান্য দেন। এই যে শহুরে দুটো মেয়ে তার ছেলের বান্ধবী এদেরকে এখানে এসে চারটা দিন থাকার অনুমতিও তারা এমনি এমনি দেননি। পাড়ার লোকের কথা খুব বেশি না ধরলেও কিছুটা পরোয়া আহসান অবশ্যই করতো। সে ভেবেছিলো শিশিরকে কোনভাবে বারণ করবে তাদের না আনতে। কিন্তু জয়তুন যখন শুনলো তখন বলল, এহন এইসব কে ধরে! আর মাইয়া দুইটা কি খালি বাড়ি আইবো আমরা আছি না!”
জয়তুনের কথাতে আশ্বস্ব হয়েই অনুমতি দিয়েছিলো আহসান। দেখতে দেখতে চারটা দিন পার হলো সুন্দর ভাবেই। আজ তারা চলে যাবে ভাবলেই খারাপ লাগছে শিফা আর জয়তুনের। এ বাড়িতে আগে আলতার চঞ্চলতা, শিউলির গুঞ্জনে মুখর থাকতো। শিশির শহরমুখো হতেই শিউলি আর আলতার চেঁচামেচি একটু কমেছিলো বটে তাদের কথায় কথায় মা*র দেওয়া মানুষটা না থাকায়। এরপর শিউলির বিয়ে হলো বাড়ি আরও খালি হয়ে গেল। দেখতে দেখতে এখন আলতা চলে গেল, নকশির নিজের বাড়ি হলো ব্যস, পুরো মাস্টার বাড়ি নীরব হয়ে গেল কয়েকটা বছরের মধ্যেই। আর শরত! সে তো বাড়ি থাকলেও কেউ টের পায় না৷ এজন্যই আজকাল জয়তুনের সাথে শিফাও তাল মেলাচ্ছে ছেলেটাকে বিয়ে দিতে। এতে যদি বাড়িতে একটা বউ আসে তাহলে তো কথাই নেই। আর মেয়েটা অবশ্যই হোক চঞ্চলচিত্তের যে কিনা এই বাড়ি আর বাড়ির মানুষগুলোকে সারাক্ষণ হৈ হল্লায় মাতিয়ে রাখবে। এমনিতেও তো শিফা জানে আর মাত্র বছর দুই কি তিন তারপর আলতা চিরদিনের জন্যই চলে আসবে তাদের ঘরে। সেই যে আলতা ওইটুকুনি থাকতেই শিফা মনে মনে ঠিক করেছিলো এ ঘরে আসবে আলতা তারপর তার বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পরই তো জানতে পারলো সে তার ছেলেটাও মন দিয়ে বসে আছে আলতাকে। তার তো পুরো সংসারই সাজিয়ে রাখা শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। এসব কথা ভেবে ভেবে আনমনেই হেসে ওঠে শিফা। এখনও তো তারা মা ছেলে মিলে আহসানকে কিচ্ছুটি জানায়নি আর কটা দিন তারপরই শিফা ভেবে রেখেছে আহসানকে বলবে সব কথা। আপাতত ছেলে মেয়েগুলো নিজেদের পড়াশোনাতেই মনোযোগী থাক। এখনই বিয়ে-শাদির কথা তুললে মন বদলে যাবে তাদের।

বাজার জুড়ে ষাট কিংবা একশো পাওয়ারের স্বচ্ছ কাঁচের বাল্ব জ্বলছে। সেই বাল্বের হলদে আলোয় সন্ধ্যের বাজারে এক গমগমে হুল্লোড়। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কাপড় ইস্ত্রি করার দোকান সব জায়গাতেই নানা বয়সের পুরুষদের আড্ডা। অনুর ভীষণরকম টানাটানিতে সোহাও এসেছে তাদের সাথে। অনু যখন বলেছিলো শিশিরের সাথে তারাও আসবে তখন এক বাক্যে নাকোচ করে সোহা। তা শুনে অবশ্য সোহার সাথে শিশিরও অবাক হয় খুব। কারণ সেও তো জানে শরতকে নিয়ে তার এই বান্ধবীটির মনে কি চলে। আর সেই বান্ধবীই কিনা আসতে চাইছে না ভাইয়ের সাথে দেখা হবে জেনেও! কিন্তু অনু বোকার মত সবার সামনে টানাহেচড়া করাতেই বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে সোহাকে। সবাই মিলে যখন দোকানের সামনে হাজির শরত বিষ্ময়ে হা হয়ে গেল। বিষ্ময় প্রকাশ না করেই সে সবাইকে বসতে বলল টুল দেখিয়ে। তার দোকানে চা বিক্রি হয় না বলে আড্ডাও বসে না তেমন। আর সে কারণেই কোন বেঞ্চের ব্যবস্থা নেই তবে দোকানে দুটো টুল আছে সেগুলোই এগিয়ে দিতে বলল সে তার কর্মচারী ছেলেটিকে। একটি টুলে অনু বসলে অন্যটিতে সোহাকে বসতে বলল শরত। সোহা তার দিকে না তাকিয়েই বলল, “না না বসবো না।”

আর এইটুকুই খেয়াল করলো অনু, শিশির। তারা বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে শরত আর সোহার মাঝে কিন্তু কি তা জানার জন্য কথা বলতে হবে। শিশির পিঠার বক্স দুটো এগিয়ে দিতেই শরত অবাক হলো। পিঠা নিয়ে তারা দোকানেই চলে এসেছে! তবে মনে মনে খুব খুশিও হলো সে। কাস্টমার একটা দুটো আসছে যাচ্ছে তাই তারা সবাই একপাশে দাঁড়িয়ে শরতের সাথে পিঠা খেলো। শরত চা আর সমুচাও আনিয়ে খাওয়ালো। প্রায় আধ ঘন্টার মত সময় তারা দোকানে থাকলো এরপরই বাড়ি ফিরবে বলে ভাবছিলো। আলতা চা খায়নি তবে সমুচা খেতেই সে পানি চাইলো। শরত বোতল ভর্তি পানি আলতাকে দিলো। প্রথম ঢোক গিলতেই পানি গলায় বিঁধলো আলতার। শরত তার পাশে থাকায় মাথায় আলতো করে দু, তিনটা থাপ্পড়ের মত করে দিতে দিতে বলল, আস্তে খা এত তাড়া কিসের!”

সন্ধ্যের বাজারে অনেক মানুষ আসে তার মধ্যে মুরুব্বিরাই যেন বেশি। শরতের দোকানের উল্টোদিকেই রফিকের চায়ের দোকান। শিশিররা দোকানে আসার পর থেকেই রফিকের নজর এদিকে ছিলো। কাল কাশফুলের মাঝে আলতাকে দেখেই সে চিনেছিলো তবে ছেলেটিকে নিয়ে একটু কনফিউশন ছিলো তার। শরত আর শিশিরকে একইরকম লাগে আজকাল। ঢাকা থেকে আগেরবার যখন এলো তখন শিশিরকে একটু একটু বড় মনে হলেও এবার আসার পর থেকেই দাঁড়ি, লম্বা চুল আর শরীরের গড়নে শরতের মতোই লাগছে। গায়ের রঙ আর চুল লক্ষ্য না করলে বোধহয় দুজনকে আলাদাই করা যেত না তাই রফিক একটু দ্বিধায় ছিলো আলতার সাথের ছেলেটা কে! কিন্তু এখন এই মুহুর্তে শরতের হাত আলতার মাথায় দেখতেই মনে হলো তার রহস্য আর খোঁজা লাগবে না। ছেলেটা শরতই ছিলো কাল। মনে মনে একটু রোষানলে পুড়লো রফিক। তার মনে বহু বছরের পুরনো এক কূটচাল আবারও সতেজ হয়ে উঠলো যা অপ্রকাশিত ছিল।
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
১৯.

মধ্যরাত; বাস চলছে হাইওয়েতে। শীতের রাত বলে চলন্ত বাসে জানালা দিয়ে হু হু করে শীতল বাতাস ঢুকেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে শিশিরের। কিন্তু জানালা আটকে দিলেই আলতা বমি করে ভাসিয়ে দিবে আবার সেই ভয়ে বড় বিপদে পড়েই কিছুটা খোলা রেখেছে সে। পুরো জানালা খুললে আবার বাসের ভেতরের অন্য যাত্রীরা রেগে চেঁচামিচি শুরু করবে৷ রাতের বেলা বাসে করে পৌঁছুতে পাঁচ সাড়ে পাঁচ ঘন্টার বেশি লাগবে না বলেই ফিরতি পথে বাসের টিকিট কেটেছে তারা। মাঝামাঝি সিটগুলোর একটাতে সোহা আর অনু বসেছে তাদের পেছনের সিটে আলতা আর শিশির। বাসে উঠে সোহা নিজেই বলেছিলো, “আমি আর অনু সামনে বসছি তোমরা দুজন পেছনে বসো।”

আলতা তখন খেয়াল করেছিলো কোন এক কারণে সোহা একদমই নিশ্চুপ আর কেমন যেন নির্লিপ্ত আছে। সে সন্ধ্যেবেলায় শিশিরদের বাড়ি গিয়েও তাকে এমন দেখেছিল এমনকি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো শরত ভাইয়ের দোকানে যাওয়া নিয়ে ভীষণ আপত্তি তুলছিলো। আর বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডে যখন শরত ভাই এলো তাদের সাথে তখন সোহা একটিবারের জন্যও কোন কথা বলেনি। বাসে উঠার সময় শরত ভাই সবাইকে একে একে বিদায় বললেও সোহা কোন জবাব দেয়নি। আর সেই থেকেই আলতার মনে হচ্ছে তার এতদিনের জানায় ভুল ছিলো। সোহা আপু তার শিশির ভাই না বরং শরত ভাইকেই পছন্দ করে। আর কি আশ্চর্য ব্যাপার যখন থেকে তার মন মানলো সোহা আপু শরত ভাইকে পছন্দ করে তখন থেকেই তার অন্তরের অন্তস্থলের এক অদৃশ্য চাপ উধাও হয়ে গেছে। এ কেমন অনুভূতি তার মনের ভেতর আজকাল! হু হু করে রাতের বাতাসে শীতের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। আলতার নিস্তেজ দেহের অসাড়তাও বাড়ছে সেই সাথে। আজ কোন দ্বিধা ছাড়াই শিশির তার আলতাকে বড় স্বস্তির সাথে বাহুতে জড়িয়ে আছে। রাতের আঁধারে আজ তার মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠছে। বয়সটা কত তার! এখনই এই অনুভূতির এই তীব্রতা ক্ষ*তি করে ফেলবে না তো তার আর তার এই চঞ্চল পাখিটির? নাহ্ তার বেসামাল হওয়া চলবে না কিছুতেই এখনও অনেক কিছু করা বাকি তার। বাকি তার আলতারও কত কি করা। আলতাকে স্বাবলম্বী হতে হবে নিজের ভরসার জায়গা তার নিজেকেই হতে হবে। আলতাকে সে কখনোই অন্যের ওপর ডিপেন্ডেড হতে দিবে না বলেই তো তার মাথায় এই শহুরে জীবনে আনার ভূত ঢুকিয়েছিল। ফুপুআম্মার মত ভাঙাচোরা জীবন নয় বরং আলতাকে বাঁচতে হবে স্বনির্ভর এক সফল জীবন। এই ভাবনাগুলো ভাবতেই শিশিরের হাতটা শিথিল হয়ে এলো আলতার বাহু থেকে। কোথাও যেন একটু সাবধানতার ছল করেই সে আলতাকে আলগা করে ধরল।

ভোর পাঁচটা ; ঝাপসা ভোর সেই সাথে চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা এই ভোরে। আলতা রাতভর শিশিরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে এখনো ঘুমাচ্ছে। কাঁধ ব্যথায় চুরচুর হয়ে আসছে শিশিরের অথচ একটুও তার আভাস নেই তার মুখে। চোখ খুলে ঝাপসা চোখে বাইরে তাকালো। বাস চলছে এখনো হয়ত গন্তব্যের খুব কাছেই আছে তারা এখন। মধ্যরাতে বাস একবার থামলে অনুরা নেমেছিলো কিন্তু শিশির পারেনি। আলতার কোন সমস্যা হয় ভেবে সে বসেই ছিলো আলতাকে নিয়ে। তা দেখে অবশ্য সোহা কফি নিয়ে এসেছিলো শিশিরের জন্য। কিন্তু এই মুহুর্তে আর কিছুতেই কাঁধটা সোজা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সে আলতো হাতে আলতাকে কাঁধ থেকে সরিয়ে সিটে মাথা রাখলো। মিনিট কয়েক গড়াতেই গাড়ি এসে পৌঁছুলো গন্তব্যে। শিশির বড় ধীর স্বরে একবার সোহাকে ডাকতেই সে জবাব দিলো। শিশির বুঝতে পারলো সোহা রাতভর চোখের পাতা এক করেনি কোন এক দুঃসহ কারণ আছে এর পেছনে। কিন্তু আপাতত এ নিয়ে কথা বলার সময় এবং সুযোগ কোনটাই নেই। সোহা অনুকে ডাকছে আর শিশির আলতার মাথায় হাত বুলিয়ে আলতাকে ডাকছে। ভোরের আলো তখনো চরাচরে এসে পৌঁছুয়নি তবুও পূব আকাশটার কমলাভ রঙ একটু একটু চোখে পড়ছে। হয়তো আর একটু পরই সেই রঙ কাচা হলদে রঙ ধারণ করে ধরনীর ফ্যাকাশে আলোকে উজ্বল করে তুলবে। চারজনই বাস থেকে নেমে নিজ নিজ ব্যাগ হাতে তুলে নিলো। আলতার ব্যাগ মানেই যেন শিশিরের বহনের জিনিস তাই আলতাকে ব্যাগে হাত দিতে হলো না। ব্যস্ত ঢাকা নগরী রিকশার শহর হলেও এত ভোরে রিকশা চোখে পড়লো না কারো। অনু চারপাশ খেয়াল করে শিশিরকে বলল, “সব একটু অপেক্ষা কর আমি আম্মুকে বলছি গাড়ি পাঠাতে।”

শিশির একবার বারণ করতে গিয়েও করলো না সোহার দিকে তাকিয়ে। সোহার চোখ মুখ কেমন যেন লালচে আর ফোলা মনে হলো তার। সে কি বাসে বসে কেঁদেছে খুব! কই সামনেই তো ছিল কান্না করলে টের পেতো না সে! তবুও সোহার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া উচিত। পরে না হয় কথা বলা যাবে এসব নিয়ে এখন সে একটু নিজেকে একা সময় দেক। খারাপ লাগছে শিশিরের যাওয়ার পথে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস তার মাঝেই ছিল আর ফিরতি পথে দুঃখী মানুষটাও সে-ই।

অল্প সময়ের মাঝেই অনুর মা তাদের বাড়ির গাড়িটি পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাওয়ার পথে প্রথমেই আলতার হোস্টেল পড়ে, তারপর সোহার বাড়ি। হোস্টেলের সামনে আসতেই দেখা গেল গেইট তখনও খোলেনি। অনুকে একরকম জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে সোহাকে পৌঁছে দিতে আর শিশির থেকে গেছে আলতার সাথে। গ্রামে থেকে চারটা দিন সকালটা ধোঁয়াশায় কেটেছে অথচ আজ কুয়াশা এখানে নামমাত্র। শিশিরের হাঁটু আর কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা তবুও তার এই কাকডাকা ভোরে ফুটপাতে হাটতে ভালো লাগছিলো আলতাও হাটছে তার পাশাপাশি। মিনিট কয়েক হাটার পর প্রথম মুখ খুলল আলতা, “সোহা আপুর কি হইছে? উনি কালকে থেকে খুব মন খারাপ করে আছে।”

আলতার কথা শুনে চকিতে তাকালো শিশির।
“তুই খেয়াল করেছিস?”

“হুম”

“আর কি খেয়াল করেছিস?”

“শরত ভাইয়ের সাথে কোন কথা বলেননি আসার সময়।”

“আর!”

“কোন কারণে মনে হয় শরত ভাইয়ের সাথে সোহা আপু অভিমান করছে। আর…”

চুপ হয়ে গেল আলতা। পরের বাক্যটা শিশিরের সামনে বলতে তার লজ্জা লাগছে বলেই থেমে গেছে কিন্তু শিশির কৌতূহলী জানার জন্য।

“আর!”

ভোরের আলোয় সফেদ পর্দা সরে পৃথিবী এখন হলদে হয়ে উঠছে। গাছের পাতায় একটু আধটু কুয়াশা লুকিয়ে আছে গুপতচরের মত। আলতার নীরবতা শিশিরকে অধৈর্য্য করে তুলল। সে আবারও বলল, “বল আর কি?”

ইতস্তত করতে করতেই আলতা এবার বলে ফেলল, ” সোহা আপু মনে হয় শরত ভাইকে ভালোবাসে।”

পা থামিয়ে শিশির তাকালো আলতার দিকে। সে বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ রইলো কিছুটা সময় তারপরই ফিচেল হেসে বলল, “তুই বুঝিস ভালোবাসা?”

আলতা বোধহয় এমন কিছু কল্পনাও করেনি। শিশির তাকে এমন কোন প্রশ্ন করতে পারে তা ভাবেনি কখনও। ভালোবাসা কি সে জানে না তবে জানতে চেষ্টা করে। প্রতি মুহূর্তে তার সকল কাজের মাঝে এই উজ্জ্বল শ্যামলা মুখের মানুষটা তার ভাবনঘরে পায়চারী করে সেটাই কি ভালোবাসা! তার সকল যন্ত্রণা, একাকীত্ব আর অস্বস্তির মাঝে এই মানুষটার একটা, দুটো মুখের কথাই তৎক্ষনাৎ যন্ত্রণানাশকের মত কাজ দেয় সেটাই কি ভালোবাসা! এই মানুষটাকে দেখার জন্য, হুটহাট তার কণ্ঠ শোনার জন্য এই যে তার চঞ্চল মনটা যখন তখন ছটফটায় সেটাই কি ভালোবাসা! মন বলে হ্যা এটাই ভালোবাসা তাছাড়া আর কি হবে! আর এগুলোই যদি ভালোবাসা হয় তবে আলতা নিশ্চিত সোহা আপু শরত ভাইকে ভালোবাসে। সে দেখেছে গত চারটা দিন সোহা আপু যখন যখন শরত ভাইকে আশপাশে পেয়েছে ঠিক তখন তখনই খুব হেসেছে। মুচকি হাসি, উচ্ছল আর প্রাণবন্ত ছিলো সেই হাসি। মনে পড়ে তার মেলায় যখন শরত ভাই কানের দুল কিনে দিলো সোহা আপু খপ করে সবগুলো দুল নিয়ে কেমন বুকের কাছটায় ছুঁয়ে রাখলো। যেন শরত ভাইয়ের কিনে দেওয়া দুল নয় ওগুলো খোদ শরত ভাইকেই হাতে পেয়ে গেছে।আর সারাক্ষণ কেমন আড়চোখে শুধু শরত ভাইকেই দেখেছে।

শিশির প্রশ্নের জবাব না পেয়ে হাঁটা থামিয়ে দিলো। আলতার দিকে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে।

“তুই এত বদলে গেলি কেন রে! এত ভাবুক, এত নীরব তো ছিলো না কখনো আমার আলতা।”

আমার আলতা! ভীষণ এক গভীর ধাক্কা লাগলো বুকের ভেতর। শিশির ভাই তাকে ‘আমার আলতা’ বলল!

“এ্যাই আলতা তুই কি কোন কথার জবাব দিবি না বলে পণ করেছিস?”

“শিশির ভাই কয়টা বাজে?”

“কয়টা বাজে দিয়ে কি করবি?”

“হোস্টেলে যাব না!”

“ওহ হু” বলে শিশির উল্টোপথে হাটা শুরু করলো আলতাকে নিয়ে৷ এ পর্যায়ে আলতা স্বস্তি পেলো শিশিরের প্রশ্ন এড়ানো গেল বলে। আজকাল লোকটা বড্ড উগ্র হয়ে ধরা দিচ্ছে। আগে তো এমন ছিলো না!

আলতাকে পৌঁছে দিয়ে সকাল আটটায় শিশির নিজের হলে পৌঁছুলো। রাতভর জেগে থাকার ক্লান্তি একমাত্র ভরপেট খাওয়ার পর একটু ঘুমাতে পারলেই দূর হবে জানে শিশির কিন্তু এখন মাথায় ঘুরছে সোহার কথা। মেয়েটার যে কাল সকাল থেকে কি হলো কে জানে! হলে ঢুকে নিজের ঘরে গিয়ে সে আগে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here