শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব -৩৯

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩৯.(১ম অংশ)
ধীর গতিতে এগিয়ে চলছিলো সময়গুলো। কখনো আলতার পক্ষে তো কখনো তার বিপরীতে তবে শিশিরের পক্ষপাতিত্ব করছিল সেই সময়ের পাতা। ভিনদেশে গিয়ে দেশের সহজ, সাধারণ আর সৎ মনের চঞ্চল চিত্ত আর উগ্র তবে একনিষ্ঠ ছেলেটির পদস্খলন হতে হতে ঠিক হয়ে উঠেনি। সেবার বাড়ি থেকে জানানো হল বিয়ের কথা। শিফা জা কে নিয়ে নকশির কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতেই সে এক কথায় রাজী। যে বাড়িতে মেয়ের জন্ম, বেড়ে ওঠা, যে মানুষগুলোর স্নেহের ছত্রছায়ায় বেঁচে থাকা সে বাড়িতেই আজীবনের ঠাঁই আলতার জন্য সোনায় সোহাগা। নকশি এক কথায় রাজী থাকলেও আহসানুল্লাহ বলল আওলাদকে জিজ্ঞেস করা উচিত তার মনে কি ভাবনা? পরিস্থিতি তাকে হয়ত সুযোগ দেয়নি মেয়েটির জন্ম, বেড়ে ওঠার মূহুর্তগুলোতে পাশে থাকার কিন্তু বিগত কয়েকটি বছর সে বাবার হক আদায় করেছে। আওলাদকে যখন জানানো হলো সে আনন্দিত হয়ে মতামত প্রকাশ করল। সে দেখেছে শিশিরকে কি করে তার মেয়েকে আগলে রেখেছে শহরের মাটিতে৷ আলতার কাছেই তো শুনেছিল, শিশির ভাই কি কি করেছে তার জন্য। এক কথায় আওলাদও রাজী হয়েছিল। নিজেরাই বিয়ের আলোচনায় সবটা এগিয়ে চূড়ান্ত মতামত বর, কনের হবে বলেই তাদের ফোন করেছিল শিফা, নকশি। তখনো দু জনে দোনোমোনা চলছে বিভিন্ন কারণে তবুও বিয়ে নিয়ে শিশির শুধু আলতা কি চায় তাই জানতে চেয়েছিল। আলতার জবাব ছিল সবাই যা বলবে তাই। মতের অমিল কোন দিক থেকেই ছিল না বলে বড়রা মিলে ঠিক করল মোবাইলেই বিয়ে হবে এখন। শিশির ফিরলে আয়োজন করা হবে দু পক্ষে। সব কিছু ঠিকই ছিল হুট করেই শিশির একটি দূর্ঘটনায় পড়ল। সপ্তাহ খানেক হসপিটালে থেকে ফিরে তার মন বদল হলো৷ মোবাইল ফোনের বিয়ে সে মানে না যা হবে সে দেশে আসার পরই হবে। ততদিনে যদি আলতা কিংবা ফুপুআম্মা মত বদলে নেয় তবে সে আপত্তি তুলবে না। প্রকৃতিতে তখন খরা সেই খরার খরতাপে ঝলসে ছিল শিশিরেরও হৃদয়। আলতার কোন দোষ ছিল না, ছিল তার নিজেরই মানসিক দ্বন্দ্ব। এরপর শিশিরের পড়া শেষ হলো তবুও দেশে আসার নাম সে মুখে নিতে পারল না। যে পরিমাণ টাকার ঋণ চেপেছিল মায়ের পৈতৃকসম্পত্তি থেকে নেওয়া সে টাকার অর্ধেকটাই সে উসুল করেছিল। তবুও বাকিটা পূরণ না করে ফেরাটা হতো অকর্মণ্যতা তাই আরেকটু সময় চেয়েছিল। দেশে ফিরেই সে মনমতো জব কিংবা পছন্দসই কিছু করতে পারত না অর্থ ছাড়া। সব মিলিয়ে বিদেশের মাটিতে তার থাকার সময়টা সত্যিই বাড়াতে হলো। তবে ততদিনে মন পরিষ্কার রেখে আলতাকেই প্রশ্ন করেছিল, “আমাকে কি আরও দুটো বছর দিতে পারবি?”

আলতার অজানা ছিল না শিশির ভাইয়ের মনস্কামনা তাই নির্দ্বিধায় বলেছিল, “যাও আরও তিনটি বছর দিলাম তোমায়৷”

“না এমনিতেই বড় অধৈর্য্য হয়ে আছি আমার চঞ্চল পাখিটার জন্য। দুটো বছরই অন্তর্দাহ সইতে সইতে পরপারে না চলে যাই সে ভয়ে আছি।”

“ফালতু কথা একদম বলবে না বলে দিলাম।”

“কেন! জ্বলে?”

“না ক্ষত হয়।”

“কোথায় রে!”

“বুকের ভেতর।”

“দেখি তো কোথায় সেটা?” বলেই ক্যামেরায় উৎসুক দৃষ্টি রাখল।

শিশিরে ফাজলামো বুঝতে পেরে আলতা ধমকে উঠলো, “অসভ্য মানুষ!”

দুজনের ভেতরকার কাঠিন্যতা কখনো বাড়ল, কখনো কমলো। সময়ে, অসময়ে ছোট-বড় অনেক ব্যাপারেই ভুল বোঝাবুঝিও হলো কিন্তু দিনশেষে তাদের সম্পর্কে রয়ে গেল অটুট। শিশিরের আলতা অস্পৃশ্য থেকে গেল তারই স্পন্দনে নতুনত্বের অপেক্ষায়। এমপির সেই ছেলেকে নিয়ে বেড়েছিল ঝামেলা। শিশির কাছে নেই তবুও যেন পাশেই ছিল প্রতিমুহূর্তে ছায়ার মত৷ সে কোন সুপারহিরো অথবা রূপকথার কোন অচিন রাজ্যের রাজকুমারও নয় তাই দূর থেকে অন্যের মদদ নিয়েি তার আলতাকে রক্ষা করে গেছে। তাওহীদের নজরে যে শিশির ছিল একসময় ঘোর শত্রু, প্রতিদ্বন্দী সে-ই একসময়ে হয়ে উঠলো পছন্দের মানুষ অনেকটা সহোদরের ন্যায়। তাওহীদের ব্যাপারে অনুকে বোঝানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল শিশির কিন্তু কাজ হয়নি৷ অনু নিজের মত চলে গেছে নতুন থেকে নতুন পথের সন্ধানে৷ কিন্তু তাওহীদ তবুও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে শিশির চেষ্টা তো করেছিল! কৃতজ্ঞতা থেকেই সে ভাল চায় শিশিরের আর শিশিরের ভাল থাকা যে আলতার মাঝে এ বিষয়েও তার সন্দেহ ছিল না। তাওহীদ স্বনামধন্য রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে৷ আলতার পেছন থেকে নিজের ভাইকে যেমন সরিয়েছিল তেমনিই সেই এমপির ছেলেকে তাড়িয়েছে৷ শিশির থেকে বয়সে অনেকটা সিনয়র তাওহীদ একদিন মজার ছলেই বলেছিল, তোমার বিয়ের রাজস্বাক্ষীটা আমাকেই রেখো। সেই থেকে তাদের মাঝে ঠিক হয়ে আছে আলতার বিয়েতে উকিল বাপটা তাওহীদই হবে৷ প্রথমে অবশ্য আফসোস করেছিল এত সুন্দর মেয়েটার যেখানে অন্য কিছু হওয়ার কথা ভাবব তুমি সেখানে বাপ বানিয়ে দিলে! মজার সেই সম্পর্ক তারা আজও চলমান রেখেছে। শিশিরের পড়াশোনা শেষ হয়েও হয়নি যেন। লন্ডনেই সে আরও তিনটি বছর কাটিয়ে আরও ডিগ্রি নিলো সেই সাথে জব তো ছিলই৷ দেখতে দেখতে পরের তিনটি বছর সব মিলিয়ে পাঁচটি বছর কাটিয়ে তার সময় হলো দেশে ফেরার। ততদিনে আলতার অনার্স শেষ হলো, ঢাকায় মোটামুটি বেতনে ভালো একটি জবও পেয়ে গেল বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে। কোচিং ছাড়ার ইচ্ছে হতো না তার তবুও মাস শেষে কোচিংয়ের যে টাকা আসতো তা দিয়ে হিসেব করে থাকা, খাওয়ার বাইরে খুব একটা পয়সা বাঁচতো না। কলেজে পড়ার সময় সে বাবার টাকা নিয়েছে অনার্সের প্রথম দুটো বছরও বাবা অনেক দিয়েছেন কিন্তু আজকাল তিনি আর্থিক সংকটে আছেন তা যেন দূর থেকেই টের পেয়ে গেল সে৷ তারপর থেকেই এক প্রকার জোর করেই বাবার টাকাটা ফেরত দিতো। একদিন ছোট ভাইটা বাবার ফোন থেকেই ফোন করে বলল, বাবা নাকি তার মায়ের গলার চেইন বিক্রি করে আলতাকে টাকা দিয়েছে। কথাটা প্রথমে মিথ্যে মনে হলেও পরে ঠিকই সে দুয়ে দুয়ে হিসেব মিলিয়ে বের করে নিলো কথাটা মিথ্যে নয়। প্রায় প্রতি মাসেই স্বশরীরে তাকে দেখতে আসা আব্বা প্রায় তিনটি মাস তাকে দেখতে আসেনি শুধু মাসের প্রথম তারিখে বিকাশে করে টাকা পাঠিয়ে দিতো৷ এরপর তার পরীক্ষার সময় একসাথেই অনেকগুলো টাকা লাগলো বলে সে বাবার কাছে চাইতেই তিনি হঠাৎ সময় চাইলেন। দিন তিনেক সময় নিয়ে তিনি হিসেব করের পরীক্ষার টাকাটাই দিয়েছিলেন আর সে মাসে একটিবারও জানতে চাননি আলতার কাছে অন্যান্য খরচ আছে কিনা। এমনটা আগে কখনোই হতো না কিন্তু সেবার এমনই হয়েছিল। আলতা অবশ্য এরপর আর আব্বার কাছে টাকা চায়নি কখনো শুধু আড়ালে খোঁজ নিয়েছিল তার আব্বার ব্যবসা কেমন চলে। গরুর খামারে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল আওলাদকে সেই ক্ষতি টেনে উঠতেই সময় লেগে গেল বছরখানেক। এখন অবশ্য তেমন সমস্যা নেই। অভাব দূর হয়েছে, শিশির দেশে এলেই মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে হবে ভেবে দ্রুত বাড়ির নকশাও বদলে ফেলেছে। টিনের ঘর এখন পাকা দেয়ালে, টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর একদম শিশিরদের মতই৷ এরই মাঝে আবার একটা ঘর পরিপাটি, রঙচটা করে সাজিয়েছে মেয়ের জন্য। আওলাদের স্ত্রী প্রথমে নাখোশ থাকলেও এখন তার খুশির সীমা নেই। সতীনের মেয়ের উছিলায় ঘর তো পাকা হলো! তারা ছেলে দুটোর জন্য সুন্দর ঘর, টিভি আর সুন্দর দুইটা পালঙ্কও হয়েছে৷ সতীনের মেয়ে তো বিয়ে দিলেই বিদায় ঘরটা তো শেষে তার ছেলেদেরই থাকবে তাই মনের পোষা রাগ এখন আর গরম আঁচ দেয়না তাকে। এদিকে এত বছরে পরিবর্তন এসেছে মাস্টার বাড়ির কোণায় কোণায়। শিশির দেশে আসবে, বিয়ে করবে সব ভেবেই শিফা বায়না করল ঘর রঙ করাতে হবে আহসান তাই করালো। দু দিন বাদেই আবার শিফা মুখ ফুলালো ছেলের বিয়ে দেবে ঘরে একটা ভাল আয়না নেই। ছেলের বউ কি তার ঘরে এসে মুখ দেখবে! আহসান সে কথাতেও পাত্তা দিয়ে সেগুন কাঠের কারুকার্য শোভিত সুন্দর একটি ড্রেসিংটেবিলও বানাতে দিলেন। হুট করেই শিফার মনে হলো বিয়ের সময় আত্মীয়স্বজন ঢের থাকবে অত মানুষ থাকবে কোথায়! আহসানও ভাবল তার নিজের না হোক শিফার তো ভাই বোন ভাগ্নে, ভাতিজা অনেকগুলো ছেলের বিয়ে উপলক্ষে সে নিশ্চয়ই সবাইকে চাইবে দাওয়াত করতে! চুপচাপ মানুষের মত আহসান হাতের টাকা খরচ করে নকশির থাকা পুরনো সেই ঘর দুটো মেরামত করিয়ে চৌকি, তোশক কিনে গোছালেন৷ এখানেই ক্ষান্ত হয়নি শিফা তার একটি মাত্র মানিক রতনের বিয়ে হবে বাড়ি ভর্তি আলোক সাজবে তার জন্যও আগাম ব্যবস্থা করিয়ে রাখতে বলেছে। এদিকে শরতের বিয়েরও কেটে গেছে তিন বছরের বেশি সময়। বাড়িতে আনা কিশোরী রূপসা হয়ে উঠেছে পাক্কা গৃহিণী, স্বামীসোহাগিও বটে! সেই যে ঝড়ের রাতে মিলন হলো সেই রাতেই যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেল ছোট্ট কিশোরী মেয়েটি৷ পড়াশোনায় তার ঠিকঠাক মন না থাকলেও সংসারের প্রতি ছিল ভীষণ টান। শরতের টেনে হিঁচড়ে পড়ানোর দায়ে বেচারি কলেজ পাশ করল টেনেটুনেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে তার পা পড়েনি কিছুতেই। জয়তুনও যেন এমনটাই চাইতেন তাই প্রায় বউমার হয়ে উকালতি করতেন ছেলের কাছে, “থাউক পড়ালেহা। অনেক করছে এই দিয়াই পোলাপান পালতে পারব।” শরতও হার মেনেছে; সংসার চলেছে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিময়। এরই মাঝে হঠাৎ খবর পেলো নতুন মানুষ আসছে তাদের। কি যে আনন্দের সেই খবর! আহসানুল্লাহ প্রথমবার দাদা হওয়ার আনন্দ পালনেই মিষ্টি মুখ করাল বাড়ির সবাইকে। বাড়িভর্তি সবাই এ নিয়ে ভীষণ খুশি কিন্তু আফসোসের পাহাড় ভেঙেছে রূপসার মাথায়। তার একমাত্র দেবরের বিয়ে উপলক্ষে সে কত সাজবে, কত নাচবে, দেবরের বউ আনতে বরযাত্রী যাবে সে কি পরিকল্পনা! অথচ শিশিরের বিয়ের তারিখ পড়তে পড়তে তার তখন চলবে পাঁচ কিংবা ছয় মাস। আঙ্গুলের কড়ায় দিন গুনে গুনে মুখটা তার ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। নিজের পেটে হাত রেখেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “তোরও কি শখ জাগছে চাচার বিয়া খাওয়ার!”

চলবে
(এই যে আপনারা শিশির আলতার বিয়ে খাব, বিয়ে খাব বলতে থাকেন গিফট কি কিনে ফেলছেন? গিফট ছাড়া কিন্তু দাওয়াত খেতে পারবেন না)#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩৯. (শেষাংশ)

জায়গাটা মতিঝিলে: মোটামুটি পরিচিত একটি বেসরকারি অফিসের নিচ তলায় গেইটের দারোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আওলাদ। নিজের গ্রাম, কাজকর্ম এসবেরই আলাপ করছে সে লোকটার সাথে সেই সাথে অপেক্ষা করছে তার মেয়ের। আলতার আজ অফিসে কাজ নেই লাঞ্চের পর তার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে টানা পনেরো দিনের৷ নিয়মের বাইরের এই ছুটি অবশ্য পাওয়ার কথা ছিল না কিন্তু পাতানো ভাই তাওহীদ আপনের মতই এখানেও তার অদৃশ্য শক্তির হাত রেখেছিল। বিয়ে উপলক্ষেই হোক কিবা হানিমুনও ছুটি তার পনেরোদিনই থাকবে।

“আব্বা আসো আমার হয়ে গেছে।”

নিচতলায় গেইটের সামনে এসে আলতা তার বাবাকে ডাকলো। আওলাদও কথায় ইস্তফা দিয়ে দারোয়ানকে বলল এই আমার মাইয়া দোয়া কইরো ভাই এই শুক্কুরবারে তার বিয়া। পাত্র বিদেশ থাইকা পড়ালেহা কইরা আসতাছে।” দারোয়ান আগ্রহ নিয়েই শুনছিলো আওলাদের কথা। এবার আওলাদ তার বেশভূশা বিশেষ পরিবর্তন করে এসেছিলো ঢাকায়। মেয়ে এখন ভালো চাকরি করে, প্রচুর শিক্ষিত ছেলের সাথে বিয়ে সেখানে আওলাদ আগের মত কমদামী প্যান্ট আর লম্বা স্ট্রাইপের শার্ট পরে এলে লোকে হয়ত হাসবে আলতাকে নিয়ে। সে শুদ্ধ জবানি বলতে না পারলেও চেষ্টা করেছে দারোয়ানটার সামনে নিজের ঠাটপাট বোঝানোর কে জানে কতটুকু পেরেছে! দারোয়ান আলতাকে দেখে বলল, ওহ আয়শা মেডামের আব্বা আপনে?

‘মেডাম’ শব্দটা আওলাদের কানে বেশ আন্দোলিত হলো। তার এইটুকুনি মেয়েকে কেউ মেডাম ডাকছে এতে বেশ গর্ব বোধ করতে লাগল। তার বংশে তার এক ভাতিজা শুধু অনেক পড়াশোনা করেছে কিন্তু মেয়ে বলতে কেউ স্কুলের গন্ডি পার করতে পারেনি৷ তার বড় ছেলেটাও নাইন পাশ করে আর পড়লো না। এখন তো তার সাথেই খামারের কাজে লেগেছে৷ আলতার দিকে চেয়ে নকশির কথা মনে পড়ল খুব। মনে মনে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করল৷ আজ এমন দিন দেখতে পাওয়ার পেছনে হাত একমাত্র নকশি। তার সংগ্রামই তো এতদূর এনেছে মেয়েটাকে।

” ব্যাগ আমার কাছে দে” বলেই আওলাদ বড় ব্যাগটা নিয়ে নিলো। আলতা দারোয়ানকে বলল, “আসি চাচা দোয়া রাখবেন।”

আজ ট্রেনে রওনা হওয়ার কথা থাকলেও শরত ফোন করে বলল কোন এক রাস্তায় ট্রেন দূর্ঘটনা ঘটেছে। ঠিকঠাক নিউজ পায়নি তবুও সতর্ক করে সে বলল, আপনারা বাসে চলে আসেন। শরতও এখন পথে সে ঢাকায় আসছে শিশিরকে রিসিভ করতে। শিশির পৌঁছুবে রাতে তাই শরত একটু আগে রওনা হয়েছে। আলতা আর আওলাদ বাসের টিকিট কাটতে এসে জানতে পারলো বাস ছাড়বে সাড়ে তিনটায়। ঘড়িতে এখন বাজে দুইটা। লাঞ্চ টাইম; আলতা প্রথমে ভেবেছিল কোন হোটেলে ঢুকে খাবার খাবে পরে মনে হলো হাতে সময়ও আছে আর আব্বা কখনো দেশে কোন রেস্টুরেন্টে খায়নি। বিদেশে থাকাকালীন খেয়েছে কিন্তু সেখানে তৃপ্তি নিয়ে খাওয়ার মত কোন খাবার পায়নি। আলতা ভাবে, আব্বা হয়ত কোন বাঙালি রেস্টুরেন্টে খায়নি তাইনি পছন্দ হয়নি। আজ জোর করেই অনেকটা নিয়ে গেল ভালো দেখে একটি রেস্টুরেন্টে। আলতা মেন্যু দেখে অর্ডার করল কাচ্চি,চাটনি আর জর্দা । বিশ মিনিটের মাঝে তাদের খাবার সার্ভ করতেই আওলাদ আঁতকে উঠল, এত্তা কিছু কয়জনে খাইবো রে মা!

“আমরা খাব আব্বা আর আমি বাড়ি গিয়ে সবাইরে এগুলান রান্না করেও খাওয়াবো। খাওয়া শুরু করো আব্বা।”

কাচ্চি খেতে খেতে আওলাদের মনে পড়ল সে লম্বা লম্বা বাসমতী চালের বিরিয়ানি শেষ খেয়েছিল বিদেশে বছর সাত কি আট আগে৷ দেশে এসে আর কখনো সুযোগ হয়নি৷ আলতা অবশ্য তাকে দেখতে আসলেই জোর করে খাওয়াতো কিন্তু প্রতিবারই সস্তা হোটেলে বসে৷ এমন শীততাপনিয়ন্ত্রিত দামী শপে সে ঢুকতে চাইতো না ভয়ে৷ মনে হতো এগুলোতে খরচ খুব বেশি হয়ে যাবে। এমনিতেই শহরে এলে পানি পর্যন্ত টাকায় কিনে খেতে হয়৷ বাবা মেয়ে খেতে খেতে আলতা একটা সেলফিও তুলে নিলো নিজেদের। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আলতাও ভালোবাসে মাঝেমধ্যে নিজের প্রোফাইলে ছোট ছোট খুশিগুলো শেয়ার করতে এটাও করবে। বাবা -মেয়ে খাওয়া শেষ করে যখন বেরিয়ে এলো আবার বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে তখন হাতে সময় আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। রিকশায় পৌঁছুতে সাত মিনিটের বেশি লাগল না। শরতের মধ্যাহ্ন প্রকৃতিতে হাওয়ার দাপট আছে কিছুটা। কিন্তু তাতে গরমের দাপটে ভাটা পড়েনি তিল পরিমাণ৷ শেষ রাতে গ্রামের মানুষ একটু আধটু টের পায় শীতবুড়ি গুটি গুটি পায়ে আসছে। ভরপেট খেয়ে এসে বসায় শরীর এবার ঘুমের জন্য বিছানা চাইছে। আলতার এমনিতেও রোজ অফিসে এ সময়টায় চোখ লেগে আসে তার। কাজের ফাঁকে ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমিয়েও নেয় সুযোগ পেলে। এখনো ব্যতিক্রম নয় বাসে মাথা এলিয়েই চোখ বুঁজেছে।

ঘড়ির কাটা বলছে সময় এখন ঠিক দশটা। শরত দাঁড়িয়ে আছে এয়ারপোর্টের বাইরে। এনাউন্সমেন্ট কানে আসছে প্লেন ল্যান্ড করেছে। অস্থির পায়ে সে পায়চারী করছে আর একটু পরই চোখের সামনে থাকবে ভাইটা। গুনে গুনে পাঁচ বছর আগে সে-ই এসে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল আজ আবার সে নিজেই নিতে এসেছে। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। অপেক্ষা লম্বা হল অনেক বেশি। শিশিরের দেখা মিলল ঠিক দেড় ঘন্টা পর। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় পর শিশির যখন সামনে এসে দাঁড়ালো তখন থমকে গেল শরত। এটা শিশির! শরত মনে করার চেষ্টা করল শেষবার তাকে কেমন দেখেছিল? পরশুও তো ভিডিও কলে দেখলো কই তখন তো আগের শিশিরই মনে হচ্ছিলো। অবশ্য তখন শুধু মুখটুকুই চোখে পড়েছে এখন সম্পূর্ণ শরীরসহ মুখটা দেখে বিষ্ময়ে খেই হারালো শরত। তারুণ্যের শুরু ছিল তখন দেখতে ছোটই লাগত কিন্তু আজ যে সামনে সে দেখতে আগের চেয়েও যেন লম্বা হয়েছে। কাঁধ চওড়া আগেই ছিল এখন হয়ত স্বাস্থ্য বেড়ে আরও চওড়া লাগছে। চোয়াল জোড়া আগের মতই কঠিন তবে গায়ের রঙ বদলেছে কিছুটা। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের ছেলেটাকে এখন ফর্সা ফর্সাই লাগছে যেন! শরত যখন ভালো করে শিশিরকে দেখছিল শিশির তখন জাপটে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরল। প্রথম বাক্যেই বলল, “ভাই তুৃমি কি অনেক শুকিয়ে গেছো?”

শিশিরের প্রশ্নে শরতের খেয়াল হলো শিশির তাকে জড়িয়ে ধরেছে। সেও দু হাতে ভাইকে ধরে জবাব দিলো, “সারাক্ষণ প্যারার মধ্যে থেকে আর কি হবো! তুই বল কেমন আছিস আর এত দেরি কেন হলো?”

” ওহ, ভাই দেরি হয়েছে এক হারামি চোর ধরা পড়ছে। ড্রা*গ ডি*লার ছিল আমাদের সাথেই এসেছে। সেখানকার কড়া সার্চিংয়ের ভেতরও চলে এসেছে কিন্তু এখানে ধরা খেয়ে গেল। সেই চক্করে সকল যাত্রীকে হয়রানিতে পড়তে হয়েছে।” কথা বলতে বলতে শিশির তার ব্যাগ দুটো টেনে সামনে আনলো। তা দেখে শরত এক ব্যাগ নিজে ধরল। রাত অনেক হচ্ছে এখন তারা বাসও পাবে না জানে বলেই শরত রুম বুক করে এসেছে। রাতটা তারা হোটেলে থেকে ভোরের গাড়িতে রওনা দিলো গ্রামের পথে৷ দেশে পা রেখে আলতার সাথে এখন অবধি শিশিরের কথা হয়নি। তার ফোনে দেশি সিম লাগাতে হবে, রিচার্জ করবে তারপর সুযোগ মিলবে কথা বলার। চাইলে শরতের ফোন থেকে করতে পারতো কিন্তু অস্বস্তি লাগছিল ভাইয়ের কাছে ফোন চাইতে। বাড়ি পৌঁছুতে ঘড়ির কাটা তিনের ঘরে৷ গ্রামে পা রাখতেই কেমন চারপাশ গমগমে মনে হলো শিশিরের। চেনা মাটি, চেনা মানুষজন সবটাই কেমন বদলে গেছে পাঁচ বছরে। আলতাও কি বদলে গেছে! সে তো কাল সকালেও দেখেছে তাকে কই পরিবর্তন তো খেয়াল করেনি! পরক্ষণেই মনে হলো এখন তো বাড়ি ঢুকে তাকে দেখতে পারবে না। আলতাকে তো তার বাবা নিজ বাড়িতে নিয়ে গেছে। আওলাদ কাকা নিজেই ঠিক করেছে বিয়ের আগ পর্যন্ত আর সে ও বাড়ি না থাকুক। একেবারে কনে বিদায়ের পর এসে ঢুকবে মাস্টার বাড়িতে। নকশিও মেনে নিয়েছে সে কথা তাই আহসানও আপত্তি তোলেনি। বাস স্টপেজ থেকে অটোতে করে শিশির শরত এসে নেমেছে বাড়ির গেইটে। অটোর আওয়াজ পেয়ে একরকম হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসেছে শিফা, জয়তুন আর নকশি। রূপসাও ততক্ষণে ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে একমাত্র দেবরকে দেখার। ফোনে ভিডিও কলে বহুবার দেখেছে, কথাও হয়েছে তাদের অনেক। দেবর- ভাবী -ননদ নামে তাদের অনলাইন গ্রুপও খুলেছিল শিউলি৷ শরতকে বাদ দিয়ে তাতে শিশির, আলতা, রূপসা আর শিউলির গল্প জমতো সেই সুবাদেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। শিশির অটো থেকে নেমেই মাকে জড়িয়ে ধরে। শিফা ছেলেকে বুকে পেয়ে কেঁদে ফেলল শিফা। চোখ ভিজলো শিফা আর জয়তুনেরও৷ আহসান দুপুরের আগে গিয়েছিল আলতাদের গ্রামে আলতাকে দেখতে সেই সাথে আংটি আর চুড়ির মাপও আনতে বলেছে শিফা। শিশির মাকে শান্ত করে বাড়ির ভেতর ঢুকে চাচী আর ফুপুআম্মার সাথেও কথা বলল। শরত অটোওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করে বাড়ি ঢুকে দেখলো রূপসা দাঁড়িয়ে আছে৷ চোখাচোখি হলো দুজনে তাতেই ইশারায় কথাও হলো, দাঁড়িয়ে আছো কেন? রূপসার জবাব, এমনিতেই। শরত ঘরে যেতেই রূপসা এগিয়ে গেল ফ্রিজে রাখা শরবত আনতে। জয়তুন মাত্রই ডাকবে তখনই দেখল শরবত হাতে রূপসা আসছে৷

“শিশির ভাই নেন শরবতটা খান।”

“কেমন আছেন ভাবী?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”

“আমিও ভালো। ভাবী.. ” কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল শিশির। সামনেই আম্মা, চাচী, ফুপু তাই সংকোচ হলো আলতার কথা জিজ্ঞেস করতে। রূপসা হয়ত বুঝতে পারলো তাই ঠোঁট নাড়িয়ে বিনা শব্দে কিছু একটা বলল। শিশিরও যেন বুঝে গেল সে কথার অর্থ তাই আর কিছু না বলে মায়ের সাথে বিভিন্ন কথায় ব্যস্ত হলো।

“শিশির ভাই কি দেশে আসার পর আলতার সাথে কথা বলে নাই?” শরবতের গ্লাসটা শরতের দিকে বাড়িয়ে প্রশ্ন করলো রূপসা।

“নাতো। কেন?” শরত হাত বাড়িয়ে গ্লাসসহ রূপসাকেও টেনে নিজের পাশে বসালো।

“কেন বোঝেন না ?”
গা ঘেঁষে শরতের বাহুতে বাহু ঠেঁকিয়ে বসে বলল। পরমুহূর্তেই শরতের বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা খুঁজল।

“এখানে কি খোঁজো চকলেট আনিনি।”

“ধুর এখন খাই নাকি! বমি পায় খালি আমি তো মোবাইল খুঁজি।”

“আমাকে বললেই হতো। মোবাইল টেবিলের ওপর।”

শরতকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রূপসা ফোন নিয়ে আলতাকে ডায়াল করল। ততক্ষণে শরত শরবত শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে জানিয়ে দিল এখন আর না ডাকার জন্য। রূপসা আলতার নাম্বারে কল দিয়ে দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেল।

আলতা ফোন ধরে সালাম দিলো, আসসালামু আলাইকুম শরত ভাই।

-আমি বলছি। কেমন আছো ননদিনী না হবু জা।

আলতা একটু লজ্জা পেলো রূপসার কথায়। তার সামনেই আব্বা আর আহসান মামা বসে কথা বলছে। সে ফোন কানে আলগোছে বেরিয়ে এলো আব্বার ঘর থেকে।

“ভাল আছি ভাবী। তুমি কেমন আছো আমাদের নতুন মানুষ কেমন আছে?”

“আমি আর সে দুজনেই ভাল আছে। কিন্তু একজন তো ভাল নেই গো আলতা সে খবর কি জানো?”

“কে ভাল নেই ভাবী? বড় মামী, শিফা মামী তো ভাল আছে মামা বলল। শরত ভাইয়ের শরীর ভাল না!” ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলো আলতা। রূপসা খিলখিলিয়ে হেসে বলল, বাহ্ গো ননদিনী সবার কথা জানতে চাইলা এদিকে যার পরাণ তোমার জন্য ধড়ফড় করে তারেই ভুলে বসলা নাকি গোপণে রাখলা নামটা?”

“শিশির ভাই কখন আসছে?”

“আলতা আম্মা এদিকে আয় তোর মামা বাইর হইতাছে” আওলাদ ডাকছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here