শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব -৩৮

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩৮. (প্রথম অংশ)

“আর ভালা লাগে না পড়াশোনা।” টেবিলে মাথা রেখে বিড়বিড় করল রূপসা। তার পাশের চেয়ারে বসা শরত শুনেছে সে কথা কিন্তু আপাতত এ নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে নেই। মেয়েটার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা সামনেই৷ কিন্তু রূপসা আগের মতোই আবারও বলল, এত কি হবে পড়ে আমি তো আমার শ্বাশুড়ির মত বাচ্চা পালমু, সংসার করমু চাকরি বাকরি করমু না।

এবার আর শরত ইগনোর করতে পারল না। রূপসার কাঁধ টেনে তাকে সোজা করে বসিয়ে দিলো৷ গাল চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে কিছুটা রেগে বলল, “আমার বাচ্চার জন্য মূর্খ মা আমার চাই না। আমার যা ইনকাম তাতে আমার বউয়ের চাকরি না হলেও আলহামদুলিল্লাহ চলতে পারবে কিন্তু বাচ্চার জন্য মূর্খ কিংবা নামের শিক্ষিত মা আমার লাগবে না। মা’ই যদি পড়া নিয়ে দিনরাত এত গড়িমসি করে বাচ্চারা কি করবে ভেবে পাই না আমি!”

“এখনো বাচ্চাই হইলো না আইছে বাচ্চার মা বাচ্চার মা করে মাথা খাইতে।” মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল রূপসা। সত্যিই তার ভাল লাগে না পড়াশোনা তার ওপর এখন তো এই আধ বুড়ো লোককে দেখলেই তার কেমন কেমন লাগে৷ খুব আফসোসও হয় কেন বিয়ের রাতে অত কান্নাকাটি করল! নয়ত এখন নিশ্চয়ই এই সুন্দর মানুষটার কাছে থাকতে পারত। সে টিভিতে কত দেখেছে এত নায়িকারা তাদের বরের সাথে থাকে আর কত আদর করে। আদর বলতে তার উড়ু উড়ু মন এখনো বরের স্পর্শ, চুমুকেই বোঝে আর তার এ বয়সটা সেসবেই যেন বেশি আকর্ষণ বোধ করে৷ এখন ভাবে বরটা কেন তাকে জোর করে নিজের কাছে রেখে দেয় না! সারাক্ষণ শুধু পড়া পড়া করে তার গোবরভর্তি মাথাটাকে চাষের উর্বর জমি বানিয়ে দিচ্ছে৷ শরত বোঝে রূপসার মনের কথা কিন্তু পাত্তা দেয়না। দিতে চায় না তা নয় সেও চায় জলন্ত সলতের মাথায় লেগে যাক স্পর্শের আগুন কিন্তু তারপর! সে নিজে একটুখানি এগিয়ে গেলেই জ্বলে উঠবে পুরোদমে কিন্তু মেয়েটা যে একদমই অল্পবয়সী। বাড়ুক না আরেকটু সময় দূরত্বের পরিধি পরে না হয় সবটা একদমেই ঘুচিয়ে দেবে। বছর হয়ে গেল সয়ে যাওয়া আর না হয় বছর আরেকটা যাক ততদিনে মেয়েটার পড়াশোনারও একটা ধাপ শেষ হবে৷ কিন্তু রূপসা আজকাল যা অধৈর্য্যপনা করছে তাতে শরতেরও বাঁধ ভাঙতে সময় লাগবে না বলেই মনে হচ্ছে৷

বছর শেষের প্রথম এচিভমেন্ট শিশিরের তার টপ রেজাল্ট। এদিকে অনুর রেজাল্ট এসেছে যাচ্ছেতাই৷ তাদের পড়াশেনায় হাতে গুণে আর মাত্রই মাস নয় সময় আছে এরই মাঝে শিশিরের নিজের জন্য কিছু একটা করতেই হবে যার দরুণ সে এখানে আরও বছর দুয়েক কিংবা তারও বেশি সময় এখানে থেকেই আর্থিক অবস্থা ঠিক করতে পারে। দেশে ফিরেই সার্টিফিকেট এর জোর নিশ্চয়ই তাকে এমন কোন জব দিবে না যা দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার সমস্যা সমাধা করতে পারে! হন্যে হয়ে সে ঘোরে বিভিন্ন লোকাল লোকদের সাথে। এখানে তার কিছু বন্ধু বান্ধব জুটেছে তাদের মধ্যে দুয়েকজন হাই প্রোফাইলেইর। অনু প্রায়ই তাকে খুঁচিয়ে যায় শিশিরকে, “হেইলির সাথে রিলেশনে যা লাইফ সেট হতে সময় লাগবে না। সে খুব ইন্টারেস্টেড তোর প্রতি।”

শিশিরও জানে সোনালি চুলের শুভ্রকন্যা হেইলি তার প্রতি প্রচণ্ডরকম আসক্ত। হেইলি নিজেই বহুবার বলেছে সে শিশিরকে পছন্দ করে ইভেন শিশিরের গায়ের শ্যামলা রঙটা তাকে খুব বাজেভাবে আকৃষ্ট করে। তাই শিশিরকে সে ফ্রিলি চায় অন্তত অল্প সময়ের জন্যই হোক। তার সেই সল্প সময়ের চাওয়ার ইঙ্গিত ঠিক কোন দিকে সেটাও শিশির জানে কিন্তু বাঙালি মুসলিম পরিবারের ছেলে শিশির বন্ধুদের সাথে ফ্রি হওয়ার মিনিং শুধু হাসিঠাট্টা, গল্প আড্ডাকেই বোঝে বন্ধুর সাথে বেড শেয়ার, ফ্রি সেক্স নয়৷ তাই যথেষ্ট ইগনোর করেই চলে সে হেইলিকে কিন্তু অনুর এই খুঁচিয়ে বলা কথাগুলো শিশিরকে বন্ধুত্ব ভুলে যাওয়ার তাড়না দেয়। অনুর এই অবাধ্যতা, অসংযত আচরণ হয়ত তাদের বন্ধুত্বের ইতি টানতেও বাধ্য করবে কোন একদিন।

বর্ষার শেষ চলছে শরত আসি আসি মুহুর্ত। বিকেলে হঠাৎই ঝড়ো বাতাস শুরু হলো। উঠোনে কাপড় আছে কিছু সেগুলো বাতাসে দড়ি থেকে নিচে পড়েছে। জয়তুন আজ সকালেই শিউলির ফোন পেয়ে তার শ্বশুর বাড়ি গেছে। রূপসা কলেজে থাকায় তাকে বলে যেতে পারেননি তাই শিফাকে বলে গেছেন খেয়াল রাখতে এদিকে। এমনিতেও জয়তুনের অনুপস্থিতিতে শিফা নিজেই দেখাশোনা করে শরতের খাওয়াদাওয়ার এখন বাড়িতে আরেকটা মেয়ে আছে তাকেও নিশ্চয়ই দেখবে! বাতাসে কাপড়গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে তা দেখে শিফা দৌড়ে এসে কাপড় তুলতে তুলতেই ডাকল, “রূপসা ও রূপসা কাপড়গুলো নে মা বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে।”

কলেজ থেকে ফিরে গোসল দিয়ে দু মুঠো খেয়েই বিছানায় গড়িয়েছিল সে। শ্বাশুড়ি ননদের বাড়ি গেছে শুনে শরতের ঘরেই দরজা লাগিয়ে শুয়েছিল রূপসা। শরত দুপুরের খাবারের পর গেলে রাতের আগে ফিরে না তাই সে নির্ভয়েই সে ঘরে শুয়েছিল। চাচী শ্বাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙতেই টের পেল বাইরে ঝড়ো হাওয়া। খাটের ওপর থেকে ওড়নাটা টেনে গলায় জড়িয়ে দৌড়ে বের হলো রূপসা। উঠোনে শিফার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে ঘরে এলো ততক্ষণে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে গেল। কাপড়ে ছিটেফোঁটা পানি লেগেছে তা হয়ত মিনিট কয়েকের মাঝেই শুকিয়ে যাবে। শিফা নিজের ঘরে যেতে যেতে বলে গেল, “ঘুমালে বাইরের গেইটটা বন্ধ করে যা রূপসা আমি একটু নকশির কাছে যাব৷”

চাচী আম্মা ফুপুআম্মার ওখানে যাবে শুনে একবার বলতে চাইলো আমিও যাব কাকী পরেই কি মনে করে ঠিক করল যাবে না৷ শ্বাশুড়ি বাড়ি নেই আজ এখন কাকীও ও বাড়ি যাচ্ছে মানে আপাতত বাড়িতে সে একা। শিফা চলে যেতেই সে গেইট বন্ধ করল ভালো করে। ঘরে ঢুকে দ্রুত শ্বাশুড়ির স্টিলের আলমারিটা খুলল। চাবিটা শ্বাশুড়ি বরাবরই নিজের সিথানে তোশকের নিচে রাখে এ খবর রূপসার অজানা নয়। আলমারি খুলে শ্বাশুড়ি মায়ের শাড়িগুলো ভাঁজে ভাঁজে নামিয়ে নিয়ে এক এক করে গায়ে জড়ালো অনেকগুলো৷ অনেক খুঁজে খুব পুরনো সময়ের জর্জেট ছাপা একটা শাড়ি তার মনে ধরল। কাকী শ্বশুড়ির শাড়িগুলো দেখেছে সে অনেক সুন্দর সব এ যুগেরই মনে হয় আর তার শ্বাশুড়ির গুলো পুরনো তবুও এই শাড়িটা খুবই সুন্দর। বাইরে ঝড়ো বৃষ্টি বাড়িতে সে একা সময়টা দারুণ ভাবতেই কিশোরী মন নেচে উঠলো খুশিতে। বিয়ের ব্লাউজটা ছাড়া তার আর কোন ব্লাউজ নেই আর এই শাড়িটার সাথের ব্লাউজটা তার গায়ে লাগবে না তবুও একটু মিল রেখে পরার জন্যই শ্বাশুড়ি মায়ের ব্লাউজটাই পরল। শাড়ি পরে হাত ভর্তি চুড়ি, চোখ ভরে কাজল আর ঠোঁটে লালরঙা লিপস্টিক। নিজে নিজে শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা তার কখনোই ছিল না। আজ তা পরতে গিয়ে রূপসার মনে হলো শাড়ি কোন পোশাক নয় বীজ গণিতের সেই সূত্র যা তার এ জীবনে কখনোই মুখস্ত হয়নি। তবুও শখ যেহেতু হয়েছে আজ আর ছাড়াছাড়ি নেই ঠিক পরীক্ষার ফেল মার্কের মতোই কোনমতে পেঁচিয়ে নিয়েছে গায়ে৷ বিকেল গড়িয়েছে অথচ বৃষ্টির তেজে তা বোঝা মুশকিল। কাকী ফেরেনি এখনো তা দেখে আফসোস হলো এখন। এই যে সে নিজে নিজে সাজগোজ করল এর কি একটা ছবি রাখা দরকার না! অবশ্যই দরকার আছে কিন্তু তাকে তো তার আধবুড়ো বরটা বাটন ফোন কিনে দিয়েছে। কাকী থাকলে তাঁর দামী ফোনটাতে একটা ছবি তুলে নিতে পারতো৷ বৃষ্টিমুখর দিনটার মত তার মনটাও মেঘে ভিজে উঠল এবার। মন খারাপ করে শরতের ঘরে ঢুকে আয়নায় তাকালো। মোবাইলটা হাতেই আছে আধবুড়ো বরটাকে কি একটা কল করবে? মন তো চাইছে একটুখানি কথা বলতে, একটু একটু আদর করতে৷ হঠাৎ মনে পড়ল সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আপা তাকে এক পাতা সাদা আর ইটরঙা বড়ি দিয়েছিল৷ সেগুলো হাতে নিয়ে হা হয়ে গেল রূপসা বড়িগুলো তো সে চেনে। এসব বড়ির কার্যকারিতা সম্পর্কেও জানে কিছুটা। স্কুলে থাকতেই তার প্রিয় বান্ধবী শেফালির বিয়ে হয়ে গেল তার কাছেই দেখেছিল। জন্মনিরোধক বড়ি গুলোর কথা শেফালির কাছেই শুনেছিল তাই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আপাকে বলেছিল, “এগুলা দিয়া কি করব আমি?”

“তুমি না বিবাহিত! মাস্টার বাড়ির শরতের বউ তুমি এমনটাই বলল তোমার ফুপুশ্বাশুড়ি।”

রূপসার মনে পড়ল তার পিরিয়ডের ব্যথায় অসুস্থ হতেই নকশি তাকে এখানে এনেছিল ঔষধ নিতে। তখন হয়ত ফুপুআম্মা পরিচয় জানিয়েছিল। রূপসাও জবাব দিল হ্যাঁ সে শরতের বউ। তাই আপা এটা দিয়ে বলল এগুলো রাখো কাজে লাগবে জামাইর সাথে থাকো না!

মনে পড়তেই লজ্জায় রক্তিম হলো শ্যামলা গালদুটো। চোখের তারায় লজ্জার ছায়া আপনাআপনি হাসতে লাগল৷ এরপরই মনে হলো ওই বড়িগুলো তার কখনোই কাজে লাগবে না। আধবুড়ো বরের মনে রসকষ বলতে কিছু নেই নাকি সে সুন্দরী নয় বলে বরটা তাকে কাছে টানে না! কথাটা মাথায় আসতেই রূপসা শরতের টেবিলের ওপর রাখা ছবির এলবামটা হাতে নিলো। শিউলির বিয়ের ছবির এলবাম এটা। খুঁজে খুঁজে শরতের একলা এক ছবি বের করে তাতে হাত রাখলো। মন খারাপের সুরে অভিযোগ জানানোর ভঙ্গিতেই সে বলে বসল, “আজ বুঝলাম আমি সুন্দর না বলেই আপনি আমায় আদর করেন না। বরেরা তো বউদের কত ভালোবাসে, আদর করে কিন্তু আপনি?” বলতে বলতেই গলা কাঁপল, চোখ ছলছল হয়ে উঠলো রূপসার।

“আর আমি!”

শরতের কণ্ঠ কানে আসতেই চমকে তাকালো রূপসা। ভূত দেখার মত ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দরজায় তাকালো। বাইরে জোর বৃষ্টি সাথে বাজ পড়ছে। দরজার সামনে মানুষটা ভিজে চুপসে গেছে মাথা থেকে পা অবধি। বাইরের গেট ভেতর থেকেই তো লাগিয়ে এসেছিল সে শরত কি করে ভেতরে আসবে! তবে এই বজ্রপাতের বৃষ্টিতে ভূত এলো বাড়িতে? দাদী বলত ঝড়তুফানের লগে দেওদানবেরা ঘুরে। সত্যিই কি ঘটে ভূত এলো! হাত পা ঠান্ডা হয়ে আচমকাই অসাড় হয়ে নিচে লুটিয়ে পড়ল রূপসা। শরত দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল শুধু এগিয়ে আসার সময়টুকুও পেল না সে।

চলবে
(আজকের পর্বটা শুধুই শরত রূপসার নেক্সট হয়ত শিশির আলতার)#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩৮. (শেষাংশ)

“কেমব্রিজে আছিস?’

“কেন?”

“কাজ আছে।”

“কর্পাস ক্লোকের পাশেই আছি তুই কোথায়?”

“ওহ ওখানেই থাক আমি আসছি” বলেই অনু কল কাটলো। সেও কাছাকাছি কোথাও ছিল তাই দ্রুত পৌঁছে গেল শিশিরের কাছে। আজ বহুদিন বাদে দু জনের দেখা হল। শিশির নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে অনুও পড়াশোনা আর পাশাপাশি একটা সুপারশপে জব নিয়েছে। তার ওপর বয়ফ্রেন্ডকেও সময় দিতে হচ্ছে তাই শিশিরের সাথে দেখা হওয়ার সুযোগটা কম। ক্লাসের সময় যা দেখা হয় এরপর শিশির ছোটে কর্মস্থলে৷ আজকে ছুটির দিন দুজনেরই তবুও অনু কেমব্রিজে এসেছে প্রথম পাওয়া সেলারির সেলিব্রেশনের উদ্দেশ্যে। দু চারজন বন্ধু আরও আছে সাথে তারমধ্যে ভারতীয় ফ্রেন্ড মিনাকষী চেন্নাইয়ের মেয়ে। আবদুল হাদী পাকিস্তানি বাকিরা লন্ডন আর অস্ট্রেলিয়ার। শিশিরের হাতে আইসক্রিম একটু আগেই আলতার সাথে কথা বলতে বলতে ওয়ান স্কুপ মুখে দিয়েছিল। চকলেট ফ্লেভারের এই আইসক্রিমটা তার লন্ডনে খাওয়া বেস্ট জিনিস। প্রায়ই সে এটা খায় আর মনে মনে আফসোস হয় পাশে আলতা নেই বলে। দেশে ফিরে কোন একদিন কোন আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে আলতাকে সব রকমের ফ্লেভার টেস্ট করাবে সে।

“চল। কি খাচ্ছিস দেখি?” অনু এসে শিশিরের হাত থেকে আইসক্রিমটা নিয়েই মুখে দিল৷

“কোথায় যাব?”

“এসেছিলাম এখানে কোথাও বসব আমার ফার্স্ট স্যালারির অন্তিম সংস্কার করতে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে লন্ডন ব্যাটার।”
আইসক্রিমটা একাই শেষ করতে করতে বলল অনু।

“মানে কি! এখন অতখানি যেতে কত ঝামেলা জানিস? যেতেই ঘন্টাখানেক লাগবে , টিকিটেও এক্সট্রা পাউন্স!” বিরক্তির সাথে বলল শিশির। অনু শুনলো সে কথা সে পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিল হাদীকে। জানালো তারা কোথায় আছে গাড়ি নিয়ে সেখানে পৌঁছুতে। মিনিট পাঁচ পর এলো হাদী। সে কার লাইসেন্স পেতেই একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি নিয়েছে৷ অনুর বুদ্ধিতেই এখন তারা সবাই লন্ডনেরই কোন এক ক্যাসিনোতে যাবে ঠিক করেছে৷ এ আয়োজনটা বিশেষ ভাবে শিশির আর মিনাকষীর জন্য। তারা প্রায় সকলেই হ্যাঙ্গআউটের নামে বারে যায়, বিভিন্ন গেমও খেলে শুধু যায়নি তারা দুজন৷ মিনাকষী ধার্মিক ধরণের মেয়ে মদটদ খাওয়া তো দূর ওগুলো ছোঁয়া মানুষের হাত থেকে কিছু খেতে ঘৃণাবোধ করে। কথায় কথায় বলে ওঠো, আইয়ো ড্রিংকস নো নো সিন!

চমৎকার ইংলিশ বলতে জানা মেয়ে মিনাকষী অথচ যখনই নেশা করার মত কোন খাবার নিয়ে কথা হয় তখনই শুধু ড্রিংকস সিন নো নো মানে পানীয়, পাপ, না না এইটুকুই তার ইংলিশ। আর শিশিরকে জোর করলে জবাব একটাই মাঝেমধ্যে নামাজ পড়ি, এলকোহল সম্ভব নয় তোরা খা। আজ কি মনে করে অনুর কথা মানতে ইচ্ছে করলো । কিছুটা জোর করেই শিশিরকে নিয়ে গেল সাথে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছেছে তারা। শিশির আবারও আপত্তি জানালে অনু বলল, “ঠিক আছে তোকে হারাম কিছু খেতে হবে না জুসটুস খাস একটু চল ভেতরটা ঘুরে দেখবি মিনাকষীও তো খাবে না।”

“কিন্তু এসবে ঢুকতে তো ড্রেসকোড থাকে আর মেম্বারশিপও লাগে আমাদের কার্ড পাবি কই?” শ

“সে চিন্তা তোর নয়। আর এই বার ওনার ইন্ডিয়ান আমার কাজিনের ফ্রেন্ডও।”

শিশির দেখলো অনু গার্ডদের সাথে কিছু একটা বলল আর একটা কার্ড দেখালো। তারপর আর বেশি সময় ওয়েট করতে হয়নি। কারো পোশাক কিংবা মেম্বারশিপ নিয়ে কোন ঝামেলাই হয়নি। সকলেই ভেতরে ঢুকতে পারল। ভেতরে ঢুকতেই আচমকা চোখের সামনেটা আঁধারে ঢাকা মনে হলো। ক্ষীণ আলোর ঝলকানি থেমে থেমে সরু একটা পথ আলোকিত হচ্ছে আবার আঁধারে ঢাকছে। শিশির কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই অনু বলল, সোজা চলতে থাক। মিনাকষী আর হাদী পাশাপাশি আসছে তাই মিনাকষী কিছুটা চিন্তামুক্ত। সরু গলির পথটা দশ কদমের বেশি নয় সেটুকু পেরুতেই চোখে পড়ল বড় একটা হল রুমের মত জায়গার একপাশে বার কাউন্টার। সেখানে দেয়ালের একপাশ জুড়ে খোলা ক্যাবিনেট যার প্রতিটি তাক সাজানো কাঁচের বোতলে রঙ বেরঙের পানীয়। মাঝখানটা সরু ফাঁকা জায়গা তার সামনে টেবিলের মত ক্যাবিনেট। সামনেই কিছু আধুনিক স্টুল পাতা৷ কেউ কেউ সেখানে বসে আছে হাতে আছে কাঁচের গ্লাস ভর্তি বিভিন্ন তরল৷ বুঝতে অসুবিধা নেই সেগুলো ওয়াইন, ভোদকা, রাম আরও অনেক নামে পরিচিত। হল রুমটা অন্যপাশে স্টেজের মত যেখানে অনেক গুলো ছেলে মেয়ে একসাথে হাত, পা, কোমড় নাচিয়ে চলছে। মিউজিক হিসেবে চলছে লানা ডেল রেয়’র কোন গান৷ শিশির গানটা চিনতে পারল না হয়ত আগে শোনেনি তবে শিল্পীর কণ্ঠটা পরিচিত তার। প্রিয় সেই “ব্লু জিন্স হোয়াইট শার্ট, ওয়াকড ইনটু দ্য রুম ” গানটি এই শিল্পীরই গাওয়া। সেলিব্রেশনের নামে বারে আসাটা প্রচণ্ডরকম বিরক্তিকর লাগল শিশিরের ঠিক যতোটা আজকাল অনুকে লাগে৷ মেয়েটার মুখের ভাষা যেমনই ছিল উশৃংখলতা কি এত বেশি ছিল! মনটা তার ভালো ছিল বলেই জানত শিশির কিন্তু আজকাল সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে তার। শিশির এর আগে মুভিতে দেখেছে এসব ক্যাসিনো এই প্রথম সরাসরি ভেতরে এসে দেখলো। দেখার মত কিছুই পেল না আর না পেল উপভোগ করার মত কোন কিছু। মিনাকষীও চারপাশ এক নজরে দেখে শিশিরের পাশে দাঁড়ালো। কানের কাছে মুখ এনে প্রশ্ন করলো, “হাউ’স ইউর ফিলিংস শিশির?”

“রিডিকিউলাস।”

“আই ফিল অওওও।” উচ্চারণটা এমন করল যেন এক্ষুনি বমি করে দেবে সে৷ শিশিরের হাসি পেয়ে গেল খুব৷ এই মেয়েটা একদম সাদামাটা যে যা বলে সব করে শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে কোন আঁচ আসবে এমন কাজ থেকে বিরত থাকে। পোশাকআশাকেও যথেষ্ট সতর্ক অন্তত মুখ, হাতের কব্জি আর পায়ের কব্জির বাইরে কখনোই কোন অংশ উন্মুক্ত রাখে না৷ এই যে আজ জিন্স আর টপ পরেছে তাতেও দৃষ্টিকটু লাগবে তেমন ব্যাপার নেই। গলায় বাঁধা চিকন স্কার্ফটাও বুকের ওপর দারুণভাবে ফেলে রেখেছে। অনুর বয়ফ্রেন্ড আসতেই অনু সকল ফ্রেন্ডের জন্য ড্রিংকস নিলো। এই বারে দেয়ালের একপাশ ক্যাফে অন্যপাশ এই বার। এখানে আবার গাম্বলিং এর ব্যবস্থা থাকায় কয়েকজন বন্ধু সেদিকেই ব্যস্ত, অনু আর তার বয়ফ্রেন্ড আছে একপাশে কিন্তু হাদী, মিনাকষী আর শিশিরকে পাঠানে হল ক্যাফেতে৷ তিন ভাগে ফ্রেন্ডরা বসল আনন্দ উদযাপনে কিন্তু এভাবে কি হয় উদযাপন! ক্যাফেতে বসে কফি আর ডোনাট নিলো তিনজনে। নিজেরাই গল্প করতে করতে খাচ্ছিল সেসব হঠাৎই একজন ওয়েটার এসে তাদের জুস দিলো৷ হাদী জানালো তারা জুস অর্ডার করেনি৷ লোকটা বলল আপনাদের বন্ধু পাঠিয়েছে৷ ব্যস, আর ভাবনা নেই অনু পাঠিয়েছে তবে। তিনজনেই জুসটা খেল এবং মিনিট দুয়েকের মাঝেই তারা টের পেল মাথা ভার লাগছে আর ঢেকুর আসছে৷ ঢেকুরে কেমন একটা উৎকট গন্ধও বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে যা তারা জুসটা খাওয়ার সময়ও পেয়েছিল তবে সল্প। শিশির কিংবা হাদী একজনও সেটা আমলে নিলো না বিশেষ করে হাদী। সে ভাবল হয়ত এটার টেস্ট আর ঘ্রাণটাই এমন৷ শিশির দ্বিধায় থাকলেও মুখে কিছু বলল না শুধু মিনাকষীই বলল, এটা শুধুই জুস নয় কিছু একটা গড়মিল আছে এতে।

জয়তুন মেয়ের বাড়িতে থাকবেন আরও দুই দিন এমনই কথা হলো শিফার সাথে। আগের দিন ঝড় তুফান হলো তাই সকাল সকাল জানতে ফোন দিয়েছেন শিফার কাছে বাড়ির কি অবস্থা? শিফা খুব রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল, বাড়ির অবস্থা খুব ভাল ভাবী।

“রাইতে রূপসা কই ছিল তুই থাকছিলি না অর লগে? মাইয়াডা ডরায় একলা ঘুমাইতে।”

“ওরে নিয়া ভাবনা এইবার ছাড়েন ভাবী। আর আমার থাকা লাগে নাই যার বউ তার কাছেই ছিল।” কথাটা বলতে গিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল শিফা। জয়তুন যারপরনাই অবাক, শিফার এ হাসি সেই কিশোরী শিফার হাসির মত। বিয়ের পর এ বাড়ি এসে এমনই হাসতো সে পরে অবশ্য বয়সের ভারিক্কি চালে হাসিতেও ভার এসেছিল। কিন্তু সে হাসতে হাসতে বললটা কি! জয়তুনের সময় লাগল বুঝতে তারপরই গলায় বিষ্ময় ঢেলে প্রশ্ন করলো, ” সত্যি কইলি না মজা করোস?”

“ধুর ভাবী বাপেরে নিয়া কি মজা করব! বাপ জানের কাছে ছিল আম্মাজান। আর… ” একটু থামল শিফা তারপর জয়তুন বলার আগেই বলে দিল, আলহামদুলিল্লাহ বলেন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে । সকালেই বউয়ে গোসল সারছে এই বার বুঝে নেন আর কিছু বলার নাই।”

শিফা ইঙ্গিতে যা বোঝালো জয়তুনের বুঝতে সময় লাগেনি৷ মনে মনে সত্যিই আলহামদুলিল্লাহ বলে উপরওয়ালার শুকরিয়া আদায় করে নিয়েছেন তিনি৷ জয়তুন বলল, মনে বড় চিন্তা আছিল রে বইন অরা দুইটা এক হইবনি না আবার জীবনটা নষ্ট হয় আমার শরতটার। রূপসা কচি মাইয়া, পোলা আমার বয়সে বড় দুইজনের মিল মহব্বত লইয়াই ডর আছিলো। যাক শোন শিফা নাতিনডার শরীল ভালা না বেশি আমি আরেকটা দিন থাকমু তুই খেয়াল রাখিস।”

“এক না পারলে আরও কয়েকটা দিন থাকেন ভাবী। শরতরাও আরেকটু থাকুক নিজের মত আমি খেয়াল তো রাখবই।”

দু জায়ে মিলে সত্যিই পরিকল্পনা করে নিলো শরতদের সময় কাটুক একটু আলাদাভাবে৷ স্বামী স্ত্রীতে সন্ধি গাঢ় হোক এটাই তো চাওয়া। শিফা মনে মনে এবার ঠিক করেছেন জয়তুন ভাবী ফিরলেই শিশিরের বাবাকে বলে নকশির কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে। আলতার পেছনে যেভাবে কখনো এমপির ছেলে, কখনো চেয়ারম্যান তার ওপর শহুরে ছেলেরাও পিছু লেগেছে। শিশির আসার আগেই একটা ব্যবস্থা করে নিবেন প্রয়োজনে মোবাইলেই বিয়েটাও করাবেন তবুও ছেলের এত বছরের ভালবাসা দূর হতে দেবেন না। আলতাও যে তার ছেলেতে মগ্ন সে খবর এখন শিফার সাথে আহসানও জানে৷ বাড়ির ছেলে মেয়ে বাড়িতেই থাক অচেনা মেয়ে আনার দরকার নেই।

আলতার পড়াশোনা চলছে ঢিমেতালে; সামনেই প্রথম বর্ষের পরীক্ষা অথচ তার কোন প্রস্তুতিই নেই। কোচিংয়ের স্টুডেন্টরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে আর তাই কোচিংয়ে নাইন, টেনের ব্যাচ হয়েছে লম্বা। আলতার যেখানে দু ঘন্টা পড়ানোর কথা ছিল সেখানে সময় বাড়িয়ে করা হয়েছে তিন ঘন্টা। ব্যাচ বড় হওয়ায় দু ভাগে পড়ানোর সময় দিতে হচ্ছে তাই সপ্তাহে তিনটা দিন তাকে রুমে ফিরতে হয় রাত নয়টার পর। শিশির প্রায়ই সন্ধ্যার পর কল দিয়ে তাকে না পেয়ে রেগে থাকে৷ আলতা প্রতিবারই বলে সে ওই সময় রান্না করে কিংবা নিজের অন্যান্য কাজের কথা বলে। শিশির মানতে নারাজ; তার সন্দেহ হয় কাজ থাকলে ফোন কেন বন্ধ রাখবে! কিন্তু আলতা প্রতিবারই কথা ঘোরায়। এ নিয়ে দু দিন ছোটখাটো ঝগড়াও হয়ে গেছে দুজনে৷ একদিন তো শিশির বলেই বসেছে, “তোর এখানে থেকে পড়াশোনা করতে হবে না৷ তোর পড়াশোনাই করতে হবে না৷ তুই কালই আব্বাকে ফোন করে বলবি তোকে নিয়ে যেতে৷ আমি যা কামাই করব তাই দিয়েই চলবি তোকে দিয়ে চাকরি করাব না।”

“তুমি বললেই আমাকে মানতে হবে! সবসময় এত জেরা করো কেন? আমার লাইফে কি নিজের মত চলার কোন অধিকার নেই আমার?”

“না নেই৷ অন্তত ততদিন নিজে থেকে কোন কিছুই করার অধিকার নেই তোর যতদিন না আমি দেশে আসছি।”

“আমি বাধ্য নই এসব কথা শুনতে ফোন রাখো কাজ আছে আমার।”

“আলতা মেজাজ খারাপ করাবি না আমার। বেশি বাড়াবাড়ি ভাল নয়।”

“বাড়াবাড়ি করছেটা কে?”

“তুই জানিস না কে করছে?”

“জানি না আর জানতে চাইও না। সব কিছুতেই নিজের মতামত অন্যদেরটা শুনতেই পারো না!”

আলতার এ কথার পর শিশির কল কেটে দিয়েছিল৷ টানা চারদিন কোন ফোনকল, মেসেজ কিছুই দেয়নি সে আলতাকে৷ আর না আলতা দিয়েছে। পরে অবশ্য একে অপরের বিরহে অভিমান, রাগ সবটাই আপনাতে গলে জল হয়েছিল কিন্তু আর আগের মত সময়টা তাদের উচ্ছলতায় কাটেনা। শিশির অনেকটা গুমোট হয়ে ছিল নিজের মাঝে৷ তার মাঝেই ঘটল অঘটন, আলতার ওপর রাগ, পরিবারের দূরত্ব, কাজকর্মের প্রেশার সব মিলিয়ে মানসিক অস্থিরতায় অনেকটা নিজের মধ্যে ছিলোই না যেন সে৷ হেইলি প্রায়ই এটা সেটা বলে ক্লোজ হতে চেষ্টা করত শিশিরের৷ হঠাৎ করেই একদিন শিশির পাত্তা দিল মেয়েটাকে আর সে পাত্তা দেওয়াটাই ছিল তার ভুল৷ অনু যে বারে নিয়ে গিয়েছিল তাদের সেখানেই আবার গেল হেইলির সাথে। গল্প করতে করতেই জুস নিলো৷ সেদিনও তার জুসে মিশেছিল অতিমাত্রার এলকোহল। তাতে নেশা হলো, নিজের ভারসাম্য হারালো৷ অচেতন প্রায় দেহটা সামলে নিলো হেইলি কায়দা করে আরও কিছু পানীয় গলাধঃকরণ করিয়ে খুব কাছাকাছি হলো শিশিরের। শিশির উষ্ণ চুম্বনে মাতোয়ারা হতে হতেও থেমে গেল এক পর্যায়ে। সে জ্ঞান হারিয়েছিল সে রাতে। যখন জ্ঞান ফিরল তখন মনে পড়ল না আগের রাতের হওয়া ঘটনা। হেইলিও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি তার কাছে গুরুতর কোন কিছুই মনে হয়নি৷ কিন্তু শিশির ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিল। আলতার সাথে কথা বলার সময় সে থাকছে নির্লিপ্ত, চোখে চোখ রাখতে অপরাধবোধ জাগছিল ভীষণ৷ সময়ের কালচক্রে আলতা শিশির কেমন ছিটকে পড়ছিল নিজেদের গাঢ় সম্পর্কটা থেকে আর ঠিক তখনই বাড়ি থেকে দুটো কল পেল দুজনে। শিফা শিশিরকে আর নকশি আলতাকে জানালো তারা বিয়ে ঠিক করেছে দুজনের। মজার ব্যাপার হলো নকশি জানায়নি আলতার পাত্র কে আর শিফাও জানায়নি শিশিরের জন্য পাত্রী কে।

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here