শিশিরের বিন্দু
১১তম পর্ব
বিন্দু কিছুক্ষন পরেই চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। কোন কথা না বলেই সোজা চলল ওর রুমের দিকে। কেন বারেবারে ও হেরে যাচ্ছে নিজের আত্মসম্মানের কাছে। কি আছে ওই মানুষটার মধ্যে যে সে সামনে আসলেই এই ভাবে ভেঙেচুরে দুমড়মে মুচড়ে যাচ্ছে ও। এটাই কি ভালবাসা। বিন্দু দরজা খুলে সোজা এসে শুয়ে পড়লো চুপ করে। কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না ওর। শিশির কতক্ষন যে মাথা নিচু করে বেঞ্চটায় বসে ছিল জানে না ও। বারেবার মনে হচ্ছে ওর এতটা ভালবেসে ফেলেছে ওই মেয়েটাকে যে ওকে ছেড়ে থাকাটা এখন সম্ভবই না। কিন্তু কি করে বিন্দুকে ও বুঝাবে ওর ভুলের শাস্তি আর অনুশোচনা দুটোই ওর হয়েছে। শিশির যেন আজ অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে। ওর পুরো জীবনের বৃত্তটাই এখন বিন্দুকে ঘিরে। চোখের কোনার পানিটা মুছে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল। প্রতিজ্ঞা করল যদি ঘরে ফেরেই তাহলে বিন্দুকে নিয়েই ঘরে ফিরবে। সোজা হিসাব।
পরের দিন সকালে বিন্দুর ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে। ওপাশ থেকে কল করেছে বিন্দুর চিফ অডিট অফিসার,
___ ” হ্যালো বিন্দু আমি সানোয়ার বলছিলাম “।
___ ” জি আসসালামু আলাইকুম স্যার “।
___ ” আপনি আজকেই ঢাকা ব্যাক করবেন। আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে আমার সাথে আপনারও এটেন্ড করা লাগবে।”
___ ” স্যার এত আর্লি গাড়ি পাবো কোথায় এখান থেকে”।
___ ” আপনি ব্যাগ প্যাক করেন আমাদের গাড়ি আপনাকে ঢাকা দিয়ে যাবে “।
বিন্দু আর কথা না বলে ফোন কেটেই রেডি হতে লাগল। ট্রলি গোছায়ে ফ্রেশ হয়ে যখন নিচে নামল তখন আবির সবে জগিং করে ফিরতেছে। বিন্দুকে ব্যাগ সহ নিচে দেখে ও এগিয়ে গেল ওর কাছে যেয়ে বলল
___ ” কি ব্যাপার বিন্দু কই যাও “।
___ ” ভাইয়া অফিস থেকে ফোন এসেছিল ঢাকা যাওয়া লাগবে আর্জেন্ট “।
___ ” হঠাৎ চলে যাচ্ছ। এখন গাড়ি পাবে যেতে? ”
___ ” অফিসের গাড়িতে যাচ্ছি”।
___ ” শিশিরকে বলেছ যে তুমি চলে যাচ্ছ? ”
আবির আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল। বিন্দু আবিরের চোখে চোখ রেখে উওর দিল,
___ ” প্রয়োজন মনে করি নি জানানো।”
আবির কথা তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে বলল,
___ ” সামনের শুক্রবার রাতে বাস। রেডি হয়ে চলে এসো।বাকি ডিটেইলস নিনা তোমাকে দিয়ে দেবে।”
কথা বলতে বলতে গাড়ি এসে পড়লো বিন্দু আবিরকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো। আবির চুপ করে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সোজা চলল শিশিরের রুমের দিকে। অনেকক্ষন নক করার পরে শিশির চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে দিল। এত সকালে আবিরকে দেখে বলল,
___ ” নিজে তো ঘুমাবিই না আমারেও ঘুমাতে দিবি না।”
___ ” দোস্ত একটা কাহিনী হয়ে গেছে! ”
___ ” তোর তো প্রতিদিন কোন না কোন কাহিনি হয়, এবার বল নিনার সাথে আবার ঝগড়া করছত?”
___ ” না রে, আসলে কথা হল বিন্দু একটু আগে চলে গেছে! ”
আবিরের কথা শুনে শিশির অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর আবিরের ঘাড় চেপে ধরে বলল,
____ ” তুই মজা নিচ্ছিস তাই না রে? ”
___ ” না রে আমি সত্যিই বলতেছি। একটু আগে নিচে দেখা হয়েছিল ওর সাথে “।
___ ” আজকে না শুভলং যাওয়ার কথা ছিল আমাদের সাথে৷ হঠাৎ চলে গেল কেন ও “?
পরে আবির সব খুলে বলতেই শিশির মুখ কঠিন করে বলল,
___ ” আমি এক্ষুনি ঢাকা ব্যাক করব।”
___ ” কি পাগলামী করতেছি তুই। ”
___ ” আমি রেন্টে এ কারে যোগাযোগ করতেছি তোরা থাকলে থাক আমি চলে যাব “।
এই বলেই শিশির রুমের ভেতরে ঢুকে গেল। আবির মাথা ঝোলাতে ঝোলাতে বিড়বিড় করে বলল,
___ ” পাগল ছাগল যদি নিজের আঁতালে না থাকে তো কিনে কি উজানো যায়। ”
ওই দিনই সকালে সবাই গাড়ি নিয়ে ঢাকা ব্যাক করে। নিনা তুলি একটু গজগজ করলেও আবির আর বিপ্লবের চোখ রাঙ্গানীতে চুপ করে যায়। ঢাকায় এসে শিশির ওঠে আবিরদের বাসায়। এক সপ্তাহ ওদের সবার যায় ছুটোছুটি আর প্যাকিং করতে করতে। শিশির বেশ কয়েকবার ট্রাই করেছে বিন্দুর সাথে দেখা করার কিন্তু বিন্দু যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। একদিন সকালে জাহানারা এলেন শিশিরদের বাসায় হাবিব সাহেবের চোখ ফাঁকি দিয়ে। তিন বছর পরে উনি শিশিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। শত হোক মায়ের মন তো। নিজের হাতে ছেলেকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন,
___ ” বাসায় চল বাবা, আমি তোর আব্বুকে বলে সব ম্যানেজ করে নেবো “!
___ ” বিন্দুকে ছাড়া আমি ওই বাসায় পা দেবো না আম্মু। দোয়া করো আমার জন্য “!
___ ” যে মেয়েকে বিয়ে করবি না দেখে পালালি বাসা থেকে এখন সেই মেয়ে ছাড়া তুই বাসায় যাবি না। এসব বলছিস কি তুই? ”
___ ” ভুল তো মানুষই করে তাই না আর সেই ভুল তো মানুষই শুধরায়।”
জাহানারা বেগম আর কথা বাড়ায় নি সেদিন। চলে গিয়েছিলেন চুপচাপ আর ভাবছিলেন এমন কেন হল। বিন্দু কিবরিয়া সাহেবের রুমে নক করে বলল,
___ ” আসবো বাবা “।
___ ” আরে মা, হ্যাঁ আয় আয় “।
___ ” আব্বু আমি সামনের সপ্তাহে ইন্ডিয়া যাব। আগ্রা দিল্লি আর কাশ্মীরে।”
___ ” বাবাহ এত লং ট্যুর। অফিসের ট্যুরে নাকি মা? ”
___ ” না বাবা নিনা আর তুলি ভাবি যাচ্ছে। ওদের সাথে।”
___ ” আচ্ছা যা তবে সাবধানে যাবি। আর আসার সময় আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবি অনেক গুলো।”
বিন্দু হেসে ফেলল বাবার কথা শুনে। রাহেলা বেগম চিল্লা চিল্লি করেও লাভ হল না।
শুক্রবার আবির শিশির আর নিনা রাত সাড়ে দশটায় রওনা হল কলাবাগান শ্যামলী কাউন্টারে ওরা পৌছে গেল। একটু পরে তুলি বিপ্লব আর বিন্দু এসে হাজির। বিন্দু পিংক কালারের টিশার্টের সাথে কালো জিন্স পরেছে। শিশিরের মনে হল বিন্দুকে দেখে ওর তপ্ত মনে এক পশলা বৃষ্টি পড়ে গেল৷ মাত্র কিছু দিন দেখা হয় নি তারপর মনে হচ্ছে কতদিন দেখে নি। বিন্দুও কেমন জানি লাগছিল কিন্তু সে যেন শিশিরকে দেখেও না দেখার ভান করে রইল। শিশির ভাবছিল বিন্দুর কাছে যেয়ে একটু কথা বলবে। কিন্তু বিপ্লব হাত চেপে ধরে বলল,
___ ” ধীরে বন্ধু ধীরে। সারারাত আছে তখন “।
___ ” সারারাত আছে মানে? ”
___ ” তুই কি হেঁটে হেঁটে বেনাপোল যাবি নাকি। বাসে বিন্দুর সাথে বসার ব্যাবস্থা করে দেবো “।
শুনেই শিশির বিপ্লবকে জড়িয়ে ধরল খুশিতে। রাত ১০ ঃ ৪৫ এ বাস ছাড়ার কথা থাকলেও বাস ছাড়লো সাড়ে ১১ টায়। ওরা শ্যামলী সৌহৃদ্য বাসের টিকিট কেটেছিল। এটা ঢাকা টু কলকাতার ডাইরেক্ট বাস। অন্যান্য বাসে গেলে বেনাপোল পর্যন্ত যেয়ে কাষ্টমস ক্লিয়ার করে আবার ইন্ডিয়ান সাইডে যেয়ে অন্য বাসে ওঠা লাগে। কিন্তু এটায় তা আর লাগবে না। এক বাসেই কলকাতা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। ওরা যেহেতু এসি বাসে যাচ্ছিল তাই জনপ্রতি ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত এক একজনের ১৭০০ টাকা করে টিকিট কেটেছিল। বাসে উঠেই তুলি আর নিনা জানলার পাশে বসে পড়ল। বিন্দু চুপ হয়ে গেল ও বুঝতেছিল না বসবে কই। বিন্দুর বাজে অভ্যাস হল জানালার পাশে ছাড়া বসতে পারে না কোথাও। কোন উপায় না পেয়ে সোজা ওদের পেছনের সিটের জানালার পাশে বসে পড়ল। আবির আর বিপ্লব যার যার বউয়ের পাশে বসল। আর শিশির যেয়ে বসল বিন্দুর পাশে।বিন্দু রাগ স্বরে বলল,
___ ” আপনি এখানে বসলেন কেন “?
___ ” এই বাসের সিস্টেম যার যার বউয়ের সাথে বসার।”
শিশির নির্বিকার ভাবে উওর দিল। বিন্দু কিটমিটিয়ে কিছু বলবে তার আগেই বাস ছেড়ে দিল। শিশির বিন্দুর কানের কাছে এসে বলল,
___ ” বিন্দু বিবি দোয়া দুরুদ পড়েন।আর আম্মুকে বলে দিয়েছি তার ছেলের বউ নিয়েই বাড়ি যাব।”
বিন্দু কিছু না বলেই রাতের ঢাকা দেখতে লাগল। বাস যখন আরিচা ঘাটে গেল তখন ভি আই পি ক্যাটাগরিতে ওদের বাস ফেরিতে উঠে গেল। তাই ফেরিতে আর কেউ নামলো না। বিন্দু তখন কানে হেডফোন গুজে ফেসবুকিং করতে ব্যস্ত। সারারাস্তা অনেক ট্রাই করেছিল শিশির কথা বলতে বিন্দু পাত্তাই দেয় নাই। ফেরিতে বাস থাকতে থাকতে আবির এলো ওর কাছে। আবিরের প্যাঁচার মত মুখ দেখে বিপ্লব শিশির দুজনেই অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, হয়েছেটা কি? আবির বলল,
___ ” আর কইস না দোস্ত গাড়িতে ওঠার পরে যে খাবারের প্যাকেটট দিছিল না ওটার পাউরুটি ডিম আর মিষ্টি খেয়ে পেটে আম পাক জাম পাক দিচ্ছে রে “।
শিশির চোখ বড় বড় করে বলল,
___ ” ওটার ভেতরে ছিলই ওই তিনটা সব খেয়ে ফেলেছি? ”
___ ” ক্ষুদা লাগছিল কি করমু “।
___ ” ভাইয়া এই ট্যাবলেট ট খেয়ে নেন। মেট্রিল এট পেটের প্রবলেম এর জন্য খুব কাজের। ”
বিন্দু শিশিরের পাশে থেকে হাত বাড়িয়ে দিল আবিরের দিকে। ওদের কথা যে বিন্দুও শুনছে সেটা খেয়ালই করে নাই ওরা। আবির চোখ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
___ ” এই না হলে বোন প্লাস ভাবি ”।
আবিরের কথা শুনে বিন্দু চুপ হয়ে গেল। ততক্ষনে ফেরি ওপারে চলে এসেছ তাই আর কথা বাড়িয়ে যে যার জায়গায় চলে গেল। গাড়ি যখন চলতে শুরু করল বিন্দুর তখন চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল। কখন যে বিন্দু ঘুমিয়ে গেছে ও নিজেও জানে না। শিশির তখন চোখ বন্ধ করে ভাবছিল কি করে বিন্দুর রাগ ভাঙানো যায়। হঠাৎ টের পেল ওর বুকের কাছে তপ্ত নিঃশ্বাস। তড়াক করে চোখ খুলে দেখলো বিন্দু কাত হয়ে ওর বুকের উপরে পড়েছে। শিশিরের বুকের রক্ত যেন ছলকে উঠলো। আস্তে করে আর একটু নিচু হয়ে বসলো যাতে বিন্দুর ঘুমাতে কষ্ট না হয়। নিচে পড়া কম্বলটা আর একটু টেনে তুলে দিল বিন্দুর গলা পর্যন্ত। অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অন্ধকারে। কি যে ভাল লাগছে ওর কাউকে বুঝাতেই পারবে না। বিন্দু ঘুমের ঘোরেই এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল শিশিরের পেটে। এবার শিশিরের কেমন জানি লাগতে লাগল। অজানা এক ভাল লাগায় ছুঁয়ে গেল মন। গাড়ির ঢুলুনিতে শিশিরের চোখও লেগে গিয়েছিল৷ হঠাৎ ঘুম ভেঙেই দেখলো সকালের সূর্যের প্রথম নরম আলো পৃথিবী ছুঁয়ে বিন্দুর গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। নরম তুলতুলে ফর্সা গালে হালকা হলুদ রোদের ছোঁয়া। এক গুচ্ছ চুল এসে মুখের উপরে পড়ে আছে। শিশিরের খুব ইচ্ছা হল ওই চুল গুচ্ছ সরিয়ে নরম ওই গালে একটু ঠোঁটের আলতো পরশ বোলাতে। হাতের আঙুল দিয়ে চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল শিশির। মুখটা ধীরে ধীরে বিন্দুর গালের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। তখন হঠাৎ বিন্দু…..
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর