শুচিস্মিতা পর্ব -০৩

#শুচিস্মিতা -৩
Tahrim Muntahana

~ এই যে মিস শুচিস্মিতা! শুনছো?

কিছুক্ষণ হলো বোনের শশুড় বাড়ি এসে পৌঁছেছে আনতারা’রা। বাড়ির লোকেরা বড়দের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। বোনকে দেখার যেন খুব তাড়া ছিল আনতারা’র তাইতো এক পিচ্চি কে ধরে বোনের ঘরের দিকে র‌ওনা হয়েছে চাচাতো বোন কেয়া কে নিয়ে। এরমধ্যে হুট করে পুরুষালি কন্ঠে নিজের নাম শুনে থেমে যায় সে। আশে পাশে তাকায়, কেউ নেই। আবার হাঁটা ধরে। এবার খুব কাছ থেকে কন্ঠটা ভেসে আসে,

~ মিস শুচিস্মিতা, তোমাকেই বলছি।

পেছন ঘুরে অচেনা একটা ছেলেকে দেখে ভড়কে যায় আনতারা। কেয়া নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। সে চিনে ছেলেটিকে। ফারাহ’র দেবর নিবিড়। কেয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই আনতারা অপ্রসন্ন কন্ঠে বলে উঠে,

~ আমার নাম শুচিস্মিতা নয়, আনতারা রাইদা! মিস আনতারা বলে ডাকলেই খুশি হবো মি.। আমি আপনাকে চিনতে পারছিনা, কে আপনি?

নিবিড় হেসে উঠে। মেয়েটা তাকে চিনে না? এও সম্ভব? বোনের দেবর কে চিনে না? সন্দেহী কন্ঠে বললো,

~ তুমি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছো না শুচিস্মিতা?

~ আপনার সাথে আমার মজার সম্পর্ক হয়তো না, তাহলে মজা করবো কেন? আর বলেছি আমার নাম আনতারা!

বিরক্তি কন্ঠের কথাটা শুনে নিবিড়ের ভ্রু কুঁচকে আসলো। মেয়ে টা কি ভাব দেখাচ্ছে। আগে আগে কথা বলতে এসেছে বলে এমন করছে? নাকি মেয়েটাই এমন? মনে প্রশ্নে নিয়ে হেসে বললো,

~ হ্যাঁ তোমার সাথে তো আমার মজার সম্পর্ক‌ই। সম্পর্কে আমার বেয়ান হ‌ও। মানে আমি তোমার আপুর একমাত্র দেবর। আর রাশিদ ভাই তো শুচিস্মিতা বলেই ডাকলো!

বিব্রত হলো আনতারা‌। আপুর দেবর বলে তার সাথে মজার সম্পর্ক হতে হবে? এই ছেলে এত কথা বলছে কেন? রাশিদ ভাই ডাকে বলে তার‌ও ডাকতে হবে? হুট করেই আনতারা বলে উঠলো,

~ রাশিদ ভাই আলাদা, আপনি আলাদা। ডাক টাও আলাদা!

কথাটা বলা শেষ হতেই আশ্চর্য ভাব ফুটে উঠলো আনতারা’র মুখশ্রীতে। রাশিদ ভাই আলাদা? হঠাৎ এমন কথা আসলো কেন মাথায়? কেয়া, নিবিড় ব্যাপার টা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো, তবে আনতারা’র কাছে নয়। তাই তো আর কোনো কথা না বলেই সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। একপ্রকার পালিয়েই গেল মনে হয়।‌ পেছনে নিবিড় কিছুক্ষণ অবাকতা বজায় রেখে কেয়ার সাথে কথা বলতে লাগলো। অদ্ভুত মেয়ে!
অন্যদিকে আড়াল দাঁড়ানো মানুষটার মুখে হাসি। সে আলাদা! সত্যিই আলাদা। তার শুচিস্মিতার কাছে সে আলাদা’‌ই!

রেডি হয়ে বসেছিল ফারাহ। আনতারা কে দেখেই চোখ মুখ চকচক করে উঠলো তার‌। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আনতারা মুচকি হেসে বোনকে পরখ করলো। একটু হলেও টের পেল মনে হয়। নরম সুরে বললো,

~ তুমি ভালো আছো আপায়?

ছলছল করে উঠলো ফারাহ চোখ। সে কি ভালো আছে? ভালো থাকার কথা? বললো,

~ বেশ আছি। তুই ভালো আছিস তারা?

~ তোমাকে ছাড়া বাড়িটা খুব খালি খালি লাগে আপায়।

হাসলো ফারাহ। তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললো,

~ খালি খালি লাগে বলেই তো এত তাড়াতাড়ি বিদায় করার কথা ভেবেছে।‌ যাই হোক সবাই এসছে তারা?

মাথা নাড়ালো আনতারা। তার জানা ছিল ফারাহ’র জবাব। সেও ভেবে পায় না, হুট করেই কেন বিয়ে ঠিক করলো? বড় চাচা তো বলেছিল পড়াশোনা শেষে বিয়ে দিবে! ফাইনাল ইয়ার টাও শেষ করতে দিল না! ফারাহ আনতারা কে নিয়ে বের হয়। সবাই এসেছে মানে ওই মানুষ টাও কি এসেছে? কেমন করে আসলো? এতটা খারাপ কি করে হয়? মানুষটা জানতো তার হৃদয় পুড়বে, সে ভেতর থেকে আরো ভেঙে পড়বে‌। তারপরেও এলো? নিচে নামতেই সর্বপ্রথম বাবাকে চোখ পড়ে ফারাহ‌’র। মনের কোণের অভিমান টা লুকিয়ে রেখেই এগিয়ে যায়।‌ ফরিদ তালুকদার মেয়ে কে দেখে হাসেন। নিরবতায় কেটে যায় কয়েক মুহূর্ত। কোনো এক অদৃশ্য জড়তায় কেউ ই কথা বলতে পারেনা। এই পরিস্থিতি থেকে দুজন কেই বাঁচিয়ে নেয় আনতারা’র বাবা আহনাফ তালুকদার। এসেই ফারাহ’র মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন,

~ কেমন আছো আম্মু? সব ঠিকঠাক আছে তো?

~ আছি ভালোয় মেজ চাচা। সব ঠিকঠাক ই আছে। তোমরা সবাই কেমন আছো?

মিথ্যেই বলে ফারাহ! বলতে ইচ্ছে করে, ‘কিছু ঠিক নেই। এবাড়ির মানুষ গুলো অন্যরকম।’ তবে বলতে পারে‌না। তার ঠিকানা এখন এটাই। ইচ্ছে না থাকলেও এখানেই থাকতে হবে‌। ভাতিজার প্রতি বাবার ভালোবাসা দেখে মলিন হাসলো আনতারা। এই লোকটা কে সে একটা কারণেই সম্মান করে, এই লোকটা তার মা কে প্রচন্ড ভালোবাসে। আজ পর্যন্ত একা থেকে গেল শুধু মাত্র মায়ের জন্য! ঠিক এই কারণটার জন্য‌ই সে বাবা নামক মানুষ টাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তবে বিনিময়ে কিছুই পায়নি, আত্মার শান্তি ছাড়া! ভাবনার মাঝেই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেল আনতারা। ঘাড় ঘুরানোর প্রয়োজন পড়লো না, ঢের‌ বুঝতে পারছে মানুষ টা কে। বললো,

~ হঠাৎ আমার পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়লো ফাতিন ভাই!

~ হিংসা হচ্ছে আমার বোন কে দেখে?

আনতারার ভ্রু কুঁচকে এলো। হিংসে হবে কেন? বিরক্তি কন্ঠে বললো,

~ কেন আপনার বোন কি বেলা হাদিদ নাকি?

ফাতিন বুঝলো না।‌ কে এই বেলা হাদিদ। কপালের ভাজ তার বৃদ্ধি পেল, সেই সাথে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মেয়েটা তাকে বার বার রাগিয়ে দেয়,

~ কে এই বেলা হাদিদ? আমার বোন বেলা হাদিদ হবে কেন?

আনতারা না চাইতেও হেসে উঠলো। হাসিতে যেন বিদ্রুপ ফেটে পড়ছিল। রক্ত টগবগানো যুবকের রক্ত কি শিতল থাকে একটা মেয়ের বিদ্রুপে? ফাতিনের‌ও রক্ত যেন গরম হচ্ছিল ক্রমশ। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রাখে। বোনের শশুড় বাড়িতে কোনোরকম সিনক্রিয়েট সে করতে চায়ছে না। আনতারা একপলক ফাতিনের রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে নিয়ে তাচ্ছিল্য কন্ঠে বললো,

~ সুন্দরের পূজারী বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে চিনে না! বড়‌ই আফসোসের ব্যাপার ফাতিন ভাই। তবে চিন্তা নাই সুন্দরের কথা নাহয় এই আঁধারিয়ার কাছেই শুনুন। ইসাবেলা খায়ের হাদিদ! গ্রিক গণিতবিদ্যার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারী। ‘গোল্ডেন রেশিও অব বিউটি ফাই স্ট্যান্ডার্ডস’-এ সবচেয়ে নিখুঁত মুখশ্রীর অধিকারী হয়েছেন সুপার মডেল বেলা হাদিদ।
আপনার বোন কে হিংসা করার‌ কারণ আছে? যা আমার তা আমার‌ই থাকবে ফাতিন ভাই; এমন দিন না আসুক আপনার বোন আমাকে হিংসা করুক!

ফাতিন কে একরাশ বিস্ময়ের মুখে ফেলে রেখে স্থান ত্যাগ করলো আনতারা। সে কখনোই এসবে ছাড় দেয় না। ছোট থেকে প্রতিবেশীদের থেকে সমবেদনা, টিটকারি শুনতে শুনতে সে এখন এতটাই শক্ত হয়ে উঠেছে যে নিজের বাবা’কেউ ভুলের জন্য ছাড়ে না। তার মায়ের নারী ছেঁড়া ধন সে, এতটা হেলায় তো নেওয়া যায় না। নিতে কেন দিবে সে? সে আলাদা, গায়ের রং আলাদা, মুখশ্রী আলাদা, মনোভাব আলাদা, গোটা সে’ই আলাদা! সবার থেকে!

বন্ধুদের নিয়ে জম্পেশ আড্ডা বসিয়েছে নিয়ন। ব‌উয়ের কাছাকাছি থাকা তো এখন আর হচ্ছে না, বন্ধুরাই একমাত্র ভরসা। কিছুটা দূরে রাশিদ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে সে। কোনো রকম সময় ব্যয় না করে জড়িয়ে ধরে। রাশিদ হাসলো। পিঠ চাপড়ে বললো,

~ কিরে বন্ধু, বেশ উৎফুল্ল লাগছে। ব‌উ একটু বেশী আদর দিয়েছে নাকি?

খানিক লজ্জা পায় নিয়ন। এই ছেলেটা লাগামহীন। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,

~ ধন্যবাদ দিয়ে তোকে ছোট করবো না বন্ধু। তবে মনে হচ্ছে আহমেদ বাড়ির জন্য যোগ্য ব‌উয়ের খুঁজ ই তুই দিয়েছিস। বরাবরের মতো সাংসারিক ঘটনা গুলো আজ‌ও ঘটেছে তবে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আমাকে করেনি। যৌথ পরিবারে মিলে মিশে থাকতে পারবে।

রাশিদ গর্বের সহিত হাসলো। নিয়নের দিক তাকিয়ে দেখলো বেশ খুশি ছেলেটা। সুন্দর ব‌উ পেলে সব ছেলেই খুশি থাকে। নিয়ন ও ব্যতিক্রম নয়। তবে তার একটা দায়িত্ব আছে তো,

~ শোন তোকে একটা সিক্রেট বলি। ফারাহ মেয়ে টা না আলাদা। কেমন আলাদা বলি, এই যেমন ধর তুই একটা কাজ করছিস সেটা করতে ফারাহ না করলো। কথাটা না শুনে এক‌ই কাজ করে গেলে ও খুশি হয়। মনে করে পুরুষ মানুষ সবসময় নিজস্ব বুদ্ধি, নিজস্ব ভাবনায় চলবে। এটাই তো পুরুষ মানুষ। ধারণা টা কিন্তু এমনি এমনি জন্ম নেয়নি, আশে পাশে যা দেখেছে তাই জেনেছে‌। তোকে এই ভাবনাটাই পাল্টাতে হবে। পুরুষ মানুষ যে ব‌উদের শাসনের সাথে তীব্র ভাবে ভালোবাসতেও পারে সেটাই বুঝাতে হবে। আশা করি বুঝতে পারছিস!

একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এমন ধারণা পুষে রেখেছে ভেবেই অবাক হলো নিয়ন। পরক্ষণে রাশিদের কথায় সায় জানালো। রাশিদ বুঝলো এই ছেলে তার কথায় প্রভাবিত হয়ে গেছে। হ‌ওয়ার ই কথা। কথাটা অবাকের হলেও সত্য। মেয়েটা ঠিক এই কারণেই তার প্রেমে পড়েছিল। তার ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের প্রভাবেই মেয়েটা দিনদুনিয়া ভুলে যাচ্ছিলো। মনে করানোর চেষ্টাই সে করেছে। বন্ধুর জন্য ফারাহ কে পছন্দ করে দিয়েছে, বিশেষ কাজ হিসেবে ফরিদ তালুকদার কে নিজের কথা দ্বারা প্রভাবিত করেছে। ব্যাস কাজ হয়ে গেল। ফরিদ তালুকদার কম সময়েই বিয়েটা দিয়ে দিলেন। রাশিদের চিন্তা টাও দূর হলো। আর যাই হোক, তার শুচিস্মিতার কাছে তো তাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারবে না এখন। এই অনেক! নাহলে মেয়েটি তার আপায়ের জন্য রাশিদ তাজ‌ওয়ার কে গুণতাই ধরতো না। ভালোবেসে শুধু নিয়তির উপর ছেড়ে দিতে রাশিদ তাজ‌ওয়ার শিখে নি। কিভাবে ভালোবাসা আদায় করতে হয় সে জানে। একবার কিছু একটা ইঙ্গিত পাক, মেয়েটাকে পৃথিবীর সব সুখ ঢেলে দিবে। তার বুকে জমায়িত সকল‌ আবেগে মেয়েটাকে ভাসিয়ে নিবে। নাহলে যে সে নিঃস্ব হয়ে যাবে। সকল আবেগ হয়তো তাকেই কোণঠাসা করে দিবে। জমায়িত ভালোবাসা গুলো তাকে ভালো থাকতে দিবে না, বার বার পরাজিত হয়ে জিতার আশায় ছেড়ে দিবে। এমন দিন না আসুক! তার নিশ্বাস নিতে যে কষ্ট হয়!
হুট করেই ভাবনায় ডুবে যাওয়ার রোগটা আবার চেপে ধরেছে। নিয়নের হাতের ছোঁয়ায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে সে। পরপর দুবার মুখ দিয়ে শ্বাস ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে। নিয়ন বলছিল,

~ ব‌উ কে কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় জানি। তুই তো জানিস আমি কেমন। খুব ভালো থাকবে ফারাহ, খুব ভালোও বাসবো। আমি সাধ্য মতো চেষ্টা করবো ওর সকল আবদার পূরণ করার। চল, খেতে চল।

নিয়নের সাথে চলে যায় রাশিদ। মাত্র‌ই রাশিদের সাথে কথা বলতে এসেছিলো ফারাহ। এসেই নিয়নের কথাটা কানে পৌঁছায় তার। নিজের প্রতি স্বামীর এমন অভিব্যাক্তি তে ভালো লাগায় ছেঁয়ে যায় ভেতর টা। তবে সবচেয়ে বেশী উৎফুল্ল হয় রাশিদ তার কথা আলোচনা করায়। ব্যাপারটা মুটেও ঠিক হচ্ছে না সে বুঝতে পারছে। তবে হুট করে বিয়ে হলেও, হুট করে‌ তো মন বসানো যায় না। মনের‌ উপর তো জোর চলেনা। এত তাড়াতাড়ি কারোর মায়ার পড়লে তার ভালোবাসা যে মিথ্যে হয়ে যাবে। সে তো সত্যিই বেসেছিল ভালো। বড় জা’র ডাকে আবার আগের‌ জায়গায় চলে যায় ফারাহ‌। এখন আর হেলাফেলা আচরণ করলে চলবে না, তাকে আরেকটু সতর্ক থাকতে হবে।‌ কোনো মেয়েই চায় না তার আচরণে তার বাবার অসম্মান হোক। ফারাহ’ও তেমন চায়না।

সময় এখন বাড়ি ফেরার। রাত প্রায় নয়টা বাজতে চললো। এখন আর গ্রামের চিত্র আগের মতো নেই। সন্ধ্যা হলেই নিশ্চুপতা নেমে আসে না। মোড়ে মোড়ে দোকান, পুরুষেরা গরম চায়ের সাথে আড্ডায় মেতে উঠে; কখনো অন্যের সমালোচনা, কখনো নিজের সমস্যা, কখনো বা নিজেদের সুখের কথা ভাগাভাগি করে নেয়। আবার দল বেঁধে তাস খেলায় বসে যায়। প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ; শহরের মতো বিশাল বিশাল দালানকোঠা, রাস্তা ভর্তি গাড়ি না থাকলেও শহরের মতোই গ্রাম এখন গমগম করে। রাস্তা গুলোও বেশ উন্নত। ফরিদ তালুকদার একে একে নিজেদের নিকটবর্তী আত্মীয়দের গাড়িতে তুলে দিয়ে র‌ওনা দেওয়ার আদেশ দিলেন। তারপর বেয়াই বেয়ান দের থেকে বিদায় নিয়ে মেয়ে-জামাইকে গাড়িতে তুললেন। সাথে আবার ফারাহ’র দেবর নিবিড় আর ফুফাতো দুই ননদ যাবে। বুদ্ধি করে ফারহা দের আনতারা’দের অটো তেই উঠিয়ে দিলেন। ছোট রা একসাথেই যাক। বোনের পাশে বসতেই আনতারা’র চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তবে তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারলো না; নিবিব এসে ঠিক সামনের বরাবর বসলো, অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তাকে। বোনের দিকে একনজর তাকালো, মাথা নিচু করে বসে আছে ফারাহ। কিছু বলতে না পেরে আনতারা শক্ত হয়ে বসে র‌ইলো। সামনে বসে সবটাই পরখ করছিলো রাশিদ। আনতারা’র অসুবিধা ধরতে সময় লাগেনি তার, আগা গোড়া সব‌ই চেনা তার। ফারাহ’র জন্য নিজে বসতে অস্বস্তি ফিল করবে বিদায় ফাতিন কে ইশারা করলো। ফাতিন বিরক্ত হয়ে চুপ র‌ইলো। রাগ হলো রাশিদের। এ কেমন ব্যবহার, তার অপরূপার প্রতি একটু অবিচার ও সে সহ্য করবে না। নিজের অবস্থান থেকে নেমে এসে বললো,

~ শুচিস্মিতা নাম, ছোট চাচির কাছে বস। অস্বস্তি হলে সেটা মুখ ফুটে বলতে হয়। সবাই তোর মতো মনোবিজ্ঞানী নয় যে ভঙ্গিমা দেখে বুঝে ফেলবে।

স্পষ্ট বিরক্তি ভাব। তবে আনতারা কথা গুলোর মাঝে অসীম মায়া খুঁজে পেল। ছোট চাচি, আপায়ের পর একমাত্র এই ব্যক্তিই তাকে গভীর ভাবে চেনে; অথচ চেনার কথা ছিল না। ফারাহ রাশিদের দিকে একপলক তাকায়, অবাক ও হয়েছে বটে। সে পাশে বসে টের পেল না, রাশিদ দূরে বসে কিভাবে টের পেল? বললো,

~ কি হয়েছে তারা? অস্বস্তি হচ্ছে কেন?

বিচলিত হয় আনতারা। সামনে কি করে বলবে? এর সমাধান ও ঠিক সময় রাশিদ করে দেয়,

~ ফারাহ! তোমার অবশ্য‌ই জানার কথা অপরিচিত দের সামনে তোমার বোন কমফোর্ট ফিল করে না। তারপরেও প্রশ্ন করছো কেন?

ভড়কে যায় ফারাহ। বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। তার নাম ধরে ডেকেছে লোকটা? কিছু বলতে পারে না, তার আগেই নিবিড় বলে উঠে,

~ অপরিচিত ক‌ই? আমরা তো পরিচিত’ই রাশিদ ভাই‌।

ভাইয়ের কথায় নিয়ন চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকায়। হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে ছেলেটা হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? তাও আবার ফুফাতো বোন তহুরা কে দেখেও। মূলত নিবিড় নামক মানুষ টা খুব চঞ্চল ও মিশুক টাইপের। শুধু মাত্র তহুরা’র সামনে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখে, মেয়েটি ফাঁক পেলেই তাকিয়ে থাকে যা তার মুটেও পছন্দ নয়, ব‌ই‌ পড়া তো শুধু বাহানা মাত্র। ফারাহ এই জন্য‌ই নিবিড় কে গম্ভীর মনে করেছে। এবার ফাতিন এগিয়ে আসলো, কেন এলো বুঝতে পারলো না নিজেও। হয়তো দেরী হচ্ছে বলে। তড়িঘড়ি করে বললো,

~ তোমার ক্ষেত্রে পরিচিত হতে পারে নিবিড়। তবে আনতারা এসব পছন্দ করে না। এক কাজ করো সামনে গিয়ে বসো, আমি এখানে বসছি।

ফাতিনের ব্যাপারটা আলাদা ছিল। ‘আনতারা এসব পছন্দ করে না’ কথাটাই যেন কানে বাজছে বারবার আনতারার। লোক দেখানো হলেও হুট করেই সত্যটা বলেছে তো। ভালো লাগলো আনতারা’র। নিবিড় মন ছোট করে সামনে গিয়ে বসলো। সব ঠিকঠাক করে ফাতিন চেপে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। পাশে আপায় আছে বলেই হয়তো দুলাভাই কে‌ নিয়ে আনতারা’র অস্বস্তি ফিল হচ্ছে না। গাড়ির গতির সাথে ঠান্ডা বাতাস নাকে মুখে বারি খাচ্ছে। অন্তরীক্ষে পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। বেশ লাগছে পরিবেশ টা, আনতারা হুট করেই মাস্ক টা খুলে ফেলে, সাই সাই করে বাতাস গুলো নাকে মুখে ঢুকে পড়ে যেন। জ্যোৎস্না পুরোপুরি যেন আঁধারিয়া কে আলোকিত করে নিলো। এই প্রথমবার ফাতিন থমকালো, ভড়কালো; এমন মনে হলো আকাশের চাঁদ ও হার মেনে যাবে আঁধারিয়ার মায়াময় রূপের কাছে। মেয়েটাকে এভাবে সে কখনোই দেখেনি, তবে আজ কেন দেখলো? বুকের ভেতর টিপটিপ করছে, শিরশির করছে পায়ের তালু। ঝট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় ফাতিন। ঠোঁট কামড়ে বাইরে তাকিয়ে রয়,‌ হুট করে আরেকবার দেখার মনোবাসনা জাগে, পাত্তা না‌ দিয়ে ওভাবেই বাইরে তাকিয়ে থাকে। মঙ্গল হয়তো এখানেই!

সোয়া এগারোটা বাজতে চললো। নির্জীব পরিবেশ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে ঝোপঝাড় থেকে, পুবের বাতাসে শরীর মন দুলে যাচ্ছে।‌ তার উপর রাত টা যদি পূর্ণিমা রাত হয় , সৌন্দর্যের বর্ণনা বলে দিতে হয় না। নিজের বাড়ির ছাদে দোলনায় দোল খাচ্ছে রাশিদ। মোহনীয় এই পরিবেশ তাকে কাবু করতে পারেনি। তার মনে যে তার অপরূপা বাস করছে। মন পুড়ছে, বুক কাঁপছে। ঘুম নেই চোখে, নয়ন যুগল পিপাসিত হয়ে উঠছে বারংবার। সে ঘেমে যাচ্ছে, প্রিয়তমার মায়াময় রূপ দেখে ঠিক থাকতে পারছে না রাশিদ। মন বলছে সামনে এনে বসিয়ে রাখতে। প্রাণ ভরে দেখবে সে। তা সম্ভব নয়! আজ যে মেয়ে বেলকনিতেও আসে নি! চোখের তৃষ্ণা মেটাবে কি করে?

“আমার বাড়ি বন্ধুর বাড়ি রে
মধ্যে প্রেম নদী
পাখা নাই উড়িয়া যাইতাম রে
ওই না বন্ধুর বাড়ি রে
সোনা বন্ধুর পিড়িতে…”

লৌকিক ও অধ্যাত্মপ্রেম মিশ্রিত গানটি হয়তো পুরোপুরি ভাবে রাশিদের মনের অবস্থা বুঝানোর সক্ষমতা অর্জন করেনি। তবুও যেন কথা কয়, গান কথা বলে। এই যে এই মুহূর্তে চরম এক সত্য প্রকাশ‌ হলো, সাধ্য থাকলে ঠিক তার অপরূপা, তার শুচিস্মিতার কাছে চলে যেত। তবে স্বাদ আছে সাধ্য নেই! বুকের ব্যাথা নিয়েই ভাটিয়ালি গানের লিরিক্স গুলো বিড়ডিড় করতে থাকে। গভীর রাতে শব্দ টা দু’তিন বাড়ি পেরিয়ে যায়। হয়তো কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না ঘুমে আচ্ছন্ন থেকে। অদূরের ওই ফসলি জমি থেকে ভেসে আসে শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। নিস্তব্ধ পরিবেশে ডাক টা যেন শরীরে কাঁপন ধরায়। বিশেষ ভাবাবেগ হয় না রাশিদের। ভাবালেশ কল্পনায় সংসার সাজাতে থাকে। ছোট্ট সংসার, ঘুম থেকে উঠেই তার শুচিস্মিতার হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী দেখবে, ছুঁতে পারবে, আগলে নিতে পারবে, আবার গভীর রাতে মুখশ্রী দেখেই সে নিদ্রায় শায়িত হবে। রাশিদের চোখেমুখে অলৌকিক আলো খেলা করে, বুকের ভেতর অপার্থিব কোনো আনন্দ। আত্মার ভেতরে তখন আনন্দ, খুশী খোলকরতাল বাজায়। মনে হয় ধরা ছোঁয়ার বাইরে মেয়েটাকে সে ধরতে পেরেছে, আগলে নিতে পেরেছে! নিজের করে পেয়েছে।

বছর দুয়েক হলো আনতারা নামক মেয়েটার মায়ায় ডুবেছে সে। হুট করেই! মেয়েটা তখন বিশে পা দিয়েছে, যুবতী মেয়ে, সারাদিন হেসে খেলে বেড়াবে, কিন্তু এমন কিছু সে এই মেয়ের মধ্যে দেখেনি। একা একা থাকা, প্রকৃতি বিলাস করা, মন‌চাইলে আপায়ের সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠা, ছোট চাচির বুকে মুখ গুঁজে থাকা; এগুলোতেই মেয়েটা সীমাবদ্ধ। আগেও দেখেছে তবে বিশেষ নজর তো তখন পড়লো, যখন শ্রাবণের বিদায়ের পর ভাদ্র তেজ নিয়ে আসছিল, প্রকৃতি কাশফুল- শিউলিতে মুখোরিত হচ্ছিলো, পুকুর তখন সেজেছিল পদ্ম-শাপলায়; এমন এক ভোরে মেয়েটিকে পুকুরের পানিতে পা ভেজাতে দেখেছিল। ভেজা‌ পায়ের রূপার নুপুর জোড়ায় কি ছিল রাশিদ জানে না, তবে সে থমকে গিয়েছিল, বুকের থকথক কাঁপুনি টের পেয়েছিল! পঁচিশ বছরের যুবকের তখন বুঝতে সময় লাগেনি ভাদ্র তার জীবনে বসন্ত নিয়ে এসেছে, বসন্তের এই কৃষ্ণফুল তার মনে গন্ধ ছড়িয়েছে! এর পর থেকেই মেয়েটিকে সে চোখে চোখে রাখতো, দূর থেকেও যেন আগলে রাখতো। হুট করেই
কেন জানি মেয়েটিকে ভিষণ ভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে করতো, কিন্তু মেয়েটিকে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। বারবার কিছু একটা বলতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছে সে। মনে হয়েছে মেয়েটি যদি তাকে ভুল বুঝে! মনের মধ্যে একঝাঁক ভয় এসে হানা দিত! হারানোর ভয়! সে যদি হারিয়ে ফেলে, তার ইচ্ছের কথা জেনে যদি মেয়েটি তার সামনে না আসে, দূরে সরিয়ে দেয়! তখন সে কি করবে? সে তো থাকতে পারবে না! হুট করেই জীবনে বসন্ত আনা মেয়েটি যে তার হৃদস্পন্দনে পরিণত হয়েছিল, একদিন না দেখলেই বুকের বামপাশে তীব্র এক ব্যাথা তাকে বার বার জানান দিতো সে ভালো নেই! আবার একদিন হুট করেই তার ইচ্ছে হলো মেয়েটির জানা উচিত, তখন সবে অনার্স কমপ্লিট করে মাস্টার্সে ভর্তির হয়েছে রাশিদ। স্নিগ্ধ এক ভোরেই মেয়েটির পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল, মেয়েটি চরম অস্বস্তিতে যখন হাঁসফাঁস করছিল, অস্বস্তি টা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটির শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল সে। চাপা উৎকণ্ঠায় বলেছিল,

~শুনো মেয়ে শুচিস্মিতা, তুমি আমার জীবনে বসন্ত নিয়ে এসেছো, হুটহাট স্নিগ্ধ হয়ে ধরা দাও,‌ বুকের কাঁপুনি বাড়াও আবার হুটহাট কালবৈশাখীর আগমনে কৃষ্ণ মেঘের মতোই যন্ত্রণা দাও। এই যাতনা কিন্তু মুটেও দুঃখজনক নয় বরং সুখ সুখ অনুভুতি হয়।

সরে আসে কাছ থেকে, একটু নয় বেশ খানিকটা দূরেই দাঁড়ায়। মিনিট দুয়েক হৃদরহরণ কারী মেয়েটির মুখশ্রী অবলোকন করে। পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করে। আবার হুট করেই থেমে গিয়ে বলে উঠে,

~ সামলে রেখো নিজেকে, এই রাশিদ তাজ‌ওয়ারের চোখ তোমার উপর পড়েছে মেয়ে, সাবধান!

মেয়েটি এক ঝটকায় রাশিদের মনোভাব বুঝতে পেরেছিল। তাই তো তার সামনে আসাটাও কমিয়ে দিয়েছিল। সেও বা কম কিসে, প্রেয়সীর মায়ায় পড়ালেখা লাটে উঠিয়ে মাস্টার্স ভর্তি হ‌ওয়া পর্যন্ত‌ই সীমাবদ্ধ রাখলো। বাড়ি থেকে মন সরছিল‌ই না। এমতাবস্থায় কি করে সে শহরে গিয়ে থাকতো? মন বসতো পড়ালেখায়? ছেলেকে মানাতে না পেরে রাজিব তাজ‌ওয়ার টাকা খরচ করে নিজ জেলার এক সরকারি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ক্লাস করতে হয় না, পরীক্ষার আগে কিছুদিন ব‌ই নিয়ে পড়ে থেকে কোনোরকম পরীক্ষা টা দিয়ে আসে। সারাদিন ট‌ই ট‌ই করে ঘুরে বেড়ায়, মোড়ের দোকান গুলোর চিপায় বন্ধুদের নিয়ে ক্যারাম খেলে, কখনো সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সন্ধ্যায় নদীর দৃশ্য উপভোই করে আবার কখনো দুপুরে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এর ফাঁকে হুট করে প্রেয়সীর কথা মনে পড়লে দৌড়ে চলে আসে। দেখে মন শান্ত করে! ভবঘুরে জীবন নিয়ে বেশ আছে সে!

খুব কাছ থেকে শেয়ালের ডাক শুনে ভাবনায় ছেদন ঘটে রাশিদের। উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের রেলিং ঘেঁষে উবু হয়ে দেখে। ইটের টুকরো তুলে ঝোপের দিকে ছুঁড়ে মারে, ধপাধপ শব্দ হয়। চলে গেছে শেয়াল। আবার নিজ অবস্থানে বসে পড়ে। শুচিস্মিতাকে নিয়ে ভাবতে বসলেই রাশিদের ঠোঁটের কোণে এক মিষ্টি হাসির আবাশ পাওয়া যায়। কল্পনাতে অপরূপাকে যে নিজ হাতে আঁকে সে। কখনো‌ ভোরের স্নিগ্ধ প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়া শুচিস্মিতাকে, কখনো রক্তজবা শিউলি রজনীগন্ধা খোপায় গুজা শুচিস্মিতাকে, কখনো হাটু সমান ফ্রকে দুই বেনী করা ছোট্ট শুচিস্মিতাকে, কখনো শাড়ির আচল ভাসিয়ে দেওয়া শুচিস্মিতাকে, কখনো স্নেহময়ী শুচিস্মিতাকে, কখনো রুদ্রমূর্তি ধারণ করা শুচিস্মিতাকে, আবার কখনো চাঁদের ন্যায় মুখটাই অমাবস্যা খেলা করা শুচিস্মিতাকে। আহা মনের মধ্যে কত অনুভূতি খেলা করে, কত রকম কল্পনা আঁকিবুঁকি করে! একেক সময় একেক রং হয়ে ধরা দেয়!

চলবে..?

( প্রথম পর্বের মতো রিয়েক্ট আসেনি। তবে আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট। মন্তব্য না‌ করলেও অন্তত রিয়েক্ট করার অনুরোধ র‌ইলো। রিচের আপ ডাউন লেখার উৎসাহ কমিয়ে দেয়। কাল এক‌ই সময়ে গল্প আসবে ইনশাআল্লাহ। শুকরিয়া!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here