শেষ কান্না শেষ পর্ব

#শেষ_কান্না
#অন্তিম_পর্ব
#লেখা_Bobita_Ray

আনন্দে প্রতীকের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছে।ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠেছে এক চিলতে মিষ্টি হাসির রেখা।খুশি হবেই না কেন!আজ এতগুলো দিন,এতগুলো মাস,এতগুলো বছর পর অরুর খোঁজ পেয়েছে প্রতীক।সেই আনন্দে প্রতীক প্রজাপ্রতির মতো উড়াউড়ি করছে।বুকের ভিতরে এতদিন এক দলা কষ্ট পাকিয়ে ছিল।মুহূর্তেই সেই কষ্ট সরে গিয়ে একরাশ সুখ অনুভব করছে।সুখ সুখ অনুভূতি যে এত মধুর হতে পারে তা প্রতীকের জানা ছিল না।প্রতীক ঘনঘন বার কয়ের নিশ্বাস ফেলে বুকের একপাশে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল,
-”তোমাকে অনেক কষ্টে খুঁজে পেতে চলেছি অরু। এ দেহে প্রাণ থাকতে কখনো নিজ থেকে হারাতে দিব না তোমাকে।কথাগুলো ভাবতেই অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করল প্রতীক।আজ ভোরবেলা প্রতীক রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিল। হঠাৎ অরুর স্কুল লাইফের বান্ধুবীর সাথে দেখা হয়ে গেল।প্রতীক প্রথমে মেয়েটিকে চিনতে পারেনি।কিন্তু মেয়েটি প্রতীককে দেখে আচমকা বলল,
-“আপনি অরুর কাজিন না?
প্রতীক অবাক হয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
-“হ্যাঁ
অচেনা মেয়েটি আর একদণ্ড সময় নিল না।অরু এখন কোথায় আছে,কি পরিস্থিতিতে আছে,কীভাবে দিন কাটাচ্ছে।সবকিছু গড়গড় করে এক নিঃশ্বাসে বলে দিল তারপর আচমকা প্রতীকের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে তাতে কিছু একটা টুকে দিল। ফোনটি প্রতীকের হাতে গুঁজে দিয়ে মেয়েটি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না গটগট করে চলে গেল।অরুর কষ্টের পরিণতি শুনে প্রতীক বাকরুদ্ধ হয়ে এক জায়গা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।প্রতীকের যখন হুঁশ ফিরল তখন অচেনা মেয়েটি চোখের আড়াল হয়ে হাওয়াই মিলিয়ে গেছে।প্রতীক এতটাই চমকে গিয়েছিল যে মেয়েটির নাম-থাম বা পরিচয় শোনার কথা প্রতীকের মাথায় আসেনি।তাড়াহুড়ো করে ফোন চেক করতেই দেখলে ফোনে একটা ঠিকানা দেওয়া।প্রতীকের আর বুঝতে বাকি রইল না এটা অরুর বর্তমান ঠিকানা।খুশিতে প্রতীকের চোখে পানি চলে এল।প্রতীক অচেনা মেয়েটিকে মনে মনে হাজার বার ধন্যবাদ দিল।মেয়েটির বলা শেষ কথা বার বার প্রতীকের কানে বাজছে।মেয়েটি বেশ কাকুতি মেশানো গলায় বলল,
-“প্রতীক ভাই,আপনি হয়তো জানেন না অরু যখন থেকে বুঝতে শিখেছে প্রেম কী! তখন থেকেই আপনাকে মনে মনে খুব পছন্দ করত।আপনি যখন অরুদের বাড়ি বেড়াতে যেতেন তখন ও খুব খুশি হতো।স্কুলে এসে আমাদের কাছে সারাক্ষণ আপনাকে নিয়ে বকবক করত।আপনি এই পছন্দ করেন,সেই পছন্দ করেন আরও কত কী?আবার আপনি যখন চলে যেতেন তখন অরু সবার সামনে হাসিখুশি থাকতেও গভীর রাতে আপনার কথা ভেবে ভেবে বালিশে মুখ লুকিয়ে খুব কাঁদত।কিন্তু অরুর প্রতি আপনার অনিহা,বিরক্তি কখন যে একটু একটু করে আপনার থেকে অরুকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে তা অরু বুঝতেই পারেনি।ততদিনে অরুর জীবনে অন্যকেউ এসে গিয়েছে।কথাগুলো আনমনে ভাবতেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রতীক।ততক্ষণে গন্তব্যেও চলে এসেছে।বাস থেকে নেমেই মেয়েটির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী একটা রিকসা নিল প্রতীক।রিসকা আঁকাবাঁকা পথ ধরে সা সা গতিতে চলছে।শৎরতের শেষের দিক। চারপাশে কাঁশফুলের গাছগুলোও কেমন শুকিয়ে গেছে।একঝাঁক প্রজাপ্রতি মনের সুখে ছোটাছুটি করছে। এক পশলা বাতাসের ঝাঁপটা প্রতীকের চোখে মুখে উপচে পড়ছে।সব মিলিয়ে মোহনীয় পরিবেশ।প্রতীক যখন প্রকৃতিক সৌন্দর্য দেখায় ব্যস্ত তখন রিকসাওয়ালা প্রশ্ন করে,
-“মামা কই যাইবেন?
প্রতীক বিব্রতবোধ করে। ধীর গলায় বলে,
-”তালোকদার বাড়িতে।
রিসকাওয়ালা হাসে!শব্দ করে হাসে!প্রতীক জানতে চায় হাসির কারণ।রিকসাওয়ালা মুখ বাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,
-“ওই বাড়ির বেবাকটি মানুষ হইলো হারামীর ঘরের হারামী বুঝছেননি?তয় আপনে কী ওই বাড়ির মেহমান না কী?
প্রতীক কৌতুহল বশত জানতে চায়,
-“তুমি তাদের হারামী বললে কেন?
-“আর কইয়েন না মামা!তালোকদার বাড়ির বড়পোলা আজ কত্তগুলান মাস ধইরা নিখোঁজ।তারা ভালা কইরা না খুঁইজ্জা বড়বৌডারে দুষ দেয়।তাতে কইরা হইসে বৌ’ডার কালা ম্যাইয়া।লোকমুখে হুনি ম্যাইয়ার খরচপাতিও না কী কেউ দেয় না।আমার তো মনে হয় বড়পোলা গ্রামে বউ বাচ্চা ফালাইয়া থুইয়া ঢাহা গিয়া আবার বিয়া-সাধী করছে।তয় বৌ’ডা হইলো মানসের বাচ্চা বুঝলেননি? এত অপমান, অপবাদ, মুখ বুইজ্জা সহ্য কইরা পইরে রইছে।কহনো টু শব্দডাও করে না।
অজানা ভয়ে প্রতীকের বুকটা কেঁপে ওঠে।প্রতীক উতলা হয়ে জানতে চায়,
-“বড় বৌ’য়ের নাম কি?
-“অরু
“অরু”নামটা শুনে প্রতীকের চোখ,মুখ শক্ত হয়ে যায়।আর এক মুহূর্ত রিকসায় বসে থাকতে ইচ্ছে করে না।অরু যে এত কষ্টে আছে তা প্রতীক জানে না!জানলে কখনো তার প্রিয়তমাকে এখানে ফেলে রাখত না।রিকসাওয়ার হর্ন দেয়। প্রতীকের ঘোর কাটে। রিকসা থেকে নেমে থমথমে গলায় বলে,” তালোকদার বাড়ি কোনটা?
রিকসাওয়ালা হাত উঠিয়ে বলে,
-“ওই যে পশ্চিম পাশের বাড়ি ডা। প্রতীক ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে গটগট করে হেঁটে যায়।প্রতীকের হৃদপিণ্ড খুব জোরে জোরে ঢিপঢিপ করছে।জানটা মনে হয় ভিতর থেকে একলাফে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে।
উঠোনে বসে খেলছে কাজু।হামাগুড়ি দিয়ে সে এখন অনেক দূর এগোতে পারে।তাই অরু কাজুর কোমড়ের সাথে দড়ি বেঁধে রেখেছে।যাতে কোথাও চলে না যায়।একদিন অরু কাজুকে উঠানে বসিয়ে রেখে পুকুরে গিয়েছিল গোসল করতে। এসে দেখে কাজু বাড়ির উঠান পেরিয়ে রাস্তায় নেমে পরেছে।রাস্তার পাশেই বিশাল গভীর হাওড়। সেদিন যদি অরু কাজুকে সময় মতো না ধরত তাহলে মেয়েটা গড়িয়ে হাওড়ে পরে যেত।এখনো সেকথা ভাবলেই অরুর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।তাই কাজুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে অরু কাজ কর্ম করে।তাছাড়া কাজু এখন দাঁড়াতেও শিখেছে। কয়েক সেকেন্ড একা একাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। সামনের দিকে পা বাড়ালেই ধপ করে পরে যায়।আধো আধো বলিতে ‘বা’ বলে ডাকে। বাবা ডাকটা এখনো স্পষ্ট করে বলতে পারে না।তবে যখন চিল্লিয়ে কান্না করে। তখন একধারে বা বা বা বা… বলার তালেই থাকে।
প্রতীক বাড়িতে ঢুকতেই দেখল,ছোট্ট একটা শিশু উঠোনে বসে খেলছে।প্রতীক শিশুটিকে অনুসরণ করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে শিশুটির মাথায় আলতো করে হাত বুলাতেই কাজু সামনে ঘুরে হা করে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল প্রতীকের দিকে।প্রতীক মুচকি হেসে বলল,
-“নাম কী তোমার?
কাজু কি বুঝল কে জানে?খিলখিলিয়ে হেসে দিল।তারপর ঝাঁপিয়ে প্রতীকের কোলে চড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।প্রতীক বাবুটাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরল।বাবুটি প্রতীকের গালে কয়েকবার চুমু খেয়ে বলল,
-“বা বা বা বা বা….
প্রতীক চমকে উঠল।প্রতীকের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।বাবা ডাকটা যে এত মধুর হতে পারে তা প্রতীকের জানা ছিল না। এই শিশুটি কে তা জানে না প্রতীক!শুধু জানে এই শিশুটির মুখের অদ্ভুত ডাকে অলৌকিক শক্তি আছে।যা প্রতীককে একটু একটু করে গ্রাস করছে।প্রতীক এই মায়াময় ‘বা’ ডাক থেকে বঞ্চিত হতে চায় না।সে এই শিশুটির মায়ায় আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে যেতে চায়।কাজু থেমে নেই সে কৌতুহলি চোখে প্রতীকের শার্টের পকেট থেকে এটা-সেটা বের করে দেখছে।

মাত্র ক’দুন হলো কাজু জ্বর থেকে ওঠেছে
।সেদিন রাতে যে অবস্থা হয়েছিল এখনো ভাবলে অরুর কলিজা শুকিয়ে যায়। অরু হাতের কাজগুলো দ্রুত সেরে কাজুকে খাওয়ানো জন্য নিতে এল।বাইরে এসে দেখে কাজু একজন পুরুষের কোলে চড়ে আছে।অরু পেছন থেকে কাজুকে কারো কোলে দেখে প্রচণ্ড অবাক হলো।কাজু কুচকুচে কালো দেখে কেউ কাজুকে সহজে কোলে নেয় না।খুব বরচ মাথায় হাত দিয়ে বা গাল টেনে নিয়ে আদর করে।অরু আস্তে করে কাজুকে ডাকল।কাজু কোনো সারা দিল না।অরু বলল,
-“কে?
প্রতীক সামনে ঘুরে দাঁড়াল।ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,
-“অরু
আজ এতবছর পর প্রতীককে দেখে একটুও চিনতে ভুল হয়নি অরুর।বরং ভীষণ কান্না পাচ্ছে । এই মানুষটার জন্য একটা সময় পাগল ছিল অরু। কিন্তু এই পাষাণ, হৃদয়হীন মানুষটা কখনো বুঝতে চায়নি অরুর মনের লুকানো অনুভূতিগুলো।এই মানুষটার কথা ভাবতে ভাবতে কত রাত যে র্নিঘুম কেটেছে তা কেউ জানে না। অরুর সারা কৈশর জুরে শুধু এই মানুষটার বিচরণ ছিল।প্রতিরাতের কল্পনায় মানুষটা আসত।কখনো বর সেজে,কখনো বাসর ঘরে,কখনো বাচ্চার বাবা হয়ে,কখনো প্রেমিক হয়ে।এসব সুখময় ভাবনাগুলো ভাবতে অরুর খুব ভালো লাগত।কিন্তু একটাই আপসোস লোকটি কখনো অরুকে বোঝার চেস্টাই করল না।সবসময় একটা সিরিয়াস মুড নিয়ে থাকত।এত ভাব যেন তার ধ্যান-জ্ঞান জুরে শুধু পড়াশোনার বসবাস। তার প্রেম পিরিত সবকিছু উপন্যাসের নায়িকাদের সাথে কিংবা পড়ার বইয়ের সাথে।দিনে দিনে লোকটি অরুদের বাড়িতে আসা একদম কমিয়ে দিল।প্রথম প্রথম অরু খুব ভেঙ্গে পড়েছিল।কিন্তু বেশিদিন দুঃখের আগুনে পুড়তে হয়নি।তার আগেই রায়হান নামের প্রেমিক পুরুষটি অরুর জীবনে এসে গিয়েছিল।রায়হানের প্রতিটা কথায় মধু মিশানো ছিল।অরুর কি যে ভালো লাগত।ইচ্ছে করত সারাক্ষণ রায়হানের কথা শুনতে।একসময় রায়হানের জন্য এতটায় পাগল হয়ে গেল অরু।রায়হান যদি রাতকে দিন বলত তাহলে তাই।আবার যদি দিনকে রাত বলত তাহলে তাই।একদম হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছিল অরুকে।কখনো কারো সাথে মিশতে দিত না,কারো সাথে কথা বলতে দিত না,ফোন বন্ধ পেলে ঝগরা করত।সবসময় অরুকে সন্দেহ করত।অরু এতটাই পাগল ছিল যে রায়হানের কাছে নিজের সতীত্ব প্রমাণ দিতে গিয়ে বিয়ের আগেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিল রায়হানের হাতে।রায়হান যখন বুঝতে পারল অরু একদম ইউনিক।তখন থেকে প্রায় সময়ই কাছে ডাকত অরুকে।অরুও বাধ্য মেয়ের মতো রায়হানের ডাকে সারা দিত।
-“এত কি ভাবছ অরু?
প্রতীকের প্রশ্নে ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে এল অরু। আমতা আমতা করে বলল,
-“কিছু না।
প্রতীক হাসল।আপাদমস্তক অরুর দিকে একনজর তাকিয়ে দেখল।অরু আর আগের মতো আগুন সুন্দরী নেই।অনেক পরিবর্তন হয়েছে।খিটখিটে কাবু, গলার রগ বেড়িয়ে গেছে,গায়ের রং ও কালচে হয়ে গেছে। মায়াবী মুখটায় একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে।প্রতীক বলল,
-“কাজটা কি ঠিক করেছ অরু?মামা না হয় রাগের মাথায় একটা কথা বলেই ফেলেছিল তাই বলে কি তুমিও অভিমান করে যোগাযোগ রাখবে না?
অরু মাথা নিচু করে বলল,
-“সেই ভুলের মাশুলই তো দিচ্ছি প্রতিনিয়ত।
-“মামী নেই অরু!
অরুর দু’চোখ ছলছল করে উঠল।অপরাধীর মতো জড়োসরো হয়ে গেল।প্রতীক বলল,
-“তুমি চলে আসার মাস’ছয়েক পরেই মামী তোমার চিন্তায় চিন্তায় হার্টফেল করে মারা গেছে।মামা খুব ভেঙ্গে পড়েছে অরু।
অরু মুখে কাপড় গুঁজে কেঁদে দিল।ছোটবেলায় মায়ের সাথে কাটানো সুখময় স্মৃতিগুলো একটার পর একটা চোখের সামনে ভেঁসে ওঠল।মা নেই! অরুর বিশ্বাসই হচ্ছে না। অরুর মনে হচ্ছে এই তো সেদিন এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিল অরু।প্রতীক আবারও বলল,
-“মামা খুব অনুতপ্ত অরু।তোমাকে আমরা সবাই অনেক খুঁজেছি কিন্তু ভাগ্য খারাপ কোথাও পাইনি।তোমার ফ্যাকাশে চেহারায় বলে দিচ্ছে তোমরা মা মেয়ে এ বাড়িতে কি হালে আছো!যাও রেডি হয়ে নাও?
অরু বিড়বিড় করে বলল,
-“আমি কোথাও যাব না।
প্রতীকের ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু তা প্রকাশ করল না।রাগটাকে গিলে খেয়ে খুব শান্ত স্বরে বলল,
-“আমি তোমাকে জোর করব না অরু!তবে তোমাকে কিছু কথা বলছি মন দিয়ে শোন,তোমার বাবার যেটুকু সম্পত্তি আছে তুমি আর তোমার ভাই সারাজীবন ঘর ভাড়া দিয়ে বসে খেয়েও ফুরাতে পারবে না।মামী অনেক আগেই মারা গেছে।তোমার ভাইটাও ছোট।এদিকে মামাও তোমার চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে।ওদের কথা বাদই দিলাম।তোমার মেয়ের কথা ভাবো তো একবার।ওকে কীভাবে বড় করবে তুমি,কীভাবে মানুষের মতো মানুষ করবে?মা’য়ের অনেক দায়িত্ব অরু। শুধু সারাদিন গাধা খাটনি খেটে ছায়ার মতো মেয়ের পাশে থাকলেই হবে না ।ওকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে,বাবার পরিচয় দিতে হবে,স্কুলে ভর্তি করতে হবে। একটা বাচ্চা মানুষ করতেও অনেক খরচ অরু।তোমরা তো ঠিকমত খেতেই পাও না। বাবুটাকে মানুষ করবে কীভাবে? যদি এখানে থাকো লোকে তোমার মেয়ের দিকে আঙুল তুলবে।লোকমুখে নানান কথা শুনে যখন তোমার মেয়ে তোমাকে প্রশ্ন করবে তখন কি উত্তর দিবে তুমি তাকে?রায়হান যে ভবিষ্যতে ফিরে আসবে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই অরু।আবেগ দিয়ে না ভেবে বিবেক দিয়ে ভাব অরু।আবেগ মানুষকে ক্ষণিকের সুখের নাওয়ে ভাঁসিয়ে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। আর বিবেক মানুষকে পুড়িয়ে তিলে তিলে খাঁটি সোনা বানায়। এখন তুমিই ভেবে দেখ, তুমি কি করবে?
অরু হতাশ হয়ে বলল,
-“আমি বুঝতে পারছি না প্রতীক ভাই,এখন আমার কি করা উচিত?
প্রতীক ভরসা দিয়ে বলল,
-“আমি সবসময় তোমার পাশে আছি অরু!
অরু বিড়বিড় করে বলল,
-“যখন আপনাকে আমার খুব বেশি দরকার ছিল তখন কেন আসেননি আপনি?আপনি এত স্বার্থপর কেন প্রতীক ভাই?
প্রতীক বলল,
-“কিছু কি বললে!
অরু কথা ঘুরালো।বলল,
-“না কিছু না।
-“যাও ব্যাগ গুছিয়ে নাও

অরু যখন রেডি হয়ে ফুলমতিকে সালাম করতে গেল তখন ফুলমতি মুখ গোমড়া করে পা সরিয়ে নিল।অরু মুচকি হেসে বলল,
-“আজকের পর থেকে আমাদের দু’আপদকে আপনার আর সহ্য করতে হবে না মা।আমরা আর কখনো এখানে আসব না।আপনার ছেলে আপনাকে না বলে হারিয়ে গেছে। আমি নাহয় আপনাকে বলেই হারিয়ে গেলাম।আপনার শরীরের যত্ন নিবেন না মা।আমাদের দু’আপনকে এতগুলো দিন আগলে রাখার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না আপনাকে।অরু ফুলমতির আর একটু কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“অনেক ভালোবাসি মা আপনাকে!আপনি আমাদের বকতেন,শাষন করতেন, হয়তো কখনো গায়ে হাতও তুলতেন। কিন্তু আমি আপনার প্রতিটা শাষণে লুকানো ভালোবাসা খুঁজে পেতাম।সেই ভালোবাসার স্বাদ নেই,গন্ধ নেই,বর্ণ নেই,মাখামাখি নেই,আছে শুধু চোখে চোখে গভীর ভালোবাসা।এই ভালোবাসা খুব বেশি ভয়ংকর মা।কাউকে বলা যায় না, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না,মনের ভিতরে সযত্নে শুধু চেপে রাখতে হয়। কিন্তু মা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি চেপে রাখতে পারলেন না। আপনার বিন্দু বিন্দু চোখের জলই বলে দিচ্ছে আপনি কতটা ভালোবাসেন আমাদের।মা আমার সামনে যে আপনার এতদিনের লুকানো ভালোবাসা প্রকাশ পেয়ে গেল আপনার কি খুব বেশি লজ্জা করছে, না কী আমার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে?
ফুলমতি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।অরুকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। অরু বিজয়ের হাসি হেসে বলল,
-”আমি পেরেছি মা।আপনার শক্ত পাথর হৃদয়টাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পেরেছি আমি।কিন্তু আমার খুব আপসোস হচ্ছে মা।পাথরটা ভাঙতে খুব বেশি সময় নিয়ে ফেলেছি।একদম শেষ বিকালে ভেঙ্গেছি। এখন চাইলেও পাথরটার সাথে বেশকিছুদিন কাটাতে পারব না।আসলে আমি চাই না কাটাতে।যেখানে বহু কষ্টে ভালোবাসার ফুল ফুটিয়েছি সেখানে আমি বেশকিছুদিন কাটিয়ে কোনো তিক্ততা আসতে দিবোই না।আমি এর রেশটুকু বুকে আগলে রাখতে চাই মা।সারা জীবনের জন্য চাই।
ফুলমতি কাঁদছে।শব্দ করে কাঁদছে।আজ তার বলার মতো কিছুই নেই।সে চাইলেও তার বৌ’মাকে আটকে রাখতে পারবে না।মায়া,ভালোবাসা, এত খারাপ কেন তা ফুলমতির জানা নেই।যখন কাছে ছিল তখন অনুভব করেনি।আজ যখন সমস্ত বন্ধন ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে তখন কষ্টে ফুলমতির কলিজা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে অরুকে বুকের ভিরত ভরে রাখতে।কিন্তু সেই সৎসাহস,বা শক্তি কোনটায় ফুলমতির নেই।অরু কাপড়ের আঁচল দিয়ে ফুলমতির চোখের জল মুছিয়ে দিল। ফুলমতি পরম মমতায় অরুর কপালে চুমু খেল। কিন্তু কোন কথা বলতে পারল না।

★★
কেটে গেছে অনেকগুলো বছর!আজ কাজু একজন নামকরা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।তার মেধাশক্তি ছড়িয়ে গেছে গোটা দেশে।তাকে এক ডাকে সবাই চিনে।তার গায়ের রং আজও কুচকুচে কালো। কিন্তু তফাৎ একটাই, একটা সময় তাকে যারা কালো বলে অনিহা করত,ঘেন্না করত,আজ তারাই গর্ব বোধ করে। যে গ্রামে কাজু জন্মেছে সেই গ্রামের মানুষজন খুশিতে আত্মহারা ।সবাই কাজুকে নিয়ে এত মাতামাতি উৎসাহ দেখে কাজুর ভীষণ হাসি পায়।তাচ্ছিল্যের হাসি!কথায় আছে, তেলওয়ালা মাথায় সবাই তেল দিতে ভালোবাসে। অরুর অপূর্ণ চাওয়া গুলো কাজুকে দিয়ে পূর্ণ করেছে অরু।তবে অরুর মুখে অতীতের ভয়ানক কষ্টের কথাগুলো শুনে শুনে কাজুর এখন আর বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না।অরুও কাজুর উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয় না।সেদিন ওই বাড়িতে থেকে প্রতীকের সাথে চলে আসার সময় প্রতীক অরুকে বলেছিল,
-”আমাকে কি একটি বার বিশ্বাস করবে অরু?কথা দিচ্ছি ঠকবে না!
অরু চোখ বুজে বলেছিল,
-“উঁহু আমার এখন কোন পুরুষ মানুষকেই বিশ্বাস হয় না প্রতীক ভাই। সবাই দূর্বলতার সুযোগ নেয়।
-“কি করলে বিশ্বাস করবে অরু?
অরু মজার ছলে বলেছিল,
-“এই মুহূর্তে বিয়ে করতে পারবেন আমাকে?তারপর গোটা সমাজের কাছে আপনার বৌ বলে পরিচয় দিতে পারবেন?আমার মেয়ের আর্দশ বাবা হতে পারবেন?
প্রতীক আর কোনো কথা বলেনি সোজা কাজী অফিসে গিয়ে অরুকে বিয়ে করেছে।এমনকি কাজুর প্রতি অযত্ন হবে দেখে প্রতীক কখনো বাচ্চা নেয়নি।একটা সময় রায়হানের অপকর্মের ঘটনা অরু যখন জানতে পারল। আর বুঝতে পারল প্রতীক অরুকে সত্যিই ভালোবাসে।তখন অরুই বলত আর একটা বাচ্চা নিতে। কিন্তু প্রতীকের সিদ্ধান্তে অটল রইল প্রতীক। প্রতীকের একটাই কথা। তোমার মেয়ে আর আমার মেয়ে কি আলাদা?সুখি হওয়ার জন্য একাধিক সন্তানের দরকার নেই।মানুষের মতো মানুষ করতে পারলে একটা সন্তানের দ্বারাই অঢেল সুখ নেমে আসবে।অবশেষে প্রতীকের কথায় সত্যি হলো।অরু জীবনে কষ্টের কান্না অনেক কেঁদেছে। কিন্তু প্রতীকের হাত যেদিন প্রথম ধরেছিল সেদিনই কষ্টের কান্না শেষ হয়েছে।সমাপ্ত ঘটেছে শেষ কান্নার।এখন অরু কাঁদে তবে সুখের কান্না।অরুর জীবনে এত এত সুখ এনে দিয়েছে শুধুমাত্র প্রতীক আর কাজু।অরুর জানা ছিল না শেষ কান্নার পরে তার জীবনে এত সুখ নেমে আসবে।অরু, কাজু,প্রতীক ভালো থাকুক,সুখে থাকুক,তিনজন তিনজনের পরিপূরক হয়ে থাকুক আজীবন।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here