#শেষ_প্রহরের_মায়াজাল
#পর্ব_৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
বারিশদের বাড়িটা খুব বিশাল । সাধারণত একক পরিবারের এমন বাড়ির কোনো প্রয়োজন নেই। বারিশের দাদা ছিলেন খুব গণমান্য এক ব্যাক্তি। তার বাড়িতে সদা মানুষের আনাগোনা ছিলো। অনেকসময় বাইরের লোকদের নিজেদের আভিজাত্য দেখানোর জন্যেও মানুষ তাদের বাড়ি সাজায়। গাড়ি করে। প্রয়োজনের বেশি নিজেদের দুনিয়া সাজসজ্জা করে। হতে পারে বারিশের দাদাও তাদের মধ্যে একজন। এ অসম্ভব কিছু নয়। মান্নাত একপাশে গম্ভীর হয়ে দাড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল ফর্সা মুখে স্পষ্ট চিন্তার চাপ। “করিডোরে তবে কে ছিলো? ” আপাতত তার চিন্তার মুল উৎস হচ্ছে এটা। তবে একটু বেশি চিন্তা করছে সে। যদি তার মনের মধ্যে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো খানিক নেড়েচেড়ে দেখতো, তবে হয়তো মনোআয়নায় ঠিক বারিশের ছবি ভাসতো। তবে সে ভাবছে না। হয়তো ভাবতে চাইছে না। মেয়েটা মাত্রই অধৈর্য্য। বারিশ একপাশে দাড়িয়ে তার বাবার সাথে কথা বলছে। বারিশের চোখে মুখে খুশি কাজ করছে। এত মানুষের কথাবার্তায় কারণে তাদের দুজনের কথোপকথন ঠিক শোনা যাচ্ছে না। তবে বাপ ছেলের সেই কাটা কাটা কথার সারমর্ম হলো,
-একটু পর বারিশের বাবা এক ধামাকা করতে যাচ্ছেন। সবার সামনে নিজ ছেলের ভবিষ্যৎ সঙ্গীকে নির্বাচন করবেন। এখন বারিশকে এই কথাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বারবার শোনাচ্ছেন। আর বারিশও বাধ্য ছেলের মতন মাথা দোলাচ্ছে।
–” লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, প্লিজ লিসেন টু আস। ”
বারিশের বাবা শাখওয়াত আহমেদ এর মান্নাতের বাবা কামরুজ্জামান উভয়েই হাতে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওদের কথা শুনে সবাই তাদের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালো। মান্নাতও তার সব চিন্তা চেতনা বাদ দিয়ে তাদের দিকে তাকালো।
— ” আজকে এই শুভদিনে এক শুভ কাজ সম্পন্ন করতে যাচ্ছি আমরা। অনেকদিন যাবত আমরা দু পরিবার আমাদের বন্ধন দৃঢ় করার জন্যে ভাবছি। অবশেষে দুই পরিবারের মিলিত আলোচনায় আমরা এক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার ছেলে আজওয়াদ আহমেদ বারিশ এবং আমার বন্ধুর মেয়ে আফসারা শেখ মান্নাতের দুহাত এক করার সিদ্ধান্ত। ”
সবাই দুহাত এক করে করতালি দিলো। কিন্তু মান্নাত চমকে উঠলো। তার কান ঠিক শুনলো তো! বারিশের সাথে তার বিয়ে! কিভাবে? মান্নাত তার বাবার দিকে তাকালো। কামরুজ্জামানের মুখ স্মিত হাসি। মানে তিনিও এই বিয়েতে রাজি।
এবার কামরুজ্জামান বললেন,
— ” আমার মেয়ে মান্নাত এবং বারিশের এনগেজমেন্ট উপলক্ষে আজ আপনাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। আশা করি সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে আপনারা আমাদের সাথে থাকবেন। ধন্যবাদ সবাইকে আপনাদের মূল্যবান সময় নস্ট করে আমাদের সাথে শরিক হবার জন্যে। ”
এবারও করতালির আওয়াজ চারপাশ মুখরিত হলো। মান্নাতের চোখ বড়বড় হয়ে গেছে। চোখের ঘন পল্লব স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। মান্নাত চোখ ঘুরিয়ে বারিশের দিকে তাকালো। বারিশ খুব হাসিখুশি কয়েকজনের সাথে কথা বলছে। হয়তো তারা শুভেচ্ছা জানাচ্ছে তাকে। বারিশ তাদের সাথে কোলাকোলি করলো। মান্নাত এবার ছুটলো নিজের বাবার দিকে। আজ কি হার্টের ঔষধ খাওয়া হয়নি তার। কি আবোল তাবোল বকছেন ইনি?
কামরুজ্জামান একজন লোকের সাথে কথা বলছেন। মান্নাত পাশে দাড়াতেই তিনি হাসলেন। পাশের লোককে ভদ্রতাস্বরূপ পরে কথা বলবেন বলে মান্নাতের দিকে ঘুরলেন। মান্নাত চোখ সরু করে বললো,
— ” তুমি আজকে হার্টের ঔষুধ খেয়েছো? ”
কামরুজ্জামান খানিক অবাক হলেন। বললেন,
— ” হ্যাঁ। আসার সময় তো তোর মা-ই খাইয়ে আনলো।”
— “ওহ্! সে তো খুব ভালো কথা। তাহলে একটু আগে এসব কি অ্যানাউন্স করলে? আমার আর বারিশ স্যারের বিয়ে.. হ্যান-ত্যান? ”
কামরুজ্জামান হাফ ছাড়লেন। বুক ভরে অক্সিজেন গ্রহণ করলেন। মেয়ের কথায় একটু সময়ের জন্যে তার বুকে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়েছিল। এখন সব ঠিক আছে। কামরুজ্জামান হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললেন,
— ” ওহ। তাই বল। বিয়ে তো তোকে একবার না একবার করতেই হতো তাইনা? তো নিজেদের মধ্যেই বিয়ে সেরে নেয়া ভালো। তোর মাও তাই বলছিলো। চেনাজানা থাকে, অসন্তুষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম হয় তখন। তাই আমি তোর বিয়ে বারিশের সাথেই ঠিক করলাম।ভালো করিনি বল? ”
মান্নাতের প্রচন্ড রাগ লাগলো। ভাত সিদ্ধ হলে ভাতের পাতিল থেকে যেরকম পানি উপচে পড়ে চুলো ময়লা করে,সেরকম মান্নাতের রাগ মগজ থেকে উপচে পড়ে ঘাড়ে এসে ঠেকেছে। ঘাড়টা রাগে ফুলে টনটন করছে। কিন্তু বাবার সামনে রাগ দেখানো চরম অভদ্রতা। তাই মান্নাত দাতে দাঁত চেপে রাগ সামলালো। নিজেকে ধাতস্থ করে শীতল গলায় বললো,
— “কিন্তু বাবা, বিয়ে ঠিক করার আগেই আমায় একবার জিজ্ঞেস করেছো? আমার এই বিয়েতে মত আছে কিনা জানতে চেয়েছো একবার? ”
মান্নাতের বাবা চোখের পাতা মেলে মেলে তাকালেন। বলেন,
— ” কিন্তু বারিশ বললো তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস। আমি একবার বলেছিলাম তোর কথা। কিন্তু ছেলেটা যা পাগল। বলতেই দিলো না। বললো তোকে সারপ্রাইজ দিবে। তোর জন্যে সেদিন এতগুলো লোকের সামনে যা পাগলামি করলো ও। তার এক কথা ও তোকে অসম্ভব ভালোবাসে। তোকে সে সুখি রাখবে। এখন বিয়েটা দিয়ে দেওয়া উচিত। তাই না পারতে আমরাও রাজি হয়েছি। ”
মান্নাত হতবাক হয়ে তাকালো বাবার দিকে। বারিশ ওকে ভালোবাসে? এ-ও সম্ভব? মান্নাতের বিস্ময়ের অন্ত রইলো না। চোখের পাপড়ি নামাতেই সে ভুলে গেছে। ঠোঁট দুটো আপনা আপনি আলাদা হয়ে “হা” আকৃতির হয়ে গেছে। মান্নাত শুধু কাপা গলায় বললো,
— ” বারিশ স্যার সত্যিই এই কথা বলেছেন? ”
কামরুজ্জামান হাসলেন। সুখী সুখী হাসি। নিজের মেয়ের জন্যে সুযোগ্য পাত্র পেয়ে তার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। কারণে অকারণে অযথাই হাসছেন তিনি। একবার মাথায় এসেছিলো , এরকম হাসি দেখলে মানুষ পাগল ভাববে। মেয়ের বাবা পাগল।কি লজ্জার ব্যাপার। সেজন্যে কিছুক্ষণ হাসি থেমেছিলো তার। কিন্তু তার মিনিট খানেক পরই সব পন-ওয়াদা ভেঙে পুনরায় হাসতে লাগলেন। একদিনের জন্য সমাজের নিয়ম ভাঙতে ক্ষতি কি?
মান্নাত চারপাশের চোখ বুলালো। চোখের মণিটা ডান পাশে তাক করতেই লক্ষ করলো বারিশকে। বারিশ দুর থেকে বুকে হাত গুজে মান্নাতের দিকেই তাকিয়ে আছে।তার চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। দুচোখের চাহনি গভীর। যেনো তার দুচোখে কেউ উত্তাল-পাত্তাল এক সাগর পুড়ে দিয়েছে। মান্নাত বারিশের চোখে চোখ রেখে এক ঢোক গিললো। তার সমস্ত জ্বলন্ত রাগ বারিশের সেই শীতল চাহনিতে পানি পানি হয়ে গেলো। কিন্তু মান্নাত এতে মোটেও দমে গেলো না। বরং চোখে স্ফুলিঙ্গের ফুলকি নিয়ে এগিয়ে গেলো বারিশের দিকে।
মান্নাত বারিশের সামনে দাঁড়াতেই বারিশ ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
— ” ইজ এনিথিং রং? ”
মান্নাত আগুন চোখে তাকালো বারিশের দিকে। বললো,
— ” রং! সবকিছু রং করে এখন আপনার সং সাজা হচ্ছে? ”
— ” মান্নাত, এটা আবার কিরকম ভাষা? ”
বারিশ মুখ কুঁচকে বললো। মান্নাত কোনো ভনিতা না ছাড়া সোজাসাপ্টা বললো,
— ” বাবাকে আপনি কি বলেছেন? হুঁ? ”
বারিশ এবার নড়েচড়ে দাড়ালো। তার উত্তর শুনে মান্নাত নিশ্চই ক্ষেপে যাবে। হয়তো তার কলার ধরে বলবে” এটা আগে বলেন নি কেনো? ” নাহয় লজ্জায় লাল রাঙা হয়ে বলবে ” ইশ! কি কথা! ” কোনটা? বারিশের তর সইলো না। সেও খুব অধৈর্য্য এক তরুণ। বারিশ মান্নাতের কাছে এগিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে বললো,
— ” আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
বারিশের ওমন ফিসফিস আওয়াজ শুনে মান্নাতের শরীরের পশম দাড়িয়ে গেলো। মান্নাত হকচকিয়ে তাকালে বারিশ দৃষ্টি এলোমেলো করে বললো,
— ” এটাই বলেছি আমার হবু শ্বশুর মশাইকে। ”
— ” কিন্তু এটা তো মিথ্যা কথা! ”
মান্নাত হতাশ হয়ে বললো। মান্নাতের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে বারিশের হাসি পেলো। তবে সেই হাসি আটকে রাখলো সে। অবসর সময় পেলে একটু হেসে নেওয়া যাবে। সময়টা ভালো কাটবে। বারিশ থমথমে চোখে তাকালো মান্নাতের দিকে। অতঃপর মান্নাতের কানের কাছে মুখ এগিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে আওয়াজে তুলে বললো,
— ” কে বললো এটা মিথ্যা কথা? তুমি যেমন আমার কাছে সত্য, তেমনই চিরন্তন সত্য আমার এই ভালোবাসাময় অনুভূতি। ”
মান্নাতের চোখ বড়বড় হলো। বুকের ভিতর থাকা লাল রঙা হার্ট চঞ্চল ব্যাঙের মতন লাফাতে লাগলো। বারিশ এবার মান্নতের কানের লতিতে চুমু দিলো। হায় হায়! মান্নাতের শরীর এত জোড়ে কেপে উঠলো। খুব কষ্ট মেলে রাখা দুচোখ এবার আপনা আপনি বুজে এলো মান্নাতের। বারিশ মান্নাতের কানেকানে বললো,
— ” ওয়েলকাম টু ম্যাই হার্ট, মিস মান্নাত। ”
#চলবে