#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_১২
#Tahmina_Akther
-আপু,দেখ তো কে এসেছে,তোমার সঙ্গে দেখা করতে?
রুশার কন্ঠ পেয়ে কাজল সামনে তাকিয়ে দেখলো, একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যার গায়ে জড়িয়ে আছে সাদা এপ্রোণ।কাজল,বুঝতে পারলো এই মেয়েটি হয়তো রুশার পরিচিত। তবুও,নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-কে,ও? তোমার বান্ধবী?
-হুম,আমার বান্ধবী,নাজ। সে আমার কাছ থেকে তোমার কথা শুনে বায়না ধরেছে আমাদের বাড়িতে আসবে তোমাকে দেখতে,তাই নিয়ে এলাম।ভালো করেছি না আপু?
-হুম, ভালো করেছ।এই যে নাজ বসো এখানে, আমার পাশে এসে বসো।
নাজ ধীর পায়ে এগিয়ে কাজলের পাশে যেয়ে বসলো। কাজল, নাজকে বলল,
-তুমি কি খাবে বলো?আমি বানিয়ে নিয়ে আসি।
-আরে, না, না, কিছু করা লাগবে না আপু। আমি ক্যান্টিন থেকে সকালের খাবার সেরে নিয়েছি।আপনি বসে থাকুন এখানে, কিছু করা লাগবে না। তাছাড়া, আমি একটু পর বেরিয়ে যাবো কারণ আব্বু যদি বাড়িতে এসে আমাকে না দেখে তবে ভীষণ রাগ করবে।
-তুমি কত চমৎকার করে কথা বলো, নাজ!একদম টিয়া পাখির মতো। তোমার এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলার কারণে বুঝি আমাদের কম কথা বলা রুশা তোমার ফ্রেন্ড হয়েছে, তাই না?
-এভাবে কেউ প্রশংসা করে আপু! আমি কিন্তু ভীষণ লজ্জিতবোধ করছি।
নাজের কথা এবং ওর চেহারার অভিব্যক্তি দেখে কাজল খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। কাজলকে ঠিক আজ কত বছর পর এভাবে হাসতে দেখলো, রায়হান সাহেব। মনে মনে শোকরগুজার করলো রুশার এবং নাজের।
এতক্ষণ ধরে নাজ আর কাজলের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো অতঃপর কাজলের হাসিতে তার মনোযোগ ভঙ্গ হতেই, কাজলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আয়াত।
কি স্নিগ্ধ এই হাসিমাখা মুখশ্রী!আজ এতবছরের পরিচয়ে একবারও কাজলের হাসিমাখা চেহারার সাথে পরিচিত হয় নি আয়াত, কিন্তু আজ হলো।
বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে কাজল বললো,
-তোমাকে আমার বেশ লেগেছে, নাজ। প্লিজ, তুমি সময় পেলে আমাদের বাড়িতে এসো। আমি অনেক অনেক খুশি হবো তুমি এলে।
-আচ্ছা, আপু আসব। এখন আমি আসছি। পরে না-হয় আবার আসব।
কাজল মাথায় নাড়িয়ে সায় জানিয়ে আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-আপনি কি জনিকে একটু বলবেন, নাজকে ওদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে?
-হুম, একটু অপেক্ষা করো বলছি আমি।
-আরে, আপু এত ঝামেলা করার প্রয়োজন নেই। আমি রিকশা নিয়ে যেতে পারবো।
-নাজ, বেশি কথা বলিস না। আপু যা বলেছে তাই হবে। লেবুর শরবত খাবি, বানিয়ে আনবো?
-এত করে বলছিস যখন তখন নিয়ে আয়। কেউ সাধলে মান করতে নেই বুঝলি?
-হুম, বুঝলাম।
বলে মুচকি হেঁসে কিচেনে চলে গেলো রুশা।
রায়হান সাহেব নাজকে টুকটাক ওর পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। নাজ সুবোধ বালিকার ন্যায় মাথানিচু করে উত্তর দিলো।
রুশা সবার জন্য শরবত বানিয়ে নিয়ে আসলো। একে একে সবার হাতে দিলো।আয়াত কিছুসময়ের মাঝে জনিকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো।ওদের দু’জনের হাতে বাকি শরবতের দুটো গ্লাস তুলে দিলো রুশা।
বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠতেই নাজ সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
রুশা কাঁধের ব্যাগটি উঠিয়ে ওর রুমের দিকে রওনা হচ্ছিল কিন্তু কাজলের ডাকে ওর পা থমকে দাঁড়ালো। কাজলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কিছু লাগবে, আপু?
-না,কিছু লাগবে না। সেদিনের অপূর্ণ কথা গুলো শুনবে না?
কাজল আপুর কথা শুনে আমি আয়াত ভাই এবং আঙ্কেলের দিকে তাকালাম। উনারা চুপচাপ বসে আছে তারমানে উনারা দু’জন শুনবেন আপু কি বলে?
-হুম, বলো।
বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজল বলতে শুরু করলো,
-জায়ান, আমাকে প্রত্যাখান করে যাবার পর, নিজেকে প্রায় একপ্রকার গৃহবন্দী করে রেখেছিলাম।আব্বা, একা মানুষ সবকিছু সামলে উঠতে পারছিলেন না। ঠিক তখনি, একজন সহৃদয়বান লোক এসে আব্বার কাছে উনার একমাত্র পুত্রের জন্য আমাকে চাইলেন। ছেলে ভালো,ওয়েল সেটেল্ড পার্সন,শিক্ষিত,নতুন চাকরিতে জয়েন হয়েছে।
আব্বা বেশ খুশি হয়েছিলেন এই বিয়ের প্রস্তাবটিতে।আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো,
-আমি এই বিয়েতে রাজি কি না?
তখন আমি বলেছিলাম,
-নিজে তো পছন্দ করেছিলাম, কিন্তু? এখন তুমি যেটা ভালো মনে করো।
অতঃপর, সেই অজানা লোকটার সাথে বিয়ে হলো ঘরোয়া আয়োজনে।অজানা,কেন বলছি জানো? কারণ, সে বিয়ের আগে আমার সাথে দেখা করতে চায় নি। তার একটাই কথা বিয়ের পর স্ত্রীর মুখ দেখবো তার আগে নয়।
বিয়ে হবার পর তার সাথে আমার দাম্পত্য জীবন মোটেও সুখকর ছিলো না। কারণ, সে চাইতো আমি তার সাথে অন্তত হাসিমুখে একটি শব্দ বলি। কিন্তু, আমার এইসবে মন টানতো না। তাকে দেখলে মুখ দিয়ে শুধু একটি শব্দ উচ্চারিত হতো “বিরক্তিকর”
তাকে না জানিয়ে এই বাড়িতে চলে আসি। শুনেছিলাম আমাকে না পেয়ে সে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলো। যে রাতে এই বাড়িতে এলাম, সে রাতে
হঠাৎ, করে আমার যে কি হলো! এরপরের আর কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। এই মাঝের সময়টুকুতে আমি ছিলাম ভারসাম্যহীন বা সহজ বাংলায় পাগল।
-তোমার স্বামী এখন কোথায়, আপু? নাকি সে তোমাকে ছেড়ে?
-সব জানবে তার আগে আমার কথাগুলো শুনো। এই যে আয়াত নামক এই ভদ্র লোকটি দেখছো, উনি সর্ম্পকে এই কুঞ্জ বাড়ির কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নন। উনি হচ্ছেন, আমার স্বামী আয়াত। যিনি আজ এতবছর ধরে বিনা স্বার্থে আমার মতো এক পাগলের পিছনে পড়ে আছেন।
কাজল আপু কথা শুনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলাম। মানে আয়াত ভাই কাজল আপুর স্বামী। এই জন্য কি সে দিন হসপিটালে ভাইয়া আপুর অসুস্থতা দেখে কান্না করেছিলেন!ও মাই গড
একটা মানুষ তার ভারসাম্যহীন স্ত্রীর জন্য এভাবে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে পারে!
হয়তো, পৃথিবীতে ভালো খারাপ মিলিয়ে দুই পুরুষ জাত আছে, তাই । যাদের মধ্যে একদলকে দেখলে শুধু ঘৃণা আসে আর অন্য দলকে দেখলে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জন্মায়।
আমি আয়াত ভাইয়ের দিকে তাকালাম, উনি মাথা নিচু করে বসে আছে।আমি ঘুরে কাজল আপুর দিকে তাকালাম,দেখলাম আপু গভীর দৃষ্টিতে আয়াত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
কই এতদিন তো দেখলাম না এভাবে আয়াত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে তবে আজ,কেন?
-কাজল,তুই কি ঠিক আছিস? মানে এতটা খেয়াল করে সবকিছু বর্ননা করলি!
রায়হান সাহেব মেয়েকে প্রশ্ন করলেন ঠিকই তবে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন,যেন এ এক দৃষ্টিভ্রম।
-আমি ঠিক আছি,আব্বা।আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ!কেন বলছিস?
-কারণ, আপনার জীবনে যদি আপনি কোনো ভালো কাজ করে থাকেন তবে আয়াতকে আমার জীবনে এনে দেয়া ছিলো,আপনার জীবনের অন্যতম ভালো একটি কাজ।এর বাইরে আপনার জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ, প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত ছিল ভুলে ভরা।আপনার এই ভুল সিদ্ধান্তগুলো আমাদের পরিবারকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমার আম্মা চলে গেলো অনেক অভিমান নিয়ে,আর আমার?সে তো থেকেও নেই।সবই আপনার জন্য।অন্তত, আমার জীবনটাকে আপনি সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন এই জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানালাম।
আয়াত?
-হুম,
-আমাকে,একটু রুমে এগিয়ে দিয়ে আসবেন?
আয়াত যেন ভুল কিছু শুনল!কারণ,তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম দু’মাসে তাকে একটি কথা বলতে শুনেনি, হা, হু, তে তাদের আলাপচারিতার সমাপ্তি হতো।কিন্তু, আজ এত বছর পর তার স্ত্রী তাকে কিছু আদেশ করেছে।কই, এতদিন তো তার সামনে আসতে চাইতো না। ভয় পেতো কি না? কাজলের তো মনে ছিল না তার জন্য কেউ একজন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, যার জন্য সে সহস্র শতাব্দী অপেক্ষা করতে পারবে, কোনোপ্রকার উফফ শব্দ ব্যতিত।
তবে, আজ বুঝি এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটল।
-এসো,
আয়াত উঠে এসে কাঁপা হাতে কাজলের একপাশের কাঁধ জরিয়ে ধরল।
এই প্রথম আয়াতের স্পর্শে কাজলের শরীরে শিহরণ বয়ে গেল।শরীরী কামনার শিহরণ নয় হয়তো অন্যকিছু!
ধীরপায়ে কাজলকে নিয়ে উপরের ঘরে চলে গেলো আয়াত।
ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল রায়হান সাহেব। এরপর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়াতে, রুশা বলে উঠল
-আঙ্কেল, কাজল আপু কি আপনার উপর রেগে আছে?
-ওর রেগে থাকা জায়েজ আছে। কারণ, আমার জন্য ওর জীবনে মা নামক শান্তির ছায়া নেই,তাকে আদর করে টুকি নামে ডাক দেয়া ভাই নামক বন্ধুটি নেই। তাহলে আমার উপর রেগে থাকবে না তো, কি করবে?
-আপনার কি ছেলে আছে, আঙ্কেল?থাকলে উনি কোথায়?
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_১৩
#Tahmina_Akhter
-ওর কথা তোমার জানার প্রয়োজন নেই, রুশা।
আয়াত ভাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আঙ্গুলের মুখপানে চেয়ে রইলাম। কিন্তু, আঙ্কেল আমাকে আশাহত করে চলে গেলেন উনার ঘরে দিকে।
আঙ্কেল, চলে যাবার পর আমি আয়াত ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
-আপনারা হয়তো এখনো আমাকে পর ভাবছেন, তাই না?আসলে আমি পাগল নয়তো।আমি কিভাবে ভাবলাম, যে এই বাড়ির সকল সম্পর্কে অবগত থাকবো?
-তুমি,একটু বেশি ভাবছো, রুশা।সবার লাইফে একটু প্রাইভেসি আছে, বুঝলে।তোমার জীবনের সব কথা কি তুমি সবাইকে বলে বেড়াবে?পিতা-মাতা,সন্তান, স্বামী-স্ত্রী,আত্মীয় সবার মাঝে আমরা একটু গোপনীয়তা বজায় রেখে চলি। আমরা কিন্ত সব কথা তাদের কাছে বলি না। সবার সাথে সবটা বলা যায় না কারণটা হলো প্রাইভেসি। বুঝতে পেরেছো, আমি কি বলেছি?
-হুম,বুঝতে পেরেছি।
-বেশ ভালো,এখন রুমে যেয়ে ফ্রেশ হও।আমি খাবার অর্ডার করে দিয়েছি কিছুক্ষণের মাঝে হয়তো পার্সেল চলে আসবে।
-ফাহিমা খালা,কবে আসবে?
-আজ বিকেলে চলে আসবে। এখন তাড়াতাড়ি যাও।
ব্যাগটি কাঁধে উঠিয়ে হেঁটে হেঁটে আমার রুমের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি আঙ্কেলের ছেলের কথা।ধ্যাত,রুশা তুই না ইদানীং বড্ড বেড়েছিস। কেন আবার এইসব ভাবছিস?আয়াত ভাই বারণ করেছে, কিন্তু।
নিজের মাথায় নিজে হালকা টোকা দিয়ে নিজেকে নিজে বকছি আমি।
কিন্ত,কি এমন হয়েছিলো যার জন্য আঙ্কেলের উপর উনার ছেলেমেয়ে রেগে আছে!
আবারও, বলে নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলাম। আসলে নিষিদ্ধ কিছুর উপর আকর্ষন জন্মায় অধিক পরিমাণে।
——————-
দখিনের জানালা দিয়ে মৃদু হাওয়া বারংবার ছুঁয়ে দিচ্ছে। কড়া রোদের তাপদহনে জনজীবন প্রায় অতিষ্ট এরইমাঝে যদি শীতল বাতাস প্রবাহিত হয় তবে এরচেয়ে স্বস্তিদায়ক বস্তু আর কি আছে!
কিন্তু,আজ আর এইসবে শান্তি পাচ্ছে না, আদিল।
সকাল থেকে মাইগ্রেনে ব্যাথায় প্রায় কাবু হয়ে যাচ্ছে। তাই হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত বাড়িটিতে এসে শুয়ে রইলো বালিশ বিহীন পালঙ্কে। খনিকের জন্য আরাম পেলেও এখন প্রায় অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছে,সে। কোনোভাবে শরীরটাকে টেনেটুনে উঠিয়ে চলে গেলো গোসলখানায়। কল ছেড়ে শাওয়ার মাঝে দাঁড়াতেই ঠান্ডা পানির পরশে মস্তিষ্ক যেন আরামবোধ করলো।
এভাবে, প্রায় আধঘন্টার মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। শরীরে যখন কাঁপন ধরলো তখন বের হয়ে এলো গোসলখানা থেকে তবে ভিজা শরীরে।এবার শুয়ে রইলো রুমের ফ্লোরে গায়ে একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই,যে উঠে গিয়ে শরীরটা মুছবে।
এভাবে, থাকতে থাকতে কখন যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেললো,আদিল।
রাত,তখন বেশ গভীর। কিছুটা গ্রামের ছোঁয়া আছে এই উপজেলায়। রাত বেশ গভীর হলে শেয়ালের হাঁক শোনা যায়। ঝিঁঝি পোকার ডাক চারপাশ মুখরিত প্রত্যেক রাত্রীতে।
মাথায় কারো স্পর্শ পেতে বহুকষ্টে চোখ মেলে তাকলো, আদিল।
অন্ধকারে ছেয়ে আছে ঘরখানা।কারণ, আদিল যখন জ্ঞান হারায় তখন ছিলো মধ্যদুপুর আর এখন রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। খোলা জানালা দিয়ে একফালি চাঁদের আলো পালঙ্কে করে রেখেছে আলোকিত।সেই আলো থেকে পুরো রুম জুড়ে আবছা আলোর খেলা চলছে।
পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাতে দেখতে পেলো চিরচেনা, আকাঙ্ক্ষিত নারীর মুখ,মাধুর্যের।
আদিল বেশ অবাক হলো মাধুর্যকে ওর ঘরে দেখে। পরক্ষনে, মনে হলো ওর নিজের মনের ভুল। শরীরী যন্ত্রণায় মস্তিষ্ক ওকে ভুলভাল দেখিয়ে বিভ্রান্ত করতে চাইছে।
আদিল। চোখদুটি বন্ধ করে রইলো মিনিট দু’একের মতো আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলো যেন চোখে মেলে তাকালে মাধুর্যের আদল খানি দেখতে না পায়। কিন্ত,না চোখ খুলে তাকাবার পর দেখলো মাধুর্য ওর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।
এবার বেশ ভয়ে পেয়ে গেল আদিল। মনে হলো এই বুঝি তার জীবনের অন্তিম মূহুর্ত চলে এলো আর যে তার সামনে বসে আছে, সে মাধুর্য নয়। মাধুর্যের রুপে থাকা স্বয়ং মালাকুল মউত।কারণ সে তো তার বিধাতার কাছে চেয়েছিলো, মৃত্যুর কয়েক মূহুর্ত আগে হলেও যেন মাধুর্যের দেখা পায়। যেন এই পৃথিবী ছেড়ে গেলে আর কোনো আফসোস না থাকে।তাই বুঝি বিধাতা মাধুর্যের রুপে তার জন্য মরণ দূত প্রেরণ করেছে।
-আদিল,আপনি কি আমায় ভুলে গেছেন?
এই প্রথম তার মাধুর্যের কন্ঠ শুনলো। একি স্বপ্ন নাকি দৃষ্টিভ্রম। এই নারী কন্ঠে আছে মাদকতা, তাকে নেশাক্ত করে অতল গভীরে টেনে নেয়ার ফন্দি আঁটছে!
-কথা বলবেন না আমার সাথে!
-আপনি কি আমার মাধুর্য?
-হ্যা, আমি আপনার মাধুর্য।
-মিথ্যা বলছেন আপনি। আমার মাধুর্যের কাছে আমি কেবল অজানা একজন মানুষ। যার অস্তিত্ব ওর জীবন কখনো ছিলো না আর থাকবেও না। আপনি শুধুই একজন বহুরূপী। যার কাজ মানুষের প্রান কেড়ে নেয়া।
-কি বললে আপনি বিশ্বাস করবেন, আমি আপনার মাধুর্য?
-আমার মাধুর্য কখনো আমাকে সেধে এসে বলবে না, সে মাধুর্য।আপনি তো আমার কল্পনার কিশোরী মাধুর্য নন, আপনি তরুণী মাধুর্য যার রুপ, হাসি, দীঘল কালো কেশে আমার সর্বনাশ ঘটেছিল। আমার তরুণী মাধুর্য চাই না, আমার তো কিশোরী মাধুর্য চাই। যার পরনে ছিলো টকটকে লাল রঙের ফ্রক আর তার কান্নামাখা মুখখানি ।যেই কিশোরী মাধুর্যকে ভাবতে বসলে আমার হৃদয়ে হাহাকার করে না, তৃষ্ণা জাগে না।
-আমায় কি ভুলে গেলেন, আপনি?
এ কন্ঠে ছিলো একরাশ বেদনার নীরব কান্না।
-আমার হৃদয়ে সবসময় মাধুর্য ছিলো, আছে এবং থাকবে।
আমার পবিত্র ভালোবাসায় থাকবে মাধুর্য।কারণ, তাকে কল্পনায় যতটা ভালোবেসে আগলে রাখতে পারি বাস্তবে তার ছায়ার পাশে দাঁড়াবার যোগ্যতাও আমার নেই।
কথাগুলো নিস্তেজ গলায় বলতে বলতে চেতনা হারিয়ে পড়ে রইলো আদিল।
চোখে তীব্র আলোর ঝলকানিতে আদিল চোখ খুলে তাকালো।বাম হাতে টান দিতে উফফ বলে হালকা আর্তনাদ করে উঠলো।হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো স্যালাইন লাগানো। সামনের দেয়ালে টাঙানো ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো আটটা বাজে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো সকালের মিষ্টি রোদের আলো চারপাশে ঝলমল করছে।
এরইমাঝে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো মিস.জিনিয়া।
মিস.জিনিয়া আদিলের কলিগ এবং শিউলি ম্যামের একমাত্র মেয়ে।
জিনিয়া এগিয়ে এসে আদিলের পালঙ্কের পাশে রাখা চেয়ারটি টেনে বসলো।এরপর,আদিলকে জিজ্ঞেস করলো,
-এখন কেমনবোধ করেছেন, মিস্টার হ্যান্ডসাম?
-আছি,ভালো।
অসুস্থ কন্ঠে বলে উঠলো আদিল। জিনিয়াকে নিজের শরীরের অবস্থা ভালো জানালেও মনে মনে বলছে বলছে,
-বেঁচে ফিরলাম কি করে? আশা তো ছেড়ে দিয়েছিলাম, এই ধরনীতে বুঝি আর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে পারবো না তার অনিন্দ্য সুন্দর।
-আপনি অসুস্থ একবার আমাকে কল করে জানালে পারতেন। ভাগ্যিস, সকালে আপনার হ্যাল্পিং হ্যান্ড তাড়াতাড়ি এসেছিল। এসে যখন দেখলো আপনি এখনো ঘুম থেকে জাগেন নি তখন বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজায় কিন্তু আপনার দরজার খোলার কোনো নাম গন্ধ নেই। বেচারি, বেশ ভয় পেয়ে যায় পরে আমাকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসে। আমি এসে পাশের বাসার কয়েকজনকে ডেকে আনতে উনারা জানালার গ্রিল কেটে আপনার ঘরে ঢুকে দেখে আপনি অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। ভিতর থেকে দরজা খুলে দিতেই আমরা প্রবেশ করি এরপর,আপনার প্রাথমিক চিকিৎসা বলতে যা দেখছেন, আর কি!
তবে,আগামীকাল কষ্ট করে আপনি কিছু টেস্ট করে নিবেন।
হাসিমুখে কথাগুলো বললো জিনিয়া। এই মেয়েটির মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে।
আদিলকে সে মনে মনে পছন্দ করে কিন্তু বলতে সাহস পায় না। যদি এই টুকিটাকি কথা বলা বন্ধ করে দেয় এই ভয়ে। তবে, কখনো কখনো মাঝরাতে কিশোরীদের মতো হাত-পা ছুড়ে কাঁদে কেন সে আদিলকে নিজের পছন্দের কথা জানাতে পারে না?কিন্তু, নতুন সকাল এলে সে হয়ে যায় গম্ভীর, হাসিমুখে কথা বলা,ডক্টর. জিনিয়া।
যাকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না, যে সে গতকাল রাতেও কিশোরীদের মতো কেঁদেছে।
জীবনের এত এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় কখনো ভয় পায় নি কিন্তু আদিলের সামনে এলে সব কথার ঝুলি যেন নিমেষে ফুস হয়ে যায়।আতঙ্কে পা’জোড়ায় কাঁপন ধরে যায়। এই বুঝি তার মনের কথা শুনে দিলো এক রামধমক, দিলো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করে।
#চলবে
#চলবে