শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -১৪+১৫

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_১৪
#Tahmina_Akhter

জিনিয়া আরও কিছু উপদেশ দিয়ে আদিলের বাম হাতে লাগানো ক্যানোলা খুলে দিয়ে চলে গেলো।

জিনিয়া রুম থেকে বের হবার,চোখের কোণে জমে থাকা কান্নার ফোঁটা ডান হাতের মধ্যমা আঙুল দিয়ে মুছে এনে চোখের সামনে মেলে ধরলো আদিল।তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

-বড্ড বেঈমান তুই।সময়, স্হান কিছুই বুঝিস না। তোর দেহে,হৃদয়ে আঘাত এলে মানুষকে তোর দুঃখ দেখানোর জন্য আপনাআপনি গড়িয়ে পরিস।

এরইমাঝে আকাশ গর্জে উঠলো। আদিল দখিনের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, কৃষ্ণ মেঘের ভেলা পুরো আকাশকে গ্রাস করে ফেলেছে। তীব্র বাতাসের বেগে জানালা স্ব-শব্দে খুলে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।উঠে গিয়ে যে জানালা বন্ধ করবে সেটা পারছে না আদিল তাই উপায়ন্তর না পেয়ে ওর হ্যাল্পিং হ্যান্ডকে বেশ কয়েকবার ডাক দিলো।

কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর এসে আদিলকে জিজ্ঞেস করলো, কেন ডেকেছে? তখন আদিল জানালার দিকে ইশারা করতে,উনি জানালা বন্ধ করে চলে গেলেন।

পুরো ঘর আবারও আঁধারে ছেঁয়ে গেলো। আদিল চোখস বন্ধ করতেই, ওর দৃশ্যপটে মাধুর্যের গতকালের কান্নামাখা মুখশ্রী ভাসমান হলো।চট করে চোখ মেলে তাকালো আদিল এরপর নিজেকে ভয়ংকর বিশ্রি এক গালি দিয়ে বললো,

-মরণ না পর্যন্ত এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব না। কে বলেছিল ভালোবাসায় সুখ? যে বলেছিল সে নিশ্চয়ই ভালোবাসার এপিঠের সুখময় যন্ত্রণা অনুভব করেছে।ভালোবাসার ওপিঠের না পাওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করেনি। যদি করতো তবে বলতো পৃথিবীতে কাউকে কঠিনভাবে ভালোবেসে না পাওয়ার যন্ত্রণা মৃত্যুসম।

পরক্ষণে, আদিলের মন এক প্রশ্ন উদিত হলো।

-আচ্ছা, মাধুর্য এখন কেমন আছে?

———————–

সময় ধীরে ধীরে অতিক্রম করতে করতে প্রায় দু’বছর কেটে গেলো। এই দু’বছরে পৃথিবীর অনেক কিছু বদলে গেছে। কারো ভাগ্য, কারো ভালোবাসার মানুষ তো কেউ হয়েছে এতিম বা কেউ বা কারো হাতে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে আমৃত্যু পর্যন্ত এই হাতের বাঁধণ কখনো ছেড়ে যাবে না।

কাজলের সাথে আয়াতের সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মতো।ওরা দু’জন কুঞ্জ বাড়িতে থাকে না।আয়াতের চাকরির সুবিধার্থে ওর অফিসের পাশের এরিয়ায় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছে আয়াত-কাজল দম্পতি।

রায়হান সাহেব উনার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন মাস ছয়েক হলো। বাড়িতে শুয়ে বসে, বই পড়ে দিন কাটিয়ে দেন।

শুধু পরিবর্তন হয়নি রুশার, এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষে এসেও ওর তেমন ফ্রেন্ড নেই শুধু নাজ ব্যতিত। সারাদিন চেহারার মাঝে এক পড়ু্য়া ভাব রেখে মুখগম্ভীর করে রাখে। কদাচিৎ তার আকর্ষনীয় হাসির দেখা মিলে।
আর আদিল,সে আর ঢাকায় ফিরে আসে নি রংপুর মেডিকেলে জয়েন হয়েছে।

-হ্যালো, রুশা?

-হুম, বল
ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো রুশা। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়ার কারণে একেবারে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে।

-ক’টা বাজে খবর আছে এখনো ঘুমাচ্ছিস? আরে, আজ হসপিটাল থেকে সোজা সুলতানা ম্যামের বাড়িতে যেতে হবে, উনার গায়ে হলুদ সেখানে যাবি না? নাকি পড়তে পড়তে সব ভুলে গেছিস?

-আরে না ভুলিনি। কিন্তু, দোস্ত আমার বিয়ের ফ্যাংশন এটেন্ড করতে ভালো লাগে না।

-কেন? তোমার এক্স হাজবেন্ডের কথা মনে পড়ে নাকি?

-আমি কি এই কথা বলেছি তোকে?

-তোর তো ভাগ্য ভালো এই কথা আমার সামনে বলিস নি। নয়তো, তোর সামনের ক’টা দাঁত আজ শহীদ হতো। কারণ, ওই হারামির কথা শুনলে রাগে আমার শরীর কেমন যেন করে?

-তুই এই কথা বলতে পারলি! আমাকে দাঁত ছাড়া কেমন লাগবে একবার কল্পনা করে দেখেছিস তুই?

রুশার কথায় নাজ চোখ বন্ধ করে কল্পনা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু, দাঁতবিহীন রুশাকে দেখতে পেলো না।
মনে মনে আশাহত হয়ে কল কেটে দিলো নাজ।

পরমূহুর্তে, আবার কল দিলো রুশাকে এরপর,একপ্রকার থ্রেট দিলো, যেন তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসে। যদি না আসে তবে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসবে।

এইদিকে, রুশা হাসতে হাসতে দম আঁটকে যাবার উপক্রম।
রুশার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো রায়হান সাহেব। রুশার ঘর থেকে হাসির আওয়াজ শুনে উনি অবাক হলো বেশ।তাই, দরজায় টোকা দিয়ে রুশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-রুশা মা, তুই ঠিক আছিস?

রায়হান সাহেবের গলার আওয়াজ শুনে হাসি থেমে গেলো রুশার এরপর উত্তর বললো,

-হ্যা,আঙ্কেল, আমি ঠিক আছি। আসলে নাজ কল করেছিলো। আপনি তো জানেন ও কেমন? ওর কথা শুনে হাসছি।

মাথা চুলকিয়ে মিথ্যা বললো রুশা। আসলে ও যে নাজকে আজ কথার জালে আঁটকে বোকা বানিয়েছে সেজন্য হাসছে।এখন এই কথা কি আর আঙ্কেলকে বলা যায়!

রায়হান সাহেব রুশার কথা শুনে মুচকি হেসে চলে গেলেন।

তড়িঘড়ি খাট থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেলো রুশা। কারণ, আজ সারাদিনের জন্য ব্যস্ত থাকবে অতএব শাওয়ার নিয়ে মন মেজাজ প্রফুল্ল করা প্রয়োজন।
কোনোভাবে সকালের ব্রেকফাস্ট করে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হলো রুশা।

অজানা এক কারণে সুলতানা ম্যাম রুশাকে বেশ স্নেহ করে।হয়তো, করুনা থেকে কারণ রুশা তো এতিম,ডিভোর্সি।
রুশাদের ইয়ারের প্রত্যেক স্টুডেন্টকে উনার বিয়েতে ইনভাইট করেছেন।

দুই বান্ধবী ক্লাস শেষ করে রওনা হলো সুলতানা ম্যামের বাড়ির উদ্দেশ্য।
সেখানে পৌঁছাতে ওদের দু’জনকে বেশ আপ্যায়ন করলো সুলতানা ম্যামের পরিবার৷ যেন উনাদের পরিবারের একজন।

বাড়ির আঙিনায় সাজানো হয়েছে স্টেজ। হলুদ রঙের বিভিন্ন ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো বাড়ি সহ আঙিনা।

আমি আর নাজ বসে আছি সুলতানা ম্যামের রুমে। উনাকে সাজিয়ে দেয়ার জন্য পার্লার থেকে লোক পাঠিয়েছে উনার হবু স্বামী। উনার ইন্সাট্রাকশনে নাকি ম্যামকে সাজানো হবে। ম্যামের সাজ যখন সম্পূর্ণ হলো আমরা তো ম্যামকে দেখে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করেছি, সুবহানাল্লাহ।

কারণ, উনার সাজ অনেক চমৎকার হয়েছিলো। লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি,সূর্যমুখী ফুলের অর্ণামেন্টস। চুলে একপাশের খোপায় বেলীফুলের মালা গুজানো।এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ম্যামের পুরো শরীরে জ্বলজ্বল করছিলো।

নাজ তো বলে ফেললো,

-ম্যাম,আমাদের স্যারের তো জবাব নেই! মানে আপনাকে কীভাবে সাজালে সুন্দর লাগবে উনি ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে বলে দিলো!

সুলতানা ম্যাম হালকা হেসে বললো,

-তোমাদের স্যার একবার আমায় বলেছিল, আমাদের বিয়ের যতগুলো ফ্যাংশন হবে আমি যেন তার মনমতো নিজেকে সাজিয়ে তুলি এন্ড ফাইনালি ওর স্বপ্ন পূরণ হলো।

-কিন্তু, ম্যাম আপনাদের তো এ্যারেন্জ মেরেজ, তাই না?
রুশা জিজ্ঞেস করলো।

-পরিবারের ক্ষেত্রে এ্যারেন্জ।কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কি তোমাদের স্যারের সাথে আমার কলেজ থেকে প্রেম।

ম্যামের কথা শুনে আমি আর নাজ বোকা হয়ে গেলাম মানে এতবছরের প্রেমকে এ্যারেন্জ মেরেজে পরিণত করে ফেললো। তারপরও,মনে মনে খুশি হলাম,দু’জন ভালোবাসার মানুষ তাদের ভালোবাসার সুখকর পরিণতি পেলো।

মেয়েদের হলুদের ড্রেস হলো সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়ি আর ছেলেদের সবুজ পাঞ্জাবি।

আমি আর নাজ বসে আছি আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে।বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই ঘরে থাকবো।
আমি শাড়ি পড়ে মোবাইল টিপছি আর নাজ ডেসিংটেবিলের সামনে বসে সাজছে আর আমাকে ইচ্ছেমতো বকে যাচ্ছে। আমার অপরাধ আমি সাজবো না তাই। আমি ওর কথাতে মনোযোগ না দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছি।

আচমকা, আমার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলো নাজ। আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলবো তার আগে ও আমাকে টেনে নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে রাখা টুলে বসিয়ে দিলো। আমি কিছু বলার আগে চোখ রাঙানি দিয়ে দিচ্ছে। বুঝলাম, আজ আর ওকে কিছু বলে ভুলানো যাবে না।

প্রায় আধঘন্টার ঘষামাজার পর আমাকে ছেড়ে দিলো নাজ। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। কারণ,আজ বহুবছর পর এভাবে নিজেকে পরিপাটি সাজে দেখলাম। সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়িটায়,কানে, গলায়, হাতে ফুলের তৈরি গহনায়,খোলা চুলে নিজেকে আজ অচেনা রুশা মনে হচ্ছে। কাঁচা ফুলের গন্ধে পুরো শরীর ঘ্রাণযুক্ত হয়ে আছে।

নাজ আমার কাঁধে ওর থুতনি ঠেকিয়ে বললো,

-দেখেছিস, সাজলে তোকে কত সুন্দর লাগে!মাঝে মাঝে একটু সাজলে কিন্তু তোকে মন্দ দেখাবে না। বুঝলি রুশা আজ আবারও আফসোস হচ্ছে কেন আমার ভাই নেই!

-হয়েছে হয়েছে, এখন আবার শুরু হয়ে যাস না তুই। এখন নিজের সাজ কমপ্লিট কর নয়তো দেরি হয়ে যাবে। আর তোর মেকাপ গরমে গলে যাবে ম্যামের সাথে ছবি তোলার আগে।

-ওকে ওকে, যাচ্ছি।

-শোন না, নাজ?

-কি?

পিছু ঘুরে রুশার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো নাজ।

-বলছিলাম কি? অন্তত হিজাবটা পরে নেই।

-না, হিজাবের প্রয়োজন এই ফ্যাংশনে কোনো পুরুষ মানুষ থাকবে না।কারণ, ম্যামের শ্বশুর এইসব ফ্যাংশন পছন্দ করেন না কিন্তু পুত্রবধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হলুদের ফ্যাংশনের জন্য অনুমতি দিয়েছেন তবে কোনো পুরুষ কেউ উপস্থিত থাকবে না। সো চিল মার,মেরি জান।

মনে মনে একটু শান্তিবোধ করলাম। কারণ,প্রথমে পর্দায় অনিচ্ছা থাকলেও এখন পর্দাহীন চলা ফেরা করতে পারি না।

যথাসময়ে, হলুদের অনুষ্ঠান আরম্ভ হলো।আমি আর নাজ মিলে ম্যামের গালে এবং কপালে হালকা হলুদ ছুঁয়ে দিলাম। এরপর,আমার মোবাইলে অনেকগুলো সেলফি তুলে নিলাম সুলতানা ম্যামের, আমার আর নাজের।

হলুদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো রাত দশটায়।গুরুজনেরা বাড়ির ভিতরে চলে গেলেও রয়ে গেলো সুলতানা ম্যামের মেয়ে কাজিনরা, ভাবি,আমাদের কিছু ক্লাসমেট সহ আমি আর নাজ।বেশ হাসি তামাশা হচ্ছিল।

—————-

হসপিটালের ডিউটি শেষ করে বাড়িতে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছিল আদিল। যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত ১০:৩৫মিনিট।হুট করে মনে পড়ল আজ সুলতানার গায়ে হলুদের ফ্যাংশন।তাড়াহুড়ো করে পরনের শার্ট চেঞ্জ করে একটি পাঞ্জাবি পড়ল।এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে গুছিয়ে নিয়ে টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে ভিডিও কল দিল ওর ফ্রেন্ড সুলতানার কাছে।

ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো। আদিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-ক্ষেপেছে আমার ওপর,বিয়েতে ইনভাইট করলো যেতে পারলাম না আর এখন ঠিক সময়ে কল দিতে পারলাম না।

আদিল যখন নিজে নিজে কথাগুলো বলে আফসোস করছিলো, ঠিক সে সময়ে টুং টুং শব্দে কয়েকটি পিক ওর মোবাইলে এলো।হাতে নিয়ে দেখলো সুলতানার মোবাইল থেকে এসেছে। মুচকি হাসি দিয়ে ছবিতে ক্লিক করতে,একঝাঁক মেয়ের হলুদ শাড়ি পরা ছবি ভেসে উঠো স্ক্রীণে।ডানপাশে স্লাইড করতে ভেসে উঠলো, একটি হাসোজ্জ্বল তরুনীর ছবি।

এই তো সে নারী যার জন্য তার পুরো শরীর জুড়ে ভালোবাসার দহন।

স্ক্রীণে ভেসে থাকা মুখশ্রীতে হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আদিল।
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_১৫
#Tahmina_Akhter

সূর্য তখন পশ্চিম আকাশের দিকে সরে এসেছে।কিছু শুভ্র মেঘের ভেলা দূর অজানায় পাড়ি জমিয়েছে।পক্ষীর দল একজোট হয়ে আপন নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। দূর থেকে ছোট ছোট বাচ্চাদের হাসির কলরব শোনা যাচ্ছে,হয়তো কোনো খেলায় মেতেছে?
আচ্ছা, আমাদের মাঝে যে আসবে তার হাসির কলরবে আমাদের মন কি আনন্দিত হবে?

হবে হয়তো, আজ আয়াত এলে জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু, উনার সামনে দাঁড়ালে যে কোনো কথা মুখ দিয়ে বের হয় না তবে ব্রেইনে থেকে কে যেন বারংবার ধাক্কা দিয়ে বলে,

-কি রে,আয়াতকে কি যেন বলবি এখন বলছিস না কেন?

ব্যালকনিতে বসে বসে সূর্যের বিদায় বেলাকে অবলোকন করছিল কাজল।আর মনের মাঝে নিজের অগোছালো ইচ্ছে গুলো গুছিয়ে রাখছে।

হঠাৎ, করে কলিং বেল বেজে উঠতে কাজলের ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটল।দ্রুত পা চালিয়ে মুখ্য দরজা খুলে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল কাজল।রোজকার ন্যায় আজও যথাসময়ে বাড়িতে ফিরেছে আয়াত।ঘরের ভিতরে এসে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো আয়াত। এরপর,কাজলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,

-কি করছিলে, জায়া?

-আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
মিনমিন করে বললো কাজল।

আয়াত তার শার্টের উপরিভাগের দু’টো বোতাম খুলে দিয়ে সোফায় বসে পড়লো।কাজলকে ইশারা করলো ওর পাশে এসে বসতে।কাজল বিনা দ্বিধায় আয়াতের পাশে গিয়ে বসলো।আয়াত কাজলকে আরও কাছে টেনে এনে বললো,

-এতদূরে গিয়ে বসে থাকলে জরুরি কিছু বলা যায় না কি?

আয়াতের এহেন কান্ডে বেশ লজ্জা পেলো কাজল।উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে চাইলেও ব্যর্থ হলো কারণ ওর হাত আয়াতের হাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ। ছাড়া পেতে আস্তে করে বললো,

-আপনি ফ্রেশ হোন এরপর নাহয় আপনার জরুরি কথা শুনবো?

-জায়া,আমি যখন বলেছি এখন জরুরি কথা বলবো তারমানে এখন বলব পরে নয়। এখন চুপচাপ আগের জায়গায় এসে বসো।

কাজল বিনাবাক্য ব্যয়ে আয়াতের পাশে গিয়ে বসলো তবে কিছুটা দূরত্বে।মাঝের যে দূরত্বখানি ছিল তা আয়াত কাজলের পাশে সরে এসে ঘুচিয়ে দিল।

-সারাদিনে আমার কথা ঠিক কতবার মনে পড়েছে তোমার?

আয়াতের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে কাজল আয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে ফেললো।

-কি হলো, বলো আমার কথা কতবার মনে পড়েছে?

-চারবার, মনে পড়েছে।

-মাত্র চারবার! কিন্তু, আমার যে সারাদিন তোমার কথা মনে পড়ে। থাক সে কথা, এখন বলো চারবার ঠিক কি কারণে মনে পড়েছে আমার কথা?

-প্রথমবার মনে হয়েছে সকালে আপনি অফিসে চলে যাবার পর।আজ কিন্তু আপনাকে চা বানিয়ে দেয় নি এই কথা আমি আমার জন্য যখন চা বানাতে গেলাম ঠিক তখন মনে হলো। জানেন, ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল আমার,মনে মনে আফসোস করছিলাম কেন আমার সব কথা মনে থাকে না?
দ্বিতীয় বার মনে হলো দুপুরে ঘুমাতে যাওয়ার সময়। মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে আপনি তো গতকাল শুক্রবার ছিলো বিধায় বাড়িতে ছিলেন তো। কাল দুপুরে আপনার বুকে মাথা পেতে ঘুমানোর লোভ আজও জেগেছিল, সেজন্য আপনাকে মনে পড়েছে।
তৃতীয় বার মনে পড়েছে, ইশশ,ঘুম থেকে জেগে যদি আপনাকে দেখতে পেতাম!এই ভাবনা থেকে।
সর্বশেষ,চতুর্থবার মনে পড়েছে একটু আগে যখন ব্যালকনিতে ছিলাম। আসলে

কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো কাজল। কিভাবে বলবে সে যে তার একটি জীবন্ত পুতুলের প্রয়োজন? যার হাসি শুনলে মনে হবে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে মধুময় সুখময় বার্তা!

কাজলের কথাগুলো চোখ বন্ধ করে বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আয়াত কিন্তু হঠাৎ করে ও চুপ হয়ে যাওয়াতে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো কাজল চুপ করে আছে। আয়াত জিজ্ঞেস করলো,

-চতুর্থ কারণটা বলবে না আমাকে, জায়া?

-আসলে,মাঠে কিছু বাচ্চারা খেলছিলো আর কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিলো।ওদের হাসি আমার কাছে অনেক সুন্দর লেগেছে।হঠাৎ করে আমার মনে এক প্রশ্ন উদয়ন হলো,যদি আমাদের মাঝে কেউ আসে তবে তার হাসির জন্য কি আমাদের হৃদয় আনন্দিত হবে? আপনাকে এই কথা জিজ্ঞেস করবো বলে আপনাকে আমার বেশ মনে পড়েছে।

মনে আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে কাজল গড়গড়িয়ে কথাগুলো বলে ফেললো।

আয়াত যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।স্থীরচিত্তে বসে শুধু পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল কাজলের দিকে।

কাজল আয়াতের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো, ওর দিকে গাঢ়দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখন যদি আয়াত ওকে কিছু বলে এই ভয়ে কাজলের মুখ এইটুকুন হয়ে গেলো।

দু’মিনিট সময় অতিক্রম হবার পর আয়াত কাজলকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-জায়া,আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় ছ’বছর হবে।তোমার সাথে যখন আমার বিয়ে হলো, তখন কিন্তু তুমি আমাকে পছন্দ করতে না। এরপর,তো? থাক সে সব কথা এরপর,তোমার সাথে আমার সংসার চলছে আজ দু’বছর ধরে। আমি কখনো তোমার উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেই নি। আমাদের মাঝে যা কিছু হয়েছে সব তোমার সম্মতিতে কিন্তু আজ আমি তোমার কাছে থেকে একটি কথা জানতে চাই, আশা করি সত্য কথা বলবে কারণ এতে তোমার, আমার, ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদের জীবন জড়িয়ে আছে। তাদের যাতে কখনো শুনতে না হয়, যে তুমি ওদের মুখের দিকে আমার সংসারের ঘানি টেনেছো।

আয়াত নাকি বেশ কঠিন কথা জানে এইকথা কাজল শুনেছিলো ওর আব্বার কাছে আর রুশার কাছে। আজ আয়াতের কঠিন কথা শুনতেও পেলো কারণ এ যাবতকালে আয়াত তার সাথে সহজ শব্দে কথা বলেছে। কি এমন কথা জিজ্ঞেস করবে? আমার উত্তরে নাকি উনার, আমার আর ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা জড়িত!

———————

একে একে সুলতানার পাঠানো সব পিকগুলো খুবই সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলো আদিল।

হঠাৎ, করে ওর শরীর অজানা এক অনুভুতিতে কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছিল সবই ওর দেখার ভুল। বারবার মোবাইল ঘেঁটে পিকগুলো দেখছে। নিজের উত্তেজন চেপে রাখতে না পেরে সুলতানার কাছে ভিডিও কল করলো আদিল। বার দুয়েক রিং হতে ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো।

-কি রে আদিল, কেমন আছিস?

-আছি ভালো। সুলতানা, ওকে তুই কোত্থেকে পেলি,দোস্ত?

-কার কথা বলছিস, তুই?

-আমি তোকে সেন্ড করছি তুই দেখ?

আদিল ছবি সেন্ড করতে সুলতানা চেক করে দেখলো ওর হলুদের অনুষ্ঠানে তোলা গ্রুপ সেলফি সেখানে একটি মেয়ের ছবি উপর টিক দেয়া।ভালো করে তাকাতেই মেয়েটিকে চিনতে পারলো সুলতানা।

-ওকে তুই চিনিস না আদিল! ও তো রুশা।

আদিল এ কথা শুনতে ওর সারা শরীরে ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে গেলো।যার জন্য এত অপেক্ষা, এক পাহাড়সম ভালোবাসা, না পাওয়ার বেদনা, নিসংঙ্গ হয়ে প্রতিটি রাতে দীর্ঘশ্বাস চেপে ঘুমানো সে তো তার অনেক কাছে ছিলো তবে তাকে চিনতে পারে নি কেন? নাকি তার ভালোবাসা কোনো খুঁত আছে?

এদিক থেকে সুলতানা দেখছে আদিলের চোখ দুটি পানিতে ভড়ে উঠেছে, যে কোনো মূহুর্তে গড়িয়ে পড়বে।আদিলের চোখের পানি তো সে দশবছর আগে দেখেছিলো, যখন সে তার মাধুর্যকে, তার মা’কে হারিয়েছিলো।তবে, আজ কেন এই চোখে পানি জমেছে?

-সুলতানা, সুলতানা আমি আমি?

-কি হয়েছে তোর কান্নার দমকে কথাও বলতে পারছিস না, বল আমাকে কি হয়েছে? তোর মতো একটি স্ট্রং মেন্টালিটির ছেলে এভাবে কাঁদে তাহলে কেমন দেখায়? বলবি না আমাকে কি হয়েছে?

এরইমাঝে টুং শব্দে সুলতানার মোবাইলে আরো একটি ছবি এলো।সুলতানা ছবিটি দেখলো,লাল থ্রী-পিস গায়ে,মাথায় সাদা উড়না দেয়া একটি হাসোজ্জল মুখশ্রী। ছবিটি দেখার পর সুলতানার মুখ দিয়ে শুধু একটি কথা বের হলো আদিলের উদ্দেশ্য,

-দোস্ত,এই মেয়েটি কি তোর মাধুর্য?

আদিল মাথা উপর নিচ করলো যার অর্থ হ্যা।

-ও মাই গড, তারমানে রুশা হচ্ছে আমাদের আদিলের মাধুর্য?তোর এত কাছে থেকেও তুই চিনতে পারলি না দোস্ত?

-চিনব কিভাবে? যে ভাবে ঢেকে ঢুকে আড়ালে হয়ে থাকে।

আগুন, আগুন

সুলতানা কারো আত্ম চিৎকারে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো রুশার শাড়ির আঁচলে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।

কখন যেন সুলতানার হাতের টাচে মোবাইলে ব্যাক ক্যামেরা অন হতেই ওপাশ থেকে আদিল দেখতে পেলো, তার মাধুর্যের শাড়ির আঁচলে লাগা আগুন ওর শরীরে প্রায় ছুঁইছুঁই।এইটুকু, দৃশ্য দেখে যেন আদিলের পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো।

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here