শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -১৬+১৭

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_১৬
#Tahmina_Akther

রুশাকে ওই অবস্থায় দেখে আদিলের যেন মৃত্যু অনিবার্য প্রতিক্রিয়া।শরীরের যেন একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই উঠে দাঁড়াবার। মনে মনে শুধু বিধাতার কাছে একটি কায়মনোবাক্যে

“তুমি তাকে সহি সালমতে রেখো।আগের বার হারিয়েছে নিজের কারণে,এবার যদি তাকে হারিয়ে ফেলি তবে আমি আর এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারব না।”

চোখের পানিটুকু মুছে সুলতানার মোবাইলে বারবার কল করছে কিন্তু কল রিসিভ করার মান গন্ধ নেই। আরেকবার কল করতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো,

-হ্যালো,আদিল?

-হ্যা,হ্যা সুলতানা রুশা কই আছে?

-ওকে নিয়ে বার্ন ইউনিটে এসেছি,শরীরে ২০% পুড়ে গেছে। জানি না কি হয়? আমার টেনশনে মাথায় কাজ করছে না।

সুলতানার কথাগুলো শুধু শুনতে পেলো আদিল।আদিলের কন্ঠ না পেয়ে সুলতানা দুবার হ্যালো বলে কল কেটে দিলো।

আদিল তার মোবাইল পাঞ্জাবির পকেটে রেখে, ম্যানিব্যাগ নিয়ে বাড়ির মূল ফটকে তালা দিয়ে দ্রুত পায়ে চলতে শুরু করলো ; উদ্দেশ্য বাস স্ট্যান্ড। রাত প্রায় দশটা এই সময় রিকশা পাওয়া অনেক দূর্লভ ব্যাপার।

পরক্ষণেই, মনে পড়লো হসপিটালের সামনে সবসময় গাড়ি থাকে তাহলে সেখানে গেলে রিকশা পাওয়া যাবে। তৎক্ষনাৎ, দৌঁড়ে যেতে শুরু করলো আদিল, পাচঁমিনিটের মাঝে হসপিটালের সামনে এসে পৌঁছালো।এসে দেখলো একটি ইজিবাইক এবং একটি সিএনজি দাঁড় করানো।হাঁপাতে হাঁপাতে সিএনজির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-ভাই যাবেন, বাস স্ট্যান্ডে?

নিজের সিএনজির সামনে কারো অস্থির কন্ঠের আকুতি শুনে বাইরে তাকিয়ে দেখলো ত্রিশ বত্রিশ বছরের এক যুবক তার দিকে বিনয়ী ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। উনার মনে হলো যে, এই যুবককে তিনি চেনেন। একটু মনে করার চেষ্টা করতে মনে পড়ে গেলো, সেদিন উনার মেয়েটির হঠাৎ করে ডায়রিয়া, বমি শুরু হয়।রংপুর মেডিকেলে মেয়েকে নিয়ে আসেন, এখানে এডমিট করানোর পরও যখন কোনো ঔষধে কাজ হচ্ছিল না তখন ডাক্তাররা প্রায় বলে দিয়েছিলেন আপনার মেয়ে হয়তো বাঁচবে না। উনার স্ত্রী তখন প্রায় বিলাপ করে কেঁদে উঠেন। তখন সেই ওয়ার্ডের সামনে দিয়ে এই যুবক ডাক্তারটি হেঁটে যাচ্ছিল। উনার স্ত্রীর কান্না শুনে এগিয়ে আসেন, এসে উনার কলিগকে জিজ্ঞেস করতে উনি সব সমস্যা খুলে বলেন। সব শুনে উনি বলেন, ওর গ্লুকোজ স্যালাইন চলতে থাকুক তবে প্রয়োজন অনুসারে। মাঝে একটু বিরতি দিবেন নয়তো শরীর ফুলে যেতে পারে। আর ওর কি ব্লাড টেস্টে করা হয়েছে? যদি করে থাকেন তবে ওর শরীর কোন এন্টিবায়োটিক কাজ করবে?

-আসলে মিস্টার আদিল,ব্লাড টেস্টে শুধু দু’টি এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে উল্লেখ্য করা আছে তারমধ্যে একটি আমরা ওর শরীরে প্রয়োগ করেছি কিন্তু সুফল পাচ্ছি না।

-তাহলে, এন্টিবায়োটিক দুটোর মধ্যে যে আরেকটা আছে ওটা দিয়ে দেখুন আশা করছি ও সুস্থ হয়ে যাবে। আর আপা, আপনি কাঁদবেন না আপনার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে। কান্নাকাঁটি না করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন।

সেদিন, উনার প্রেসক্রাইভ করা এন্টিবায়োটিকে উনার মেয়েটি এখন সুস্থ আছে।

-স্যার, আপনে এতরাতে কই যাইবেন?

-ভাই, আমার খুব প্রিয় একজনের পাশে থাকা আমার খুব প্রয়োজন।আমার ঢাকায় যাওয়া খুব দরকার আমাকে একটু বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে যাবেন? ভাড়া যত চান তাই দিবো।

-আপনে উঠেন ভাড়া কত নিমু পরে দেখা যাইবো নে।

আদিল উঠে পড়তে সিএনজি চলতে শুরু করলো। রাতের আঁধারে নিস্তব্ধ রাস্তায় সিএনজি এগিয়ে চলছে।মাঝে মাঝে ল্যাম্পপোস্টের আলো আদিলের মুখে এসে পড়ছে। সামনে থেকে সিএনজি চালক ভাইটি ফ্রন্ট মিরর দিয়ে দেখছে ডাক্তার ভাইটির চোখের পানি চিকচিক করছে।

বাস স্ট্যান্ডের সামনে এসে পৌঁছাতে আদিল সিএনজি থেকে তড়িঘড়ি করে নামার সময় হাতে ব্যাথা পেলো।কিন্তু, ব্যাথার পরোয়া না করে পকেট থেকে টাকা বের করে ভাড়া এগিয়ে দিলো ড্রাইভারের দিকে।

-স্যার, আপনে ডাক্তার মানুষ। আপনার উসিলায় আমার মাইয়াটা অহন সুস্থ আছে। আপনার ভাড়া দেয়া লাগতো না। হেইদিন এক মাইয়ার ঔষধ আফনে বদলায় দিছিলেন মনে আছে, স্যার?

আদিল, একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেলো।শুধ বললো,

-ভাই,আমার প্রিয় মানুষটির জন্য একটু দোয়া করবেন। আমি আসি ; কখনো হসপিটালে এলে নিয়ে আসবেন আপনার মেয়েকে।

-আইচ্ছা ভাই, নিয়া যামু। এহন আপনে যান আর একটা বাস আছে ঢাকার নয়তো এই বাস ছাইড়া দিলে ঢাকার বাস আর সারারাইতেও পাইবেন না। জলদি যান।

আদিল সিএনজি চালকের থেকে বিদায় নিয়ে টিকেট কাউন্টারের ভিতরে চলে গেলো।

আর এদিকে, চালক ভাইটি মন মনে বললেন,

-ও মাবুদ গো, আপনার কাছে দোয়ার অভাব নাই, আফনার দোয়ার ভান্ডার থেইকা নাহয় এই ভাইটারে একটু দোয়া কইরা দেন। তার জীবনের আশা ভরসা আপনে পূরণ কইরা দিয়েন।

টিকেট কেটে বাসে উঠে কাঙ্ক্ষিত সিটে বসে পড়লো আদিল।মনে মনে দোয়া করছে যেন খুব তাড়াতাড়ি বাস তার গন্তব্যের জন্য চলতে শুরু করে।

এরইমধ্যে আরো একবার সুলতানার কাছে কল করেছে আদিল। কল রিসিভ করতেই সুলতানা জানায়,

-রুশার শরীরের পোড়া অংশ গুলো ড্রেসিং করে কেবিনে দেয়া হয়েছে। তবে জ্ঞান ফিরে নি ; জ্ঞান ফিরে আসলেই তো রুশার আর্তনাদ শুরু হবে কারণ পোড়া অংশের জ্বলণ বেশি।

-সুলতানা,তুই রুশার দিকে খেয়াল রাখবি দোস্ত, আমি না আসা পর্যন্ত। ওর জ্ঞান ফিরে আসলে ও পোড়া জায়াগার যন্ত্রনা সহ্য করতে পারবে না।

-তুই কি ঢাকায় আসছিস!

-হ্যা, আমি আসছি।

-কিন্তু?

সুলতানার পুরো কথা সম্পুর্ন না শুনে কল কেটে দিলো আদিল।ততক্ষণে, বাস চলতে শুরু করেছে।

———————-

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো আয়াত-কাজল দম্পতির। আজ আয়াতের মন ভীষণ রকমের আনন্দিত। কারণ, তার জায়া আজ মনের অনুভূতি প্রকাশ করেছে। আয়াত যখন কাজলকে জিজ্ঞেস করলো,

-কাজল,আমাকে ঠিক কতখানি ভালোবাসতে পেরেছো?সত্যি কথা বলবে কারণ আমি মিথ্যা শুনতে পছন্দ করি না।

কাজল,আয়াতের দিকে তাকিয়ে রইল,সে তো আয়াতের সামনে অন্য কথাগুলো বলে মেপে মেপে আর এখন কি না ভালোবাসার কথা বলতে হবে!

-কি হলো,বলবে না? সত্য কথা বলবে মিথ্যা বলবে না। আমাকে খুশি করার জন্য তুমি মিথ্যার আশ্রয় নিবে না।

-আজই বলতে হবে!অন্যদিন বললে হবে না।

কাজলের বাচ্চা বাচ্চা কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকালো আয়াত। কাজল, আয়াতের বড় বড় চোখ দেখে ভয়ে ভয়ে বললো,

-দেখুন, আপনি কিন্তু আবার বলবেন না যে আমি মিথ্যা বলছি।

-বলো, তুমি। আমি তোমার কথা শুনছি কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা আমি শুনলেই বুঝতে পারবো?

কাজল একটানে জোড়ে শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,

-আয়াত,আপনি আমার কাছে ছিলেন সবচেয়ে বিরক্তিকর একজন মানুষ। বিয়ের পর যে ক’মাস আপনার সাথে আমি সজ্ঞানে ছিলাম চেষ্টা করতাম আপনার সাথে মিলেমিশে থাকতে কিন্তু ব্যর্থ হতাম বারংবার।চেষ্টায় সফল হতে না পেরে আমাদের বাড়িতে চলে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পর দেখলাম, বাড়িতে আব্বা নেই, ফাহিমা খালা নেই।একা একা ড্রইংরুমে বসে রইলাম । হঠাৎ, করেই জায়ানের কথা মনে পড়ল।আমি ঠিক যে সোফায় বসে ছিলাম সে তো এই জায়গাটিতে বসেছিল।সে তো এই জায়গায় বসেছিল আমাকে তার বঁধু বানিয়ে নিয়ে যাবার সমাচার নিয়ে। কিন্তু,তাকে নিয়ে আমার যত ভ্রম ছিল সে নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছিল।তার সাথে আমার চারবছরের যত ভালোবাসাময় সংলাপ ছিল সে এক নিমিষেই তার এক বাক্য দিয়ে নিজ হাতে শেষ করেছে। আমি কালো, এইটাই ছিল আমার প্রতি তার অভিযোগ। তার সাথে আমার সর্ম্পক চলাকালীন চারবছরে বহুবার দেখা হয়েছে, কই তখন সে দেখেনি আমার গায়ের রঙ কালো?
এগুলো ভাবতে ভাবতে এরপর যে কি হলো আমার আর কিছুই মনে নেই।কিভাবে যেন বিধাতা আমার উপর রহম করল?আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে লাগল।জায়ানের থেকে পাওয়া ধোঁকা,সেই ধোঁকার রেশ থেকে আপনাকে অবহেলা করা। জানেন,আমার মনে অনেক কষ্ট আম্মা যেদিন মারা গেলো সেদিন রাতের খাবারের সময় আমাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়েছিল।অথচ, সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার আম্মা চিরতরে ঘুমের রাজ্য প্রবেশ করেছেন।আব্বা যদি সেদিন আম্মার সাথে ওমন না করত তবে আমার আম্মা আমার পাশে থাকতো, আমার ভাই আমাদের সাথে থাকতো।
রুশা, সে আমাদের বাড়িতে আসার পর বুঝলাম, পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মেয়ের কিছু না কিছু সুপ্ত বেদনা থাকে, যেগুলো তাদের দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকে।কজন জানে তাদের হৃদয়ে কত দুঃখ জমে আছে! আমি কালো তাই জায়ান আমাকে ছেড়ে চলে গেলো,রুশার মেয়ে হবে তাই ওর শ্বাশুড়ি, স্বামী মিলে ওকে মেরে বাড়ি থেকে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বের করে দিলো।
থাক সেসব কথা এখন আপনার প্রসঙ্গে আসি,
আপনি বললেন না, আমি আপনাকে ভালোবাসি কি না? আমি আপনাকে ভালোবাসার চেয়ে সম্মান করি। আপনাকে আমার জীবনের সবচেয়ে উচ্চ স্থানে রেখেছি, যে আমার মতো একটি কালো, কুৎসিত, ভারসাম্যহীন মেয়েকে বিনা লাভে ভালোবেসেছে,অপেক্ষা করেছে সে জন্য।সম্পর্কে পাহাড়সম ভালোবাসা থাকলে কি হবে যদি সম্মান না থাকে! আমি আপনাকে আমার মতো করে ভালোবেসেছি, ভালবাসছি, ভালোবাসবো নূর আহমেদ আয়াত। এই জনমে আর কারও বুকে মাথা পেতে হৃৎস্পন্দন শুনো মোহিত হতে চাই না আমি শুধু আপনার বুকে মাথা পেতে আপনার প্রত্যেকটি হৃদস্পনন্দনের সংখ্যা গুনে রাখতে চাই।
আমি আপনার ভালোবাসাকে সম্মান করে আপনাকে ভালোবাসি।

আয়াত এতক্ষণ ধরে কাজলের প্রত্যেকটি কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে।তার জায়া’র জীবনে অনেককিছু ঘটেছে সে জানে কিন্তু তার মনে যে এতটা কষ্ট জমে ছিলো জানতো না। তাকে তার জায়া ভালোবাসে।এরচেয়ে সুখকর সংবাদ আর কি আছে পৃথিবীতে!

কাজলের সামনে যেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে কাজলের হাঁটুতে মাথা রেখে আয়াত বলছে,

-কাজল,তোমার শারীরিক বর্ননা শুনে আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই নি। আমি তোমার গুন দেখে, তোমার শিক্ষার মান দেখে তোমাকে নিজের বাবা-মা’র পর সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ স্থানে আমার হৃদয়ের ঘরে তোমায় ঠাঁই দিয়েছি।তুমি জানো তুমি কালো দেখে তোমাকে সুন্দর লাগে। তুমি যদি ধবধবা ফর্সা হতে তোমাকে কিন্তু একটুও সুন্দর দেখাতো না। এই যে তুমি মাঝে মাঝে মিস্টি করে ভয় ভয় চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো, তখন সেই দৃশ্য আমার কাছে হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা চমৎকার একটি মূহুর্ত।আমি তোমার জীবনে কোনো কিছুর কমতিও রাখব না বিনিময়ে শুধু আমায় একটু ভালোবাসা দিও। জানো, সেই চারটি বছরে ঠিক কয়টি রাতে ঠিক ভাবে ঘুমিয়েছি বলতে পারি না। শুধু তোমার দুশ্চিন্তায়, মনে হতো এই বুঝি তুমি সুস্থ হয়ে আমায় ভুলে গেলে। কিন্তু, না তুমি ভুলে যাও নি।
আজ ঠিক এখন,এই মূর্হত্ব থেকে আগের সব পুরনো স্মৃতি চাপা দিয়ে নতুন দিনের সূচনা করো। যেখানে শুধু তুমি আমি মিলে আমরা হবো।

কাজল এক প্রাপ্তির হাসি হেঁসে আয়াতের চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো।আয়াত হেসে কাজলের হাত ওর মুঠোয় নিয়ে হাতের উল্টো পিঠে
চুমু দিল সশব্দে।

আচমকা, মোবাইল বেজে উঠতেই কল্পনার দেশ থেকে বের হয়ে এলো আয়াত। হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। আবার কল আসতে কল রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_১৭
#Tahmina_Akther

-হ্যালো,আপনি কি নূর আহমেদ আয়াত?

-জি,আমি নূর আহমেদ আয়াত।

-রুশা হাসানের অভিভাবক কি আপনি?

-জি,আমি।রুশার কি হয়েছে?

-আমি রুশার ম্যাম ডা. সুলতানা তমা বলছি।আসলে রুশাকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে এডমিট করা হয়েছে। কাইন্ডলি,আপনি যদি হসপিটালে আসতেন?

আয়াতের পুরো শরীর অজানা আতংকে কেঁপে উঠলো। কোনোভাবে মুখ দিয়ে হু শব্দ করে কল কেটে দিল।এরপর, তাড়াতাড়ি করে কাপড় চেঞ্জ করে তড়িঘড়ি বের আসতে নিবে এমন সময় কাজল পিছু থেকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে, কে কল করলো? যে এতরাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছো?

-কাজল,রুশাকে নাকি বার্ণ ইউনিটে এডমিট করা হয়েছে।আমাকে ওর ম্যাম কল করেছে। আমাকে যেতে হবে এখন। তুমি দরজা লক করে শুয়ে পড়ো।আমি বাড়ি ফিরে আসলে কল করব তোমাকে।

-আমিও যাব আপনার সাথে।

-না, তোমার এতরাতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কাল সকালে যেয়েও এখন আমার রুশার কাছে যাওয়া বেশি প্রয়োজন।

বলে আয়াত বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।আর কাজল দ্রুত ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে লাগলো।

আয়াত তার বাইক নিয়ে চললো হসপিটালের উদ্দেশ্য। হসপিটালে পৌঁছাতে বাইক পার্ক করে রুশার ম্যামের নাম্বারে ডায়াল করলো আয়াত। ওপাশ থেকে রিসিভ হতে আয়াত জিজ্ঞেস করলো,কত নাম্বার রুমে আছে রুশা। তখন ডা.সুলতানা উনাকে বলে দিলেন কোথায় আসতে হবে?

আয়াত সেখানে যেতেই দেখলো নাজ সহ আরো অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। আয়াত এগিয়ে গেলো নাজের দিকে। নাজের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আয়াতকে দেখে কান্না করে ফেললো নাজ। আয়াত নাজকে অভয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে, রুশার?

-আসলে,মি.আয়াত রুশার গায়ে কিছুটা আগুনের আঁচ লেগেছে।
ডা.সুলতানা বলে উঠলো আয়াতের উদ্দেশ্য।

-কিন্তু, আগুন ওর শরীরে লাগলো কিভাবে?আর তোমরা ছিলে কোথায়?
নাজকে উদ্দেশ্য করে বললো আয়াত।

-আয়াত ভাই,আসলে আমরা সুলতানা ম্যামের বিয়ের উপলক্ষে উনাদের বাড়িতে যাই আজ দুপুরের পরে।রাতে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে আমরা সকলে বাড়ির আঙিনায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। রুশার যে পাশে বসে ছিল,সেখানে দিয়া রাখা ছিল ও খেয়াল করে নি। কিভাবে যেন ওর শাড়ির আঁচল সেই দিয়ার উপর পড়ে আর সেখান থেকেই আগুন লেগে যায় ওর শাড়ির আঁচলে।আল্লাহ সহায় ছিলেন আমরা ওর চিৎকার শুনে পাশে থাকা সুইমিং পুল থেকে ওর শরীর পানি ঢেলে দেই,আগুন ওর পুরো শরীরে ছড়াতে পারেনি। কিন্তু, ততক্ষণে রুশা ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

-ওর কোমড় থেকে পা পর্যন্ত আগুনের আঁচ লাগাতে শরীরে এই অংশটুকু প্রায় ফোসকা পড়ে গেছে। রুশার জ্ঞান ফিরে এলে পরবর্তী করনীয় কি হবে ডক্টর আমাদেরকে বলে দিবেন।

ডা.সুলতানা বললো আয়াতকে।আয়াত সব শুনে শুধু এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মনে মনে বললো,

-আর কত কষ্ট পাবে মেয়েটি! মা-বাবা হীন এতিম,স্বামী বের করে দিল বাড়ি থেকে, সন্তানহারা, আর এখন কিনা শরীরের মাঝে নতুন করে ঘায়ের দাগ হয়ে হয়ে গেল!সবই উপর ওয়ালার ইচ্ছে নয়তো একজীবনে একটি মানুষের এত কষ্ট থাকবে কেন?

————-

দীর্ঘ আট ঘন্টার জার্নির পর বাস থেকে নেমে পড়লো আদিল।তিনবছর পর ঢাকায় এলো,অথচ এই ঢাকা থেকে সে চলে গিয়েছিল কারণ তার কোনো পিছুটান ছিল না। কিন্তু, কে জানতো অতীতের পিছুটানে আবারও ফিরতে হবে তার জন্মস্থানে।

বাস থেকে সিএনজি চললো ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্য। হসপিটালে পৌঁছাতে সিএনজির বিল মিটিয়ে এগিয়ে চললো বার্ণ ইউনিটের দিকে। কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর আদিলের মোবাইলে কল এলো। মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখলো, সুলতানা কল করেছে। রিসিভ করে বললো,

-হ্যালো,সুলতানা আমি হসপিটালের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। কত নাম্বার রুমে আছে রুশা?

-তুই কই আছিস সেটা বল আমি আসছি?

-আমি নিচে আছি।

-দাঁড়া তবে আমি আসছি।

পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর সুলতানা এলো।সুলতানা দূর থেকে আদিলকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। আসলে,অনেকটা শুকিয়ে গেছে আগের মতো চেহারায় সেই আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। আগের থেকে যেন চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব বেড়ে গেছে। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো বন্ধুর সামনে।

আদিল সুলতানাকে দেখে মলিন কন্ঠে বললো,

-সুলতানা, ও কেমন আছে রে?

আদিলের কন্ঠে যেন একরাশ কান্নারা লুকিয়ে আছে যে কোনো মূহুর্তে তারা বের হয়ে আসতে চাইছে কিন্তু আদিলের বাঁধায় তারা আসতে পারছে না।

-তোর ও এখন ভালো আছে। আয় তোকে নিয়ে যাই দেখবি না তোর মাধুর্যকে?

আদিল মাথা নেড়ে চললো সুলতানার পিছু পিছু। মনে একরাশ উৎকন্ঠা বিরাজ করছে আদিলের। ঠিক কতকাল পর তার মাধুর্যকে সামনে থেকে দেখবে। তার তৃষ্ণার্থ আঁখিযুগল পাবে একটুখানি শান্তি।

কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই সুলতানা আর আদিল দেখলো কেউ নেই। সুলতানার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিল।সুলতানা আদিলের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বললো,

-আসলে,গতকাল রাত থেকে অনেকে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে সকাল হয়েছে আর আমি ওদের বিদায় করে দেই।

-বেশ করেছিস তবে রুশার পরিবারের কেউ আসে নি?

-এসেছে তো ওর হসপিটালের ফর্মালিটিতে অভিভাবকের জায়গা নূর আহমেদ আয়াত নামের একজনের নাম দেয়া ছিল। আমি সেই নাম্বারটি আমার মোবাইলে সেভ করে রেখে দিয়েছিলাম। কে জানতো এই নাম্বার এত শীঘ্রই কাজে লাগবে!

আদিল মনে মনে ভাবেছে এই নাম তো বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। আমি যার কথা ভাবছি সে নয় তো!
যদি সে হয়ে তবে তার সঙ্গে রুশার কি সম্পর্ক?আর ওর মামা-মামী কি ওর সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি?

-কি রে যা ভিতরে। রুশা এখন ঘুমিয়ে আছে টুক করে গিয়ে দেখে আয়। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

আদিল মাথা নাড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করলো কেবিনে।রুশা শুয়ে আছে তবে ওর কোমড়ের অংশ থেকে পা পর্যন্ত পুরোটা অংশ কাপড় দিয়ে উঁচু করে ঢেকে রাখা হয়েছে।

রুশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আদিল। গাঢ দৃষ্টিতে তাকালো তার প্রিয়ংবদা মাধুর্যের দিকে। ঠিক কতবছর পর এই আদল খানি দেখল?কতশত রাত মাধুর্যের ছবির পানে চোখ ভরা জল নিয়ে চেয়ে থাকতো আর কখন যেন সেই চোখের পানি গড়িয়ে বালিশে গিয়ে পড়তো।

তার সাথে নতুন করে দেখা হবে এই আশা সে কখনোই করে নি কিন্তু বিধাতার বুঝি অন্য চাওয়া ছিল নয়তো হারিয়ে যাওয়া প্রিয় জিনিস এত কাছে এলো কি করে?
আগের থেকে কত বড় দেখাচ্ছে তার মাধুর্যকে। আচ্ছা, ডান গালের এই জায়গাটি লাল হয়ে আছে কেন?

হাত দিয়ে ছুঁতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলো আদিল। তার মাধুর্যকে সে অধিকার ছাড়া স্পর্শ করতে পারে না নয়তো যে অপবিত্র হয়ে যাবে তার মাধুর্য। তাকে মনে করার প্রত্যেকটি ক্ষণে সে কখনো কল্পনায় তার মাধুর্যকে স্পর্শ করতে চায় নি। শুধু চেয়েছিল কোনে এক পৌঁষের শীতে সেই মেলায় যেয়ে এক গুচ্ছ চুড়ি তার মাধুর্যের হাতে পড়িয়ে দিবে। মাধুর্যের প্রত্যেকটি পদে তার চুড়ির শব্দ দূর থেকে শুনে মনকে করবে আনন্দিত।

হুট করে কেবিনের দরজা খুলে কে যেন ভিতরে প্রবেশ করলো।আদিল ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো অতি পরিচিত একটি মুখ।

আয়াত নিচে গিয়েছিল কিছু ঔষধপত্র আনতে। কেবিনের সামনে এসে দেখলো সুলতানা ম্যাম দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে কিছু না বলে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করলো আয়াত কিন্তু পিছন থেকে হয়তো একবার ডাক দিয়েছিলো ডা. সুলতানা ।

কেবিনে প্রবেশ করতে দেখতে পেলো এক আগন্তুক আগে থেকে এই রুমে অবস্থান করছে। রুশার বেডের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।যখন দেখলো ও কেবিনে এসেছে তখন ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে একপ্রকার দৌঁড়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো সেই আগুন্তক।

এইদিকে, আয়াত যেন স্থির হয়ে রইল। কে ছিলো এই আগুন্তক? আর রুশার শিয়রের পাশে বা কি করছিল?তবে কি রুশার খুব পরিচিত কেউ?

-চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here