#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_২২
#Tahmina_Akhter
-আচ্ছা, পুতুল তোমার কখনো জানতে ইচ্ছে হয়নি আমাদের পরিবারের লোকজনের ব্যাপারে?
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রুশাকে প্রশ্ন করলো কাজল।রুশা কাজলের দিকে পাশ ফিরে বললো,
-মন তো জানতেই চায় কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে সবকিছু জানতে হয় না, আপু।
-কিন্তু, আমি তোমাকে আমার পরিবারের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সম্পর্কে বলতে চাই।
-বলো তবে। আমি শুনছি।
-আমরা কিন্তু দু’ভাইবোন। ভাইয়া বড় আর আমি ছোট। ভাইয়া ছোট থেকে একটু চাপা স্বভাবের তাই আম্মার সাথে ভাইয়ার সখ্যতা খুব বেশি ছিল।
ভাইয়া যখন মেডিকেলে চান্স পেলো তখন আব্বা-আম্মা,আমি সে কি খুশি!এইচএসসি পরীক্ষার পর মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য ভাইয়া দিনরাত এক করে পড়াশোনা করেছিল তাই ভাইয়াকে ক’দিনের জন্য আমার আম্মা কুমিল্লায় আমার নানুর বাড়িতে বেড়াতে পাঠিয়ে দেয়।কিন্তু, সেখান থেকে আসার পর আমার গম্ভীর ভাইটা আরও গম্ভীর হয় গেল।আমি তখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী।
হুট করে একরাতে ভাইয়া আমার রুমে এসে বলতে লাগল,
-টুকি,আমি না তোর জন্য একটি ভাবি খুঁজে রেখেছি যদি তোর পছন্দ হয় তাহলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসব, ভালো হবে না?
-অনেক ভালো হবে ভাইয়া কিন্তু ভাবি থাকে কোথায়?
-এই যে তোর ভাইয়ার বুকের বা’পাশটা দেখছিস না, এখানেই তোর ভাবি থাকে। একদিন সময় করে বুকের ভিতর থেকে বের করে এনে তোকে দেখাবো। এখন আসি আমি পড়া অনেক বাকি।
এইদিকে আমি ভাইয়ার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম কারণ আমার ভাইয়ের মুখে জীবনেও মজার কথা শুনলাম না, সেখানে সাহিত্যিক ভাষায় আমার ভাবি কোথায় আছে সেটি বর্ননা করে দিয়ে গেলো আমার কাছে।
এরপরের ক’বছর ধরে ভাইয়ার মুখ থেকে প্রায়ই ভাবির কথা শুনতাম। কখনো বলতো তোর ভাবিকে না বিয়ের সময় গাঢ় সবুজ রঙের লেহেঙ্গা কিনে দিবো দেখবি এই কালারে তোর ভাবিকে আরও সুন্দর দেখাবে।আবার কখনো বলতো আচ্ছা টুকি তোর ভাবিকে আমি আপন করে পাবো তো?
আমি নিরব শ্রোতা হয়ে ভাইয়ার কথাগুলো শুনতাম।
ভাইয়ার সামনে এমবিবিএস ফাইনাল প্রফ পরীক্ষা কিন্তু, সে কোনোভাবে পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছিল না। ভাইয়া উপায় না পেয়ে আম্মাকে গিয়ে তার পছন্দের মেয়েটির কথা জানালো। আম্মা শুনে বেশ খুশি হয়েছিলেন। ভাইয়াকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন ঠিকমতো পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা শেষ হলেই আব্বার সাথে কথা বলবেন।
ভাইয়ার যেদিন ফাইনাল প্রফ শেষ হলো সেদিন একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে কুমিল্লায় ছুটে যায় কারণ অনেকদিন হয়ে গিয়েছিল সেই মেয়ের সাথে ভাইয়ার দেখা না হওয়ার। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভাইয়া জানতে পারলো, উনার ভালোবাসার মানুষের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
আমার কাছে কল করে সে কি কান্না আমার ভাইটার! কিন্তু, সে রাতে কি হয়েছিল জানো আমার আম্মা কাকতালীয়ভাবে সেই রাতে মারা গেলেন। আমার ভাইটা যখন জানতে পারলো, আম্মা মারা গেছে সে এই ধাক্কা সামলাতে পারেনি অচেতন হয়ে যায়।মামারা মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার অচেতন ভাইটাকে নিয়ে ঢাকায় আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়। আমার ভাইয়ের হাতের একমুঠো মাটি আমার আম্মার কবর পৌঁছায়নি।
জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে আমার ভাইটা জড়বস্তুর ন্যায় একদিকে তাকিয়ে বসে থাকতো। একদিকে আমি মা হারিয়েছি অন্যদিকে আমার ভাইটা একইদিনে নিজের জন্মদাত্রী জননীকে এবং ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছে।
ধীরে ধীরে সময় যেতে লাগল ভাইয়া সুস্থ হতে লাগল।কিন্তু, একরাতে আব্বা আর ভাইয়ার চেঁচামেচি শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
উঠে গিয়ে আব্বার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে শুনতে পেলাম আমার ভাইয়া বলছিল,
-আব্বা, শুধুমাত্র আপনার অহংকারের জন্য আজ আমি আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছে সাথে আমার আম্মাকেও।
-আমি আবার কোথায় অহংকার করলাম? তুমি যে মেয়েটিকে পছন্দ করেছো তার কি আছে? না আছে বাবা-মা, না আছে যোগ্যতা। ডা.রায়হানের ছেলে কি না বিয়ে করবে চালচুলোহীন গরীব ঘরের মেয়েকে! হাসালে আমায় তুমি?
-আব্বা,আপনি একদিন বুঝবেন আপনি কি হারিয়েছেন? আমার আম্মার কি অপরাধ ছিল? আপনাদের না প্রেমের বিয়ে ছিল কিভাবে পারলেন ছেলের অপরাধের শোধ নিতে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে?আমার আম্মা আপনার থেকে এই আচরণ মোটেও কামনা করে তাই বুঝি আমার মা আর চাপ নিতে পারেনি হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেলো। আমার মায়ের মৃত্যুর পিছে আপনি দায়ি আমি দায়ি। যদি না আমি আমার ভালোবাসার মানুষটার জন্য আম্মার কাছে আবদার করতাম আর না আম্মা আপনাকে এসব কথা বলতো আর আপনি অহংকার নিয়ে নাক উচু করে আমার মায়ের গায়ে হাত তুলতেন আর না কটু বাক্য শোনাতেন।
আমি আর এক মূহুর্তের জন্য এই বাড়িতে থাকবো না। আজ থেকে আমি আপনার কেউ না, এই শহরের গলিতে যদি কখনো আপনার সাথে আমার দেখা হয়ে যায় তবুও আমায় পিছু ডাকবেন না।
ভাইয়া সেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল অনেক আকুতি-মিনতি করেও তাকে আটকাতে পারিনি।
সেদিনের পর থেকে আব্বার প্রতি আমার রাগে-অভিমান বেড়ে গেলো। আমার আম্মা-আব্বার বিবাহিত জীবনে নাকি তারা কখনো ঝগড়া করেনি সেখানে ছেলের পছন্দের কথা বলতে গিয়ে স্বামী গায়ে হাত তুলল কটু বাক্য শোনালো এই কথাটি আমার আম্মা সহ্য করতে পারেনি, সে রাতে ঘুমের ঘোরে মারা যায় হার্ট এ্যাটাকে। এইসব কথা আমি জানতে পারি আমার ভাইয়ের ডায়েরি থেকে। সেখানে তার ভালোবাসার মাধুর্যের সাথে প্রথম সাক্ষাত থেকে শুরু করে বিচ্ছেদ পর্যন্ত সব ঘটনা লেখা সাথে মাধুর্যের একটি ছবি। ডায়েরির শেষের পাতায় আম্মার সাথে ঘটে যাওয়া কথাগুলো লেখা ছিল হয়তো ভাইয়া চেয়েছে আমিও যেন জানতে পারি এই ব্যাপারটা।
আজ কতবছর হয়ে গেলো আমি আমার ভাইটাকে স্বচোক্ষে দেখি না।
বলেই হু হু করে কেঁদে উঠলো কাজল। যেন আজ বহুদিনের চেপে রাখা দুঃখগুলো অনায়াসে একজনের কাছে জমা করতে পেরেছে।
রুশা ঠিক কি বলে সান্ত্বনা দিবে কাজলকে বুঝতে পারছে না তবে ভীষণ খারাপ লাগছে কাজল আপুর ভাইটার জন্য। না জানি কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন উনি! না পেলো ভালোবাসার মানুষকে আর না রইল মা নামক শান্তির জায়গা।
-আপু, তোমার ভাই এখন কোথায়?
-সে আছে এই শহরে।
-তোমার ভাইকে কখনো দেখতে ইচ্ছে করে না?
-হয় তো। কিন্তু, আব্বার জন্য ভাইয়ার সাথে দেখা করি না। জানো, আব্বা ভিতরে ভিতরে গুমরে কাঁদে আম্মার জন্য, ভাইয়ার জন্য। অনুশোচনায় ভুগেন কেন সেদিন তিনি তার অহমিকা ত্যাগ করেননি। যদি করতেন তবে আজ উনার হাসিখুশি একটি পরিবার থাকতো।
বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে রুশাকে উদ্দেশ্য করে কাজল বললো,
-আচ্ছা, পুতুল তোমার জানতে ইচ্ছে করে না আমি কেন তোমায় আসল নামে না ডেকে পুতুল নামে সম্বোধন করি? আচ্ছা, আমার ভাইয়ের ছবি দেখবে, ছয়মাস আগে ফেসবুকে আপলোড করেছিল সেখান থেকে আমার মোবাইলে সেইভ করে রেখেছি, এই দেখো।
বলেই রুশার দিকে মোবাইল তাক করতেই দেখতে পেলো রুশা ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজল,হেসে বললো,
-আজও তোমায় জানাতে পারলাম না তুমি আমার ভাইয়ের অনেক সাধনার মাধুর্য। যাকে চাইতে গিয়েও আমার ভাইয়ের হাত আজ শূন্য।
———————
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন আপনি?
-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো রিধিমা?
-এই তো ভালো আছি, আদিল স্যার।
-আচ্ছা, রিধিমা রুশা হাসান আজ আসে নি?
-নো স্যার, ও আসেনি। ও আগামীকাল থেকে আসবে।
-আচ্ছা, রিধিমা রুশার অভিভাবক নামে যেই ব্যক্তিটি আছে তার সাথে রুশার সম্পর্ক কেমন ধরনের?তুমি,জানো কিছু ?
-আসলে, স্যার রুশাকে মাঝে মাঝে নিতে আসে ওই লোকটি। হয়তো তারা সম্পর্কে আছে শুনলাম, ক্লাসের প্রায়ই অনেকেই এই কথাগুলো বলে।
রিধিমার কাছে থেকে কথাগুলো শুনে রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠলো আদিলের তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-তুমি রুশার বাড়ির ঠিকানা জানো?
-আমি জানি না তবে মিসবাহ জানে। ওর কাছে থেকে এ্যাড্রেস নিব, স্যার?
-কল করে জলদি ঠিকানাটা নিয়ে আমাকে দাও।
রিধিমা মিসবাহর কাছে কল করে রুশার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে আদিলের কাছে দিল। আদিল ঠিকানা জানার পর বারকয়েক মুখে উচ্চারণ করে গাড়িতে গিয়ে বসলো, উদ্দেশ্য কুঞ্জ বাড়িতে।
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_২৩
#Tahmina_Akther
ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় অতৃপ্ত হৃদয়ে বিশুদ্ধতায় ছেয়ে যায়।এই ভোরের সময়টাতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি থাকে সন্তুষ্ট। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিরা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আরামের ঘুম,আয়েশের বিছানা ছেড়ে পাক-পবিত্র হয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লার সম্মুখে দাঁড়িয়ে পড়েন জায়নামাজ বিছিয়ে। সেই মুমিন মুত্তাকিদের পবিত্র শ্বাসে ভোরের বাতাসে থাকে অকৃত্রিম নেয়ামত যাতে থাকে না আল্লাহর নাফরমান বান্দাদের উপস্থিতি। তারা যে সারারাত দুনিয়ার মোহ-মুগ্ধতায় ডুবে থেকে শেষরাতে যায় বিশ্রাম নিতে। তারা কি জানে ভোরের আলো ফোঁটার আগে তাদের রব তাদের জন্য অপেক্ষা করে অফুরন্ত নিয়ামত-রিজিক নিয়ে।আফসোস, অনেকেই আমরা জেনেও মানতে চাই না আর অনেকেই জানি না বা জানার চেষ্টা করি না।
নামাজ শেষ করে বারান্দায় বসে উপরোক্ত কথাগুলো ভাবছিল কাজল।আজ রাতে আর ঘুম আসেনি কাজলের। যখন দেখলো রুশা ঘুমিয়ে পড়েছে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো তখন সময় রাত সাড়ে তিনটা। তাই আর না ঘুমিয়ে ওযু করে এসে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে নিলো।নামাজ শেষ করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে যেন, তার ভাইটা যেখানে আছে সেখানে যেন ভালো থাকে। যদি তার ভাইয়ের জন্য রুশা উত্তম হয় তবে যেন অতিশীঘ্রই ওদের দু’জনের চার হাত মিলিয়ে দু’হাত করে দেয়। আর যদি নাইবা তার ভাইয়ের রিজিকে রুশা না থাকে তবে যেন রুশার মায়া কাটিয়ে তার ভাই সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে।
এরপরে, ফজরের আযান দিতেই নামাজ আদায় করে বারান্দায় বসে বসে নানা রকম চিন্তা-ভাবনায় ডুবে ছিল কাজল।হাতে থাকা মোবাইলটি ভাইব্রেট হতেই কাজল ভাবনার শহরে থেকে বের হয়ে এলো।
আয়াত কল করেছে, এত ভোরে আয়াতকে কল করতে দেখে ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে কল রিসিভ করল,
-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।জায়া?
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। এত ভোরে কল করেছেন? কি হয়েছে আপনার শরীর খারাপ? বাসায় আসবো আমি?
-আরে বাপরে, একসাথে কত প্রশ্ন করলে! আরে গতকাল তো তোমার সাথে কাজের ব্যস্ততায় কথা বলতে পারিনি তাই তোমার ভাবনায় আমার সারারাত একক্ষণের জন্য চোখ লাগাতে পারিনি। তাই এইসময়ে তোমাকে কল দেয়া, কারণ আমি তো জানি এইসময় আমার জায়া ঘুম থেকে জেগে নামাজ পড়বে এরপর বারান্দায় গিয়ে বসে বসে কি যেন ভাবতে বসবে, এইভেবে তোমায় কল করলাম,আর তুমি রিসিভ করে তোমার সুমধুর কন্ঠ শুনিয়ে আমার আজকের দিনটা ভালো করে দিলে, জায়া।
-ওহ হো, আজ জনাবের কথায় মিষ্টতা খুঁজে পাচ্ছি।ব্যাপার কি বলুন তো?
-আসল ব্যাপার হচ্ছে তুমি একটু নিচে তাকাও তাহলে বুঝতে পারবে।
কাজল আয়াতের কথা শুনে বারান্দার নিচে তাকিয়ে দেখলো, সকাল হবার আগে যে আবছা আলো সৃষ্টি হয় সে অস্পষ্ট আলোয়ে একটি মানুষের কালো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। কাজলের মুখবয়বে হাসির রেখা ফুঁটে উঠেছে। আয়াতকে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনি এসেছেন?
-হু,কাজল। আমি এসেছি। নিচে আসবে না, জায়া?
কাজল যেন এই কথাটির অপেক্ষায় ছিলো,মোবাইল হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে সদর দরজা খুলতে যাওয়ার আগে কে যেন পিছন থেকে কাজলের নাম ধরে ডাকলো?
কাজল,পিছনে তাকিয়ে দেখলো রায়হান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। হয়তো নামাজ শেষ করে নিচে এসেছিলেন।
কাজল, মাথা চুলকিয়ে আমতাআমতা করে বললো,
-আসলে,আব্বা আপনাদের জামাই এসেছে। নিচে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রায়হান সাহেব মেয়ের কথা শুনে মুচকি হেঁসে বললেন,
– যা তাড়াতাড়ি আয়াতকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আয়, দেখেছিস সকালে কেমন শীত শীত অনুভুত হয়, পরে ছেলেটার ঠান্ডা,জ্বর লেগে যাবে।
কাজল লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারলো না ওর আব্বার দিকে। এক দৌঁড়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে মেইনে গেট পেরিয়ে আয়াতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল।
আয়াত মেইন গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল আর অপেক্ষা করছিল। না জানি কখন তার জায়া বাড়ি থেকে বের হয়ে আসবে?
হঠাৎ, এক নারী ছায়ামূর্তি মেইন গেট খুলে দৌঁড়ে ওর সামনে এসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল।
আয়াত অপেক্ষা করছে কখন তার দিকে মুখ তুলে চাইবে,জায়া ?
একটু স্বাভাবিক হতেই মুখ তুলে তাকালো কাজল। দু’জোড়া চোখের মিলন ঘটলো। মনে হচ্ছে কতকাল ধরে এই চোখের মাঝে ডুব দেয়া হয় না। কাজল ওই চোখে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলো না, কেমন যেন এক অদ্ভুত শিহরণে পুরো শরীরে কাঁপন ধরে যায়!
আর,আয়াত সে তো পলকহীন দৃষ্টিতে তার জায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামলা দাগহীন চেহারা,ডাগরআঁখি,ঘন পাপড়িযুক্ত চোখ,চকলেট বর্ণের ঠোঁট জোড়া যেন বহুকাল ধরে দেখা মেলেনি আয়াতের।
অথচ,তাদের ক্ষণিকের বিচ্ছেদের সময়কাল পনেরো ঘন্টা। এই পনেরো ঘন্টা যেন পনেরো দিনের সময় অতিক্রম করেছে। কাজলের, ডানহাতটি আলতোভাবে নিজের মুঠোয় নিয়ে কাজলকে নিজের বুকে টেনে নিলো, আয়াত।
কাজল,আয়াতের বুকে ঘাপটি মেরে আছে। ধুকপুক শব্দ কানে এসে ঠেকছে কাজলের। কাজল, একবার মাথা তুলে আয়াতের দিকে তাকাতে চাইলেও আয়াতের বাঁধা পেয়ে আর মুখ তুলে তাকাবার সাহাস করেনি।
আয়াতের বুকে মাথা রেখেই কাজল জিজ্ঞেস করলো,
-কি হয়েছে, আয়াত?
-কি হবে আবার?
-না মানে,এইভাবে জরিয়ে ধরে রেখেছেন আমায়?
-কেন,আমার স্ত্রীকে জরিয়ে ধরলে তোমার সমস্যা হয় নাকি?
আয়াতের কথা শুনে কাজলের মুখে তালা লেগে।মানে কি? আমাকে জরিয়ে ধরা মানেই তো উনার স্ত্রীকে জরিয়ে ধরা,উনি কি না বলছেন আমার সমস্যা!
কাজল নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আয়াতের বাহুডোর থেকে। এরপর, লম্বা কদম ফেলে বাড়িতে ঢুকে পড়লো।
আয়াত বুঝতে পারলো তার জায়া রাগ করেছে। এখন রাগ তো ভাঙতেই হবে, কি আর করা ধীরপায়ে কুঞ্জ বাড়িতে প্রবেশ করলো আয়াত।
—————————-
আজ সকালে হসপিটালে জয়েন দেয়ার পর নিজের চেম্বারের দিকে যাচ্ছিলো আদিল কিন্তু রিধিমার সাথে করিডরে দেখা। কৌতূহল দমাতে না পেরে কাজলের অভিভাবকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে বসলো আদিল।কিন্তু, রুশার সাথে তার অভিভাবক আয়াতের সম্পর্ক আছে, এই বাক্যটি অনেক তিক্ত লেগেছিল আদিলের কাছে। যেন দুই কানে কেউ গরম সিসা ঢেলে দিয়েছে।
রুশা কোথায় থাকে?সেই ঠিকানা নিয়ে রওনা হলো কুঞ্জ বাড়ির উদ্দেশ্য।
আদিলের ভাগ্যে কি আছে কে জানে? কুঞ্জ বাড়িতে যাওয়া কি তার জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনবে নাকি ভাগ্যের মোড় ঘুরে যাবে?
————————
ড্রইংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন রায়হান সাহেব। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ হচ্ছে, কাজল সকালের খাবার তৈরি করছে।আয়াত,কাজলের পাশে দাঁড়িয়ে তার জায়ার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছিলো।
এরইমাঝে, কলিংবেল বেজে উঠলো। কাজল একবার আয়াত মুখের দিকে তাকাতেই আয়াত বুঝতে পারলো, ওর স্ত্রী ওকে হুকুম করছে গিয়ে দরজা খোলার জন্য।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে সদর দরজা খুলতে অতি পরিচিত এবং অপ্রত্যাশিত মুখ দেখলো আয়াত। নিজের দু’টো চোখকে অবিশ্বাস করছে আয়াত। কারণ, যাকে সে চোখের সামনে দেখছে সে কখনোই এই বাড়িতে আসবার কথা না।
মূহুর্তের মাঝে আয়াতের গালে থাপ্পড় মেরে বসলো আদিল। থাপ্পড়ের শব্দ শুনে রায়হান সাহেব একপ্রকার দৌঁড়ে গিয়ে দেখলেন একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে পরিচিত মনে হচ্ছে, মনে করার চেষ্টা করতে মনে পড়ে গেলো রায়হান সাহেবের। আর তখন উনার মুখ দিয়ে শুধু একটি নাম উচ্চারিত হলো,
“আদিল”
রায়হান সাহেবের মুখে আদিল নামটি এত জোরে উচ্চারিত হলো যে,কাজল নামটি শুনে রান্না করা বন্ধ দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেলো। গিয়ে দেখলো,আয়াত গাল হাত দিয়ে মাথা নিচু করে আছে আর ওর আব্বা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কালো শার্ট আর ব্লু জিন্স পরা একটি যুবকের দিকে।
কাজল সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো আর অস্পষ্ট মুখটি স্পষ্ট হতে লাগলো।কাজলের দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো।তার দোয়া বুঝি আল্লাহ পাক কবুল করেছেন। তাই বুঝি আজ তার ভাই আদিল রহমান স্বয়ং কুঞ্জ বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছে।
তবে কি, আয়াতের গালে থাপ্পড় ভাইয়া দিয়েছে?কিন্তু কেন?
#চলবে
#চলবে