শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ১০
রুমাইসার চোখ টা রাগে জ্বলজ্বল করে উঠল। ও চেচিয়ে বলল “আমি কি খেলার জিনিস নাকি আপনাদের ব্যবহৃত বস্তু? দুই ভাই যেভাবে খুশি সেভাবে আমাকে ব্যবহার করে যাবেন!!”
“নিজেকে এমনটা ভাবলে কার কি করার আছে।”
“আমি কাল সকালে এখানে আর এক মিনিট ও থাকব না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাব। ”
ইহান রুমাইসার কোমড়ে চেপে ব্যথা দিল। রুমাইসার মুখ দিয়ে শুধু গোঙানি বের হল। ব্যথায় রাগে কেঁদেই দিল রুমাইসা। “এখানে তুমি থাকবে এটা আমার অর্ডার। তুমি মানতেও বাধ্য কারন এখন লিগালি আমার ওয়াইফ তুমি। আর তুমি যেখানে ই যাও আমার থেকে পিছু ছাড়াতে পারবে না। সবাইকে বলব আমি তোমার হাজবেন্ড। তুমি আমার সাথে থাকতে চাও না।তোমার কি মনে হয় কেউ তোমাকে ভালো চোখে দেখবে। দ্বিতীয়ত আজ না হয় আমি ছিলাম তাই বেচে গেছ। কাল যদি কেউ না থাকে? এমনো তো হতে পারে ইহিতা কে কেউ মেরে দিল আর তুমি ধর্ষিতা হয়ে বেচে রইলে। তুমি কি সইতে পারবে? ”
প্রতিটা যুক্তি শুনে রুমাইসার শরীর শিরশির করে উঠছে। দুনিয়াটা এমন কেন। এতিম কে সবাই যে যার যার মত ব্যবহার করে। আজ বাবা মা থাকলে তো এ অবস্থায় ও কে ফেলে দিত না । ও এক পোড়া কপালিনী। রুমাইসার নিশ্চুপ চোখের পানিতেই মৌন সম্মতি ছিল। ইহান আর কিছু বলে নি। চুপচাপ ছেড়ে দিয়েছে।
রুমাইসা কে ফ্রেশ হতে বলে নিজে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ১ টা ঘন্টা পাগলের মত ওয়াশরুম এ কান্না করেছে রুমাইসা।আজ ওর সব হারিয়ে ফেলেছে। আজ থেকে প্রতি সেকেন্ড এ নিজের ভালোবাসার মানুষ কে অন্য কারো সাথে দেখবে। কতক্ষন সহ্য করে যাবে ও। ইহানের ডাকে বের হতে বাধ্য হল। শাড়ি ভিজিয়ে ফেলেছে অনেকটা। ইহান ওর দিকে তাকিয়ে বলল “রাতের বাজে ৩ টার কাছাকাছি, এখন শাড়ি ভিজায় কি করস। কাপড় কই পাব আমি এখন? ”
রুমাইসা অভিমান এর স্বরে তেজ দেখিয়ে বলল “লাগবে না কাপড়। আপনি ঘুমান। ”
“এই যে তেজ দেখানি,এই তেজ অন্য কারো সাথে দেখাবা। আমার সাথে এইসব দেখাতে আসবে না। আমাকে এখনো চিনো নাই। চিনবে আসতে আসতে। বারান্দায় আমার টাওয়াল আছে সেটা দিয়ে শরীর মুছে শুয়ে পড়। আর ইহিতা কে ধরবে না তুমি।”
রুমাইসা বিরক্ত হয়ে বলল “আমার মেয়েকে আমি কেন ধরব না।ফাইজলামি করেন আমার সাথে? ”
“ভেজা শরীরে ও কে ধরে কি ঠান্ডা লাগাবে তুমি। ধরবে না তুমি ও কে।তোমার শাস্তি কেন শাড়ি ভিজিয়ে ফেলেছ। শাড়ি শুকিয়ে তারপর মেয়ের কাছে আসবে। ”
রুমাইসার কান্না পাচ্ছে। এক দৌড়ে বারান্দায় ছুটে গেল। বারান্দার সাথেই লম্বা হাসনাহেনা ফুলের গাছ।ঘ্রানে মৌ মৌ করছে চারিদিকে । রুমাইসার এই নিস্তব্ধ পরিবেশ এ বসে কান্না করা ছাড়া আর কিছুর কথা মনে হল না। জীবন টা ও কে নিয়ে খেলছে। মানুষের জীবনের কিছু ভুল গুলো মানুষ কে প্রতি পদে পদে কাঁদায়। যেমন আজ রুমাইসার পরিস্থিতি। ভালোবাসার মোহে অন্ধ হয়ে রুমাইসা নিজের মান সম্মান ইজ্জত আশ্রয় আর ভালোবাসা সব ই হারিয়েছে।নতুন ঠিকানা একটুকু আশার আলো দেখিয়েও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। হাটুতে মুখ গুজে শুয়ে আছে। কান্না আসছে না বরং একাকীত্ব ও কে ঘ্রাস করছে।
সকাল বেলার কড়া রোদের আলো তে রুমাইসার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে ঠিক বুঝতে পারছিল না কই আছে ও। হুট করে ঘুম ভাঙায় মাথাও কাজ করছে না। চারিদিকে তাকিয়ে হালকা গোলাপি রং এর দেয়াল দেখে চোখ একদম খুলে গেল। তাকিয়ে দেখল বিছানায় শুয়ে আছে কাল রাতের লাল শাড়িটা পড়ে। ইহিতার কথা মনে আসতেই হাতের ডান দিকে তাকাল। ইহিতা ও নেই ইহান ও নেই।
বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় এপাশ ওপাশ খুজতে লাগল। কিন্তু কাউকে দেখছে না। ভয় লাগছে ওর।কিছু না ভেবেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। বের হতেই দেখল তৃষা বড় একটা ব্যাগ টানতে টানতে বের হচ্ছে আর সাহিল পেছন পেছন চেচাচ্ছে “তৃষা প্লিজ কোথাও যেও না প্লিজ তৃষা। ”
রুমাইসা ঠিক কি করবে আর কি বলবে বুঝতে পারল না। অভির সাথে ওর একবার চোখাচোখি হল কিন্তু অভির ওর দিকে কোন খেয়াল নেই। তৃষা কে আটকাতে ব্যস্ত। রুমাইসা আরেকটু আগাতেই দেখল ড্রয়িং রুমে সবাই দাড়িয়ে আছে সাথে ইহান ও। কোলে ইহিতা হাত পা নাড়ছে। রুমাইসা কলিজায় পানি ফিরে পেল মেয়েকে দেখে। তৃষা কে ওর শ্বাশুড়ি খুব অনুনয় বিনয় করছে থাকতে। কিন্তু তৃষার এক কথা এই প্রতারক এর সাথে এক ঘরে থাকা সম্ভব না।
এমন সময় ইহান বলল “তৃষা ভাবী, আপনার হাতে দুই মিনিট সময় হবে? ”
উপস্থিত সবাই ইহানের দিকে তাকাল রুমাইসাও কৌতুহল চোখে তাকিয়ে আছে ইহানের দিকে। তৃষার মুখ চোখ ফুলে আছে। কান্না করে মুখ লাল করে ফেলেছে। তৃষা ভারী গলায় বলল “আপনি আবার কি বলবেন ভাইয়া? নতুন কোন কাহিনী করা বাকি আছে আপনার? ”
ইহান একদম শান্ত গলায় বলল “কাহিনী আমি কিছুই করি নি। কাহিনী আপনার স্বামী করেছে অযথা আমার উপর রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। বরং আমার বউ কে বাসায় না নিয়ে আসলে তো আপনি আপনার প্রতারক স্বামী কে ফেরেশতা ই ভাবতেন।”
অভির মুখ রাগে ফুলতে লাগল। সব দোষ ইহানের, ইহানের কারনেই মূলত ওর আজ এই অবস্থা। দাতে দাত চেপে হাতের মুঠি শক্ত করে দাড়িয়ে রইল। তৃষা কোন জবাব দিতে পারল না এ কথার। বাহিরব গাড়ির হর্ন শুনা গেল। বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য উবার ডেকেছে তৃষা। সেটার হর্ন বাজছে।
“মিলি আপা গাড়ি নিচে দাড়াতে বল। ভাবীর সাথে আমার দুই মিনিট কথা আছে। ভাবী দয়া করে আপনার রুমে চলেন। এটা আমাদের পার্সোনাল কথা। আশা করি কান পেতে কেউ শুনতে আসবেন না। ”
সবাই এক রকম অবাক হল ইহানের এমন কথা শুনে। তবে ইহান বরাবর ই এমন। যা বলার মুখের উপর সোজা সাপটা বলে দিবে। কে কি ভাবল সেটা ও চিন্তা করে না। তৃষা ও খানিকটা অবাক হল। তবে এটা জানে যে ওর দেবর বাকি সব দেবরের মত না। কথা বলবে সহজ ভাবে সোজাসোজি।যেমন মজা করতে পারে তেমন যথা সময়ে যথাযথ কথা টাও বলে। কিন্তু দেবরের সাথে কোন দিন তৃষার এত খাতির নেই। আজ হঠাৎ কি বলতে ডাকল শেষ সময়ে কে জানে।
ইহিতা এখন ওর দাদীর কোলে। রুমাইসা কে দেখেও ওর কোলে দেয় নি মেয়েকে। রুমাইসা সাহস করল না ওর শ্বাশুড়ির হাত থেকে নেওয়ার মেয়েকে। চুপচাপ পাথরের মত দাড়িয়ে রইল। ইহিতা কে কোলে নিয়ে শ্বাশুড়ি ভালোভাবে দেখতে লাগল। একবার আড়চোখে রুমাইসা কে দেখে একবার ইহিতা কে। তারপর ফিসফিস করে তার স্বামীর কানে বলল “মেয়ে তো আমার দুই ছেলের মত ই দেখতে লাগে। ভালো মত দেখ। ”
তালুকদার সাহেব ও ভালোভাবে দেখে এটাই বলল। তালুকদার সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ইহিতার। ইহিতা হেসে দিল সাথে সাথে ।তালুকদার সাহেবের স্ত্রীর নাম ইশিতা। ইশিতা বেগম হেসে বলল “দেখেছ একদিনেই দাদার আদর চিনে গেছেরে। চেহারা টা দেখলেই মায়া লাগে গো। ”
সাইয়ারা এগিয়ে এসে বলল “মা দেখ ইহিতা কত কিউট। ইচ্ছা করে সারাদিন শুধু আদর করি। ”
ঝুকে একটা চুমু লাগিয়ে দিল সাইয়ারা। অভি আর রুমাইসা দূর থেকে দাড়িয়ে সব ই দেখছে। হঠাৎ দুজনের চোখাচোখি হল কিন্তু রুমাইসা ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো। অভির তাতে কিছু যায় আসে না। আপাদত ওর একটাই চিন্তা তৃষা কে আটকাতে হবে।
ইশিতা বেগম রুমাইসার দিকে তাকিয়ে বলল “সাথে কাপড় এনেছো কোন? ”
রুমাইসা মাথা নাড়া দিয়ে জানাল “না।”
“সাইয়ারা রুমে যেয়ে আমার আলমারি খুলে দুটা শাড়ি বের করে দে। দেখবি ডান সাইডের তাকে রাখা আছে কিছু সুতি শাড়ি। তোর ভাবী কে দে একটা এনে। কাল রাত থেকে পড়ে আছে এই ভারী শাড়ি। ” ইশিতা বেগম সাইয়ারা কে উদ্দেশ্য করে বলল।
এমন সময় দরজা খুলে ইহান বের হয়ে আসল আর তার পেছনে তৃষা। সবাই আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে আছে তৃষার ডিসিশন জানার জন্য।
তৃষা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল “আমি এ বাড়িতেই থাকব যাব না। তবে ওই প্রতারক এর সাথে আমি নরমাল হতে পারব না আগের মতন। এটা নিয়ে আমায় কিছু বলবেন না মা-বাবা।”
অভি খুব অবাক হল। রুমের ভেতর এমন কি কথা হল যে তৃষা তার রাগ কে মাটি চাপা দিয়ে থাকতে রাজী হয়ে গেল। অভি এসব ভাবতে ভাবতেই তৃষাকে এসে জড়িয়ে ধরল। তৃষা মূর্তির মত দাড়িয়ে রইল। “ধন্যবাদ তৃষা। ঠিক আছে আমি তোমার থেকে দূরে থাকব কিন্তু প্লিজ তুমি আর আমাদের বেবি কে নিয়ে দূরে যেও না। আমি থাকতে পারব না তোমাদের ছাড়া প্লিজ। ”
তৃষা কোন জবাব দিল না ঠিক ই কিন্তু কথাটা রুমাইসার বুকে লাগল। আজ কেবল ওর মেয়ে আর ওর ভাগ্যে টাই খারাপ। ভালোবাসা টা ওদের ভাগ্য তেই জুটল না।সবকিছুই যখন ঠিকঠাক হল তখন রুমাইসার শ্বাশুড়ি ও কে কাপড় পাল্টে নিচে আসতে বলল। সাইয়ারা কে পাঠাল মার্কেটে রুমাইসা আর বাবুর কাপড় আনতে। তালুকদার বাড়ির মেয়ে ইহিতা। ওর যেন কিছুর কমতি না থাকে।
রুমাইসা সবুজ রং এর একটা সুতি শাড়ি পড়ে চুল মুছতে মুছতে বের হল বাহিরে। বিয়ের শাড়িটা কি করবে বুঝতে পারছে না। তাই বাহিরে এনে বিছানায় রেখে ও ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছিল।ইহান কেবল মাত্র রুমে ঢুকতেই দেখল এলোমেলো ভেজা চুল পিঠে ছড়িয়ে রুমাইসা শাড়ির আচল ঠিক করছে। পুরো রুমে এক অন্যরকম ঘ্রাণ বয়ে যাচ্ছে। এতদিন ছিল কিনা ইহান জানে না। তবে রুমাইসার আগমনে ঘরের মাঝে যেন সবকিছু ই নতুন নতুন লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা ভেজা চুলের রুমাইসা কে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। তবুও ইহানের মত ব্যক্তি ছাড়া বোধ হয় এই অবস্থায় নিজের বউ কে ছাড়ার কথা না কারো।
ইহান গলায় কাশি দিয়ে রুমাইসার এটেনশন বাড়ালো। রুমাইসা শাড়ি পড়ে একদম পুরোদমে প্রস্তুত। ইহান ওর দিকে না তাকিয়েই বলল “আমার টাওয়েল এখানে ফেলে রেখেছ কেন? আর ভেজা কেন? আমি ফ্রেশ হব না? ”
রুমাইসা লজ্জা পেল সাথে অপমানিত হল। এখানে ওর নিজের বলতে কিছুই নেই। ইহান সব জানে তবুও কথা শুনানোর যেন কোন রাস্তা ছাড়তে চায় না।হুট করে রুমাইসা ইহানের দিকে তাকিয়ে সোজাসাপটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
“ইহান সাহেব আপনার স্বার্থ টা কোথায় আমার আর আমার মেয়ের বেলায় জানতে পারি কি? ”
ইহান একটা ভ্রু উপরে তুলে রুমাইসাকে জিজ্ঞেস করল “মানে? ”
“আপনি তো স্বার্থ ছাড়া কিছু করেন না। তাহলে আমাদের বেলায় কি স্বার্থ লুকিয়ে আছে? ”
ইহান বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। রুমাইসা কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল।
এবার ইহান শান্ত গলায় ঠোঁট চেপে বলল “বেশি কিছু না সম্পত্তি আর কি। ”
“মানে? কিসের সম্পত্তি? ”
“সত্যি বলতে বিয়ের ইচ্ছা আমার নেই। আর বিয়ে না করলে আমি কিছুই পাব না সম্পত্তির ভাগ। তাই বিয়ে করা আর কি। ”
“তোহ আমাকেই কেন? দুনিয়ায় মানুষের অভাব পড়েছিল? ”
“নাহ সেটার অভাব নাই। তুমি তো টেম্পরারি। ইহিতা সাহিল এর মেয়ে। সেজন্য সাহিল কে ডাউন করতে তোমায় বিয়ে করা। আর রেডিমেড বউ বাচ্চা পেয়েই যাচ্ছি তাহলে আর কষ্ট করব কেন। তবে চিন্তামুক্ত থাক। আমি তোমাকে টাচ করব না। সম্পত্তি হাতে আসা মাত্র ই তুমি আর ইহিতা মুক্ত। তবে তুমি চাইলে ইহিতা কে এখানে রেখে বিদায় নিতে পার। আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্ট অন ইউ। ততদিন পর্যন্ত একটু সহ্য করে থাক নিজের এক্স আর আমাকে। ”
রুমাইসার মুখ টা শুকিয়ে গেল এসব শুনে। নিজের উপর ই হাসি আসছে এখন। ব্যবহৃত জিনিস ছাড়া ও আর কিছুই না।