শেষ বিকেলের আলো পর্ব ১২

শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ১২

একটা কথা আছে না, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কে যদি বাবা মা’য়ের সম্মতি থাকে তবে সেখানে আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত এমনেই চলে আসে।ইহান আর রুমাইসার বেলায় ব্যাপার টা একটু অন্যরকম। এরা কাগজের দলিল আর সমাজের সামনে স্বামী -স্ত্রী। কিন্তু এরা নিজেদেরকে সেভাবে ভাবতে চায় না, ভাবেও না। একি রুমে দুটো প্রাণীর বাস। অথচ প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে কথা বলে না। তবে ওই যে বাবা মা যেহেতু মন থেকে মেনে নিয়েছে তাই ওদের ভেতর ও কেমন অনুভূতির সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে। হয়ত সেটা সাময়িক তবে ক্ষনস্থায়ী হওয়া কেবল ই সময়ের ব্যপার।

আজকাল রুমাইসা ইহিতার জন্য যা চাওয়ার মুখ ফুটে ইহান কে বলে। অবশ্য সেটার বিশেষ কারণ ও আছে। একদিন ইহিতার প্যাকেট দুধ শেষ । অথচ রুমাইসা লজ্জায় ইহান কে বলে নি। ইহিতার তখন ২ মাস শেষ হয়েছে। কি করবে, সারাদিন বুকের দুধ খাইয়ে তো পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারছে না। মেয়েটা কান্না করছে ক্ষুধায় একটু পর পর। তার উপর রুমাইসা নতুন বাড়িতে লজ্জায় যতটুকু দরকার ততটুকু খেতে পারে না। যার কারনে পুষ্টি তো হচ্ছেই না উল্টো শরীর দুর্বল হচ্ছে।

ইহান বাহির থেকে এসে জিজ্ঞেস করল “ও কান্না করছে কেন এত? ”

রুমাইসা লজ্জায় বলতে পারছিল না। ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে মেয়েকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। ইহানের রাগ লাগছিল প্রচুর। উত্তর না দিয়ে মেয়েকে থামাচ্ছে অথচ মেয়ে চুপ করার নাম ই নেই। বিরক্ত হয়ে ইহান রুমাইসার কোল থেকে ছো মেরে টান দিয়ে নিয়ে নিল।

“ওরেহ আমার বাবা টার কি হইসে। কান্না করে না রে। ”

সারাঘর ইহিতার সাথে কথা বলে একা একা হাটছিল। ইহিতা একটু একটু চুপ হচ্ছে আবার কান্না করছে। ইহান ইহিতার পেটের দিকে তাকাতেই দেখল পেট যেন একদম লেগে আছে। বুঝাই যাচ্ছে খালি পেট একদম। ভয়ানকভাবে রেগে রুমাইসা কে খুব জোরে ধমক দিল ইহান। ভয়ে রুমাইসা কেপে উঠল।

“ও কে খাওয়াচ্ছো না কেন তুমি? ক্ষুধা লেগেছে ওর, তুমি বুঝো না? কেমন মা তুমি হ্যা? ”

রুমাইসা লজ্জায় অলমানে মাথা নত করে খুব মৃদু কন্ঠে বলল “আসলে দুধ দিয়েছি খাচ্ছে না। আর প্যাকেটের টা শেষ হয়ে গেছে। ”

ইহান আবার ধমক দিয়ে বলল “শেষ হয়েছে তো বল নি কেন? তোমার জামাই আছে আরেকটা যে তাকে যেয়ে বলবে আনতে? ”

রুমাইসা কান্না চোখে ইহানের দিকে তাকাল। এতগুলো কঠিন কথায় ওর কান্না আসছে। এমনেই মেয়ে টার জন্য কষ্ট পাচ্ছে আবার ইহানের অপমান। তবুও মুখ ফুটে উত্তর দিতে ইচ্ছে হল না। কারন এ রাগের পেছনে আছে ইহিতার প্রতি ইহানের ভালোবাসা , দায়িত্ব আর কর্তব্য। এখানে তর্ক করা সাজে না।

ইহিতা কে কোলে দিয়ে আবার বের হয়ে গেল ইহান। নাসিমা বেগম প্রশ্ন করছিল কই যাচ্ছে। কিন্তু ইহান ঝড়ের বেগে দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। নাসিমা বেগম ভারী শরীর নিয়ে এক রকম দ্রুত পায়ে ইহানের রুমে আসল। দেখল রুমাইসা বসে আছে ইহিতাকে কোলে নিয়ে।

“কি ব্যাপার, ইহান এমন করে দৌড়ে বের হল কেন? ” নাসিমা বেগমের কন্ঠে উৎকন্ঠা ।

“ওর দুধ শেষ । ক্ষুধায় কান্না করছে তাই ওটা আনতে গেছে উনি। ” রুমাইসা আড়ষ্ট গলায় উত্তর দিল।

নাসিমা বেগম চুপ করে রইল। নাতনি কে কোলে নিয়ে মাথায় আর পেটে হাত বুলাতে লাগল। রুমাইসা চেয়ে আছে মেয়ের দিকে। একটু পর নাসিমা বেগম বলল “তোমার কপাল ভাল মেয়ে। তা না হলে আমার বড় ছেলের ফেলানো জিনিস আবার ছোট ছেলে নিত না। আমার ছোট ছেলেটার রাগ জিদ বেশি হলে কি হবে মন থেকে পরিষ্কার । ভাই ফালায় দিসে তো কি হইসে, সে তুইলা ঘরে আনসে আবার। আজকে ঠেকাতে পড়ে সবাই তোমাকে মাইনা নিসি। না হয় এমন এতিম মেয়ে ভুলেও ঘরে আনতাম না আমরা। তার উপর আবার বিয়ার আগেই নোংরামি করা মেয়ে। ”

রুমাইসা হা করে চেয়ে রইল এ গুলো শুনে। প্রতিটা কথা বুকের ভেতর ছুড়ির মত বিধে গেল। মুহুর্তেই চিন্তিত মুখ টা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ও ফেলানো জিনিস অভির। ও ই কি একা নোংরামি করেছে আর কেউ করে নি? দোষ টা কি কেবল ওর ই ছিল অভির না? অথচ সবার সামনে ওর শ্বাশুড়ি ই ও কে আগে এক্সেপ্ট করেছিল। সম্মান বাচাতেই বুঝি ঘরের ঝামেলা ঘরেই রেখেছে।

এটা ভাবতেই রুমাইসার শ্বাশুড়ি ওর মনের কথা গুলো বলে ফেলল।

“কি করব আর বল। ঘরের ঝামেলা ঘরেই যখন উঠিয়ে এনেছে ছেলে ফেলে তো দিতে পারি না। তাত উপর আবার মেয়ে জন্ম দিয়ে বসে আছো। বংশের তো কোন কাজেই আসবে না। অকারণে দুইটা আলাদা উটকো ঝামেলা কে পালা। কত ভেবেছিলাম বান্ধবীর মেয়ের,সাথে বিয়ে দিব ছেলেটার। আমার বান্ধবীর একটাই মেয়ে। বনানীতে দুটা বাড়ি ওদের। আবার গাজীপুরে রিসোর্ট আছে একটা। কক্সবাজার এ নাকি একটা হোটেল দিবে।বিয়ে হলে সব পেত আমার ছেলেটা। তার উপর কি করে বসল আমার ছেলেটা। বয়স তো কম হয় নি।৩১ বছর বয়স, অথচ কাজ করে বসল ১৮ বছরের ছেলের মত। কিছু বলতেও পারি না আমি। দাঁত চেপে সহ্য করছি। এই যে সাহিল কে, নিজের পছন্দ করা মেয়ের সাথে বিয়ে দিলাম।তৃষার কথাই ধর। আমার কথা ছাড়া চলে না মাইয়া। একদম ৫০ টা থেকে একটা হিরা বেছে আনছি। রূপ সৌন্দর্য তো কম নাই কিছু। এখন খালি প্রেগন্যান্ট দেইখা, তাও কি সুন্দর লাগে। বাপে মন্ত্রণালয়ের সচিব। সিঙ্গাপুরে পর্যন্ত বাড়ি করছে বেয়াই সাহেব এর। ওর এক বোন আছে। বোনের বিয়ে হইসে। হাজবেন্ড সহ আমেরিকা তে শিফট। ওইখানের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দেশের সব তো কম বেশি আমার সাহিল ই পাইব। আমার মা ভক্ত ছেলে সাহিল। তাও একটা ভুল করে ফেলছে। তাই বইলা ইহান এই ভুল আবার গলায় নিব। মানতে পারি না রে মানতে পারি না। মায়ের দুঃখ বুঝে না পোলা আমার। ”

রুমাইসার গলায় কান্না দলা পেকে আছে। একটা কথার জবাব দিতে পারল না ও। আর কত অপমানের কাটা গলায় ঝুলিয়ে দিন কাটাতে হবে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করছে গলায় দরি দিয়ে মরতে। এমন সময় ইহান চলে আসল।

ইহান কে ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকতে দেখে নাসিমা বেগম বলল “বাবা আসছিস তুই? গোসল কর খাবার দিতাসি আমি। ঝামেলায় ঝামেলায় আমার পোলা চিকন হইয়া গেসে কেমন।”

ইহান নূন্যতম গ্রাহ্যে করল না কথার। “রুমাইসা তাড়াতাড়ি ওর খাবার বানাও। খাবার খাওয়াও এখনি। ”

নাসিমা বেগম মনক্ষুন্ন হল একটু। ছেলে ওনাকে পাত্তা না দিয়ে এই মেয়ের দিকে বেশি আগ্রহ দিচ্ছে। এসব ওনার ভালো লাগছে না।রুমাইসা কে ভাগাতে পারলে বান্ধুবীর মেয়ের সাথে এখনো সম্পর্ক টা আগানো যাবে। রুমাইসা যে কখন ওনার সামনে দিয়ে উঠে যেয়ে বাচ্চার খাবার ও নিয়ে এসেছে উনি খেয়াল করেন নি।

“মা ইহিতা কে আমার কোলে দিবেন খাওয়াব। ”
রুমাইসার গলা শুনে ওনার হুশ হল। মেয়েকে দিয়ে দিয়ে নাসিমা বেগম রুম থেকে চলে গেল।
ইহান এসে সামনে বসল। রুমাইসা এক মনে খাওয়াচ্ছে মেয়েকে। মেয়েটা চুপচাপ খাচ্ছে একটুও মর্জি করছে না। খুব ক্ষুধা লেগেছিল।ইহান রুমাইসার দিকে একবার তাকালো।

মুখ টা কেমন লাল হয়ে আছে আবার ঠোঁট কেন যেন চেপে আছে দাত দিয়ে। ইহান আগে কখনো এভাবে দেখে নি ও কে। তবুও রুমাইসা কে একটু ধমক দিয়ে বলল “এর পর ইহিতার যা লাগবে আমাকে সরাসরি বলবে। আর আমি কাল মোবাইল নিয়ে আসব তোমার জন্য।যদি মুখে বলতে সমস্যা হয় ফোনে মেসেজ করে বলবে।”

রুমাইসা জবাব দেয় নি মেয়েকে খাওয়াচ্ছে চুপটি করে। ইহান ফ্রেশ হতে চলে গেলেই রুমাইসার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানি মেয়ের গালে পড়ল। রুমাইসা মুছে দিল। আবার আরেক ফোটা পড়ল। জীবনের একটা ভুল মানুষ কে বিষিয়ে তুলে সারাটা জীবন । ভেবেছিল ইহানের বাবা মা হয়ত খুব আন্তরিক। আজ যেন কথা ফুটে উঠেছে শ্বাশুড়ির। যা শুনিয়ে গেল তারপর লজ্জায় এ বাড়িতে থাকা ওর জন্য অসম্ভব। পালিয়ে যাবে এখান থেকে। ইহান কোন দিন ও কে যেতে দিবে না কিন্তু ও পালিয়ে যাবে মেয়েকে নিয়ে কারো গলগ্রহ হয়ে বাচার চাইতে মরে যাওয়া ভালো। কাল মেয়েটা বড় হলে যখন কেউ খোটা দিবে তখন কি হবে। আজ সব থাকতেও ওর মত ই এতিম ওর মেয়ে। আর ও তো নষ্টা আর নোংরা উটকো ঝামেলা। তবে ইহানের জীবন কেন নষ্ট করবে।

হঠাৎ রুমাইসার মনে হল যেখানে ইহান ওই মেয়েকে বিয়ে করলে এত সম্পদ পাবে তবে রুমাইসা আর ইহিতা কে দিয়্ব অল্প কিছু সম্পত্তি কেন পেতে যাচ্ছে ইহান। এটা কেমন বোকামি!! ইহান দের সম্পত্তি তো এত নেই যতটুক শ্বাশুড়ির কাছে শুনেছে। তাহলে ইহান কি চাইছে ওদের কাছে!!!

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here