শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ২
গোধুলি বিকালে খুব চিন্তিত মুখে পার্কের এ কোন থেকে ওই কোনে পায়চারি করছে অভি। আজকে রুমাইশা কে মনের কথা টা বলবে। কিন্তু এত নার্ভাস লাগছে নিজের কাছেই কি করবে আর কি বলবে বুঝতে পারছে না।
সামনে বসা একটা কাপল খুব রকম ঝগড়া করছিল । অভি সেটা দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। কিন্তু পরক্ষনেই নিজের কথা ভাবতেই ফিক করে হেসে দিল। সেদিনের সেই স্টেডিয়ামে অপমান করা মেয়েটিকেই আজ ও খুব ভালোবাসে। কি আশ্চর্য বিধান ভাগ্যের। কখন কোন লীলাখেলা খেলে কেউ জানে না। কত ঝগড়া করেছে সামনাসামনি দুজন। সেদিনের স্টেডিয়ামে অপমান হওয়ার পর অভির রাগ টা যেন আকাশে উঠে ছিল। যত সময় মেয়েটা কে শিক্ষা না দিবে ওর শান্তি নেই। তবে শিক্ষা দিতে যেয়েই যে প্রেমে পড়ে যাবে তাই বা কে জানত।
এলোমেলো ভাবনা গুলোর মাঝে প্রজাপ্রতির মত ডানা ছড়িয়ে উড়ে বসল রুমাইশা। পেছন থেকে চোখ টা ধরে বসল অভির। অভির চোখ ধরে যেন মুখের হাসি আটকে রাখতে পারছে না রুমাইসা। দুজনের বন্ধুত্ব টা খুব গভীর পর্যায়ে চলে গেছে সেটা রুমাইশার গত রাতেই বুঝা হয়ে গেছে। তবে আজ হঠাৎ অভির আচমকা তলবে একটু নার্ভাস লাগছে।
অভি চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল “এসেছে ঝাগড়াটে রুমাইসা। ”
রুমাইসা কপট রাগ দেখিয়ে বলল “সমস্যা কি আপনার।আমি ঝগড়া করি, আমি ঝগড়াটে, আমায় কেন ডেকেছেন এখানে? ”
অভি একদম রুমাইসার সামনে দাড়িয়ে হাত দুটো ধরে বলল “ভালোবাসার বয়ান করতে প্রেয়সী। ”
রুমাইসা অবাক হয়ে বলল “মানে? ” মনের ভেতর অসংখ্য চিন্তার রেখা উকি দিচ্ছে। সেকেন্ডের মাঝে অনুভূতি গুলো যেন তীব্র গতিতে দৌড়ে দৌড়ে রুমাইসার হার্ট বিট ছুঁয়ে দিচ্ছে।
তারপর আসল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন রুমাইসা কে হাটু গেড়ে এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ দিয়ে অভি নিজের মনের কথা বয়ান করল। রুমাইসার খুশিতে হাত পা কাপছিল। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে দিল “ইয়েস, আই ডু লাভ ইউ। ”
তারপর তো প্রেম জমে গেল সেদিন থেকে। ইশ কতটা সুন্দর সময় ছিল তখন রমাইশা ভাবতেও পারে না।
দরজায় খটখট আওয়াজে পুরোনো স্মৃতি থেকে ফিরে আসল রুমাইসা। হঠাৎ দরজার করাঘাতে একটু ভয় পেয়ে গেল। বাচ্চা টা কে বুকের সাথে শক্ত করে লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল “কে?”
বাহির থেকে শব্দ আসল “আমি। ” গলা শুনে রুমাইসার বুঝতে বাকি থাকে না এটা কে।দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। সেই বয়স্কা মহিলার হাতে একটা বল, ঢাকনা দিয়ে ঢাকা।
রুমাইসা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল “খালা কি হয়েছে? ”
মহিলা বল টা বিছানায় রেখে বলল “খিচুড়ি আনসি। খাইয়া ল। আমাগো বস্তিত আজকা সবাই মিলা টাকা তুইলা রান্দাইসিলাম। তুই তো নয়া চিজ। চিনোস না কিছু। এর লাই তোরে ঘরে দিয়া গেলাম। এক বলে মনে হয় তোর রাইত এও হইয়া যাইব। খাইয়া লইস। ”
রুমাইসা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মহিলা চলে গেল। রুমাইসার মুখে এক চিলতে হাসি উঠল। রিযিকদাতা রিযিক না দিলে বুঝি কারো সাধ্য নেই এক দানা মুখে নেওয়ার। মেয়ে কে শুইয়ে দিয়ে বল টা সামনে এগিয়ে নিল। রাত থেকে এক রকম না খাওয়া ও। রুমের আশেপাশে তাকিয়ে দেখল একটা জগ আর মগ আছে। তবে মাকড়সার জালে ময়লা হয়ে আছে। রুমাইসা হেসে দিল। এক সময় মাকড়সা দেখলে চার লাফ দিয়ে ফেলত। আর আজ কি এক করুন অবস্থা।
জগ মগ ধুয়ে কলের পানি নিয়ে রুমে আসল ও। দরজা আটকে বল টা হাতে নিল। সবজি খিচুড়ি কোন মাংস নেই তাতে।মাংস ছাড়া কোন দিন এই খিচুড়ি খেয়েছে বলে মনে আসে না ওর। তবুও এখন এটাই অমৃত ওর কাছে। বলে হাত লাগিয়ে খাওয়া শুরু করল ও। খেতে খেতে যেন সব ভুলে গেছে। মনে হচ্ছে এ কোন অমৃত খাচ্ছে, এর চেয়ে সুস্বাদু খাবার বুঝি হয় না। গোগ্রাসে বলের সবটুকু খিচুড়ি খেয়ে ফেলল ও। পানি খেয়ে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল।
পরক্ষণেই মনে পড়ল এ দিয়ে রাত টুকুও চলার কথা ওর। কিন্তু একে না খাওয়া সারাদিন তার উপর সদ্য বাচ্চা জন্ম দেওয়া মা,তাই খাবারের চাহিদা যেন বেশি ই এখন। রাতের কথা চিন্তা করতেই মুখ কালো হয়ে গেল।তবুও আলহামদুলিল্লাহ বলল।
ঘরের অবস্থা খুব ই খারাপ। এই অবস্থায় চাইলেও শুইতে পারবে না । অনেক খুজে খাটের নিচ থেকে একটা ঝাটা পেয়ে গেল। পুরো রুম টা খুব যত্ন সহকারে পরিষ্কার করে ঘন্টা দুয়েক এর মাঝে ঝকঝকে করে তুলল। বিছানার তল পরিষ্কার করতে যেয়ে একটা ছোট মাটির ব্যাংক পেল রুমাইসা। ব্যাংক টা বের করতেই একটু ভারী ভারী লাগল।অনেক কষ্টে একটা আঙুল ঢুকিয়ে বুঝল ভালো টাকাই আছে জমানো।
রুমাইসা দ্বিধা দ্বন্দ্ব তে ভুগছে। ব্যাংক টা কি ভাঙবে নাকি ওই খালার কাছে জমা দিবে।অন্যের জমানো জিনিস নেওয়া কি ঠিক হবে।কিন্তু এখন যে ওর ভীষণ প্রয়োজন । মেয়েটা মাত্র জন্ম নিল। ওর কাছে এক পয়সাও নেই যে একটা রুটি কিনে খাবে। আর এই সময়ে কোথায় কাজ খুজবে এদিকে। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে ওর। সাত পাচ ভেবে ব্যাংক টা ভেঙেই ফেলল। আওয়াজে মেয়েটা উঠে গেল। টাকা, কয়েন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল এদিক সেদিক। রুমাইসা সব ফেলে মেয়েকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা কাদছে জোরে জোরে। রুমাইসা ও কে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে আদর করে। অবশেষ এ একটু চুপ হল। চোখ খুলে মিটিমিটি করে এদিক ওদিক দেখছে। রুমাইসা ছোট আঙুল টা নিজের আঙুলের উপর রেখে বলল “আম্মু এই বিশাল পৃথিবীতে আমাদের কেউ নাই রে। তোর আম্মু টা বড় পাষন্ড আর খারাপ। তোকে একটা ভালো জীবন দিতে পারবে কিনা জানি না।তবে তোকে এমন ভাবে বড় করব যেন তুই নিজে নিজের পায়ে দাড়াতে পারিস আম্মু। তোকে নিয়েই আমার সংগ্রামের জীবন। আর তুই না থাকলে আমি হয়ত এতদিন বাচতাম ও না। ” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রুমাইসা।টাকা গুলো একএক করে এক জায়গায় রাখল গুছিয়ে। তারপর গোনা শুরু করল।টাকা গুনছিল আর ভেতরের অন্তরাত্মা বারবার যেন ভয়ে কাপছিল। আজ পর্যন্ত এমন কিছুই হয় নি ওর যে টাকা চুরি করতে হবে। আজ সেখানে অন্যের টাকা না বলে নিচ্ছে। প্রায় ৪ হাজার টাকার মত আছে ব্যাংকে। ও এখনো মন থেকে সায় পাচ্ছে না টাকা গুলা নিজের কাছে রাখার। কিন্তু এই মুহুর্তে এই টাকা গুলা খুব দরকার। অসহায়ত্ব আর অভাব কি শেষ পর্যন্ত ও কে চুরি করতে বাধ্য করছে। বিবেকের আদালতে ও আজ অসহায়। বিবেক যেন ও কে বারবার এ কাজে অনুৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু মন বলছে এই কঠিন দুনিয়ায় এইটুক না করতে পারলে যে ওর সন্তান টা আর বাচবে না।
টাকা গুলো গুছিয়ে একটা বক্সে ঢুকিয়ে রাখল। রুম পরিষ্কার করতে যেয়ে অনেক পুরাতন কাপড়, কাগজপত্র আরও টুকটাক অনেক কিছু পেয়েছে। রুমাইসা সব গুছিয়ে মেয়ে কে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। খুব ক্লান্ত লাগছে। পেটে কিছুটা ব্যথা হচ্ছে। কপাল ভালো নরমালে বাচ্চা হয়েছে। সিজারে হলে হয়ত এতক্ষনে ও আর মেয়ে দুজনের অবস্থাই খারাপ হয়ে যেত। আল্লাহ যেন কোথাও না কোথাও ওদের পাশে এখনো আছে। চোখ বন্ধ করতেই পুরানা স্মৃতিতে ডুবে গেল আবার।
“রুমাইসা আজ একবার আমার বাড়ি আসবে প্লিজ?”
অভির আকুতি ভরা গলা শুনে রুমাইসা অবাক হয়ে বলল “কি হয়েছে অভি কোন সমস্যা? ”
“আসোই না বাসায় সারপ্রাইজ আছে। ”
রুমাইসা মাথা চুলকে বলল “কি সারপ্রাইজ আবার? ”
“আরেহ বাবা সারপ্রাইজ নিবে আবার জিজ্ঞেস করস কি সারপ্রাইজ ? আমি কোন কথা শুনব না রুমাইসা আমি বলেছি মানে আসবে ”
তারপর ফোন টা কেটে গেল। রুমাইসা ভাবছিল হঠাৎ কি সারপ্রাইজ আবার। বাসা থেকে মিথ্যা বাহানা দিয়ে বের হয়ে গেল রুমাইসা। দুপুর নাগাদ অভির বাড়িতে চলে আসল। চার পাঁচবার কলিং বেল টিপলেও অভির কোন নাম গন্ধ নেই দরজা খোলার। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে রুমাইসার। অভির কোন বিপদ হল না তো।
দরজা টা একটু জোরে ধাক্কা দিতেই খট করে খুলে গেল। রুমাইসা ভয় পাচ্ছে এত নিস্তব্ধতা দেখে। যদিও অভি একাই থাকে বাড়িতে কিন্তু তারপর ও আজ কেমন ঘুমোট হয়ে আছে। এক পা দু পা করে সামনে এগিয়ে গেল অভি কে ডাকতে ডাকতে।
শেষ বিকালের আলো
তানিশা আহমেদ
পর্ব ৩
অভির ফ্লাটের ভেতর ঢুকতেই দেখল দিনের বেলায় ও সব বন্ধ করে রুম অন্ধকার করে রেখেছে। রুমাইসা ধীর পায়ে যখন রুমের মাঝখানে পৌঁছে গেল তখন হুট করে মাথায় উপর অনেক গুলো ফুলের পাপড়ি ঝড়ে পড়ল আর সাথে সাথে চিৎকার করে অভি বলল “হ্যাপি এনিভার্সারি জান “।
রুমাইসা দেখল পুরো রুম টা অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো।আর অভি এক হাতে কেক আরেক হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। খুশিতে রুমাইসা কেদে দিল একদম। এত ভালোবাসে অভি ও কে। ইশ ভালোবাসা টা যেন নিজে এসে ও কে ধরা দিয়ে গেছে। দৌড়ে অভি কে জড়িয়ে ধরল।
বাকিটা সময় দুজনের পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন এ কেটে গেল। দুই বছর পাড় হয়ে গেছে সম্পর্কের। অভি এখন খুব ভালো একটা জব করে ঢাকায়। আর রুমাইসার সামনে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা। দুজনের মাঝে কমিটমেন্ট হয়ে গেল এক্সামের পরেই রুমাইসার ফুপু ফুপার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবে অভি। রুমাইসার বাবা রুমাইসার ৩ বছর বয়সেই মারা যায়। আর তার দু বছর বাদে মা। মা বাবা হারিয়ে এতিম রুমাইসার আশ্রয় হয় ফুপু ফুপার কাছে। ফুপা রুমাইসা কে নিজের মেয়ে থেকে কম ভাবে না।কিন্তু ফুপুর ই যেন একটু সবকিছু তেই ঘ্যান ঘ্যান। রুমাইসার প্রতি চরম বিরক্তি তার। ওর ফুপুর মতে ওর ফুপা কেবল রুমাইসার পেছনে অকারনে টাকা নষ্ট করছে। তারচেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলে রুমাইসা নামক আপদ দূর হবে।রুমাইসার খুব কষ্ট হয় সেই ক্লাস ৯ থেকে এগুলা শুনে। এখন কিছুটা সয়ে গেছে তবুও অভি ই একমাত্র ভরসা। অভির সাথে বিয়ে করে এবার সত্যি ই বিদায় হতে চায় ও।
দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল অভি। রুমাইসা চুপচাপ খাটের উপর বসে আছে। অভি হাত বাড়িয়ে ওর একটা হাত নিজের হাতে নিল। রুমাইসা হেসে দিল। তবে ভেতরে এক অস্বস্তি কাজ করছে। একটু আগেই অভি হঠাৎ করে ওর কাছে ও কে দাবী করে বসে। ব্যাপার টা ঠিক তেমন না যে ও অভির না। আসল কথা হল অভি রুমাইসার উপর পুরো অধিকার চায় শরীর মনে। মন টা যেমন অভি কে দিয়েছে শরীর টাও অভির চাই। রুমাইসার খুব রাগ হয়েছে এটা শুনে।বিয়ের আগে এমন কিছু ও করতে চায় না। পরক্ষনেই অভি চুপসে যায়। একটু আগে দুপুরের খাবার টাও খায় নি ঠিক মত। অভি সচরাচর কোন দিন কিছু চায় না। বরং চাওয়ার চাইতে ধের বেশি রুমাইসা কে দিয়েছে। প্রতি মাসে ওর বেতনের অর্ধেকটা দেয় রুমাইসা কে। যেন ও ঠিক মত চলতে পারে। ফুপু ফুপার কাছে হাত পাততে না হয়। রুমাইসার এত অবদানের মাঝে এই চাওয়া টা প্রত্যাখ্যান করে দেওয়ায় খুব খারাপ লাগছে। অভিও জোর করে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তবুও ওর যে খারাপ লাগছে। রুমাইসা বিছানার উপর বসে দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে আছে। কি ডিসিশন নিবে এখন।
প্রায় ত্রিশ মিনিট লাগিয়ে চিন্তা করেই রুমাইসা ডিসিশন নিয়ে নিল। অভির দিকে চেয়ে বলল “অভি আমি রাজি। ”
অভি বিষ্মিত হয়ে বলল “কিসে রাজী তুমি রুমাইসা? ”
রুমাইসা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে রইল। অভির মুখ টা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল। ভালোবাসার পূর্ণতা দেওয়ায় দুজন ব্যস্ত হয়ে গেল।
সুখের সময় গুলো মনে করে ঘুমের ভেতর ই রুনাইসার চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগল। বেশিক্ষন আর ঘুম হল না। জেগে গেল রুমাইসা। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে এখন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই। সময় কত হয়েছে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। বাহিরে বাচ্চা থেকে বড় সব রকম মানুষের কথা বলার আওয়াজ আসছে। রুমাইসা আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। কিন্তু জগে পানি নেই। বাচ্চা টা কে রেখে কলের পাড় গেল পানি আনতে। খুব অবাক লাগে নিজের নিয়তির উপর। ফিল্টারের পানি খেত রুমাইসা। এখান সেখানে পানি কিনে খায় নি কোন দিন। বরাবরই এগুলো তে একটু সচেতনতা রাখত নিজের সেফটির জন্য। অথচ আজ এই কলের পানিও খেতে হচ্ছে। খুব একটা স্বাধ নেই আবার পানির নিচে কালো কালো কি যেন। তবুও খাচ্ছে দুপুর থেকে এই পানি।
সারাদিন এ যাও মানুষের আনাগোনা ছিল কিন্তু অন্ধকার হতেই এ পাশ টা একদম নিরব হয়ে গেছে। একটা পিন পড়লেও যেন আওয়াজ টা বিকট শুনা যাবে। কেমন যে গা ছমছমে ভাব চলে আসল রুমাইসার মনে। শত হোক বাঙালি তো, মনের মাঝে অন্ধকার নিয়ে কত ভাবনা চিন্তা খেলছে নিজেও বুঝতে পারছে না।দ্রুত পানি ভরে কল ঘর থেকে বের হল। ঝিঝি পোকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বুকটা ধুকধুক করছে ভয়ে। রুমাইসার পরক্ষনেই মনে হল মেয়েটা একা রুমে। দুপুরে খালা বারবার বলেছে মেয়ে রেখে একা বের হতে না। শত হোক সেটা ফাসির রুম।
এটা মনে আসতেই এক ছুটে রুমের দিকে দৌড় দিল রুমাইসা। ঘরে এসে দেখল মেয়েটা চোখ মেলে উপরের দিকে তাকিয়ে হা পা নাড়ছে। রুমাইসার বুকে একটু পানি ফিরে আসল। রুমাইসার পাশের রুম থেকে এখন পর্যন্ত কোন শব্দ পায় নি আসার পর থেকে। কোন ভাবে ওই রুমটাও কি খালি নাকি বুঝতে পারছে না। আবার ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে পেটে। কি করবে এখন, খাবার কই পাবে। রুমাইসার কান্না পাচ্ছে। বারবার মনে মনে অভি কে খুজছে। কতটা কপাল পোড়া ও। জন্মের পর বাবা মা মারা গেল। আর মেয়েটা হওয়ার আগে ওর বাবা। কেন ও কে আর ওর মেয়েকেই এত অভাগী হত হল দুনিয়ায়।
দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার আওয়াজ হল। রুমাইসা আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইল দরজার দিকে। ভেতর থেকে বাহিরের আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছে। রুমাইসা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল “কে? ”
ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ নেই। কিন্তু অনবরত আওয়াজ হচ্ছে ঠিক ই। রুমাইসা ভাবলো ওই খালা হয়ত এসেছে। তাই কিছুটা ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে এসে আবার জিজ্ঞেস করল “খালা আপনি এসেছেন? ”
ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ নেই। রুমাইসার এবার সত্যি ভয় করছে। মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে দরজা খুলে দিল।
যেই দরজা খুলল ওমনি হুড়মুড় করে এক লোক ভেতরে ঢুকে গেল। আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেল হাতে মদের বোতল আর লোকটা একটা আস্ত মাতাল।
ঢুকেই যেয়ে রুমাইসার বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর খুন অকথ্য ভাষা তে গালিগালাজ করতে লাগল কারন ছাড়াই।
রুমাইসা ভয়ে একদম জমে যাচ্ছে মাটির সাথে।কোন মতে জিজ্ঞেস করল “আ.. আয়া.. আপনি কে? এমন করছেন কেন? রুম থেকে বের হন। ”
লোকটা যেন ক্ষেপে গেল এগুলা শুনে। খুব বাজে ভাষায় গালি দিয়ে রুমাইসা কে বলল আধ ভাঙা গলায় “আমার ঘরে আমি আসব, তুই কে রে শালী? ”
রুমাইসা সাহস করে বলল “আপনার ভুল হয়েছে কোথাও, আমি এই ঘরে থাকি। দয়া করে বের হয়ে যান। ”
লোকটা একটু ভেংচি কেটে বলল “কিসের দয়া রে শালী। মেয়ে কে বিছানায় ফেলে আয় তো এদিকে। ”
রুমাইসার চোখ বিস্ফরিত হয়ে গেল এ কথা শুনে। ও যেন আর কিছু বলতে পারছিল না। এই রুমে মেয়েকে নিয়ে বড্ড অসহায় লাগছে ওর কাছে। রুমাইসা তবুও কঠিন গলায় বলল “আপনি এ রুম থেকে বের হন। না হয় আমি আপনাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করব।”
লোকটা মদের বোতলে চুমুক দিয়ে বলল “হ্যা রে শালী আমার কথার উপর কথা বলস, আইজকা আমি তোরে শিখামু। ”
লোকটা যেই রুমাইসার দিকে ছুটে আসতে নিবে রুমাইসা এক চিৎকার দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল। লোকটা এটায় যেন আরো ক্ষেপে গেল। সেও উদ্ভ্রান্তর মত ওর পিছে পিছে ছুটল। রুমাইসা পাগলের মত চিল্লাচ্ছে “বাচাও, বাচাও কে আছো। আমাকে মেরে ফেলল। ”
অথচ সব রুমের দরজা বন্ধ কেউ এগিয়ে আসছে না। লোকটা মদের বোতল টা দেয়ালে ছুড়ে অর্ধেক করে নিল। সেটা দিয়েই আজ মেরে ফেলবে এমন ভাব দেখাচ্ছে। রুমাইসা পেছন ফিরে দেখল লোকটাও যেন সমান গতিতে ছুটছে। মেয়েকে নিয়ে আপ্রান ছুটে চলছে বস্তির গলি ধরে আর চিৎকার দিচ্ছে। জানে না কোন অপরাধে লোকটা ও কে মারতে চাইছে। কি ভয়ংকর লাল রঙের চোখ হয়ে আছে লোকটার। চেহারায় লম্বা কাটা দাগ। যেন পেশাদার খুনি।