#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১০।
দুপুরের খাবার খেয়ে সবেই রুমে এসে বসে মেহুল। কিছু একটা চিন্তা করে আবার উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে সেই চিরকুটটা বের করে। সে আবার পড়ে সেটা। লোকটা হুট করে এই কথা কেন লিখল? এমন তো নয় মেহুলকে তিনি এই প্রথম স্বচক্ষে দেখেছেন। তার সাথে তো তার দেখা আরো আগেই হয়েছে। আজ তবে এত প্রেম কোথ থেকে এল উনার?
মেহুল ভেবে উত্তর না পেয়ে রাবীরকে কল দেয়। রাবীর কল রিসিভ না করে কেটে দেয়। মেহুল বুঝতে পারে সে যে এখন ব্যস্ত আছে। তাই আর কল দেয় না। চিরকুটটা ব্যাগে রেখে এসে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ে।
________
সন্ধ্যায় চাচির জোরে জোরে ডাকে ঘুম ভাঙে মেহুলের। মেহুল ঘুমের মাঝেই ধরফরিয়ে উঠে বসে। তার চাচি হাঁপাচ্ছেন। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সাংঘাতিক কিছু হয়ে গিয়েছে। মেহুলও তাই ভয় পেয়ে যায়। বিচলিত হয়ে পড়ে। জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, চাচি? তুমি এমন করছো কেন?’
‘ভাই হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, মেহুল। তুমি চলো তাড়াতাড়ি, উনাকে হাসপাতালে নিতে হবে।’
মেহুলের বুকের ভেতরে যেন মোচড় দিয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গেই বাবা বলে চিৎকার দিয়ে সে বাবার রুমে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে, তার বাবা যেন শুয়ে শুয়ে কেমন যেন করছেন। মনে হচ্ছে যেন উনার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মেহুল অনেক উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কী করবে বুঝতে পারছে না। রামিনা বেগম তখন মেহুলকে বললেন,
‘মেহুল, তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে কল করে আসতে বল। তোর বাবার অবস্থা ভালো না।’
মেহুল কাঁপতে থাকে। সে ভীত স্বরে বলে,
‘মা, বাবার কিছু হবে না। আমি ডাক্তারকে কল দিচ্ছি। এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মেহুল দ্রুত ডাক্তারকে কল দেয়। ডাক্তারের আসতেও বেশ সময় লেগে যায়। ঐদিকে তার বাবার শারিরীক অবস্থার আরো অবনতি ঘটছে। রামিনা বেগম তো একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। মেহুল বাবার হাত পা ঘষছে, উনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু, তার বাবা কোনো রেসপন্সই করছে না।
অবশেষে ডাক্তার এলেন। পেশেন্টকে দেখেই উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
‘উনাকে এক্ষুনি হসপিটালে এডমিট করুন। উনার ইমিডিয়েট ব্লাড লাগবে।’
‘কিন্তু ডাক্তার, এই মাসে তো আমরা ব্লাড নিয়েছিলাম। এই মাসেই আবার কেন?’
‘উনার কন্ডিশন এখন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন ব্লাড বেশি লাগবে। কারণ উনার শরীরে একদম হিমোগ্লুবিন উৎপাদন হচ্ছে না। এখন কথা না বাড়িয়ে উনাকে আগে হসপিটালে নিয়ে যান।’
________
মেহুল অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে। সে কোনোভাবেই এবি নেগেটিভ রক্ত পাচ্ছে না। আশে পাশের সব ব্লাড ব্যাংক খুঁজে ফেলেছে সে। কিন্তু কোথাও নেই। এইদিকে তার পরিচিত কোনো আত্মীয় স্বজনেরও এই রক্তের গ্রুপ নেই। প্রতিমাসে খুব কষ্ট করে এক ব্যাগ রক্ত তাকে জোগাড় করতে হয়। আগে থেকে খুঁজে বের করে রাখে। তবে আজ হুট করেই রক্তের প্রয়োজন হওয়াতে সে যেন একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কোথায় পাবে এই রক্ত? ঐদিকে হাসপাতালে রামিনা বেগম চেঁচামেচি করে অস্থির করে ফেলছেন সবকিছু। তার স্বামী রক্তের অভাবে তার চোখের সামনে মারা যাচ্ছেন আর তিনি কিছুই করতে পারছেন না। এর থেকে ভয়ানক কষ্ট আর কী হতে পারে।
চারদিকে কোথাও রক্ত না পেয়ে মেহুল রাস্তার এক কোণে বসেই কাঁদতে আরম্ভ করে। মনে হচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে বাবাকে যেন হারিয়ে ফেলছে সে। কী করবে? কোথায় রক্ত পাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। হাতে আর বেশি সময়ও নেই। তার বাবা হাসপিটালে পড়ে পড়ে কষ্ট পাচ্ছেন, আর সে মেয়ে হয়ে কিচ্ছু করতে পারছে না। মেহুল মাথায় দুহাত দিয়ে বসে থাকে। কী করবে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে তার রাবীরের কথা। উনাকে বললে তো উনিও সাহায্য করতে পারবেন। মেহুল রাবীরকে কল দেওয়ার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই সেখানে একজন লোক এসে উপস্থিত হয়। মেহুল লোকটার দিকে চেয়ে বলে,
‘কে আপনি?’
‘আমার পরিচয় জানাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি এভাবে রাস্তার মাঝে বসে আছেন কেন, সেটার কারণ জানা? একটা এক্সিডেন্ট হলে তো আর পাত্তাও পাওয়া যাবে না।’
মেহুল তখন কেঁদে ফেলে। বলে,
‘মেয়ে হয়ে বাবার মৃত্যু দেখার আগে নিজে মরে যাওয়াই ভালো।’
লোকটা বলল,
‘কোনো সমস্যায় পড়েছেন? চাইলে আমাকে বলতে পারেন। এমনও তো হতে পারে, আমার দ্বারা আপনি আপনার সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন।’
মেহুল তখন চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। ভেজা গলায় বলে,
‘আমার বাবা খুব অসুস্থ। উনার ইমিডিয়েট এবি নেগেটিভ রক্ত লাগবে। কিন্তু, আমি সেটা কোথাও পাচ্ছি না। আপনার পরিচিত এমন কেউ আছে কি, যার রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ?’
লোকটা মৃদু হাসে। বলে,
‘দেখেছেন, সাহায্য করার জন্য আল্লাহ কাউকে না কাউকে ঠিক পাঠিয়েই দেন। আমার রক্তের গ্রুপই এবি নেগেটিভ। আপনি চাইলে, আমি আপনার বাবাকে রক্ত দিতে পারি।’
মেহুল এবার শ্বাস নেয়। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল সে নিজেই হয়তো মারা যাচ্ছে। সে বলে,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। প্লিজ আপনি রক্ত দিয়ে আমার বাবাকে বাঁচান। আমি চির ঋণি হয়ে থাকব আপনার কাছে।’
‘ঠিক আছে, চলুন।’
________
মেহুল সেই লোকটাকে নিয়ে হসপিটালে গেল। সেখানে গিয়েই সে দ্রুত ডাক্তারের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করতে বলল। রামিনা বেগম এবার কিছুটা শান্ত হয়েছেন। মনে হচ্ছে, আল্লাহ তার ডাক শুনেছেন। সাহায্য হিসেবে এই লোকটাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ডাক্তার সব টেস্ট করে লোকটার কাছ থেকে রক্ত নিলেন। মেহুল তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। রক্ত নেওয়া শেষ হওয়ার পর মেহুল বলল,
‘আপনি আমার অনেক বড়ো উপকার করেছেন। আমি আপনার এই উপকারের কথা কখনোই ভুলব না।’
লোকটা শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে হেসে বলে,
‘আজ যেমন আমি আপনার উপকার করলাম, একদিন আপনিও আমার একটা উপকার করে সবটা শোধ বোধ করে ফেলবেন, তাহলেই হবে।’
মেহুল মৃদু হাসে। বলে,
‘যদি সুযোগ পায়, তবে অবশ্যই করব।’
লোকটা তারপর তার পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মেহুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা আমার কার্ড। এখানে আমার ফোন নাম্বার আছে। আপনার বাবার যা সমস্যা শুনেছি, উনার তো প্রতিমাসেই রক্ত লাগে। আপনি চাইলে আমার থেকে রক্ত নিতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা নেই। যখনই প্রয়োজন পড়বে কল দিবেন, চলে আসব।’
মেহুল বুঝতে পারছে না, ঠিক কীভাবে লোকটাকে শুকরিয়া জানাবে। আজকাল এত ভালো মানুষ হয় নাকি। সে বলল,
‘আপনি ভালো মানুষ বলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্য কেউ তো এইটুকুও করে না। এক ব্যাগ রক্ত দেওয়ার কথা বললে,এমন ভাবে রিয়েক্ট করে যেন উনার পুরো শরীরের রক্ত দিয়ে দিতে বলেছি। কিন্তু, আপনি আসলেই খুব ভালো মানুষ। আমি অবশ্যই প্রয়োজনে আপনার কথা স্মরণ করব।’
‘ঠিক আছে, এখন আসি তাহলে। আপনার বাবার জ্ঞান ফিরলেও আমাকে ছোট্ট করে টেক্সট করে জানিয়ে দিয়েন। তাহলে খুশি হবো।’
‘জি, অবশ্যই।’
লোকটা চলে গেল। মেহুল কার্ডটা হাতে নিয়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে বসল। রামিনা বেগম বললেন,
‘ঐ লোকটা ফেরেশতার মতো এসে আমাদের সাহায্য করে গিয়েছেন। নয়তো আজকে যে আমাদের কী হতো।’
‘হ্যাঁ মা, আমিও তাই ভাবছি। মানুষটা আসলেই খুব ভালো। দেখো, আবার কার্ড ও দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, আবার রক্তের প্রয়োজন হলে উনাকে যেন কল করে জানায়। ‘
‘ওমা তাই। নাম কী উনার?’
‘নাম? দাঁড়াও কার্ড দেখে বলছি।’
মেহুল কার্ডটা চোখের সামনে ধরে নামটা পড়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘উনার নাম সাদরাজ আহমেদ। কার্ডে এটাই দেওয়া।’
‘ওহ, সাদরাজ। সুন্দর নাম।’
মেহুল বলল,
‘হ্যাঁ। তবে নামের সাথে সাথে, মনটাও উনার বেশ সুন্দর।’
চলবে…