#গল্পঃ শ্রাবণ মেঘের দিন (শেষ পর্ব)
#সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো উৎপলকে,
“এতরাতে নষ্টামি করতে এসেছিস তাও আবার আমাকে দেখিয়ে। দেখ আজ তোর কি অবস্থা করি”।
তুলিকে দাঁড়াতে বলে খাট থেকে নিচে নেমে দরজার দিকে পা বাড়ালো সেঁজুতি।
চুপিচুপি দরজা খুলে বাহিরে পা রাখতেই সেঁজুতির চোখ চকচক করে উঠলো কারণ রাতের আকাশে ছিলো অজস্র জোৎস্নার ছড়াছড়ি।
সেঁজুতি রুমের পিছনে গিয়ে উৎপলকে দেখে বললো,
“এটাও দেখার বাকি ছিলো, তাই না?
আপনার বাবা-মা তো আপনাকে নিয়ে খুব গর্ব করে এমনকি গ্রামের সবাই।এখন সবাইকে ডেকে এনে দেখাই? আপনি রাতের অন্ধকারে একটা মেয়েকে কোথায় নিয়ে এসেছেন”?
সেঁজুতির কথা শুনে উৎপল “হা” করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
তুলি হঠাৎ সেঁজুতিকে বললো,
“সেঁজুতি, তোর মাথা ঠিক আছে তো”?
কথাটা বলতে বলতেই রাসেলের দেখা মিললো।রাসেল চুপিচুপি একটু দূর থেকে হেঁটে আসছে ওদের দিকে।
সেঁজুতি রাসেলকে দেখে বললো,
“এর মানে কি”?
তুলি বললো,
“আমরা চলে যাচ্ছি সেঁজুতি। তুই ভালো থাকিস।সেই ছোট্টবেলা থেকে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। কত হইচই দুষ্টুমি করেছি।কষ্ট পেলে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। কিন্তু আর থাকতে পারলাম না রে তোর সাথে।
আমার বাবা-মাকে বলিস আমার কথা।তোকে খুব ভালবাসতাম বলেই তোকে না বলে যেতে পারিনি।
চলে যাই রে! তোর সাথে আবার কোন একদিন দেখা হবে।তখন না হয় আমরা আবার মেতে উঠবো শৈশবের সেই খুন শুঁটিতে।
একটা কথা বলে গেলাম,
উৎপল তোকে অনেক ভালবাসে।যে তোকে ভালবাসবে তাকে কখনো কষ্ট দিবিনা তাহলে দেখবি কোন একদিন তুই সত্যিকারের
ভালবাসার অভাব বোধ করবি।
সবার ভালবাসা মন কাঁড়তে পারেনা”।
এই বলে তুলি রাসেলের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
সেঁজুতি রাতের অন্ধকারে বেশীদূর যেতে পারেনি।তুলির চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে সেঁজুতি হু হু করে কেঁদে উঠলো।
আজ উৎপল সেঁজুতির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
“আমি ১৫ দিনের জন্য ছোট মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাই তোর সাথে দেখা হয়নি।আর তুই মনে মনে কি ভেবে নিয়েছিস আল্লাহ জানে।
রাসেলের সাথে সেদিন শিউলির বিয়ে হয়নি।অনেক ঝড় তুফানের পর আজ ওদের মিলিয়ে দিলাম”।
–শোন সেঁজুতি।
–হুম,বলেন
“আমি কিন্তু তোকেই ভালবাসি।কথাটা বলে উৎপল আবারো মুচকি হাসি দিলো।যে হাসির প্রেমে অনেক আগেই পড়েছে সেঁজুতি”।
সেঁজুতি কিছু বললো না।আজ সেঁজুতি ও উৎপলের সাথে মুচকি হাসলো।
সকাল সকাল পাশের বাড়ির মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো সেঁজুতির।
সবাই রাসেল আর তুলিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে গ্রামের আনাচে-কানাচেতে। কিন্তু তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তুলি আর রাসেলের মায়েদের কান্না দেখে সেঁজুতির চোখের কোনে ও কয়েক ফোঁটা জলের জন্ম নিয়েছিলো।
সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো,
“আরো আগে যদি আপনারা ব্যাপারটা মেনে নিতেন তাহলে আজ এমনটা দেখতে হতো না”।
সেঁজুতির বিয়ের সেই প্রস্তাবটা ভেঙে গিয়েছিল বারবার বাঁধা আসার কারণে।
গ্রাম বাংলার মানুষ বড্ড কুসংস্কার বিশ্বাসী।
সেঁজুতির আজ ইচ্ছে করছে নৌকায় করে নদীতে ঘুরতে যাবার।
সেঁজুতি বৈঠা নিয়ে যেই নৌকায় বসলো অমনি উৎপলকে দেখা গেলো ওদের বাড়ির সামনে।
সেঁজুতিকে নৌকায় বসে থাকতে দেখে উৎপল ও দৌঁড়ে নৌকায় এসে বসলো।
নৌকা যখন মাঝ নদীতে চলে গেলো তখন উৎপল বললো,
“সেদিনের প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিসনি”।
উৎওলের কথা শুনে সেঁজুতি পড়ে গেলো মহাবিপদে।এখন সেঁজুতি কিভাবে বলবে সেও উৎপলকে ভালবাসে! বলার আগেই তো চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা সেঁজুতি।
একটুপরে উৎপল সেঁজুতির হাত ধরে বললো,
“বল,তুই কি আমাকে ভালবাসিস”
?
সেঁজুতি কেবল মাথা নাড়ে কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
উৎপল ও বুঝে নেয় সেঁজুতি ও তাকে ভালোবাসে।
উৎপল সেঁজুতির হাত ধরে বলে,
“কথা দে,কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবি না।আমি যদি কখনো নিখোঁজ ও হয়ে যাই অনেকদিনের জন্য তবুও আমায় ভুলে যাবি না।মনে রাখবি আমি যেখানেই থাকি না কেন তোকে ঠিকই মনে রাখবো।আমার কথাগুলো কি তুই রাখবি?
সেঁজুতি আবারো মাথা নাড়লো।
সেঁজুতি সম্মতি উপলব্ধি করে,
উৎপল অনেক জোরে গান গাইতে গাইতে নৌকা বাইতে লাগলো।
অতঃপর তাদের প্রেমটাও হয়ে গেলো।
কত যে লুকিয়ে লুকিয়ে ওরা দেখা করেছে,কথা বলেছে তার কোনো হিসেব নেই।সেঁজুতি গুনেগুনে ১০ মুঠো কাঁচের চুড়ি জমিয়েছে যেগুলো উৎপল ওকে দিয়েছে।
উৎপলের কাঁচের চুড়ি অনেক প্রিয়।
এভাবে প্রায় অনেকদিন কেটে গেলো।
আজ আবারো আকাশে
মেঘের ছড়াছড়ি।
যুথি আপা বেড়াতে এসেছে।
সেই সুযোগে
উৎপল ছোট তিতলীকে বলে দিয়েছে,
সেঁজুতিকে যেন বলে তার সাথে দেখা করার জন্য।
তিতলীর কথা শুনে সেঁজুতি দৌঁড়িয়ে উৎপলের কাছে চলে গেলো।এরমধ্যে শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি।
সেদিনের সেঁজুতির
স্বপ্নের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে লাগলো ওরা।
করিমদের বাড়ির পিছনের কদম গাছ থেকে উৎপল সেঁজুতিকে কদম ফুল পেড়ে দিলো।
সেঁজুতি মনে মনে বলতো লাগলো,
“এই বৃষ্টি যদি আর কখনো শেষ না হতো তাহলে বোধহয় ভালোই হতো।কখনো আমাদের আলাদা হতে হতো না”।
সেঁজুতি হঠাৎ উৎপলকে বললো,
“আপনি না আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে মানা করেছিলেন”?
উৎপল বললো,
“আমার সাথে ভিজলে সমস্যা নেই কিন্তু অন্য কারো সামনে ভিজবি না”।
উৎপল আবারো বললো,
শোন সেঁজুতি, আমি আজ থেকে তোকে আর তুই করে বলবো না।তুমি করে বলবো।
আর আজ থেকে তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।মনে থাকবে?
সেঁজুতি বললো,
“আমি আমার বর ছাড়া আর কাউকে তুমি করে বলব না”।
উৎপল সেঁজুতির কথা শুনে জোরে হেঁসে উঠলো।
উৎপলের হাসি দেখে সেঁজুতি লজ্জা পেল খুব।
একটুপরে উৎপল সেঁজুতিকে বললো,
“আমি তো তোমাকেই বিয়ে করবো।সুতরাং আমাকে তুমি করে বললে, কিছু হবে না।কি বলবে তো?
তুলি,হ্যাঁ, না কিছু বলেনি কেবল মাথা নাড়িয়েছে।
ফরিদা বেগম তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললেন,
রমিজা গতকাল রাইতে গলায় দড়ি দিয়া মরছে,ওরে দেখতে যাইতাছি।
রমিজার মৃত্যুর কথা শুনতেই সেঁজুতির বুকটা কেঁপে উঠলো।সেঁজুতি বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
মানুষ একটুখানি ভালবাসা পাওয়ার জন্য কতটা উতলা হয়ে উঠতে পারে তা রমিজাকে না দেখলে জানতাম না।
আজ বিকেলে জোহরা চাচিদের বাড়িতে যাওয়ার সময় উৎপলের মা রেনু বেগম সেঁজুতিকে দেখে বললো,
“জানিস সেঁজুতি,আমি উৎপলের জন্য মেয়ে দেখেছি”।
কথাটা শুনেই সেঁজুতির বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠলো।
একটুপরে আবার রেনু বেগম বললো,
“মেয়েটার নাম শ্রাবণী। খুব সুন্দর মেয়ে।উৎপল ও সেদিন গিয়ে দেখে এসেছে। আমরা কয়েকদিন পরে গিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আসবো”।
সেঁজুতি কিছু না বলে পথে পা রেখেই কান্না শুরু করে দিলো।এমনকি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেলো।ফরিদা বেগম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে বারবার প্রশ্ন করতে লাগলো,
“কি হয়েছে?কিন্তু সেঁজুতি কিছু না বলে কথা কাটিয়ে নিয়ে গেলো”।
৩দিন ধরে আবারো উৎপল নিখোঁজ হয়ে গেলো।
তারপরের দিন উৎপলের দেখা মিললো।বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই উৎপল বললো,
“আরে আমি তো তোমাকেই বিয়ে করবো।মাকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়েটাকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি তারচেয়ে আমার সেঁজুতিই আমার কাছে অনেক সুন্দর”।
সেঁজুতি আর কিছু বলে না, লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলে।
আজ উৎপল কয়েকদিনের জন্য শহরে যাচ্ছে।
যাওয়ার আগেরদিন উৎপল বলে গিয়েছিলো এসেই বাবা-মাকে বলে সেঁজুতিকে বিয়ে করবে।
উৎপল চলে গেলো।
বিকেলে সেঁজুতি হাঁটতে হাঁটতে করিমদের বাড়ি গেলো।
সেই বাড়ির আমেনা চাচির সাথে জ্বিন আছে। সে মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
আমেনা সেঁজুতিকে দেখেই বললো।
“তোর খুব কাছের একজন মানুষ তোকে ছেড়ে চলে যাবে অনেকদূরে,আর কখনো তাকে খুঁজে পাবিনা”।
কথাটা শোনার পর সেঁজুতির বুকের ভিতর ধক করে উঠলো।
আজ সারাবিকেল সেঁজুতির ভালো কাটেনি।সারারাত ঘুম ও হয়নি।
সকালে মানুষের চিৎকার চেচামেচিতে ওর ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম থেকে উঠেই শুনতে পেলো,
“উৎপল যে লঞ্চে উঠেছিল সেটা নাকি ডুবে গেছে। কথাটা শুনে সেঁজুতির বুকটা ফেটে যাওয়ার অতিক্রম হলো”।
সেঁজুতি দৌড়ে উৎপলদের বাড়ি চলে গেলো।সেখানে সবার কান্নার আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে উঠলো।
দেখতে দেখতে ১ সপ্তাহ কেটে গেলো কিন্তু উৎপল আর ফিরলো না।সেদিন অনেকের লাশ পাওয়া গেলেও উৎপলের লাশ আর পাওয়া যায়নি।হয়তো ওর লাশ ভাসতে ভাসতে পাড়ি জমিয়েছে অচিনপুরে।
পুরো ব্যাপারটা ফরিদা বেগম বুঝতে পারলো।কিন্তু কি বলে মেয়েকে স্বান্তনা দিবে সে ভাষা খুঁজে পায়না।
সেঁজুতির বারবার মনে হতে লাগলো,
“উৎপলের কি বেশি কষ্ট হয়েছিলো পানিতে ডোবার সময়?
যে মুখ দেখে সেঁজুতি একসময় একটা সুন্দর সংসার রচনার স্বপ্ন দেখেছিলো,শেষবারের মতো একবার দেখতেই পেলনা তার সেই চিরচেনা মুখটা!
ইসস যদি উৎপলের লাশটাও পাওয়া যেতো তাহলেও না হয় ওর কবরটার সামনে গিয়ে মন উজাড় করে কাঁদা যেতো কিন্তু উৎপল ভালবাসার কোন শেষ চিহ্নই রেখে যায়নি”।
তারপর অনেকবছর কেটে গেলো।গ্রামের বুক জুড়ে গ্রীষ্মের দাবদাহে ফসলের মাঠে ফাটল ধরলো,কত বর্ষা এলো আর গেলো।শরৎকালে কত কাশফুলই না সেই নদীর পাড়ে ফুটলো।
কিন্তু আর কখনো বসন্তে লাল শিমুল ফুল কুড়ায়নি সেঁজুতি।
সেঁজুতির ভাগ্যক্রমে সেই হাই স্কুলের মাস্টারের সাথেই একদিন বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।সেঁজুতির আজ বড় একটা ছেলে আছে তার নাম রেখেছে উৎপল।
করিমের বউ,জোহরা,আমেনা চাচি, রেনু বেগম সবাই আজ বৃদ্ধাদের কাতারে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
এরমধ্যে কত মানুষেরই না মৃত্যু হলো।
তুলি আর কখনো ফিরে আসেনি এই গ্রামে। ওরা কেমন আছে,কোথায় আছে আজ বড্ড জানতে ইচ্ছে করে সেঁজুতির।
সেঁজুতির সেই শ্রাবণী নামের মেয়েটার কথাও জানতে ইচ্ছে করে খুব।
আজ সেঁজুতির ও মাথার কালো চুল সাদা রং ধারণ করেছে। শৈশবের সেই উচ্ছ্বল বালিকা আজ বৃদ্ধাদের কাতারে পা রেখেছে।
উৎপল একদিন সেঁজুতির হাত ধরে বলেছিলো,
“কথা দে,কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবি না।আমি যদি কখনো নিখোঁজ ও হয়ে যাই অনেকদিনের জন্য তবুও আমায় ভুলে যাবি না।মনে রাখবি আমি যেখানেই থাকি না কেন তোকে ঠিকই মনে রাখবো।আমার কথাগুলো কি তুই রাখবি?
কথাগুলো কি সত্যিই রাখতে পেরেছে সেঁজুতি?
একজীবনে কি আর সবকথা রাখা যায়?সেঁজুতি আর উৎপলের সেই দুরন্ত প্রেমের
কথাই তো কেউ মনে রাখবে না সেঁজুতির মৃত্যুর পর।তখন কেউ জানবেই না,
উৎপলের এক লজ্জাবতী ভালবাসা ছিলো আর সেঁজুতি ও একদিন এক ছেলের মুচকি হাসির প্রেমে পড়েছিলো এবং সেই প্রেমের একদিন মৃত্যু ও হয়েছিলো কোনো এক শ্রাবণ মেঘের দিনে।
লেখাঃ হামিদা ইমরোজ।
#