শ্রাবণ মেঘের দিন পর্ব ১

#গল্পঃ শ্রাবন মেঘের দিন

“বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েদের দেখতে একদম বাজে লাগে। তুই আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবি না।”
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো উৎপল, সেঁজুতিকে বলছিলো। ওদিকে উৎপলের এই টাইপের কথা শুনে সেঁজুতি একপ্রকার রাগ আর লজ্জায় এই কথার কোন উত্তর না দিয়েই সেখান থেকে চলে গেলো।
ঘরে এসে ভেজা কাপড় পাল্টে সেঁজুতি সরাসরি মাকে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা মা,বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েদের দেখতে বাজে লাগে কেন?”
সেঁজুতির মা ফরিদা বেগম সেঁজুতির প্রশ্নের উত্তর তো দিলোই না বরং ওকে আচ্ছা মতো বকে দিলো।
“মেয়েটার যা খালি বয়সীই বেড়েছে, বুদ্ধি হয়নি।”
সন্ধ্যার দিকে সেঁজুতির বাবা রহমত আলী মাঝারি একটা প্লাস্টিকের লাল বালতি ভরে অনেকগুলো তাজা মাছ নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে শোল,টাকি,কই,পুঁটি সহ অনেকরকমের মাছ ছিলো, সাথে ছিলো দুইটা বড় বোয়াল।
মাছগুলো বারান্দায় রাখতে রাখতে রহমত আলী বললেন,
“উজানের বিলে জাল পাতছিলাম,অনেকগুলো মাছ আটকা পড়ছে জালে। আর বাকি মাছগুলো ধরে নিয়ে আসছি।বুঝলা ফরিদা,নতুন পানিতে মাছগুলা খালি কিলবিল করতেছিলো।তুমি এই মাছগুলো সুন্দর করে রান্না করো।
কথাগুলো বলেই রহমত মিয়া সেখান থেকে উধাও হলো।
মাছগুলো কাটার দ্বায়িত্ব পড়লো সেঁজুতি আর ওর মায়ের।সেঁজুতির কাজ করতে একদম ভালো লাগে না। কিন্তু রেহাই নেই এখন মায়ের সাথে মাছ না কাটলে তার খুব বিপদ হবে।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই ঘরের এককোনায় জড়ো হয়ে বসে বিভিন্ন গল্পে মেতে উঠলো।এরমধ্যে কে যেনো হঠাৎ দরজায় কয়েকটা টোকা দিলো।
এই ঝড়বৃষ্টির রাইতে আবার কে আইলো,কথাগুলো বলতে বলতে একরুম পেরিয়ে সামনের বসার ঘরে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সেঁজুতি।
একটুপরে দেখা গেলো উৎপল আর মিজান এসেছে।
উৎপলকে দেখে মুখ ভেংচি কাটে সেঁজুতি। উৎপল আজকাল কেমন দৃষ্টিতে যেনো তাকায় সেঁজুতির দিকে।
এই দৃষ্টির মানে সেঁজুতি জানে না কিন্তু মনে মনে ঠিকই লজ্জা পায়।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর সেঁজুতির বড় ভাই সিরাজকে নিয়ে ওরা বেরিয়ে যায় বাহিরে সেঁজুতিদের নৌকা নিয়ে মাছ ধরার উদ্দেশ্য।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় উৎপল প্রায় কয়েকবার ঘরের দিকে উঁকি মারে। বিষয়টা চোখ এড়ালোনো সেঁজুতির।সে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব খেয়াল করেছে।ওর এই উৎসুক প্রখর চোখের দৃষ্টি সম্পর্কে কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও ব্যাপারটা ঠিকই বুঝতে পারে সেঁজুতি।
একটুপরে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়া হলো।
পুরো ঘরজুড়ে অন্ধকার। সেঁজুতি ওর রুমে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে আর দূরে কয়েকটা ব্যাঙ একটানা ঘ্যাঙরঘ্যাঙ করে ডেকে যাচ্ছে।একটুপরে সেঁজুতি পৌঁছে যায় ঘুমের দেশে।রাতও কেবল বাড়তে থাকে এখন কেবল প্রভাতের অপেক্ষা।
সাত-সকালে ঘুম ভাঙ্গলো সেঁজুতির।আকাশটা আজ একদম পরিষ্কার, কোনো মেঘের ছিটেফোঁটা নেই।
মা’য়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেঁজুতি এক দৌড়ে চলে গেলো মানিকের ঘরে।
পুকুরপাড়ের খেজুর গাছটায় এবার অনেক খেজুর হয়েছে, ওগুলো পেরে এনে ঝাঁক দিতে হবে তাহলে পরেরদিন একেবারে পেঁকে যাবে।এই খেজুরগুলো সেঁজুতির খুব প্রিয় তাছাড়া এর বিচি দিয়ে ঘরে বসে খেলা করা যায়।
অতঃপর সেঁজুতি দুইহাতে কয়েক ডাল ভর্তি সবুজ কাঁচা খেজুর নিয়ে ঘরে ফিরলো।
ফরিদা বেগম এইসব কাজ একেবারে অপছন্দ করেন,তাঁর মতে এইসব খাবারে পেটে সমস্যা হয় তাই সে এগুলো ধরে উঠোনের দিকে ছুঁড়ে মারলো।সেঁজুতি ছলছল দৃষ্টিতে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো।একটুপরে রহমত মিয়া মেয়ের মনের কথা বুঝতে পেরে ওগুলো এনে ঠিকঠাক ভাবে রেখে দিলো।
অতঃপর তার আদরের মেয়ের মুখে হাসি ফুটলো।
পাশের বাড়ির তুলি এসে সেঁজুতিতে ডাকতে লাগলো, আজ স্কুলে যাবে কি-না সেটা জানার জন্য।
শিউলি দের বাড়ির পাশের রাস্তায় অনেক পানি জমেছে আজ।নৌকা ছাড়া হেঁটে যাওয়া যাবে না । এই খবরটা নিয়ে এলো সেঁজুতির ছোটো ভাই সবুজ।
ওদের নাও এখন মাঠে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালের সেই শুঁকনো মাঠ,
ক্ষেত
এখন বর্ষার জলে টুইটুম্বর।এখন নাও নিয়ে ফেরা যাবে না তাই ওদের আজ স্কুলে যাওয়া হবে না।
একটুপরে সেঁজুতি, তুলিকে নিয়ে ঘরের পাটাতনে গিয়ে বসে।সমবয়সী দুই কিশোরী এক অদম্য গল্পে মেতে ওঠে।
একটুপরে তুলি ওর ওড়নার আঁচলের এক কোনা থেকে একটা গিট্টু খুলে এক জোড়া ছোটো কানের দুল বের করে সেঁজুতিকে দেখালো।
সেঁজুতি দুল জোড়া হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো।অনেক সুন্দর এক জোড়া কানের দুল।কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তুলি সেঁজুতির কানের কাছে এসে চুপিচুপি বললো রাসেলের কথা।রাসেলের নাম শুনতেই সেঁজুতি মুচকি হাসি দিলো সাথে তুলিও।
একটুপরে সেই দুল জোড়া কানে পরে মুচকি হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরলো তুলি।আর সেঁজুতি ওদিকে তাকিয়ে রইলো,নরম কাঁদা পায়ে মেখে খালি পায়ে মেয়েটা কত সুন্দর হেঁটে যাচ্ছে। এ যেনো এক উচ্ছ্বল বালিকা,যার জন্মই হয়েছে এই পৃথিবীর সুখ উপলব্ধি করার জন্য।
বিকেলে শিকদার বাড়ির আবুলের বউ দৌঁড়ে আসলো সেঁজুতিদের বাড়ি।এসেই ফরিদাকে খুঁজতে লাগলো।ফরিদা বেগম এই মুহূর্তে ঘরে নেই হয়তো তার জায়ে’র ঘরে গেছে। তাকে খোঁজার কারণ জানতে চাইলে আবুলের বউ জোহরা বললো,
“মোল্লা বাড়ির ইউনুসের বউয়ের লগে জ্বিন ভর করছে।ঐ মহিলা নাকি এক বসায় ৩ গামলা ভাত খেয়ে ফেলে।তার মাথার চুলে নাকি জট পড়েছে আর
সে নাকি মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারে।”
কথার মাঝে ফরিদা বেগম এসে কথাটা শুনে দৌঁড়ে তারা ইউসুফের বউ আমেনাকে দেখতে গেলো।সেঁজুতি তাদের সাথে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তারা নেয়নি বরং বলেছে সেঁজুতি গেলে নাকি ঐ খারাপ জ্বিন ওর উপর ভর করতে পারে।
প্রায় সন্ধ্যা ঘোরঘোর তারা বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু বাড়িতে ফিরেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কারণ তার ১০ টা হাঁসের মধ্যে ১টা হাঁস নিখোঁজ। এই সন্ধ্যাবেলা ফরিদা বেগম কোমরে কাপড় গুঁজে এক হাঁটু কাঁদার মধ্যে নেমে বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজতে লাগলো।কিন্তু কোথাও সন্ধান পাওয়া গেলো না।
একটুপরে সেঁজুতি চেঁচিয়ে বললো,
–“মা,তুমি এখনি আমেনা চাচির কাছে যাও।সে নাকি সবকিছু বলতে পারে? তাহলে আমি নিশ্চিত সে তোমার হাঁসের খবরও দিতে পারবে।”
ফরিদা মেয়ের কথা শুনে রাগে জ্বলতে লাগলো।
সন্ধ্যার পর সেঁজুতির ভাই সিরাজ -উৎপল আর মিজানকে নিয়ে ঘরে এলো। ওরা ঘরের মধ্যে পশ্চিম পাশের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।সমবয়সী হলে যা হয় আরকি।
একটুপরে সিরাজ সেঁজুতিকে ঢেকে এক বাটি মুড়ি আর চা করে দিতে বললো।
সেঁজুতি ভাইয়ের কথা মতো সবকিছু নিয়ে ওদের রুমে পৌঁছে গেলো।উৎপলকে দেখলেই কেন যেনো সেঁজুতির হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় কোন কারণ ছাড়াই।উৎপল নামের ছেলেটা খুব ভদ্র। কথা কম বলে, কেউ ওকে হালকা বকে দিলেও মুচকি হাসে।
সেঁজুতিদের বাড়ির পাশেই ওদের বাড়ি।ওর বাবা করিম মোল্লা খুবই ভালো মানুষ।বিশাল বড় ব্যবসা আছে ওদের তাই গ্রামের মধ্যে ওরা বেশ নাম করা।এই একটাই ছেলে তাদের।
রুমে ঢুকেই উৎপলকে দেখে সেঁজুতি একটু আনইজি ফিল করলো কারণ উৎপল, সেঁজুতিকে দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
আজ যুথি ওর স্বামী আর এক মেয়ে নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। যুথি সেঁজুতির বড় বোন।গ্রামবাংলায় বিশেষ করে বর্ষাকালটা একটু বেশীই অবসরের সময়। তখন তেমন বেশী একটা কাজ থাকেনা।তাই যুথি আজ বাবার বাড়িতে এসেছে।
যুথির মেয়েটার বয়স ৪বছর। তিতলীকে নিয়ে আজ সারাদিন সেঁজুতির ভালোই কাটলো।বিকেলে তিতলীকে নিয়ে একটু হাঁটতে বের হলো সেঁজুতি।
তুলি দের বাড়িতে যাবে বলে বেরিয়েছে।সেঁজুতিদের বাড়ির পর উৎপলদের বাড়ি তারপর তুলিদের বাড়ি।
ক্ষেত ভর্তি এখন পানি তাই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।উৎপলদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই উৎপলের মা উঠোনে বসে সেঁজুতিকে ডাক দিলো।উৎপলের মা রেনু বেগম প্রায় অনেকক্ষণ সেঁজুতি সাথে কথা বললো।উৎপলের বিয়ের ব্যাপারটাও এড়ালোনা এই কথার মধ্যে থেকে।
রেনু বেগম ছেলেকে নিয়ে বেশ চিন্তিত।ভালো একটা মেয়ে খুঁজতেছে ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য।
উৎপলের বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই, কোন কারন ছাড়াই সেঁজুতির মুখটা লাল হয়ে উঠলো।মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখের সামনে উৎপলের মুখটা ভেসে উঠলো।
ওদের বাড়ি থেকে যেই বের হতে যাবে অমনি ঘরের মধ্যে থেকে উৎপলের কন্ঠ ভেসে আসলো। উৎপল সেঁজুতিকে ডাকছে।
সেঁজুতি ঘরের মধ্যে যেতে চাইলো না তারপরেও যেতে হলো।
ঘরে ঢুকতেই উৎপল বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার, তুই আমাকে দেখলে এমন করিস কেন?সমস্যা কি তোর?”
সেঁজুতি কোনো উত্তর দিতে পারে না,ওর হাত পা কাঁপছে।
সেজুতির এই অবস্থা দেখে উৎপল হাসতে লাগলো।
একটুপরে উৎপল আবার বললো,
–“আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। কোথায় বের হয়েছিস তুই এখন?”
–“তিতলীকে নিয়ে তুলিদের বাড়ি যাবো”।
–“এখন আর তুলিদের বাড়ি গিয়ে কাজ নেই।অনেক জোরে বৃষ্টি নামবে।বাসায় চলে যা।আর শোন তুই সারাদিন এতো এদিকসেদিক দৌড়াদৌড়ি করিস কেন? এখন থেকে প্রয়োজন ছাড়া কোথাও বের হবি না।
মনে থাকবে?”
–“সেঁজুতি মুখ দিয়ে কোন কথা বলতে পারলো না।কেবল মাথা নাড়ালো।”
একটুপরে উৎপলের মা ঘরের
বারান্দায়
পা রাখতেই,উৎপল তিতলীকে নিয়ে কোলে বসালো।খুব মিষ্টি একটা মেয়ে বলতে বলতে
চুপিচুপি উৎপল সেঁজুতির হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো।
উৎপলের মা ওর রুমে এসেই বলতে লাগলো,
“কবে যে আমার উৎপলকে বিয়ে করাবো আর ওর ও এমন মিষ্টি একটা মেয়ে হবে আর আমার হবে নাতি।কথাটা বলতে বলতে রেনু বেগম হাসতে লাগলেন।”
সেঁজুতি একেবারে চুপচাপ এককোনায় দাঁড়িয়ে রইলো। উৎপল ওর মায়ের কথা শুনে আবারো সেঁজুতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগলো।
এই মুহূর্তে সেঁজুতি লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে উঠলো।
তুলিদের বাড়িতে আর যাওয়া হলো না সেঁজুতির। এইমুহূর্তে সেঁজুতির বুকের হৃৎস্পন্দন ব্যাপক হারে বেড়ে গেলো।ও বাসায় এসেই আগে ঐ কাগজটা বইয়ের ভিতর লুকিয়ে রাখলো সবার অগোচরে। ঘর ভর্তি মেহমান।আজ ফুফুরা তাদের ছেলেমেয়ে সহ এসেছে। পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ।
আজ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মনে একটুও শান্তি পায়নি সেঁজুতি। মনে বারবার একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে আর সেটা হলো “কি লেখা আছে চিঠিতে।”
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে ধীরেধীরে ঘরে মানুষের কোলাহল কমতে লাগলো।একটুপরে রাতও বাড়লো আর সবাই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লো।
বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে সাথে প্রচন্ড বাতাস।টিনের চাল থেকে অনবরত বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ভেসে আসছে,সাথে বুকের মধ্যে কাঁপনটাও খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।
সেঁজুতি কাঁপাকাপা হাতে চিঠি টা খুললো।
সেখানে লেখা ছিলো………..
(চলবে)

লেখা: Hamida Imrose

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here