শ্রাবণ_তোমার_আকাশে পর্ব পর্ব ৬+৭

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

ভোরের সূর্য চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙে বেলার। মাথাটা হালকা ভার হয়ে আছে। সে পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকায়। কোথায় আছে প্রথমে বুঝতে পারেনা। আস্তে আস্তে মনে করার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই সবকিছু মনে পড়ে যায়৷ কাল বিকেলে কিডন্যাপ হয়েছিল এখন ভোর! শাইনির চেহারাটা ভেসে ওঠে মানসপটে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসতেই শক্ত কিছুর আভাস পায় সে। বুঝতে পারে এটা বিছানা নয়, সিমেন্টের শক্ত ফ্লোরে খড় বিছানো। তার উপরে এতক্ষণ শুয়ে ছিল বেলা। চারদিকে চোখ বুলায়। একটা বেড়ার ঘরে আছে ও। একটু দূরেই চৌকি পাতা৷ বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসছে সকালের মিঠা রোদ্দুর। আশেপাশে শাইনিকে না দেখতে পেয়ে অবাক হয় বেলা। সে উঠে দাঁড়ায়। বাসার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে যায়৷ যে করেই হোক, একটা খবর দিতে হবে। ওকে না পেয়ে সবার কি অবস্থা কে জানে। নিশ্চয়ই টেনশনে টেনশনে সবার অবস্থা খারাপ। কি করা উচিৎ বুঝে উঠতে পারেনা ও। কোথায় নিয়ে এসেছে ওকে কে জানে! সে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। এমন সময় খ্যাচখ্যাচ শব্দ করে বেড়ার দরজা খুলে যায়। বেলা পেছনে ফিরে শাইনিকে দেখে থমকে যায়। ওর হাতে খাবারের প্লেট। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-কী? পালানোর পথ খুঁজছিলে?
বেলা কয়েক পা পিছিয়ে বলে, ‘আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন?’
-বলবো না।
-কেন করছেন এমন? কী পাবেন এসব করে?
-তোমাকে।
-আমার মধ্যে তেমন কিছুই নেই। আমি খুব সাধারণ মেয়ে।
-তেজ তো কম না।
-আপনার সাথে কথা বলাই অন্যায়।
-তো বলো না।
-আমার বয়েই গেছে ।
-কথা পরে হবে। খাবার খেয়ে নাও।
-খাব না।
শাইনি শক্ত কন্ঠে বলল, ‘খেতেই হবে। দিস ইজ মাই অর্ডার।’
-আমার ক্ষিধে নেই। আমাকে যেতে দিন দয়া করে।
শাইনি হাত নাড়িয়ে বলে, ‘এসব বললে চলবেনা।’
-আপনি একটা নর্দমার কিট।
-হু তাই। মানলাম।
বলে শাইনি পরোটার একটা অংশ ছিঁড়ে তুলে ধরলো বেলার সামনে। রেগে গিয়ে সে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেললো খাবার। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
-নোংরা লোকদের হাতের খাবার আমি খাইনা।
শাইনি রেগে বলল, ‘এখন যদি না খাও তাহলে কী করব ভাবতেও পারছোনা।’
-কী করবেন? মারবেন? তো মারুন।
-তোমাকে মারলে আমারই ক্ষতি।
-তো বলছেন কেন?
-কারণ তোমার ফ্যামিলির লোক আছে। তাদের এক আধটু ক্ষতিতে আমার কিছুই যায় আসবেনা।
বেলা ছোট ছোট চোখ করে বলল, ‘মানে?’
-মানে ধরো, তোমার বাবাকে বললাম যে তোমাকে মেরে ফেলেছি তাহলে নিশ্চয়ই তিনি হার্ট-অ্যাটাক করবেন। বা, তোমার বাবাকে রাস্তায় একা পেয়ে গুন্ডারা ছুড়ি বসিয়ে দিল। এমন তো করতেই পারি, এটুকু করার ক্ষমতা আমার আছে। তোমার মাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেললাম বা দাদীকে ধাক্কা মারলাম! এমন কতকিছুই করতে পারি আমি।
বেলা আহত চোখে চেয়ে রইলো। শাইনি এত খারাপ ভাবতে পারছেনা। ও মিনমিন করে বলল, ‘এসব কিছু করবেন না আপনি.. ‘
-অবশ্যই করব যদি না খেতে চাও।
বেলা চুপচাপ খাবার খেয়ে নিলো। শাইনি বারবার ভয়ানক হাসি দিচ্ছে৷ ওর হাতে একটা ছুড়ি। বারবার মাটিতে আঁকিবুঁকি কাটছে। ওকে দেখতে কোনো খুনীর চেয়ে কম মনে হচ্ছেনা। এরকম লোকের পাল্লায় পড়েছে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে বেলার। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে সেখানেই বসে থাকে। শাইনি সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে যায়৷ বেলা বুঝতে পারে অন্যপাশে আরেকটি ঘর আছে। শাইনি আসতেই জিজ্ঞেস করে, ‘খাবার তো খেয়েছি। এবার প্লিজ বলুন আমাকে কোথায় এনেছেন?’
-লোকালয় থেকে দূরে এটাই জেনে রাখো।
-জায়গার নামটা কী?
শাইনি রেগে বলল, ‘কেন? পালাতে চাও নাকি?’
বেলা বলল, ‘এমনি জানতে চাইছি।’
-বোকা তুমি।
-যে অন্যকে বোকা ভাবে, তার মতো নির্বোধ এই পৃথিবীতে নেই।
-বাহ। কথার খই ফুটছে মুখে।
বেলা রাগে বলল, ‘আমি বোবা না। আপনি ব্ল্যাকমেইল করে আমাকে আটকে রেখেছেন। নইলে সাপের পাঁচ পা আরো আগেই দেখিয়ে দিতাম। এতদিন ভাবতাম আপনি চরিত্রহীন। কিন্তু আপনি যে তার চেয়েও বেশিকিছু তা ভাবিনি।’
শাইনি খড়ের গাদার উপর শুয়ে পড়ে। তার মাথায় এখনো একটা টুপি। এই গরমে কেন টুপি পরে আছে বেলা বুঝতে পারেনা। আর ওর বোঝারও দরকার নেই৷ গুন্ডা, মাস্তানরা একেক সময় একেক রুপ ধারণ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। গিরগিটি নিজেকে বাঁচাতে রঙ পাল্টায়। আর মানুষ নামের এসব অমানুষরা লোকজনকে ঠকাতে রঙ পাল্টায়। সেদিন নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় লোকটাকে এতোটা হিংস্র মনে হয়নি, যতোটা এখন হচ্ছে। বিচিত্র এই পৃথিবী! এর চেয়েও বেশি বিচিত্র এই পৃথিবীর মানুষজন। অথচ এখন বেলার কিছুই করার নেই। সে চুপচাপ বসে থাকে। মাথা ঘুরিয়ে ঘরটাকে পরখ করে।
মাঝারি আকারের রুম। একপাশে চৌকি, চেয়ার, মাথার ওপর খটখট শব্দ তুলে সিলিং ফ্যান ঘুরছে। অন্যপাশে একটা শোকেস রাখা। এই ভাঙা ঘরে কেন শোকেস রাখা হয়েছে ভেবে পায়নি বেলা। মাটিতে বিছানো খড়ের গাদা। সেখানে শাইনি হাত-পা মেলে শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে সে। বেলার হঠাৎ ভীষণ ভয় করতে লাগলো। একলা পেয়ে শাইনি যদি ওর কোনো ক্ষতি করে দেয়? তাহলে ও কার কাছে সাহায্য চাইবে? ঘেমে উঠলো ও।
এক-পা, দু-পা করে চৌকি থেকে নামে বেলা। ওমনি শাইনি পেছন থেকে খপ করে ওর হাত ধরে টান মারলো। বেলা একটু পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। শাইনি রুক্ষ স্বরে বলে ওঠে, ‘খুব সাহস তোমার? চেষ্টা করে দেখো পালাতে পারো কিনা! এমনি এমনিই তো আর হাত-পা বাঁধিনি। পালাতে চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারো। কিচ্ছু করতে পারবেনা।’
বেলা নিচু স্বরে বলল, ‘আ আমি পালাচ্ছিলাম না।’
-তাহলে?
বেলা ইতস্তত করে বলল, ‘আমি ওয়াশরুমে যাব।’
শাইনি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তুমি চিনো? জানো কোথায় যেতে হবে?’
-না।
-তাহলে? আমাকে বোকা ভাবো তুমি?
-না, আমি সত্যিই ওয়াশরুমে যাব। কোথায় সেটা?
শাইনি ওঠে এসে ওর হাত এমনভাবে ধরলো যেন হাত ছাড়লেই বেলা পালিয়ে যাবে। তারপর ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে চললো। ঘরের সাথেই লাগোয়া একটা টিনের বাথরুম। কোনো উপায় না পেয়ে অগত্যা ওটাতেই যেতে হলো বেলাকে। মিনিট দু’য়েক পর বাইরে বেরিয়েই দেখল শাইনি একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বোঝার চেষ্টা করলো ও কোথায় আছে। অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলো ও কোনো পাহাড়ের উপরে আছে। কারণ চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, সবুজে ঘেরা টিলা। দূরে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে কিছু বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। আকাশ মেঘলা। বেলার মন খারাপ হয়ে গেলো। এত উঁচু পাহাড়ে আছে সেখান থেকে চাইলেও পালানো যাবেনা। উপর থেকে পড়ে নির্ঘাত মৃত্যু। এই শাইনি লোকটা তো ভীষণ বদমাশ! কিছুতেই ওকে শান্তি দিচ্ছেনা। কিন্তু পরিবেশটা মনোমুগ্ধকর! কালো কালো মেঘকুঞ্জ ঠিক পাহাড়ের চূড়ায় লেগে আছে। ভেসে বেড়াচ্ছে তারা। অপরুপ সেই দৃশ্য। বেলা গুনার চেষ্টা করছে এখন কী মাস!
-এখন শ্রাবণ মাস। বললো শাইনি।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি কীভাবে জানেন?’
-ফোন থেকে জেনেছি। বর্ষাকালে এখানে প্রায়ই আসি।
-তো আমাকে নিয়ে আসার কারণ?
-বউয়ের সাথে হানিমুনে এসেছি। এখন এটা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেনা যে আমার বউটা কে!
বেলা বিরক্ত চোখে চাইলো। বলল, ‘বউ কে? আপনি তো ডিভোর্সের কাগজে সাইন করেছেন।’
-বোকা আমি? তক্ষুনি কাগজ হাজারকুচি করে ডাস্টবিনে ফেলেছি!
বেলা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ও মাই গড!’
শাইনি জোরে হাসে। বেলার মাথাব্যথা হচ্ছে। বাবার সব পরিশ্রম ব্যর্থ হলো তাহলে। বুঝতে পারে এই লোকটার কাছ থেকে এত সহজে মুক্তি পাবেনা ও। শাইনি সামনে থেকে এগিয়ে আসে। বলে, ‘খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
-বাসায় ফোন করব।
-মগের মুল্লুক? এত সহজে প্ল্যান নষ্ট করব? আবাল না আমি।
-প্লিজ। সবাই চিন্তা করবে।
শাইনি চিন্তাভাবনা করে বলল, ‘আমি জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। নো টেনশন।’
-আপনি কিডন্যাপার। কখনো বিশ্বাস করিনা আপনাকে।
-সে তোমার ব্যাপার। হা হা।
বেলা ছলছল চোখে তাকালো। রাগে সে বলে ফেলল, ‘খুনী, নর্দমার কীট!’
কথাটা শুনে শাইনি দু-পা এগিয়ে আসে। বেলা ভয় পেয়ে যায়৷ চোখ বন্ধ করে বলল, ‘আমি কিন্তু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।’
#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

কথাটা শুনে শাইনি দু-পা এগিয়ে আসে। বেলা ভয় পেয়ে যায়৷ চোখ বন্ধ করে বলল, ‘আমি কিন্তু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাব।’
শাইনি উচ্চস্বরে হেসে উঠে। বলে, ‘আমাকে ছেড়ে মরে যাবে? এত আগে? মরতে হলে আমাকে নিয়েই মরে যেও।’
-হুহ!
-চলো দুজন একসাথে ঝাঁপ দিই৷ ইতিহাসের পাতায় গোটাগোটা অক্ষরে আমার পাশে তোমার নামও লেখা থাকবে। চিরকাল সবাই আমাদের জুটিকে মনে রাখবে।
বেলা চোখ বড়বড় করে তাকায়। কি হচ্ছে ওর সাথে! ওফ.. পাহাড়ের উপর থেকে নিচে চোখ গেলেই ওর আত্মা কেঁপে উঠে। ইশ, কী ভয়ংকর! শাইনি ওর হাত ধরতেই বেলা ভাবে সত্যিই বুঝি এখন ওকে নিয়ে ঝাঁপ দিবে। এই লোককে বিশ্বাস নেই। লোকটা যে অতিশয় পাগল এটা ইতোমধ্যে বুঝে গেছে। আর পাগল লোকদের বেলা ভীষণ ভয় পায়। অনেকটা সময় পার হলেও নড়াচড়া টের না পেয়ে বেলা অবাক হয়।
সে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকায়৷ শাইনির ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে। সেইসাথে ওর গালের ডিম্পলগুলোও যেন হাসছে। বেলা চোখ কুঁচকে বলল, ‘হ হাসছেন কেন পাগলের মতো? আপনি কী মদ-গাঁজা খান নাকি?’
শাইনি হাসি থামিয়ে বলল, ‘মদ-গাঁজা খেলে কী হয়?’
-না মানে, এসব খেলে মানুষ পাগলের মতো হাসে শুধু।
-তুমি কী খেয়েছো এসব?
-না।
-জানো কীভাবে?
-মুভিতে দেখেছি।
-আর কী দেখেছো?
-মানে?
-রোমান্স দেখোনি?
বেলা রেগে বলল, ‘আমি আপনার মতো না। সারাদিন নোংরা চিন্তা নিয়ে ঘুরেন, ছিঃ!’
-ছিঃ বলার কী হলো? এসব নরমাল ব্যাপারস্যাপার।
-মোটেও তা নয়। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। নিয়মের বাইরে গেলে সেটা আর নরমাল থাকেনা। নিয়মবহির্ভূত কাজ যেমন জঘন্য তেমনি অপরাধও বটে! অবশ্য কাকে কী বলছি! হোটেলে ওই আপুটার সাথে যা করেছিলেন!
শাইনি চেপে ধরে ওকে নিজের সাথে। বেলার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। গলা কাঁপতে থাকে। কোনোমতে বলে, ‘কি করছেন, ছ ছাড়ুন আমায়।’
শাইনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘কী দেখেছিলে সেদিন হোটেল ঘরে? যে বারবার আমাকে নোংরা বলো? ভুলে ভরা একটা ঘটনা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই রটিয়ে বেড়াচ্ছো।’
-ভুল? কোনটা ভুল? আমি নিজের চোখে সবটা দেখেছি!
-সব দেখা সবসময় সত্যি হয়না। বলিনি বারংবার?
বেলা কটমট করে বলল, ‘ছাড়ুন আমাকে।’
শাইনি ছেড়ে দিলো ওকে। তারপর ঘরের ভিতরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়লো। তীর্যকভাবে রোদ এসে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। হালকা বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। খুব দূরে সরু একটা ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে। অন্তনীল আকাশখানি ঘন নীলের সমারোহে ডুবে আছে। শুভ্রসাদা মেঘেরা চোখের পলকেই দূরে ছুটে যাচ্ছে। কিছু মেঘ নিচে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। বেলা অবাক হয়ে গেলো। এ কোথায় আছে সে? এটা ওর নিজের দেশ? এত মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! এত আনন্দিত সে কোনোদিন হয়েছে বলে মনে পড়েনা। পৃথিবী কী আসলেই এতো সুন্দর? কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে মেঘেরা ওর দিকে আস্তে করে এগিয়ে আসছে। বেলা চোখ বন্ধ করে দু’হাত পাখির মতো ছড়িয়ে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড পরেই ভেজা ভেজা অনুভব করলো ও। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকালো। মেঘ ওর হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেলা খুশিতে চিৎকার করলো খুব জোরে। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে সেই চিৎকার আবারও ফিরে এলো ওর কর্ণকুহরে। খুশিতে ওর চোখে জল চলে এসেছে। জাগতিক সব চিন্তাভাবনা ভুলে সে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করায় মগ্ন হয়ে আছে। শাইনি কখন থেকে ওকে দেখে চলেছে। মেয়েটার মাঝে শিশুসুলভ এক ধরণের স্নিগ্ধতা, নমনীয়তা আছে যার কারণে কিছুতেই বেলাকে চোখের আড়াল কর‍তে পারছেনা ও। ওকে ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলেই গায়ের পশম কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ শূন্যতা অনুভূত হয়।
বেলার ধ্যান কাটে শাইনির ডাকে। ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। শাইনি বলল, ‘মেঘ দেখা শেষ হলে ঘরে আসো।’
-কেন?
-বরকে বাইরে রেখে এত ঘুরাঘুরি কীসের তোমার?
-আচ্ছা এগুলো কী সত্যিই মেঘ? নাকি কুয়াশা? প্রশ্ন এড়িয়ে প্রশ্ন করলো বেলা।
শাইনি মুচকি হেসে বলল, ‘উহু। সত্যিই মেঘ। শ্রাবণের মেঘলা দিন, মেঘলা আকাশ।’
-খুব সুন্দর।
-কী?
-জায়গাটা।
-আগে পাহাড় দেখোনি?
-না। সিলেটে একবার দূর থেকে দেখেছিলাম। কাছ থেকে কখনো নয়। এবারই প্রথম।
শাইনি জিজ্ঞেস করলো, ‘একটু পরে আরেকটা জায়গায় নিয়ে যাবো। সেটাও অসাধারণ।’
বেলা সন্দেহ নিয়ে বলল, ‘কোথায়?’
-আকাশে।
বেলা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ‘মানে? আপনি মেরে ফেলবেন আমায়?’
-না গো আমার বউ। শ্রাবণ মাসে আকাশের অপরুপ সৌন্দর্য দেখা যায় ওখান থেকে। সেটাই দেখাতে নিয়ে যাবো তোমায়।
-ওহ। কিন্তু এসবের থেকেও বেশি প্রয়োজন আমার এখান থেকে ফিরে যাওয়া।
শাইনি বলল, ‘যেদিন আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা তৈরি হবে সেদিনই যেতে পারবে। তার আগে নয়।’
বেলা তব্দা মেরে রইলো ওর কথা শুনে। এই লোককে ও দেখতেই পারেনা আবার বলে ভালোবাসার কথা! কিন্তু এখান থেকে যেতে হলে কিছু একটা ভাবতে হবে। হোক সেটা নাটক করে বা অন্যকিছু! কেশে বলল, ‘এর জন্য এতদূর নিয়ে আসার কী প্রয়োজন ছিল?’
শাইনি উদাস কন্ঠে বলল, ‘ভালবাসতে, গভীরভাবে ভালোবাসতে। আর ভালবাসানোতে। এই দুইটা জিনিস অনেকটা সূর্যের দুই দিক থেকে ছোঁয়া পাবার মতো৷ প্রকৃতির কাছে থাকলে অনুভূতি প্রগাঢ় হয়। আমাকে ভালোবাসতে হবে তোমার।’
বেলা তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘আপনি ভালোবাসার কী বুঝেন?’
-বুঝিনা। তবে বোঝার চেষ্টা করছি। এই এতগুলো দিন পরে এসে উপলব্ধি করতে পেরেছি নিশা আমার কেউ-ই ছিল না। সে মরিচীকার ন্যায় দৃশ্যমান হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। সত্যটা হলো, তুমি সত্যিই আমার কেউ হও। একদম নিজের কেউ, যার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবনা।
রোদ পড়ে যেতেই চারদিকে অন্যরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় পাহাড়ে। বেলা নিচে নামতে ভয় পায়। কিছুতেই নামতে চায়না। শাইনি ওর চোখ বেঁধে দেয়। অতি সাবধানে উঁচু পাহাড়টির ওপর থেকে নেমে আসে ওরা। কাঁটায় পা লেগে কতবার ব্যথাও লেগেছে শাইনির। সেসবের তোয়াক্কা না করেই নামতে সক্ষম ও। নিচে নেমে বেলার চোখ খুলে দেয়। সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। বেলা কৌতূহল দমাতে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার মাথায় টুপি কেন?’
শাইনি হাসে৷ বলে, ‘কেন?’
-অচেনা মনে হয়। গুন্ডা গুন্ডা লাগে।
-খুলে ফেলব?
-আপনার যা ইচ্ছা তাই করুন। আমি জানতে চাইছি ওটা পরে আছেন কেন?
-ভালো লাগে।
-আপনি না অসুস্থ। কী হয়েছিল আপনার?
-জানিনা। ওসব বিষয়ে আরকিছু জিজ্ঞেস করলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিব নিচে।
বেলা ভয় পেয়ে চুপ করে যায়। অদ্ভুত লোক, অসভ্য ব্যবহার তার।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকদূর চলে যায়। এদিকটায় কোনো বাড়িঘর নেই। এ সময়ে বেলার বাসার কথা মনে হয়। পা দুটো আর চলতে চাইলোনা। হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শাইনি হতচকিত হয়ে ওকে দেখে। শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কাঁদো কেন?’
বেলা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, ‘আম্মুর কথা মনে হচ্ছে!’
-একা থাকতে আর বাঁচতে শিখো। পিছুটান বড় খারাপ জিনিস। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
-আপনি নিষ্ঠুর। আমি কখনো ওদের বিশ্বাস ভাঙতে পারবনা।
-এখানে বিশ্বাস ভাঙার প্রশ্ন আসছে কেন?
-আপনি উল্টোপাল্টা কথা বলে আমার ব্রেইনওয়াশ করতে চাচ্ছেন। কিন্তু আমি সেসব শুনবোনা।
শাইনি বেক্কল হয়ে যায়। বেলার হাত মুঠোতে নিয়ে
হাঁটতে থাকে। ওর মুখ গোমড়া। রাস্তার ধারের বুনো লাল রঙের ফুল দেখে বেলা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখফুটে কিছু বলেনা। শাইনি ওকে ছেড়ে দিয়ে কয়েকটা বুনোফুল ছিঁড়ে নেয়। লাল আর গোলাপির মিশেলে জবাফুলের ন্যায় বড় ফুল। হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। হুট করেই বাতাসে উড়ন্ত বেলার কানের পাশে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো পেছনে গুঁজে দেয় শাইনি। আলতো হাতে ফুলগুলো পরিয়ে দেয়। বেলা হতভম্ব কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।
শাইনি মুগ্ধ কন্ঠে বলল, ‘মাই কুইন লুকস ভেরি নাইস! টু সুইট…’
বেলা ধমকের সুরে বলল, ‘চুপ করুন আপনি।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here