সখি ভালোবাসা কারে কয় পর্ব -০২

#সখি ভালোবাসা কারে কয়?
#পর্ব——২
কানিজ ফাতেমা

জানি না ভালোবাসা কারে কয়? আর জানতেও চাই না।
এই ফালতু কাজটা আমার সাথে কে করছে ? আর ভালো লাগে না। সামনে মাসে ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হবে। আমার কতদিনের স্বপ্ন হলে থেকে পড়বো, বান্ধবীদের সাথে ঘুরবো আর এই সময় যদি বাবার কানে এই কথা যায় তাহলে কোনো দিন তিনি ঢাকাতে হলে থেকে আমাকে পড়তে দিতে রাজি হবেন না। শেষে বাড়িতে থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। কথাটা মনে আসতেই মাথার মধ্য চক্কর দিয়ে উঠলো।

সেই ছোটবেলা থেকে এই মানিকগঞ্জ শহরে নিজেদের বাড়িতে থেকে বড় হয়ে উঠেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দাদার বাড়িতে বাবা-মার সাথে আমি আর নির্ঝর ভাইয়া নির্ভয়ে বড় হয়েছি।আমাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িটাই মিথিলা আপুদের বাড়ি। মিথিলা আপুর বাবা আমার বাবার একমাত্র আপন চাচাতো ভাই। পাশাপাশি বাড়ি বলে সব সময় এক সাথে উঠাবসা চলে আমাদের। তাছাড়া আমার বাকি চাচা ফুফুদের নিয়ে বিশাল বংশ আশেপাশের এলাকাতে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।আর এই এলাকাতে বিয়ে শাদি করে সবাই এই মানিকগঞ্জে ডজন খানেক আত্মীয় তৈরী করে রেখেছেন।

তাই বলতে গেলে বাড়ির আশেপাশের এলাকাতে একরকম নির্ভয়েই চলাফেরা করি আমরা। আশেপাশের কোনো ছেলের সামনে এসে কিছু বলার ক্ষমতা হবে না কোনো দিন। কিন্তু এই চিঠি পাঠানো মানুষটা কে? প্রথম দিকে রাগ হলেও ইদানীং কেমন জানি জানতে ইচ্ছে করে। আমাদের বাসায় একমাত্র আম্মু বিষয়টা জানে আর আম্মুই বলেছিল এসব কথা তোর বাবা কিংবা নির্ঝর কাউকে বলতে যাস না। কে না কে বদমায়েশি করে এসব করছে ? শেষে তোর বাবা কিংবা ভাইয়া জানলে অযথা চিৎকার করে তোর চাচা ফুপুদের জানাবে তারপর পাড়ার লোক জানবে অযথা কথা ছড়াবে।

অযথা এসব ফালতু বিষয় নিয়ে না ভেবে সামনের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তা ভাবনা কর। কোন ভার্সিটিতে পড়বি। কোন সাবজেক্টে ভর্তি হবি এসব নিয়ে ভাব। তখন আম্মুর কথাই ঠিক মনে হয়েছিল আর তাছাড়া এতোদিন ভেবেছিলাম কলেজের কোনো স্টুপিড হবে হয়তো। তাছাড়া এতোদিন কোচিং, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে ব্যাপারটাকে তেমন আমলে নেয়া হয়নি।কিন্তু আজ বাড়ি পর্যন্ত এসে যখন হাতে চিঠি ধরিয়ে দেওয়ার সাহস করেছে তখন আর চুপ থাকা যাবে না। কিন্তু কাকে বলবো ? নির্ঝর ভাইকে বলবো ? না থাক ঝামেলা বাঁধানোর ওস্তাদ একটা।

তাছাড়া আজ সারাদিন বাসার মধ্যে নির্ঝর ভাইয়ার বন্ধু থেকে শুরু করে বাইরের অনেক দাওয়াতের লোকজন ছিল তাই কাকে সন্দেহ করে কিছু বলবো বুঝে পেলাম না। হঠাৎ মনে হলো শুভ ভাইকে বলি? শুভ ভাই আমার বড় খালার ছোট ছেলে। সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে ইন্টার্ন শুরু করেছে মাত্র। একসময় সাভারেই থাকতো খালামনিরা, আর শুভ ভাইয়াও আমাদের কলেজ থেকেই ইন্টার পাস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল। নেহায়েতই শান্ত ভদ্র আর খুব হেল্পফুল ছেলে। কখনো কোনো মেয়ের দিকে বাজে ভাবে তাকাতে দেখিনি।
এই যে আমি মীরা আপু মিথিলা আপু তার আশেপেশেই বড় হয়েছি। আমার ভর্তির সময়ও শুভ ভাইয়া নিজে কী কী পড়তে হবে কতবার মানিকগজ্ঞে এসে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, কিন্তু কখনো দেখিনি কোনো বাজে কথা বলেছেন। হ্যাঁ শুভ ভাইয়াই সেফ ব্যক্তি যে চুপ থেকে সব ঝামেলার সমাধান করতে পারবে।

যাই হোক, এখন মনে হচ্ছে এই লুকিয়ে থাকা রোমিওটা কে সেটা খুঁজে পেতে শুভ ভাইয়ের সাহায্য আমাকে নিতেই হবে। সেই ইন্টার পরীক্ষার পর থেকে একটার পর একটা চিঠি পাঠাতে থাকে কখনো গেটের সামনে তো কখনো ঘরের জানালার ফোঁকর গলিয়ে আবার কখনো ডাকপিয়নের হাতে ঠিকানাবিহীন চিঠি। দুবার বাবার হাতে ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে গেছে আম্মু তার বান্ধবীদের নাম বলে আমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে চললে ঝামেলা আরো বাড়বে । তাছাড়া মিথিলা আপুর বিয়েতে বড় খালামনিদের সাথে শুভভাইও এসেছে। সকালে উঠেই শুভ ভাইয়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে হবে। এমনিতেই মীরা আপু জেনে ফেলেছে তাই নির্ঝর ভাইয়ের কানে যেতে কত দিন লাগবে কে জানে ? তার আগেই শুভ ভাইকে দিয়ে ব্যাটা রেমিওকে শায়েস্তা করতে হবে।

সবার সাথে প্রায় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালে বাসায় এসে বিছানায় যেই না শুয়েছি বেহুঁশের মত ঘুমিয়ে উঠেছি প্রায় তিনটায়। ঘুম থেকে উঠে ডাইনিংয়ে আসতেই আম্মু বকা দিয়ে বলল “কি রে নিধি ঘুমিয়েছিস ভালো কথা। মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে ঘুমাবি না। যা তাড়াতাড়ি গোসল করে আস। মেকাপে সারা মুখে লেপ্টে কেমন ভূতের মত লাগছে তোকে, একবার আয়নাতে গিয়ে দেখ।”
আম্মু কথাটা বলতেই বেসিনের সামনে গিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখি যাচ্ছে তাই অবস্থা একেবারে ডাইনি মনে হচ্ছে আমাকে । এর মধ্যে বাবা ও বড়খালু কথা বলতে বলতে ভেতরে আসছেন বুঝতে পেরে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম।

বাথরুম থেকে বের হতেই আম্মুকে বড় খালার সাথে ডাইনিংয়ে গল্প করতে দেখে মাথার চুল মুছতে মুছতে কাছে এগিয়ে আসতেই আম্মু বলল -“তাড়াতাড়ি কর তোর বড়চাচী কতবার খাওয়ার জন্য ডাকতে পাঠিয়েছে। তোর জন্য যেতে পারছি না।”
“হুম চলো”- বলে ঘরে যাওয়ার সময় শুভ ভাইয়ের কথা মনে আসতেই পেছন ফিরে বড়খালাকে জিজ্ঞেস করলাম – খালামনি শুভ ভাই কোথায়?
কোথায় আবার নির্ঝরের সাথে মিথিলাদের বাড়িতে খেতে গেছে। আম্মুই উত্তর দিয়ে বলল তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয় না! এতো দেরি করলে খারাপ দেখাচ্ছে না বলো তো বড় আপা।
উফ্ আম্মু আসছি। তুমি সব কিছুতে এতো অস্থির হয়ে যাও না।

মিথিলা আপুদের বৌভাত আগামীকাল। সেই কারণে আত্মীয়-স্বজন বেশ রিল্যাক্স মুডে গল্প আড্ডায় মজে রয়েছে শুধুমাত্র বড়চাচী বাদে। আম্মু যাওয়ার সাথে সাথে হাতে হাতে কাজ শুরু করে দিল। সাথে আমার গুন-কীর্তন -“বড় ভাবী আর বলেন না সেই সকাল থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।এখন উঠলেন বাবার রাজকুমারী। তারপর বাড়ি থেকে বের হতে পারলাম। আর বলেছিলাম না সেই ঘটনা”- কথাটা বলতে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল আম্মু।

আমার বুঝতে বাকি রইলো না চিঠি আসার ব্যাপারটা বড়চাচীকে জানানো হয়ে গেছে। আম্মুর এই এক দোশ আমাকে বলবে বলিস না এদিকে নিজের বেলায় পেটে কথা থাকে না।
আম্মুর কথাকে অ্যাভয়েড করে শুভ ভাইকে মনে মনে খুঁজতে খুঁজতে বসার ঘরে আসতেই হুলুস্থুল ব্যাপার চোখে পড়লো।
হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না ঠিক। শুভ ভাই বসার ঘরে আছে ঠিকই কিন্তু বিয়েতে আসা এক দল মুরুব্বি তাকে ঘিরে বসে আছেন।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি এই ভেবে শুভ ভাই ফ্রি হলে চিঠির কথাটা বলবো। আসলে ফ্রি ডাক্তার পেয়ে সবাই নিজের প্রেশার মাপিয়ে নিচ্ছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে আছি দেখে শুভ ভাই-ই ডেকে বলল “কি নিধি তুমিও কি প্রেশার মাপতে এসেছো” -বলে হাসলে বললাম – “না ভাইয়া এমনি দাঁড়িয়ে আছি”- বলে সামনে থেকে ডাইনিংয়ের দিকে আসতেই বড়চাচী ডেকে বললেন -“কই নিধি চেয়ার টেনে বস । খাবি না?”
ডাইনিংয়ে বড়চাচী বড় খালা আম্মু সহ আমার দুই ফুপু খেতে বসেছেন।
বললাম পরে খাবো বড়চাচী- বলে মীরা আপুর কাছে গিয়ে সোফায় বসতেই মিরা আপু বলল “এই নিধি দ্যাখতো চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে নাকি?”
“না তো আপু।”
“ধুত কাল রাত জাগা ঠিক হয়নি॥”
“থাক অসুবিধা নাই কাল যাওয়ার আগে সেইরকম মেকাপ নিয়ে নিব। কি বলিস নিধি?”
“আমি আর মেকাপ করবো না আপু।”
“চুপ খালি নাকে কাঁদার স্বভাব তোর। আরে এখনইতো সাজগোজ করার বয়স। না হলে চলবে ক্যানো।তাছাড়া তোর প্রতি আমার অন্যরকম দায়িত্বও রয়েছে না।”
“হুম তাই তো “-বলে দুজনেই একসাথে হেসে উঠতেই শুভ ভাইয়া সামনে এসে দাঁড়ালো।

শুভ ভাইয়াকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বললাম – ভাইয়া আপনার সময় হবে ? একটু কথা বলতাম।
কি বলো।
এখন না পরে বলবো।
ঠিক আছে।ও আচ্ছা নিধি তোমার নামে একটা চিঠি পিয়ন দিয়ে গেলো।
শুভ ভাইয়ার মুখে কথাটা শুনেই ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে শুভ ভাইয়াকে চুপ করতে ইশারা করে মীরা আপুকে বললাম আপু একটু ছাদে আসবে। শুভ ভাইয়া আপনিও।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here