সখি ভালোবাসা কারে কয় পর্ব -০৪

#গল্প——
#সখি ভালোবাসা কারে কয়?
পর্ব—-৪
কানিজ ফাতেমা

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, বাসায় কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে আম্মু যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর নির্ঝর ভাইয়া এসে বড় চাচা ও চাচীকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। তারাও এখনো বাসায় ফেরেনি দেখে টেনশনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এদিকে এই বাসায় থাকা মেহমানরা বার বার মীরা আপুকে আমাদের বাড়িতে কি হয়েছে সে কথা জিজ্ঞেস করে অস্থির করে তুলেছে? যাই হোক, সন্ধ্যার পর বড়চাচী ফিরে এসে খুব খুশি মনে বাড়িতে আসা মুরুব্বী আত্মীয়-স্বজনদের কি হয়েছে সে প্রশ্নের কিছু একটা উত্তর দিলেন। যেটা আমার এ মীরা আপুর কান পর্যন্ত পৌঁছালে না। তবে বড়চাচীর একটা কথা শুনে খুব অবাক লাগলো । কথাটা হলো-“আমার বাবা এই বাড়িতে অর্থাৎ মিথিলা আপুর বিয়েতে আসা সকল আত্মীয় স্বজনদের আজ রাতে আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়াতের আয়েজন করছেন।” সত্যিই অবাক করার মত কথা।

যাইহোক বড়চাচী সবাইকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও দ্রুত হাতে বাড়ির সব কাজ গুছিয়ে নিতে লাগলেন।
বড় চাচীকে তাড়াহুরা করে সবকিছু গুছিয়ে সব ঘরে তালা লাগাতে দেখে মীরা আপুও অবাক হয়ে বড়চাচীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো- মা সব ঘরে তালা দিচ্ছো কেনো?
কেনে আবার শুনলি না নিধিদের বাড়িতে এখন দাওয়াত।
সে তো শুনলাম কিন্তু কেনো?
কেনো সেটা গেলেই জানতে পারবি বলে বড়চাচী আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল-
মীরা তুই এক কাজ কর এখনই নিধিকে নিয়ে ওদের বাড়িতে চলে যা, আমিও আসছি ।
পরক্ষনেই বললেন না হয় একটু অপেক্ষা কর এক সাথেই যাবো।
মীরা আপুর সাথে আমিও অবাক চোখে বড়চাচীর দিকে তাকিয়ে রয়েছি।

তবে বড়চাচীর হাসিমুখ দেখে এটা ভেবে শান্তি লাগছে যে নির্ঝর ভাইয়া বোধ হয় বাসায় গিয়ে কিছু বলেনি। উফ হাফ ছেড়ে বাঁচার মত অবস্থা আমার।
কিন্তু বড়চাচীর হাসিটা বড় সন্দেহজনক লাগছে আমার কাছে।
মীরা আপু খুব বিরক্তি দেখিয়ে বলল- দেখ আম্মু এসব সাসপেন্স ভালো লাগছে না কিন্তু। কোথায় এখন ফেসিয়াল করতে বসবো কাল পোগ্রাম আর তোমরা কি সব শুরু করেছো। বলবে কি হচ্ছে নিধিদের বাড়িতে।
বড়চাচী হেসে বললেন-কেনো পরে শুনবি । এখন যেটা বলছি সেটা কর তো। আচ্ছা না থাক একটু পরে আমিই তোদের সাথে করে যাবো।

কেনো তোমার আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে কেনো? গেট পেরোলেই তো নিধিদের বাড়ি।
মীরা তুই সব সময় এত কথা বলিস কেনো বলতো ? কথাটা বলেই মিথিলা আপুর বিয়েতে আসা আমার বড়ফুপুকে ডেকে বড়চাচী বললেন- বড়আপা আপনিই না হয় নিধি আর মীরাকে নিয়ে ও বাড়িতে চলে যান। আপনার ভাই নির্ঝরকে সাথে করে বাজার করতে গেছে। ওরা আসুক আমিও সব গুছিয়ে বাকি সবাইকে নিয়ে আসছি। আর মীরা নিধি মাথায় কাপড় দিয়ে যাও।

মা আমার কিন্তু আর ভালে লাগছে না। কাহিনি কি আগে বলবে?সবাই সিনেমার মত সাসপেন্স করছো কেনো? মীরা আপু বিরক্তি দেখিয়ে কথাটা বলতেই বড়চাচী আবারও হেসে বললেন- তোকে যেটা বলছি সেটা কর। আর নিধিদের বাড়ি গিয়ে ছোটচাচীর থেকে শুনে নিবি কি কি করতে হবে? সবাই মিলে হাতে হাতে সব কাজ করলে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিতে পারবো বুঝেছিস? বলেই বড় ফুপুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আপা একেই বলে ভাগ্যের লিখন।
আপনারা গিয়ে দেখেন ছোট বৌকে কোনো সাহায্য করতে হবে কি না। আমিও তাড়াতাড়িই আসছি।

বাড়িতে ঢুকেই কেমন অদ্ভুত লাগলো আমার। আম্মু আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। এর মধ্যে ডাইনিংয়ে বসে থাকা আমার বড়খালা চেয়ার থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর কপালে চুমু খেয়ে নিজের গলায় পরে থাকা একটা চেইন খুলে আমাকে পরিয়ে দিলেন।
আমি হতভম্বের মত সবার প্রতিক্রিয়া দেখছি। আম্মু চোখ মুছতে মুছতে খালার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি মীরা আপুর দিকে জিজ্ঞাসার চোখ নিয়ে তাকালে সেও অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি ঘটছে?

এর মধ্যে বড়চাচা দুই হাত ভর্তি শপিংব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় এসেই আম্মুকে ডেকে বললেন- ছোটবৌমা এই নাও আমার নিধির বিয়ের বাজার। বড়চাচার পেছনে নির্ঝর ভাইয়াও দুই হাতে শপিংব্যাগ নিয়ে বাসায় ঢুকলো। বড়চাচা আবারও বলে উঠলেন
বাকি জিনিসপত্র মোকারম আর বড় বেয়াই নিয়ে আসছেন ।
বড়চাচা শুভ ভাইয়ার বাবাকে বড় বেয়াই বলে ডাকেন। তারপর আবার বললেন তোমরা সব কিছু দেখে নাও আর কিছু লাগলে নির্ঝরকে বলো ও তাড়াতাড়ি গিয়ে কিনে আনবে।
হঠাৎ বিয়ের বাজার কথাটা কানে আসতেই বুকের মধ্যে ধপাস করে উঠলো আমার। আমার বিয়ে মানে মীরা আপুর দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই মীরা আপু অবাক চাহনি নিয়ে নির্ঝর ভাইয়ার দিকে তাকালো।

নির্ঝর ভাইয়া কাছে এগিয়ে এসে হাসি মুখে বলে উঠলো কেমন হুট করে তোর আর শুভর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললাম দেখেছিস?
নির্ঝর ভাইয়ার মুখে কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি দেখে মীরা আপু আমার ডান হাতটা ধরে বলল- ছোটচাচী আমি নিধিকে নিয়ে ওর ঘরে যাই- বলেই আবার নির্ঝর ভাইয়াকে আমাদের সাথে আসতে ইশারা করে বলল, তুমি একটু নিধির রুমে আসোতো।
মীরা আপুর সাথে ঘরে ঢুকেই আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।
আমাকে কাঁদতে দেখে নির্ঝর ভাইয়া অস্থির হয়ে এগিয়ে এসে বলল কি রে কাঁদছিস কেনো?
কাঁদছে কেনো সেটা তোমরা কি করে বুঝবে? নিধিকে একবার জিজ্ঞেস না করে এভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করার মানে কি? আর শুভ ভাই সে কি রাজি?

আরে জিজ্ঞেস করার কি আছে শুভ নিধিকে পছন্দ করে। তাছাড়া নিধিরও ঢাকাতে গিয়ে পড়ার ইচ্ছা। তাই শুভর সাথে নিধির বিয়েটা হয়ে গেলে আব্বা-মাও চিন্তা মুক্ত হয়ে যাবেন।
এবার আমি ভাইয়ার সামনে এগিয়ে এসে বললাম- কে বলেছে শুভ ভাইয়া আমাকে পছন্দ করেন?
কেনো তুই জানিস না? পছন্দ না করলে আজ তোকে চিঠি দিয়েছিল কেনো?
কোন চিঠি?
তোর হাতে যেই চিঠিটা শুভ তোকে দিয়েছিল। ওই চিঠিটা বড়খালুকে দেখলে তিনিই বললেন তোরা দুজন যখন দুজনকে পছন্দই করিস তাহলে আজই তোদের বিয়েটা পড়িয়ে দিই । সব নিকটাত্মীয়রা এসেছেনই তখন শুভ কাজটা সেরে ফেলি। মাসখানেক পর অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিয়ে যাবো।
বড়চাচা, বাবা আম্মু সবাই রাজি হয়ে গেলো তাই সব আজই আয়েজন করা হচ্ছে। তাছাড়া বাবা মাও মহাখুশি হয়েছেন তোর আর শুভর বিয়ের সিদ্ধান্তে।

কিন্তু ভাইয়া বলে নির্ঝর ভাইয়াকে চিঠির সত্যিটা বলতে যাবো এমন সময় ভাইয়াই উল্টো আমাকে বলল- শোন শুভকে আমারও খুব পছন্দ। যদিও চেয়েছিলাম কয়েক বছর পর তোর বিয়ে দেবো। কিন্তু সবই আল্লাহর ইচ্ছা বুঝলি। আর শুভর মত ছেলে অনেক খুঁজলে একটা পাওয়া যায় বুঝলি পাগলি -বলে আমার মাথায় হাত রেখে মীরা আপুর দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বলল আমার পিচ্চি বোনটা এতো তাড়াতাড়ি শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি- কথাটা বলতে গিয়ে চোখদুটি ভিজে উঠলে তাড়াতাড়ি শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে আবার হেসে বলল- মীরা শোনো এক কাজ করো -নিধির জন্য আর যা কিছু লাগবে একটা লিস্ট করে দাওতো তাড়াতাড়ি। আমাকে আবার বাজারে যেতে হবে।
আমি বাবার সাথে কথা বলে আসছি তুমি তাড়াতাড়ি লিখে রাখো আমি এসে নিয়ে যাচ্ছি- বলে নির্ঝর ভাইয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি ধপ করি বিছানায় বসে কেঁদে ফেললাম।

আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল শুভ ভাইয়া আমার সাথে এটা কীভাবে করতে পারলো। আমাকে তার কবে থেকে পছন্দ? আর চিঠির মানুষটা যে সে নয় সে কথাটাই বা সকলের সামনে বললো না কেনো? কথাগুলো ভেবে শুভ ভাইয়ের উপর যতটা না রাগ হচ্ছিল তার চেয়ে এখন কী করবো? কী করে এই বিয়ে বন্ধ করবো? সে কথা ভেবে নিজেকে কেমন অসহায় মনে হচ্ছিল। সবচেয়ে এটা ভেবে খারাপ লাগছিল চিঠির মানুষটা জানতেও পারবে না তার নাম নিয়ে অন্য কেউ আমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কথাটা মনে আসতেই আমি মীরা আপুকে বললাম – আপু সেই চিঠির মানুষটা তো শুভ ভাইয়া না। তবে কেনো সে আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে?
জানি না রে।
আমি শুভ ভাইকে বিয়ে করতে চাই না মীরা আপু । প্লিজ কিছু করো।
কিন্তু কেনো নিধি? শুভ ডাক্তার হতে চলেছে সুন্দর দেখতে ভদ্র স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়েও দারুন একটা ছেলে। আমারও এখন মনে হচ্ছে যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। তুই না করছিস কেনো? তাছাড়া তোর তো কেনো পছন্দের কেউ নেইও- তাই না?

চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here