সতীনের ঘর
সিজন ২
পর্ব ১
কলিংবেল দিতেই একটা মেয়ে এসে দরজা খুললো।মেয়েটির বয়স খুব বেশি হলে, বাইশ কি তেইশ হবে।তবে মেয়েটি খুব চঞ্চল, উস্মৃঙ্খলতা তার স্বভাবে ফুটে উঠেছে।মেয়েটি দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
– কে আপনি,কাকে চাই?
কিছু না বলে ঘরে ঢুকে যাওয়াতে,মেয়েটি বেশ রেগে গেলো।
– এইযে শুনছেন,কাকে চাই?এভাবে কিছু না বলে ঘরের ভিতর ঢুকে যাচ্ছেন যে?কথা বলছেন না কেনো?আপনি কি পাগল?কি আশ্চর্য কথা নাই বার্তা নাই,এভাবে বাসার ভেতর ঢুকছেন,আপনি যদি পাগল হয়ে থাকেন তাহলে পাগলা গারদে গিয়ে মরেন এখানে কি?
দারোয়ান!এই দারোয়ান! ব্যাটা কই গেলো,এই ব্যাটা রে ইচ্ছে করছে কান ধরে উঠবস করাই। ব্যাটা খায় আর ঘুমায় আর মাস শেষে আরামসে বেতন নিয়ে যায়।বাসায় কে আসে কে যায় তার কোনো খেয়ালই নেই।
– দারোয়ান!এই দারোয়ান!
– যে আফা?
– কোথায় ছিলেন এতক্ষন?
– বাথরুমে গেছিলাম আফা।
– এই মহিলা ভেতরে ঢুকলো কিভাবে,আপনি কোথায় ছিলেন?
– আফা আমি হেরে না করছি ভেতরে ঢুকতে, কিন্তূ নজু দারোয়ান কইলো,হে নাকি এই বাসার মালিক,তাই আমি হেরে ঢুকতে দিছি।
– ইস রে আসছে আমার বাড়ীর মালিক,এইযে মহিলা শুনছেন নিজে থেকেই বের হয়ে যাবেন নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে হবে?
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বিজয় ঘর থেকে বের হয়ে এসে,হা করে তাকিয়ে রইলো।দরজা খুলে দেওয়া মেয়েটি বিজয়ের কাছে গিয়ে বললো,
কি বাবা আপনি ওনার এমন কাণ্ড কারখানা দেখেও চুপ করে আছেন,কিছু বলছেন না কেনো?
বিজয় বলে উঠলো,সুফিয়া!
সুফিয়া এতক্ষন কোনো কথায় কান না দিয়ে, ভালো করে পুরো বাড়ীটা ঘুরে দেখছিলো। বাড়ীটা আগের মত থাকলেও,কিছুই আর আগের মতো নেই।
আগে বাড়ীর সামনে অনেক গাছ পালা ছিলো,এখন ওগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। বাড়ীর সামনে করা হয়েছে আকর্ষণীয় পানির ঝর্না।বাড়ির ভেতরও অনেক চেঞ্জ এসেছে।
ড্রয়িং রুমের দেয়ালে টাঙানো ছবি গুলো ছুয়ে দেখছিলো সুফিয়া।পুরো দেওয়াল টা কে সাজানো হয়েছে কিছু পুরনো ছবি দিয়ে।কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ছবি গুলোতে। পরীর ছবি, পরীর বাবা মা,দাদু,এমন কি সুফিয়ারও অনেক ছবি আছে এইখানে,মনের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ছুয়ে গেলো এক চিলতে হাসি।
সুফিয়া এতক্ষন ওই মেয়েটার কথায় কোনো কান না দিলেও, বিজয়ের সুফিয়া বলে ওঠায়, ওর দিকে ফিরে তাকালো।
বিজয় কে দেখে একটু অবাকই হলো সুফিয়া,উইল চেয়ারে বসে আছে মানুষ টা,তার এই অবস্থা হলো কি করে!তবে দেখতে আজও দারুন।শেমা চেহারায় চাপ দাড়ি।বয়সের কারণে দাড়িতে হালকা পাকা ধরেছে বটে,তবে দাড়ির শেপ সেই আগের মতই আছে। মাথার চুল গুলোও সাদা সাদা হয়ে গেছে,তবে বয়স হলেও যে মানুষটাকে দেখতে মন্দ লাগেনা,আজও অনেক সুন্দর দেখায়।
বিজয় চোখে মুখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে সুফিয়ার দিকে,সুফিয়া বিজয়ের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেলো সব প্রশ্ন কে।বিজয় অবাক চোখে দেখছে সুফিয়া কে,মনে মনে ভাবছে সে কোনো স্বপ্ন দেখছে না তো!
এতক্ষণ চেঁচামেচি করা মেয়েটার গলার স্বর,এখন নিচু হয়ে আসলো।ভাবতে লাগলো এই সুফিয়া নামটা কোথায় যেনো শুনেছে সে।
সুফিয়া মেয়েটাকে ভালো করে দেখছিলো,ও ধরেই নিয়েছিলো মেয়েটা পরী।এর মধ্যে উপর থেকে আরেকটা মেয়ে নিচে নামলো,জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে,চিল্লাচিল্লি শুনলাম আর উনি কে?
সবাই চুপ,কেও কোনো কথা বলছেনা।
সুফিয়া এখন একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো,বুঝতে পারছেনা ওই মেয়েটা যদি পরী হয় তাহলে মাত্র যে নিচে নেমে আসলো এটা কে?
সুফিয়া ওদের সাথে কোনো কথা না বলে,হর হর করে উপরে উঠে সেই খালি ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলো,সেই ঘরটায় যেখানে বিজয়ের দ্বিতীয় বিয়ের দিন রাতে সুফিয়া ছিলো এবং পরবর্তীতে যেখানে থাকতো। কিন্তূ আশ্চর্যের বিষয় এই ঘরটা এখন আর খালি নেই,ঘরের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এই ঘরটায় কেউ থাকে।এবং এই মাত্রই কেও ছিলো এখানে,কারণ বিছানা থেকে উঠে যাওয়ার ফলে বিছানার চাদরটা একটু কোচকানো হয়ে আছে।তবে ঘরটা বেশ গোছানো,একজন মানুষ থাকতে হলে যতোটা গোছানো থাকার কথা ঠিক তেমনই।সুফিয়া বুঝতে পারলো এইঘরটা এখন আর খালি নেই।
মেয়ে দুই টা ও সুফিয়ার পেছন পেছন উপরে গিয়েছিলো।
সুফিয়া ওই মেয়ে দুজনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,এই ঘরে কে থাকে?
প্রথম মেয়েটা, মানে এতক্ষন যে চেঁচামেচি করছিলো, সে সামনে এসে বললো
– এটা আমার ঘর।
সুফিয়া মা মা করে ডেকে,শাশুড়ির ঘরের দিকে যেতেই,দ্বিতীয় মেয়েটা মানে পরে যে মেয়েটা নিচে নেমেছে, সে সামনে গিয়ে বললো
– এটা আমার ঘর।
সুফিয়া নিচে নেমে,হাত থেকে ব্রিটকেস টা রেখে,ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টা টেনে বসলো।এক গ্লাস পানি খেয়ে,বিজয় কে জিজ্ঞেস করলো
– মা কোথায়?
– মা নেই।
– কোথায় গেছে?
– আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে।
– কি বলছো!কবে হয়েছে এটা?
– প্রায় সাত বছর।এইটা বলে বিজয় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।সুফিয়া কথাটা শুনে খুব কষ্ট পেলো।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।সুফিয়া চোখের পানি মুছে,আবার বিজয় কে জিজ্ঞেস করলো
– ছোটো কই,ছোটোকেও তো কোথাও দেখছিনা।
– ও আর মা একসাথেই….
– মানে!কি বলছো এইসব?
– পরীর নানার বাড়ী যাওয়ার সময়, রাস্তায় গাড়ি একটা বড়ো খাদে পড়ে যায়, আমরা সবাই খুব বাজে ভাবে আহত হয়ে ছিলাম,তবে আমরা বেচে গেলেও মা আর পরীর মা কে বাচানো যায়নি।
– তোমার এই অবস্থাও কি ঐ একসিডেন্টের কারনেই?
– হ্যা।
– পরী কোথায়?
– বিজয় মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে,আর ওর একটা সুন্দর মেয়েও হয়েছে।
– সুফিয়া হাত দিয়ে পাশে দাড়িয়ে থাকা মেয়ে দুজনকে দেখিয়ে বললো,ওরা কে তাহলে?
– ওরা তো আমাদের যমজ ছেলে,রিফাত আর সিফাতের স্ত্রী।
– কি বলো,ওদের বিয়ে হয়ে গেছে?ওরা তো এখনও অনেক ছোটো,ওদের বিয়ের বয়স হয়েছে?
– বিজয় একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,সুফিয়া তুমি ওদের পাঁচ বছরের রেখে গিয়েছিলে,এখন ওদের পঁচিশ বছর।
– তবুও পঁচিশ বছর কি খুব বেশি?
– তা না,আসলে ওদের মা মারা যাবার পর,খুব কষ্ট করে সামাল দিয়েছি ওদের।তারপর দেখতে দেখতে পরীর ও বিয়ে হয়ে গেলো,বাড়িটা একদম খালি তাই ওদের বিয়েটা একটু তাড়াতাড়িই দিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া রান্না খাওয়াও তো কষ্ট,আমিও অসুস্থ ওদের ঠিক মত খোজ নিতে পারিনা।কাজের মানুষ দিয়ে কি আর সব হয়?ভাবলাম বিয়ে হলে,ওদের খোজ নেওয়ার মত মানুষ হবে।তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া,আর ওদের বিয়ের পর অফিসের সব কাজ ওদের বুঝিয়ে দিয়ে এখন আমি নিশ্চিন্তে অবসর নিয়েছি, অবশ্য পা ঠিক থাকলে এখনও অফিস করতাম।
– সুফিয়া একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,আসলে বিশ বছরে কত কিছু পাল্টে গেছে তাইনা?
– হুম।
সুফিয়া মেয়ে দুজনকে কাছে ডাকলো,
– তোমাদের নাম কি?
– প্রথম মেয়েটা বললো আমি শিমু,রিফাতের স্ত্রী।
– দ্বিতীয় জন বললো আমি মিথি,সিফাতের স্ত্রী।
-তোমরা দুজনেই দেখতে ভারী মিষ্টি,তবে শিমু একটা কথা মনে রাখবে,বাসায় কেও এলে ভালোভাবে কথা বলার চেষ্টা করবে,এভাবে দুর্ব্যবহার করবে না,কেমন।
– আমিতো আপনাকে চিনতে পারিনি তাই…
– ঠিক আছে,তবে বাসায় কেও এলে আগে তার ব্যাপারে ভালো করে জেনে,পরে মন্তব্য করবে।
– শিমু রাগ ভরা মুখ নিয়ে বললো, আচ্ছা।
– সুফিয়া মিথি কে জিজ্ঞেস
করলো,গেস্টরুম খালি আছে তো?
– জি খালি।
– বিজয় বললো,গেস্টরুম কেনো?তুমি চাইলে আমাদের ঘরেই থাকতে পারো,আমি না হয় গেস্ট রুমে…
– না বিজয়,আমার ওখানে কোনো সমস্যা হবেনা।মুখে একটা মিষ্টি হাসি নিয়ে গেস্টরুমের দিকে এগিয়ে গেলো সুফিয়া।
সুফিয়া ফ্রেশ হয়ে,খেয়ে বিছানায় একটু হেলান দিলো,খুব ক্লান্ত লাগছে।ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তূ ঘুম আসছিলো না,তাই শুয়ে শুয়ে বই পরছিলো।এমন সময়
সুফিয়া একজনের গলা শুনতে পেলো,কে যেনো মামনি মামনি বলে চিৎকার করছে।সুফিয়া ঘর থেকে ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে আসতেই,একটা মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো,মেয়েটা আর কেও না, পরী।সুফিয়ার কলিজার টুকরা পরী।সুফিয়া বললো
– তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো?
– কেনো চিনতে পারবোনা,তুমি কিভাবে ভাবলে আমি তোমাকে ভুলে যাবো?
– ওরে আমার লক্ষী মেয়ে,কত বড় হয়ে গেছে।
– শুধু বড়োই হইনি,মেয়ের মা ও হয়ে গেছি।
– তাহলে আমি নানী হয়ে গেছি,হাহাহা।তা কোথায় আপনার সেই মেয়ে?
– ওই তো আমার ছোটো মামনি।
– সুফিয়া পরীর মেয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,তোমার নাম কি সোনা?
– সুফিয়া।
– সুফিয়া বললো,তোমার নাম জিজ্ঞেস করেছি,আমার নাম না।
– আমার নাম ই তো সুফিয়া।
– সুফিয়া খুব অবাক হয়ে, একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,তোমার নাম সুফিয়া কে রেখেছে?
– আমার নানু ভাই।
পাশ থেকে পরী সুফিয়াকে বললো
– আমার বাবা তোমাকে আজও অনেক ভালোবাসে,আমিও।তুমি ফিরে আসায় ভালোই হয়েছে,আমরা এতিম গুলো এখন একটু মায়ের আশ্রয় পাবো,বাবা ও তোমাকে পাশে পেয়ে খুশি থাকবে।
– রিফাত আর সিফাত আমাকে কি আমাকে মেনে নিবে?
– না মামনি তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন টা না,ওরাও মন থেকে অনেক ভালো।তুমি তো ওদের অনেক ছোটো রেখে গিয়েছিলে তাই জানো না।আমি ওদের কাছে তোমার অনেক গল্পঃ করেছি,ওরা এসব শুনে তোমাকে খুব দেখতে চাইতো।দেখবে ওরা তোমাকে দেখে অনেক খুশি হবে।
– দেখা যাক কি হয়।আচ্ছা এখন ঘরে চলো,তোমার জন্য কিছু জিনিষ এনেছি,দেখবে।শিমু আর মিথি কেও আসতে বলো।
সুফিয়া খাটের উপরে সব জিনিস গুলো রাখলো, পরীর জন্য সাতটা শাড়ি এনেছিলো,সুফিয়া তো আর জানতো না,শিমু আর মিথির কথা,তাই ওদের জন্য আনা হয়নি। শাশুড়ি আর ছোটোর জন্য যেই জিনিস গুলো এনেছিলো সে গুলো এখন পরার মানুষ নেই তাই ওইগুলো আলমারিতে তুলে রাখলো।সুফিয়া বললো
– আমিতো মিথি আর শিমুর কথা জানতাম না,তাই যে শাড়ি গুলো এনেছি,ওই গুলোই তোমরা ভাগ করে নিয়ে নাও,মিথি খুশি হলেও,শিমু এখনও রাগে গিজগিজ করছে।সুফিয়া তখন শিমুকে ওইসব বলাতে খুব রেগে আছে ও।সুফিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান করে,আবার শিমু কে কাছে ডাকলো,বার বার এভাবে ডাকাতে না এসে পরলো না শিমু।
তিনটা শাড়ি পরী নিলো আর চারটা শাড়ি মিথি আর শিমু ভাগ করে নিলো,যদিও শিমু আর মিথি নিতে চায়নি সুফিয়া এক রকম জোর করেই দিলো।।শিমু মনে মনে ভাবছিলো,
মহিলার পছন্দ আছে,সব গুলো শাড়িই বেশ সুন্দর আর দামিও।তবে দেখে মনে হয় অনেক রাগী টাইপের।
সুফিয়া চারটা পাঞ্জাবি দেখিয়ে বললো,ওখানে চারটা পাঞ্জাবি আছে,রিফাত আর সিফাতের জন্য। পরীর মেয়ের কথা তো আমি জানতাম না,তাই আনা হয়নি তবে সমস্যা নেই আমি পরে ও কে মার্কেটে নিয়ে কিছু কিনে দিবো। পরী জিজ্ঞেস করলো
– মামনি বাবার জন্য কিছু অানোনি?
– সুফিয়া একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,সবার জন্যই এনেছি।
তারপর দেওয়া নেওয়ার পর্ব শেষ হলো।সবাই যার যার ঘরে চলে গেলো। সুফিয়া পরী কে বললো,
– তোমার বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি আছে,তুমি কি একটু দিয়ে আসবে?
– মামনি তুমিও চলো না,তুমি নিজের হাতে দিলেই বাবা খুশি হবেন।
– সুফিয়া একটু আমতা আমতা করছিলো।
– পরী বললো,আচ্ছা চলো আমিও সাথে যাচ্ছি।
চলবে…
সালমা আক্তার।