সতীনের ঘর পর্ব -০৭ ও শেষ পর্ব

সতীনের ঘর
পর্ব ৭+ শেষ পর্ব

ঘুম ভাঙলো সাজ্জাতের ফোনে।আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে।এতদিন পর তাহলে সেই প্রতীক্ষিত সময়টা এসেই গেলো।খবরটা পেয়েই বিজয়ের কাছে গেলাম,গিয়ে দেখি ও অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে।আমি বললাম
– বিজয় আজ তোমার একটু সময় হবে?
– কেনো কোনো কাজ আছে কি?
– কাজ না,এক জায়গায় যাবো।
– বিজয় কিছুক্ষন ভেবে,মাথা নাড়িয়ে শায় জানালো বললো আচ্ছা।
আসলে সুফিয়া বিজয়ের কাছে অনেক দিন যাবৎ কিছু চায়না।আজ এভাবে একটু সময় চাওয়াতে নিষেধ করতে পারলোনা,যদিও অফিসে ম্যানেজ করতে একটু প্রবলেম হবে,তাও রাজি হলো।

আজ একটা শাড়ি পরলাম,এই শাড়িটা বিজয় আমাকে প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে দিয়েছিলো।খুব সাজতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ তাই একটু সাজলাম, মুখে হালকা মেকআপ আর ঠোঁটে হালকা কালারের একটা লিপস্টিক দিলাম।
রুম থেকে বের হতেই বিজয় আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো।আমি চোখের ইশারাতে প্রশ্ন করলাম,ও কানের কাছে এসে বললো আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম।
বিজয় গাড়ি নিয়ে বের হতে চাইলো,আমি বললাম গাড়িতে না রিক্সায় যাই?
ও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
একটা রিক্সা ডাকলো,আমি রিক্সা ওয়ালা কে বললাম, মামা কবর স্থানে যাবেন?
উনি বললেন উঠেন।বিজয় আমাকে জিজ্ঞেস করলো
– হটাৎ কবর স্থানে কেনো?
– ঐখানে গিয়ে তুমি আর আমি একসাথে মরবো তাই।
– মরার জন্য বুঝি এতো সুন্দর করে সেজেছো?
– হুমমম।কেনো তোমার আফসোস হচ্ছে নাকি?
– আফসোস হবে কেন?
– এইযে মরার আগে সাজতে পারলেনা বলে।
– আমার তো খুশি লাগছে,একসাথে বাচতে না পারি,মরতে তো পারবো, হাহাহা।
– চুপ করো,এভাবে রাক্ষসের মতো হেসো না তো।
– আমি রাক্ষস?
– তার চেয়েও বড় কিছু।
গল্প করতে করতে কবর স্থানে এসে গেলো।
রিক্সা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম থাকবেন নাকি চলে যাবেন?
আপনারা কইলে থাকমু।
– আচ্ছা থাকেন তাহলে।
বাবার কবরের সামনে এসে খুব কান্না পাচ্ছিলো,কিছুক্ষন কান্না করে হালকা হলাম।মায়ের কবরটা গ্রামের বাড়িতে,তার কবরটা আর দেখা হলোনা।আজ খুব মনে পরছে বাবা মায়ের কথা।যদি আজ তারা বেচে থাকতো,আমার জীবনটা অন্যরকম হলেও হতে পারতো।

পুনরায় রিক্সায় এসে বসলাম,বললাম মামা উত্তরা আজমপুর চলেন।বিজয় জিজ্ঞেস করলো
– আবার আজমপুর কেনো?
– দরকার আছে।
– কি দরকার?
– গেলেই বুঝতে পারবে।
– আমার কিন্তূ এখন ভয় হচ্ছে।
– কিসের ভয়?
– আমাকে এভাবে একা কোথাও নিয়ে গিয়ে যদি আবার পুরুষ নির্যাতন করো।আজকালের মেয়েদের তো বিশ্বাস নেই।
– পাগলের মত বক বক করা বন্ধ করবে?
– আমি পাগল?
– তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে?।
– আচ্ছা তাহলে এই পাগলের একটা পাগলামি রাখবে?আজকে একটু আমাকে নির্যাতন করবে?অনেক দিন হলো….
– বিজয়! চুপ করবে নাকি ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো রিক্সা থেকে?
– ফেলে দাও,আমি নায়কের মত পড়ে যাবো,তুমি নায়িকাদের মত আমার উপড়ে পরে যাবে।তারপর সুযোগ পেয়ে আমি তোমাকে চুমু দিবো,আর তুমি চোখ বন্ধ করে….
– বিজয় আসলেই মনে হয় তোমার মাথার তার ছিড়ে গেছে,কখন থেকে শুধু উল্টা পাল্টা বক বক করে যাচ্ছো,সত্যিই তুমি পাগল হয়ে গেছো, হাহাহা।
– বিজয় অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– কি হলো,এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?আমাকে কি এর আগে কখনো দেখোনি?
– দেখেছি তবে,অনেকদিন পর এভাবে তোমাকে হাসতে দেখলাম।
রিক্সা থেমে গেলো,তাকিয়ে দেখি সেই পুরোনো বাসার সামনে এসে পরেছি।
কলিংবেল দিলাম,বাড়িওয়ালী চাচী এসে দরজা খুললেন।এতদিন পর আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন।
অনেকদিন পর এই বাসায় আসলাম,এই বাসাতেই বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন,এই বাসাতেই আমার আর বিজয়ের বিয়ে হয়েছিলো।কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাসায়।তবে আমরা যেই ঘরটায় ভাড়া থাকতাম সেটাতে এখন অন্যকেও থাকে।আমি চলে যাওয়ার পর নতুন ভাড়াটিয়া এসেছেন।
চাচীর সাথে অনেক সময় বসে গল্প করলাম।চাচী না খাইয়ে ছারছিলোই না,তারপর দুপুরে খেয়ে ওখান থেকে বের হলাম।

রাস্তা দিয়ে হাটছি,বিজয় বললো
– আর কোথাও যাওয়ার আছে,মেডাম?
– একটু ভার্সিটিতে যাবে?
– ওখানে গিয়ে কি করবে?
– কিছুনা,এমনি যেতে ইচ্ছে করছে।
– ইচ্ছে যখন করছে তাহলে তো যেতেই হয়।
ভার্সিটিতে কিছুক্ষন ঘুরলাম,পরিচিত স্যারদের সাথে দেখা করলাম।তারপর অফিস হয়ে,সাজ্জাতের সাথে দেখা করে,একটা পার্কে এসে বসলাম।
বিয়ের আগে বিজয় আর আমি এই পার্কে অনেকবার দেখা করেছি।আজ শেষ বারের মত….
বিজয় জিজ্ঞেস করলো
– মেডাম আজকে আপনার কি হয়েছে শুনি? এতো জায়গায় ঘুরলেন,আপনাকে আজ বেশ খুশি খুশি ও দেখাচ্ছে কারনটা কি জানতে পারি?
– আজ তোমার অফিস মিস হয়ে গেলো তাইনা?
– আরেহ ধুরর..অফিস তো সারাবছর ই করি।আজ অফিসে গেলে এতো সুন্দর মুহূর্ত গুলো কি পেতাম?কতকিছু মিস করে যেতাম।
-তাই নাকি?
– জী মেডাম।
– আসলে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
– বুঝেছি,আজকে আমাদের বাসর রাত হবে তাইনা?
– তোমার মাথায় এইসব ছাড়া আর কিছু নেই?
– কি করবো বলো,সুন্দরী বৌকে পাশে রেখে নিজেকে নিয়ত্রণ করা যে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
– হাহাহা,আমিও আবার সুন্দরী!
– হুম,তুমি আমার চোখে সব চেয়ে সুন্দরী একজন নারী।
– ভালই বলেছো।আসলে আজকে আমার প্রমোশন হয়েছে।
– ওহ,তার জন্যই বুঝি এতো আয়োজন?
– এটার জন্যই বলতে পারো,তবে আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।
– কি সারপ্রাইজ?
– বাসায় গেলে জানতে পারবে।
– এখনি বলো।
– বললাম তো বাসায় গিয়ে বলবো।
– তাহলে বাসায় চলো।
– আচ্ছা চলো।

পার্কের অনেক টা ভেতরে এসে বসেছি আমরা। হেটে হেটে পার্কের গেটের মুখে যাচ্ছিলাম। হাটতে হাটতে বিজয় বললো
– আজকের দিনটা অনেক ভালো কেটেছে।অনেকদিন পর দুজনে এভাবে ঘুরলাম।অনেকদিন পর তোমার মুখে এত সুন্দর হাসিটা দেখতে পেলাম।আজ আবারো অতীতে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।আবারও প্রাণ খুলে বলতে ইচ্ছে করছে,ভালোবাসি সুফিয়া তোমায়, অনেক ভালোবাসি।
– ভালোবাসো বলেই তো ব্যাংকের দশ লাখ টাকা, আর বাড়ি আমার নামে লিখে দিয়েছো। ভালোবাসো বলেই তো, আড়ালে থেকে আমার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ করে দিয়েছো, তাইনা?
– বিজয় হাটা বন্ধ করে বললো, তুমি এসব জানো?
– কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছি।
– বিজয় আমাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে পার্কের একটা দোলনায় বসলো।
– আমি আসলে চেয়ে ছিলাম…
আচ্ছা বিজয় আমি কি কখনো তোমার কাছে এসব চেয়েছি?বাড়ি,টাকা পয়সা এসব দিয়ে আমি কি করবো।আমার তো এসবের কোনো দরকার ছিলোনা,এখনও নেই। আমিতো শুধু এক ছাদের নিচে তোমাকে নিয়ে বাচতে চেয়েছিলাম।সুখী হতে চেয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে।সুখী হতে বেশি টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়না, প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে অল্পতেও সুখী হওয়া যায়।বিজয় টাকা পয়সাই কি জীবনের সব?তুমি আমার জন্য এতো কিছু না করে যদি আমাকে একটু ভালোবাসতে তাহলেই আমি খুশি ছিলাম।
– সুফিয়া আমি তোমাকে এখনও অনেক ভালোবাসি।
– এ কেমন ভালোবাসা তোমার?এমন ভালোবাসা তো আমি চাইনি।যে ভালোবাসা দুজনের মধ্যে দুরত্ব তৈরি করে,যে ভালোবাসা তিলে তিলে মানুষকে মন থেকে শেষ করে দেয়।
– সুফিয়া চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই,যেখানে কোনো পিছুটান থাকবেনা,শুধু তুমি আর আমি থাকবো।নতুন করে বাচার চেষ্টা করবো।
– সত্যিই কি সেটা আর সম্ভব?
– তুমি চাইলেই সম্ভব।
– না বিজয়,আমি চাইলেই যদি সব হতো,তাহলে আমি তোমাকে নিজের করে রাখতে চেয়েছিলাম কই রাখতে পারিনি তো।তুমি আমি এক সাথে থাকা এটা এখন শুধুই একটা মিথ্যে সপ্ন,মিথ্যে সপ্ন দেখে আনন্দ পাওয়া গেলেও ভালো থাকা হয়না।
এসব বলে আর কি লাভ,চলো বাসায় যাই রাত হয়ে আসছে।
বিজয় আর কিছুই বললোনা,চুপ করে শুধু বার বার দেখছিলো আমায়।

বিজয় আর আমি দুজন এক সাথেই বাসায় ঢুকলাম।অফিস হয়ে আসার সময় সাজ্জাত দরকারি সব কাগজপত্র দিয়ে দিয়েছিলো সাথে।আমি সাজ্জাত কে বলেছিলাম,কাগজ গুলোর ফটোকপি করে দিতে,যাতে বিজয় কে একটা দেখার জন্য দিতে পারি।যদি আসলটা দেই পরে যদি যেতে কোনো বাধা দেয়।আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনা এই ব্যাপারে।
বাসায় ঢুকেই আমি বিজয়ের হাতে একটা খাম তুলে দিয়ে বললাম
– এটাই তোমার সারপ্রাইজ।
– কি এইটা?
– খুলে দেখলেই বুঝবে।
– বিজয় তখনই খুলতে চাইলো।
– আমি বললাম,এখন না ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পরে দেখো। ছোটোকেও দেখিও,ও দেখলে খুশি হবে।
আমি ফ্রেশ হয়ে মায়ের কাছে গেলাম।মা কে বললাম
– মা আমি কালকে চলে যাচ্ছি।
– কোথায় যাচ্ছিস?
– দুবাই তে।
– দুবাই তে মানে?ওখানে কেনো?
– এখন থেকে ওখানেই থাকবো।
– হটাৎ এমন সিদ্বান্ত কেনো নিলি মা?তুই জানিস না তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারিনা।তাছাড়া তুই তো আমাকে কথা দিয়েছিলি‌ এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবিনা কিন্তু এখন দেশ ছেরেই চলে যাচ্ছিস?
– পৃথিবীতে কারো জন্য জীবন থেমে থাকেনা মা।আপনি বাবাকে কত ভালোবাসতেন, সে ছিলো‌ আপনার অনেক কাছের মানুষ,তাকে ছাড়া যখন বাচতে পারছেন, আমাকে ছাড়াও আপনি থাকতে পারবেন।আর মা কথা দেওয়ার কথা বলছেন? কতো মানুষ,অনেক বড়ো বড়ো কথা দিয়ে নিমিষেই ভুলে যায়,প্রয়োজনে ভালোবাসার মানুষকে ও ছেড়ে দেয় আর আমিতো সামান্য দেশ ছাড়ছি মাত্র।আর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে কারো কোনো ক্ষতি হবেনা বরং ভালই হবে।
– অভিমান করেছিস মা?রাগ করেছিস?
– না মা রাগ বা অভিমান কোনোটাই না,শুধু এই হাপিয়ে যাওয়া জীবন থেকে বেরিয়ে একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই।অন্য কারো সংসার এ আর তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে চাইনা।এসব থেকে দূরে গিয়ে,একটু নিজের মতো বাচতে চাই।
মা দয়া করে আপনি আমাকে বাধা দিবেন না,আপনি বাধা দিলেও,আমি সেটা মানতে পারবোনা।শুধু একটু দোয়া করবেন আমার জন্য তাহলেই হবে।
শাশুড়িকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই চলে এসেছি। কারন আমি জানি,আমি ওখানে থাকলে সে আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিবে।

ঘরে এসে ব্যাগ পত্র গুচ্ছাচ্ছিলাম,বিজয় এসে আমাকে সজোরে একটা চর মারলো।
– কি নাটক শুরু করেছো তুমি?চাকরি করো বলে যা খুশি তাই করবে?তোমার দুবাই যাওয়া কেন্সেল।আমি তোমাকে যেতে দিবো না।তুমি এক পা ও বাসা থেকে বেরোতে পারবেনা।আজ থেকে তোমার চাকরি করাও বন্ধ।মনে থাকে যেনো‌ কথাটা।ভুলে যেওনা আমি এখনও তোমার স্বামী।
– ভুলে যাইনি তুমি আমার স্বামী,খুব ভালো করেই মনে আছে।তুমিতো আমার ঐ স্বামী যে নতুন বৌ পেয়ে,বাসর রাতে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলে।তুমি তো আমার ঐ স্বামী যে আমার সতীনের দুই বাচ্চার বাবা।তুমিতো আমার ঐ স্বামী যে মায়ের কথা রাখতে গিয়ে,আমাকে ময়লার মত ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেছিলে। এতো ভালোবাসার স্বামীকে আমি কিভাবে ভুলতে পারি।
বিজয় একটু কাছে এসে বললো,
– আমি পুরোটাই বাধ্য হয়ে করেছি সুফিয়া,সেটা তুমিও জানো।আর তুমিই আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলে।
– বাধ্য হয়ে হোক আর মন থেকেই হোক করেছো তো?আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলেছিলাম, কিন্তূ আমার থেকে দূরে যেতে তো বলিনি।কখনো কি ভেবে দেখেছো আমি এসব কিভাবে সহ্য করেছি?
কতরাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি,কতবার মৃত্যু আহ্বান করেছি।তোমাকে একটু পাশে পাবার জন্য ছট্ফট করেছি,কেদেছি,চিৎকার করেছি,মাঝে মাঝে বেহুষ ও হয়ে পড়েছিলাম,কই তুমিতো তখন আমার একবারও খোজ নাওনি।
তুমি তোমার মায়ের মন রাখতে,গিয়ে আমাকে দূরে ঠেলেছো।তুমি তোমার সন্তানের মুখ দেখবে বলে,আমাকে দূরে ঠেলে ছোটোকে আপন করে নিয়েছো।এসবের মধ্যে কি কখনো আমার কথা ভেবেছো?ভাবনি।দায়িত্ব হিসেবে বললে ভুল হবে,হয়তো গরীবের মেয়ে হিসেবে আমার জন্য কিছু টাকা আর এই বাড়িটা বরাদ্দ করেছো।আসলে তুমি আমাকে নিয়ে শুধু খেলেছো। আমি কি তোমার কাছে এসব চেয়ে ছিলাম?আমি এখন হাপিয়ে গেছি,ক্লান্ত হয়ে গেছি এমন জীবন নিয়ে।রোজ রোজ তোমার অপমান,তোমার বৌ এর অপমান আমি এসব আর মেনে নিতে পারছিনা।ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড,আমাকে যেতে দাও,না হলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।
– প্লিজ সুফিয়া তুমি এমনটা করোনা।আমি তোমাকে ছাড়া বাচতে পারবোনা।এই বলে বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরলো,কিন্তু আজ তার এই জড়িয়ে ধরার কোনো রিএকশন আমার মধ্যে হচ্ছেনা।আমিযে মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।আমাকে যেতেই হবে এখান থেকে দূরে,বহু দূরে।
আমি বিজয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
– তুমি যদি আমাকে যেতে না দাও তাহলে আমি তোমাকে ডিবর্স দিতে বাধ্য হবো।
– সুফিয়া তুমি এমনটা বলতে পারলে?
– তুমিই বলতে বাধ্য করলে।
আচ্ছা তোমার যা খুশী করো,আমি আর তোমাকে বাধা দিবো না।
বিজয় ঘর থেকে চলে গেলো,আমি বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম।আজ জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষটার সাথে এভাবে কথা বলেছি,হয়তো‌এটাই জীবনের শেষ।আর কখনো তার সাথে কথাই হবেনা।

সারারাত ঘুম হয়নি, বড্ডো খারাপ লাগছে সব কিছু ছেড়ে যেতে।কত স্বপ্ন নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিলাম আজ একবুক হতাশা নিয়ে চলে যাচ্ছি। পরী টার জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছে,খুব মিস করবো মেয়েটাকে।মায়ের জন্যও খারাপ লাগছে, বয়স্ক মানুষ প্রায় অসুস্থ থাকে, ছোটো তো ওর বাচ্চাদের কে সামলাতেই হিমশিম খায়,উনাকে কিভাবে দেখবেন।বিজয়ের জন্যও খারাপ লাগছে,এখনও যে ভালোবাসি তাকে।সে যে আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।আশা করি ছোটোও ওর বাচ্চাদের নিয়ে ভালো থাকবে।অবশ্য আমি চলে গেলে ওরা এমনিতেই ভালো থাকবে।ওদের সংসার টা ভালোবাসায় পুর্ণ হবে।এসব ভাবছিলাম আর খুব কাদছিলাম।কেনো এতটা কষ্ট হচ্ছে আমার।ভাবতে ভাবতে কখন যেনো চোখটা লেগে গেলো।

ফজরের আযানের শব্দে ঘুম ভাঙলো।উঠে ফ্রেশ হয়ে পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলাম।তারপর ব্যাগ পত্র নিয়ে নিচে নামলাম।নাহ কাওকে আর বলার দরকার নেই।শুধু শুধু সিনক্রিয়েট করবে। কালকে তো বলেছি, এখন কাওকে না বলেই চলে যাবো। যত সকাল সকাল সম্ভব বাসা থেকে বের হতে হবে,বেলা হয়ে গেলে আবার বিজয় ঘুম থেকে উঠে পরবে,আমি চাইনা যাওয়ার সময় আর কোনো ঝামেলা হোক।দরজা খুলে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম,পেছন থেকে একজন বলে উঠলো
– পালাচ্ছো????
– আমি পেছন ফিরে দেখি, ছোটো।
– কি ভাবো তুমি নিজেকে?এসব করে কি প্রমাণ করতে চাও?
– কিছু প্রমাণ করতে চাইনা তো,শুধু চাই তোরা ভালো থাক।
– তুমি এখান থেকে চলে গেলেই কি আমরা ভালো থাকতে পারবো?
– আমিতো তাই মনে করি,আর কেও ভালো না থাকলেও তোর বর ঠিকই ভালো থাকবে কারন সে এটাই চেয়েছিলো।
– তুমি তার মুখের কথাটাই শুনলে,তার মনের ভেতরটা একবারও বুঝলেনা?
– তার মনের ভেতর তো আমি নেই,সেখানে এখন শুধু তোরই বসবাস।
– নাহ বুবু তুমি ভুল।তার ঘরে আমার বসবাস হলেও তার মনে শুধু তোমার জায়গাই আছে।আমি তার স্ত্রী হলেও তার মনের মানুষ না।
– তাতে কি আসে যায়,তুই ওর সন্তানের মা।
– সন্তানের মা হলেই কি সব হয়?হয়না বুবু, আমিতো ওর সন্তান দেওয়ার একটা মেশিন মাত্র,ওর সাথে তো আমার মনের কোনো সম্পর্ক নাই।তুমি না বলো আমি দেখতে সুন্দর আর তুমি শেমা।কিন্তু দেখো তোমার কি ভাগ্য শেমা হয়েও তুমি তোমার স্বামীর মন জুড়ে আছো আর আমি সুন্দর হয়েও তার মনে জায়গা পেলাম না।এই সুন্দর্যের কি দাম,যদি স্বামির মনে জায়গায় না পেলো।মেশিনের যেমন কোনো মন থাকেনা,তবুও কাজ করে যায় নিরলস ভাবে, আমরাও বলতে পারো একটা মেশিনের মত শুধু নিজেদের চাহিদা পূরণ করছি,আমাদের বাচ্চার দরকার এটাই বড় কথা,বাকি সব কিছুতো শুধুই …।
বুবু আমি কখনোই চাইনি তুমি এখান থেকে চলে যাও,এ বাড়িটা তো তোমার,গেলে আমি যাবো,তোমার তো যাওয়ার কথা না।এখনও বলছি থেকে যাও আমার সতীন হয়ে না,আমার পরীর মামনি হয়ে। সে যে তোমাকে ছাড়া খেতে চায়না,ঘুমাতে চায়না,তুমি না থাকলে পরী কে সামলাবে কে?
– আমিতো ওর সৎ মা কিন্তূ তুই তো ওর আসল মা, তোর কাছে পরী অনেক ভালো থাকবে।
– আর তোমার বর,তার কি হবে?
– তুইতো আছিস,দেখে রাখিস।
– বুবু,চলো একসাথেই থাকি,কথা দিলাম তোমাকে আর কষ্ট দিবো না।
– না রে ছোটো তুই আমাকে কখনোই কষ্ট দিসনি,তুই তোর জায়গা থেকে ঠিকই ছিলি।আমার তোর উপর কোনো রাগ নেই। আমিতো শুধু নিজের মতো বাঁচতে চাইছি।

বিজয় আর পরী কে নিচে নামতে দেখে,আমি তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইলাম কিন্তূ পেছন থেকে পরী এসে আমাকে মামনি বলে জড়িয়ে ধরলো।
– মামনি তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে যাবে?
– না মা,তুমি চলে গেলে তোমার ভাইদের কে কে দেখবে?তোমার দাদুকেও তো তোমার দেখতে হবে তাইনা?শুনো বাবু লক্ষ্মী মেয়ের মত থাকবে,মা কে একদম জ্বালাবে না।ভাইদের দেখে রাখবে,আর বাবা কেও।
– মামনি বাবা সারারাত ঘুমায় নি,শুধু কেদেছে,আর বলেছে তুমি নাকি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো।বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসে মামনি,আমার থেকেও বেশি।
আমি পরী কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলাম।

বিজয় পাশে এসে বললো
– আমি কালকে তোমার গায়ে হাত তুলেছি,আমাকে ক্ষমা করে দিও।
– না বিজয় এভাবে বলো না।তুমিতো আমার স্বামী,আমাকে যেমন ভালোবাসার অধিকার আছে, আমাকে মারার ও অধিকার তোমার আছে।বরং আমিই কালকে তোমার সাথে‌ খুব খারাপ ব্যাবহার করেছি,তুমিই আমাকে মাফ করে দিও।
– সুফিয়া কোনো ভাবে কি থেকে যাওয়া যায়না?
– না বিজয়,তুমিই না চেয়ে ছিলে আমি মাথা উচু করে বাচি,এখন সময় এসেছে বাচার।
– তাহলে কোনোভাবেই আর তোমাকে আটকাতে পারলাম না!
– তুমি কি আমাকে পাখির মত খাচায় আটকে রাখতে চাও?
– না,আমি চাই তুমি স্বাধীন ভাবে আকাশে ওড়ো।
– তাহলে পাগলামি করছো কেনো?
– অনেক ভালোবাসি তোমায় তাই।
– তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে না,আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি কি না,সত্যি বলবো?
– হুম।
– ভালোবাসি তোমায় অনেক ভালবাসি।ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।
– তাহলে থেকে যাওনা আমার কাছে।
– সেটা এখন আর সম্ভব না।
– চলেই যখন যাবে,কোনো ভাবেই যখন আর আটকাতে পারবোনা,তাহলে আমাকে ও তোমার সাথে নিয়ে চলো না।
– তোমার তো চলে গেলে চলবেনা।তোমার তো পরিবারের পাশে থাকতে হবে।মা, ছোটো আর বাচ্চাদের যে তোমাকে প্রয়োজন।
– আর তোমার?তোমার কি আমাকে কোনো প্রয়োজন নেই?
– আমি তো চিরো জীবনেরই একা,আমার একা থাকতে কষ্ট হবেনা।আর কে বলেছে তোমাকে আমার দরকার নেই,তুমি তো আমার স্বামী,এটাই আমার সব চেয়ে বড় পরিচয়,আমি না হয় তোমার পরিচয় টুকু নিয়েই বাঁচবো।

আমি কাদছি, পরী,মা বিজয় সবাই কাদছে।আশ্চর্যের বিষয় ছোটোর চোখেও আজ পানি।আমি বিজয় কে বললাম শেষ বারের মত একটু জড়িয়ে ধরবে আমায়?
বিজয় আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বাচ্চাদের মত কাদতে লাগলো। আমিও বিজয় কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি।আমি ওর কাছ থেকে ছুটতে চাইলাম কিন্তূ ও ছাড়ছেনা,আরো শক্ত করে ধরছে।যেনো পালাতে না পারি।আমি জোর করেই ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম।চোখের পানি মুছে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।

পা বাড়ালাম অজানা এক দেশের উদ্দেশ্যে।জানিনা ওই জিবনটা আমার জন্য কেমন হবে,জানিনা আগামী দিন গুলোতে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।তবুও একবুক ভালো থাকার প্রয়াস নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।জানিনা এদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না,জানিনা মনের স্বপ্ন গুলো পূরণ হবে কিনা তবুও পা বাড়িয়েছে অনেক আশা নিয়ে,যদি এই কালো মেঘ ভেঙে কখনো নতুন সূর্যের আগমন ঘটে।
শেষ বারের মত একবার পিছু ফিরে চাইলাম, পরী আর তার বাবা এখনো কাদছে।যতক্ষণ চোখের আড়াল হইনি, ঠায় দাড়িয়েই ছিলো….

আজ অনুপম রায়ের একটা গান খুব মনে পড়ছে

আমাকে আমার মত থাকতে দাও,আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি,
যেটা ছিলোনা,ছিলোনা সেটা না পাওয়াই থাক।সব পেলে নষ্ট জীবন…..

সমাপ্ত।
সালমা আক্তার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here