সতীনের ঘর
সিজন ২
পর্ব ২
পরী বিজয়ের ঘরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও,সুফিয়া যেতে রাজি হলো না।বিজয়ের সামনে যেতে কেমন যেনো একটা ইতস্তত বোধ হচ্ছিলো।তাই সুফিয়া পরী কে বললো
– তুমি যাও,আমি খুব ক্লান্ত।একটু বিশ্রাম নিতে চাই।
– আচ্ছা মামনি তাহলে তুমি বিশ্রাম নাও,আমি পরে আসবো।
– সুফিয়া একটা হাসি দিয়ে, পরী কে বিদায় জানালো।
সুফিয়া জানালার পাশে দাড়িয়ে,চোখ বন্ধ করে ওর দুবাইতে কাটানো সময় গুলোর কথা ভাবছিলো।
মনে পরে গেলো প্রথম দিনের কথা গুলো।
যেদিন প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম,খুব কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন।অচেনা একটা দেশ,সব মানুষ গুলোও অচেনা।অচেনার মাঝে নিজেকে কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলছিলাম,মনে হচ্ছিলো এই পৃথিবীতে আমি একজন যার পৃথিবীতে কেও নেই।তবুও দেশে থাকতে একটা শান্তি ছিলো নিজের দেশে আছি, কিন্তূ এখন তো মনে হচ্ছে আমি ছাড়া সবাই জীবিত আর আমি মৃতো একজন মানুষ।বুকটা যখন হাহাকার দিয়ে উঠছিলো,ঠিক তখনই সাজ্জাতের মুখটা সামনে আসলো।আমি অবাক হলাম সাজ্জাত কে দেখে, ও এখানে কি করছে?
আমি অবাক হওয়ার সাথে শান্তিও অনুভব করছিলাম,যাক একজন পরিচিত মানুষ কে তো পেয়েছি।
আমি দেরি না করে সাজ্জাতের কাছে গেলাম
– কি ব্যাপার সাজ্জাত তুমি এখানে কেনো?
– চুপ করো বেআদব মেয়ে,স্যারের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না?
– স্যার?
– হ্যা আজ থেকে আমাকে স্যার বলে ডাকবে,বুঝতে পেরেছো?
– জী স্যার।
– হাহাহা।
– হাসছেন কেনো স্যার?
– হাহাহা।তুমি জানো তোমাকে কোথায় এনেছি?
– দুবাই তে।
– কেনো এনেছি সেটা জানো?
– অফিসের কাজে।
– হাহাহা,ভুল জানো।আসলে তোমাকে এখানে বিক্রি করতে এসেছি।
– মানে?
– তোমাকে এখানে বিক্রি করে অনেক টাকা পাবো,তারপর ঐ টাকা দিয়ে দেশে গিয়ে সুন্দর দেখে একটা বিয়ে করে সুখে ঘর সংসার করবো।
– কি বলছো সাজ্জাত,প্লিজ তুমি এমনটা করো না,আমি তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাচ্ছি।আমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছি,আর সবই তো তুমি জানো,একজন এতিম মানুষের সাথে তুমি এমন টা করতে পারোনা।
– কাকুতি মিনতি করে কোনো লাভ নেই,তুমি এখন বিক্রি হয়ে গেছো।চুপচাপ গাড়িতে উঠে বস,আর যদি কোনো চিৎকার করেছো তো এখনই গুলি করে উড়িয়ে দিবো।
আমি সাজ্জাতের থেকে এমন কিছু শুনবো ভাবিনি,কি করলাম এটা আমি!শেষ পর্যন্ত একজন পাচার কারির হাতে পড়ে গেলাম?
কেনো এসেছিলাম দেশ ছেড়ে, যদি দেখি উল্টা পাল্টা কিছু হয়েছে আমার সাথে,তাহলে নিজের জীবন দিয়ে দিবো তাও নিজের সাথে কোনো অন্যায় হতে দিবো না।
গাড়িতে বসে যখন কান্না করছিলাম,সাজ্জাত বললো
– আরেহ এভাবে কেদোনা,আমি তো জাস্ট মজা করেছি তোমার সাথে।তুমি এতো বোকা কেন বলো তো?
– সত্যিই তুমি মজা করছিলে?
– হাহাহা,আমি তো জানতাম তুমি খুব শক্ত মনের মানুষ,এখন তো দেখছি তুমিও অন্য সব মেয়েদের মতই অল্পতে ভয় পাও আর কান্না করো।
– এমন মজা করা কি খুব দরকার ছিলো?
– বন্ধুর সাথেই তো মানুষ মজা করে তাইনা?
– তুমি না বলেছিলে তুমি এখানে আসবেনা।
– আসতে তো চাইনি কিন্তূ না এসে পারলাম কই!আচ্ছা সুফিয়া তুমি কি সত্যিই ভয় পেয়েছো?
– আমি ওর দিকে একটু চোখ গরম করে তাকাতেই,ও আমার কাছে কান ধরে ক্ষমা চাইলো।
আমি কিন্তু তখন সত্যিই সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম।তবে পরে যখন দেখলাম সত্যিই ঐটা একটা মজা ছিলো,খুব বোকা বোকা লাগছিলো নিজেকে।
দেখতে দেখতে গাড়িটা একটা ত্রিশ তলা বিল্ডিং এর সামনে এসে থামলো।আমরা যখন উপরে উঠলাম,দেখলাম ঐখানে বেশির ভাগই আমাদের দেশের মানুষ আর প্রায় মানুষই আমার অফিসের পরিচিত,আর ঐখানে অনেক মেয়েরাও আছে,তবে ওদের সাথে ওদের হাসব্যান্ড ও আছে।প্রথম যতটা ভয় হচ্ছিলো,এখন আর ততটা ভয় হচ্ছেনা,তবে খুব কষ্ট হচ্ছিলো বিজয়ের জন্য।মন কে বুঝলাম কষ্ট হলেও বা কি করবো,আমাকে এখানেই থাকতে হবে,কিছু করে দেখাতে হবে।কষ্ট পেলেও কার জন্য পাবো,যারা আমাকে অপমান ছাড়া কিছুই দেইনি জিবনে।নাহ আমাকে শক্ত হতে হবে।নিজেকে নতুন ভাবে তৈরি করতে হবে।
আর এভাবেই প্রতিদিন নিজেকে তৈরি করেছি। মনের কষ্ট গুলোকে হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছি,কারণ ওইসব কষ্টের কথা ভেবেই নিজেকে শক্ত করতাম।
তবুও মাঝে মাঝে হেরে যেতাম সকল রাগের কাছে, মনের পরাজয় ঘটতো পুরনো সৃতির কথা ভেবে। পরী আর বিজয় ওদের কথা খুব বেশিই মনে পড়তো,খুব কাদতাম।সব চেয়ে বেশি কষ্ট হতো তখন, যখন দেখতাম কলিগদের কেউ নিজের পরিবারের সাথে কথা বলতো,আমারও খুব ইচ্ছে করতো বিজয় আর পরীর সাথে কথা বলতে, কিন্তূ কোনো এক অজানা ভয়ে ফোন করতাম না।মাঝে মাঝে ভাবতাম বিজয় হয়তো আমার খোজ নিবে, কিন্তূ আমার ভাবনা শুধু ভাবনাতেই রয়ে গেলো।কখনোই ও আমার খোজ নেয়নি।তাই আমিও নিজেকে আর ওর কাছে ছোটো করতে চাইনি,তাই ফোন ও করিনি কখনো।
প্রথম যখন দুবাইতে গেলাম খাওয়া দাওয়া খুব কষ্ট,ওই দেশের খাবার খেতে পারতাম না,দেশের খাবার খুব মিস করতাম।যখন অফিস শেষে বাসায় আসতাম,রাইস কুকারে ভাতের উপর মরিচ সিদ্ধ দিয়ে ,মরিচ ভর্তা করে ভাত খেতাম।কারণ এই বিদেশি খাবার খাওয়ার চেয়ে মরিচ ভর্তা টাই আমার কাছে বেস্ট লাগতো।মানুষ তো এমনই,যতই ভালো কিছু করুক,যতই উপরে উঠুক না কেনো,নিজের অস্তিত্ব কে তো আর ভোলা যায়না।খাবার কষ্টটা যেমন মরিচ ভর্তা দিয়ে পূরণ করতাম,বিজয়ের অভাব টা ও তেমন ওর ছবি গুলো দেখে পূরণ করতাম।মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করতো ফিরে যাই ওর কাছে,থাক করুক না অপমান,তবু বিজয়ের কাছে তো থাকতে পারবো।মাঝরাতে ছট্ফট্ করতাম,ঘুম আসতো না,মনে হতো সব ছেড়ে ছুটে যাই ওর কাছে। কিন্তূ যখন দিনের আলো ফুটতো তখন আবার নতুন করে নিজেকে তৈরি করতাম।
প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো।খেতে বসলে বিজয়ের সাথে খাওয়ার মুহূর্ত গুলো মনে পড়ে যেতো,অফিস যাওয়ার সময়,ও কি করছে ভাবতাম।কোনো কাপল কে একসাথে দেখলে বিজয়ের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো মনে পড়ে যেতো।খুব কাদতাম তখন।মাঝে মাঝে সাজ্জাত আমাকে সান্তনা দিতো,বুঝাতো।বলতো
– তুমি যার কথা ভেবে এতো কষ্ট পাচ্ছো, সে কি একবারও তোমার খোজ নিয়েছে?তুমি চলে আসাতে সে ভালই আছে। বৌ সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে,দেখো গিয়ে তোমার কথা হয়তো তার মনেই নেই।
আমিও এটা ভেবেই নিজেকে শক্ত করতাম,ও যদি আমাকে ভুলে থাকতে পারে তাহলে আমি কেনো পারবোনা?
একসময় নতুন জিবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম,এখন আর আগের মতো কষ্ট পাইনা।ভুলে গেছি বলবোনা,তবে ভুলে থাকতে শিখে গেছি।প্রতিদিন নিয়ম মাফিক চলি।সারাদিনের রুটিনে নিজেকে এতোটাই ব্যাস্ত করে রাখতাম যে,কোনো ভাবেই যেনো কাওকে মিস করার সময় না পায়,তবুও মন কিভাবে যেনো নিয়ম করে মিস করেই যেতো তাকে।নিজেকে বেধে রাখলেও মন কি আর বাধা মানে?
সাজ্জাত দিনকে দিন আমার আরো বেশি কাছের বন্ধু হতে লাগলো।দেশে যেমন ও আমাকে অফিসের কাজে হেল্প করতো,এখানেও তেমনটাই করে।শুধু অফিসের কাজ বললে ভুল হবে,অন্য সব কিছুতেই আমাকে হেল্প করে।
রাতে বাসায় ফিরতে লেট হলে আমাকে এগিয়ে দিয়ে যায়,আমার কোনো বাজার লাগলে করে দিতো।যে কোনো প্রয়োজনে সাজ্জাত কে পাশে পেতাম।আমি ওর মতো একজন বন্ধু পেয়ে সব কষ্ট ভুলে থাকতাম।সব কিছু ওর সাথে শেয়ার করতাম।খুব বিশ্বাস করতাম ও কে।
কিন্তূ একদিন ও সব বিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে আমার কষ্টের কারণ হয়ে দাড়ালো।
ওইদিন কোম্পানির বিজনেস এর প্রথম বছর পূর্তি উৎসব পালন করা হচ্ছিলো।দেশের বাইরে বিজনেস টা ভালোই চলছে।কোম্পানি ভালোই সফলতা পেয়েছে।কোম্পানির সফলতা মানেই তো আমাদের সফলতা। সবাই এক সাথে কেক কাটার পর যখন বসে আলাপ করছিলাম, সাজ্জাত তখন হঠাৎ করেই আমাকে প্রপোজ করে বসলো,তাও আবার অনেক মানুষের সামনে। হাটু গেড়ে একটা আঙটি নিয়ে বললো
– সুফিয়া ইউ উইল মেরি মি?আমি সারাজীবনের জন্য তোমাকে নিজের করতে চাই,তোমার সব সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে চাই। আই হোপ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিবেনা।
ব্যাপারটায় আমি খুব কষ্ট পেয়ে ছিলাম।কিছু না বলেই ওখান থেকে চলে আসি।
পরে আর সাজ্জাতের সামনে পড়তাম না,ও ফোন দিলেও ধরতাম না।এমন ভাবে তিনদিন কাটার পর,সাজ্জাত আমার সামনে এসে দাড়ালো।আমাকে প্রশ্ন করলো
– সুফিয়া তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?
– কেনো করলে তুমি এমন টা?
– আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– কিন্তূ আমি তো তোমাকে নিয়ে তেমন টা কখনো ভাবিনি।
– সময় তো চলে যায়নি,এখন ভাবো।
– সাজ্জাত তুমি তো জানো আমি বিবাহিত,আর আমার স্বামী বেচে আছে।
– রাখো তোমার স্বামী,এমন স্বামী থাকলেই কি আর না থাকলেই বা কি।তুমি চাইলেই বিজয় কে ডিভোর্স দিতে পারো।
– চাইলেই কি আর সব হয়?কই বিজয় কে কত ভুলতে চাই,ভুলতে তো পারিনা।
– তুমি আসলে বিজয় কে ভুলতেই চাওনা,যদি চেষ্টা করতে ঠিকই ভুলতে পারতে।
– না সাজ্জাত,চেষ্টা করলেই সব হয়না।আমি চাইলেও তোমাকে বিজয়ের জায়গা দিতে পারবোনা।আমি তো তোমাকে খুব ভালো বন্ধু ভাবতাম, কিন্তূ তুমি আজ আমার সেই বন্ধুত্ব কে ছিনিয়ে নিলে?
– ছিনিয়ে নেইনি, বরং বন্ধুত্ব কে আরো প্রখর করতে চাইছি।
– সাজ্জাত বিয়ে জিনিস টা থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে,বিয়ের কথা শুনলে এখন ঘৃণা হয় আমার।
– আমি তোমার সেই ঘৃণা কে ভালোবাসায় পরিণত করবো।
– সেটা আর কখনোই সম্ভব না।
– সুফিয়া একটা প্রশ্ন করবো ,কিছু মনে করবে না তো?
– বলো।
– তুমিও তো একজন মানুষ,তোমারও শারীরিক চাহিদা আছে।তোমার স্বামী যেখানে অন্য বৌ নিয়ে দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে,তুমি তাহলে কিসের আশায় পরে আছো।তুমিও বিয়ে করে নিজের জীবন টা কে গুছিয়ে নাও।তোমার পাশে কাওকে প্রয়োজন,এই যৌবন কে এতো অবহেলা করছো,এক সময় চাইলেও ফিরে পাবেনা।
– তোমার প্রশ্নের জবাব কিভাবে দিবো ঠিক বুঝে পারছিনা,তবে এটুকু বলতে পারি
– একটা মেয়ের শারীরিক চাহিদা শুধু তার ভালোবাসার মানুষের জন্যই জাগে।যেখানে ভালোবাসা নেই,সেখানে এইসবের কোনো মূল্য নেই।ভালোবাসা আর বিয়ে ছাড়া ফিজিক্যাল রিলেশন জাস্ট একটা নোংরামি।
– সুফিয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– কিন্তু আমি তো তোমাকে ভালোবাসতে পারবোনা।তাছাড়া আমি কোনোভাবেই তোমার যোগ্য না।তুমি জানো তো আমি মা হতে পারবো না।
– জানি।
– তাহলে?
– বাচ্চাই কি জীবনের সব?আমি এমন অনেক দম্পতি দেখেছি,যারা বাচ্চা না হওয়া সত্বেও সুখে আছে,খুব ভালোভাবেই সংসার করে যাচ্ছে।তাদের জীবনে দ্বিতীয় বিয়ের ও কোনো প্রয়োজন পড়েনি।
– হয়তো তুমিই ঠিক,তবুও আমি তোমাকে ঠকাতে পারবোনা।তুমি তোমার লাইফে একজন ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করো।আমার সাথে কোনো দিক থেকেই তোমায় মানায় না।
– আমি সব মানিয়ে নিবো।
– না সাজ্জাত এটা হয়না।প্রথমত আমি বিবাহিত।দ্বিতীয়তঃ আমি মা হতে অক্ষম আর তৃতীয়তঃ তুমি আমার বয়সে ছোটো।
– আমি যদি সব কিছু মেনে নিতে পারি,তাহলে তোমার নিশ্চয় কোনো সমস্যা হবেনা.
– সমস্যা আছে।তোমার মা কখনো এমনটা মেনে নিবেন না,আমি দেখেছি ছেলে মায়ের পছন্দ মতো বিয়ে না করলে কি হয়।তোমার মায়ের পুরো অধিকার আছে একজন যোগ্য পুত্র বৌ পাওয়ার।আর সব চেয়ে বড় কথা আমি এখনও বিজয়ের স্ত্রী,আর আমি শুধু বিজয় কেই ভালোবাসি।
– তাহলে শুনে রাখো,আমিও তোমাকে ভালোবাসি।যদি বিয়ে করতে হয় তোমাকেই করবো,আর নাহলে জীবনে বিয়েই করবোনা।
সেই থেকে এতো বছর কেটে গেলো,ছেলেটা আজও বিয়ে করলো না।কত অনুরোধ করলাম,কত বুঝলাম কোনো কাজ হলো না।ওর মা খুব কান্নাকাটি করে,খুব করে বলে বিয়ে করতে কিন্তূ ও তো নাছোড় বান্দা কোনো কথাই শুনেনা।
চলবে…
সালমা আক্তার।