#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দশম_পর্ব
২৭.
হৃদিতার সামনে পড়ে রয়েছে তার বাবার নিথর দেহ। এর থেকে আর হৃদয়বিদারক কি হতে পারে? পৃথিবীতে তার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে মিস্টার আবরার ই ছিলেন; তার আইডল। অথচ আজ তার বাবার প্রাণহীন দেহটা তার সামনেই মেঝেতে সাদা কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে।
কথায় আছে “অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর!” হৃদিতার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। বাবার মৃত্যুর শোক মেনে নিতে না পেরে অনুভূতিহীন পাথর শরীরটাকে নিয়ে এক কর্ণারে বসে আছে সে। হাজার চেষ্টা করেও মৃত্যুর কোল থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে নি তাকে। চোখে জমে থাকা অশ্রু গুলো বাঁধ ভেঙে বাইরে আসার কোনো চিহ্ন ও নেই।
আশপাশের বড়রা তাড়া দিতেই কয়েকজন পুরুষের সহযোগিতায় আবরার সাহেবের লাশের খাটিয়া উঠানো হয়। উদ্দেশ্য মৃত্যুর পরবর্তী ঠিকানা কবরে দাফন সম্পন্ন করা। ইহানের কাছ থেকে খবর পেয়ে আকাশ ও একপ্রকার ছুটে আসে হৃদিতার বাসায়।
পশ্চিমা আকাশে সন্ধ্যে নেমেছে। আকাশের রং নীল থেকে কালচে রূপ ধারণ করছে ক্রমশ; সাথে করে হৃদিতার ভারাক্রান্ত হৃদয়েও বিষন্নতা জমছে প্রতিনিয়ত।
সুবিশাল আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিতা। টিমটিমে আলোয় তারাগুলো দূরে জ্বলজ্বল করছে। কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই হালকা শিউরে উঠে হৃদিতা। হালকা ঘাড় ঘোরাতেই আকাশের মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। ছোট্ট একটা দম নিয়ে নিচু কন্ঠে নীরবতা ভেঙে আকাশ বলে উঠে,
– “হৃদিতা?”
ডাক শুনতে পেয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় হৃদিতা। চোখগুলো তার অশ্রুসিক্ত; এই বুঝি টুপ করে গড়িয়ে পড়বে চিবুক বেয়ে।
– “হৃদিতা, লিসেন,,”
ব্যাতিব্যস্ত হয়ে কিছু বলার পূর্বেই আকাশকে জড়িয়ে ধরে হৃদিতা। আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা ভড়কে গেলেও স্বাভাবিক হয়ে যায় আকাশ। মিনিট দুয়েক যেতেই তার পরনের শার্টে পানির স্পর্শ পেতেই আতকে উঠে সে। তার মানে কি হৃদিতা কান্না করছে? করুক না; এতে যদি হৃদয়ে জমে থাকা কষ্ট গুলো অশ্রুসিক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে তাতে ক্ষতি কি? আকাশ ও নিজের হাত দুটোকে প্রসারিত করে হৃদিতাকে জড়িয়ে ধরে।
টানা তিন দিনের হলিডে কাটানোর পর ঢাকায় ব্যাক করার জন্য প্রস্তুতি নেয় সবাই। এই তিন দিনে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত প্রাচীর কাছে স্পেশাল মনে হয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রের সাথে স্পেন্ড করা প্রতিটা মুহূর্ত। দীর্ঘ চার বছর পর আবারও একসাথে এতটা সময় সমুদ্রের সাথে কাটাতে পেরেছে প্রাচী।
সন্ধ্যে নামার পরপরই স্টেশনে চলে যায় সবাই। ট্রেন আসতে এখনো বেশ খানিকটা সময় বাকি। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে শত মানুষের ভিড়। প্ল্যাটফর্মের এক কর্ণারে সিট পেয়ে সবাই বসে রয়েছে। সমুদ্র ইশরাকের সঙ্গে এক পাশে দাঁড়িয়ে খোশগল্পে মেতে ছিল এমন সময় হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশন বেজে ওঠার দরুন থমকে যায় সমুদ্র। পকেট থেকে ফোন বের করতেই স্ক্রিনে ’অর্পিতা’ নামটা জ্বলজ্বল করতেই সামান্য ভ্রু কুঁচকে নেয় সে। ইশরাককে ইশারা দিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
২৮.
– “হ্যালো, মিস অর্পিতা! ইজ এভরিথিং ফাইন? ওখানে সব ঠিক আছে?”
– “ইয়েস স্যার, বাট পিহু একটাই জেদ ধরে বসে রয়েছে; আপনার সাথে কথা বলা ছাড়া খাবার খাবে না। আর যদি মেডিসিন টাইম মতো না দেয়া হয় তাহলে,,”
– “ঠিক আছে, আর কিছু বলতে হবে না। পিহুকে ফোনটা দিন।”
সমুদ্রের কথায় অর্পিতা তার হাতে ফোনটি সামনে থাকা চার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ের দিকে এগিয়ে দিতেই মেয়েটা ফোন হাতে নিয়ে আধো আধো কন্ঠে বলে উঠে,
– “আমি তোমাল সাথে রাগ কলেছি(করেছি) বাবা।”
– “কেন, পিহু মামনি? আমার মামনি তার বাবার সাথে রাগ করেছে কেন?”
– “তুমি এখনো আমাল সাথে দেখা কলো নি কেন? জানো আমি তোমাকে এতোখানি মিস কলেছি।”
অভিমানের সুরে বলা কথা শুনে আলতো হাসে সমুদ্র।
– “আচ্ছা মামনি প্রমিজ আগামী সপ্তাহেই আমি তোমার সাথে দেখা করব আর তোমার জন্য সারপ্রাইজ ও নিয়ে আসব। এবার লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে মেডিসিন খেয়ে নাও, কেমন?”
– “ইয়েএএ, কি মজা; বাবা আসবে বাবা আসবে। লাভ ইউ বাবা।”
– “লাভ ইউ টু পিহু মামনি।”
বলেই দ্রুত কল কেটে দেয় সমুদ্র। ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই দ্রুত পায়ে গিয়ে ‘চ’ নং বর্গিতে প্রবেশ করে সবাই। টিকেট নাম্বার অনুযায়ী সিটে বসে পড়ে প্রাচী। যাত্রী পরিপূর্ণ হতেই দ্বিতীয় হুইসেলের আওয়াজের সাথে সাথে ট্রেনও শুরু করে তার নিজস্ব যাত্রা।
আবছা আলো, কোলাহলহীন চারপাশ, ট্রেনের জানালার বাইরে থাকা দৃশ্যে একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে প্রাচী। রাত বাড়ার দরুন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আড়চোখে একবার ডান পাশে তাকাতেই সমুদ্রের ঘুমন্ত চেহারা চোখে পড়ে তার। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, কপালের ওপর চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ব্লেজার টাও হাতের একপাশে ঝুলিয়ে রেখেছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে সমুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করায় ব্যস্ত প্রাচী।
– “লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম অতটাও খারাপ না। সবসময় গম্ভীর, রাগী ভাব, অ্যাটিটিউড নিয়ে থাকবে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এই তিন দিনে এর কোনোটাই দেখলাম না তার মাঝে।
ওয়ান মিনিট, ওয়ান মিনিট! তুই কি সব ভাবছিস প্রাচী? এই লোকটাকে নিয়ে এত ভাবছিস যে কি না সবসময় তোকে পিঞ্চ মেরে কথা বলে!
তবুও যেন মনে হয় হাজারো রহস্যের সংমিশ্রণ তার মাঝে। এই বদ লোকটাকে বোঝা আসলেই মুশকিল।”
মনে মনে বিড়বিড় করে পুনরায় বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করায় ব্যস্ত হয় প্রাচী।
ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্রেন পৌঁছে যায় তার নিজস্ব গন্তব্য ব্যস্ত ঢাকা নগরীতে অর্থাৎ কমলাপুর রেলস্টেশনে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল প্রাচী। সবার ডাকাডাকিতে চোখ দুটো পিটপিট করে তাকায়। জেবা বেগম সহ ফিহা তাড়া দিতেই উঠে দাঁড়ায় সে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়তেই হোসেন বাড়ির ড্রাইভার জব্বার সাহেবকে চোখে পড়ে সবার। সমুদ্র ও নিজের জন্য বুক করা ক্যাব দেখতে পায়। বড়দের সাথে কুশল বিনিময় করে সে তার লাগেজ নিয়ে ক্যাবে বসে পড়ে। অপরদিকে প্রাচী একদৃষ্টে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল এই আশায় যে কথা না বলুক তার দিকে একটু চোখ তুলে তাকাবে। কিন্তু না, তার সেই কল্পনাকে মিথ্যে করে দিয়ে ক্যাব ছুটে চলে তার নিজ ঠিকানায়।
২৯.
কেটে গিয়েছে দীর্ঘ একমাস। সেমিস্টার ফাইনালের এক্সাম, পড়াশোনা নিয়ে একপ্রকার ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই সময় কেটেছে প্রাচীর। আর সবার সহযোগিতায় হৃদিতাও আগের চেয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। অবশ্য তার পেছনে আকাশের ক্রেডিট টাই বেশি। কিন্তু এসবের মাঝে প্রাচীর মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো আর সবার সাথে হাসাহাসি, দুষ্টুমি ভাবটা নেই। সবসময় কেমন যেন গম্ভীর হয়ে ভাবনার জগতে ডুবে থাকে সে।
অজানা আগন্তুকের প্রতি এক আকাশ পরিমাণ বিরক্তি থাকলেও তার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছে এই এক মাসে। আশ্চর্যজনকভাবে এই মাসের ভেতর কোনো প্রকার চিরকুট, হুটহাট সামনে চলে আসা কিছুই হয়নি; যা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে প্রাচীকে।
এসব ভাবনার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে হুট করে কারো সাথে ধাক্কা খেতেই হাতে থাকা ব্যাগটা পড়ে যায় প্রাচীর। বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই চোখ পড়ে রাইয়্যানের উপর।
– “আ’ম সরি স্যার, আমি খেয়াল করি নি।”
– “ইট’স ওকে মিস প্রাচী।”
বলেই নিচে পড়ে থাকা ব্যাগ তুলে প্রাচীর দিকে এগিয়ে দেয় রাইয়্যান।
বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রাইয়্যানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় প্রাচী।
– “ Something is going to be very special, Miss Prachi.”
প্রাচীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠে রাইয়্যান।
– “হোয়াট! বিয়ে? কি সব বলছো তুমি মা?”
জেবা বেগমের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় প্রাচী।
– “হ্যাঁ, তো এত অবাক হওয়ার কি আছে? এমনিতেই আর কয়েকদিন পর অনার্স থার্ড ইয়ারে উঠবি, তাছাড়া আমি তো বলছিনা যে বিয়ে হয়ে যাবে।
শুধু দেখতে আসবে তোকে, পছন্দ হলে কথা আগে বাড়ানো যাবে। তাছাড়া তোর বাবা বলেছে পাত্র নাকি বেশ ভালো। এখন কথা না বলে ঝটপট রেডি হয়ে নে, বিকেলের দিকেই পাত্রপক্ষ চলে আসবে।”
– “কিন্তু মা, আমার কথাটা তো শোনো।”
– “আর কোনো কথা না, যেটা বলেছি সেটাই কর। আর আমারো কাজ আছে। দেখি যেতে দে আমায়।”
বলেই প্রাচীর কথাকে উপেক্ষা করে বাইরের দিকে পা বাড়ালেন জেবা বেগম।
এদিকে মায়ের কথায় যেন মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ার দশা প্রাচীর। একবার অসহায় দৃষ্টিতে বিছানায় পড়ে থাকা শাড়ীর দিকে তাকিয়ে আবারো দরজার দিকে তাকায় সে। কান্না পাচ্ছে। প্রচুর কান্না পাচ্ছে আর সাথে করে কাউকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় বাসা বাঁধে প্রাচীর মনে। কি হবে তাহলে?……….
#চলবে 🍂