#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:১৭
,
,
রাতে আমি বারবার ঘুরেফিরে শুভর রুমে গেলাম।কিন্তু নাহ,শুভ একাবারের জন্যও থাকতে বলেনি।এমনকি আমার দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকায়নি।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো সে।
আমি মুখ ফুলিয়ে আপার রুমে এসে শুয়ে পরলাম।
শোয়ার সময় শাড়িটা বদলে নিলাম।শাড়ি বদলানোর সময় আমার এতো কান্না পেলো!হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
কতো শখ করে শাড়িটা পরেছিলাম আর শুভ কিনা ফিরেও তাকালোনা?তাকাবেই বা কিভাবে?সে তো রুবি না ফুবি সেই মেয়ের কাঁধে মাথা ঘসতে ব্যস্ত ছিলো।
রাগে দুঃখে একাকার হয়ে আমি বিছানায় এসে চোখ বুজলাম।
আপা আমাকে দেখে উঠে বসলো।টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে অবাক হয়ে বললো,
—তুই এঘরে কেনো রে পিহু?শুভর ঘরে থাকবিনা?শুভর রাগ ভাঙেনি?
আমি শুয়ে শুয়েই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।রাগ ভাঙানোর সুযোগ দিলে তো ভাঙবে?সে সুযোগটা আমি পেলাম কই?
বললাম,
—না আপা!
—কিন্তু কেনো?রান্না পছন্দ হয়নি?নাকি তুই ঠিকমতো কথা বলিসনি?
—কোনটাই না।
—তাহলে?
আমি বড় করে শ্বাস নিলাম।মুখটা অসহায় করে আপার দিকে তাকালাম।আপা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে হলোনা।তারচেয়ে বরং অন্য একটা ব্যাপারে জানার আগ্রহ জন্মালো।
বললাম,
—রুবি কে আপা?
—কেনো?হঠাৎ রুবির কথা কোথায় জানলি?
—আগে বলোইনা,রুবিটা কে?কি হয় শুভর ও?
—শুভর ফ্রেন্ড,বেস্ট ফ্রেন্ড।
বিদেশে দুজন একসাথে পড়াশোনা করেছে।
কিন্তু হঠাৎ ওর কথা কোথায় শুনলি।
আমি সোজা হয়ে বসলাম।
শুয়ে শুয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।তাছাড়া চোখে ঘুমেরও দেখা নেই।
—শুনিনি আপা,দেখেছি।
আজ এসেছিলো বাড়িতে।
শুভকে ধরে নিয়ে এসেছিলো।সে আজ ক্লাবে গিয়ে নেশা করে ফিরেছে।
আপার চোখ কপালে উঠলো।আমার কথা হয়তো তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
সে বিস্ময় নিয়ে বললো,
—শুভ নেশা করে ফিরেছে? শুভ?
আমি জোরে জোরে মাথা নাড়লাম।
–কি বলছিস তুই?ও তো আগে কখনো এমন করেনি,তাহলে আজ কি হলো?
আমি আলগোছে আপার কাঁধে মাথা রাখলাম।মিনমিন করে বললাম,
—আমি হয়তো ওনাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি,তাইনা আপা?খুব বেশিই ভুল করে ফেলেছি!
আপা আমার মাথায় মৃদু গাট্টা মারলেন।
—নিজের ভুলটা বুঝতেও তো পেরেছিস?
একটু থেমে গম্ভীর গলায় বললেন,
—এতোটা বাড়াবাড়ি করা শুভর মোটেও ঠিক হচ্ছে না,মোটেও না।
আমি ফট করে আবার শুয়ে পরলাম।হঠাৎ করে একরাশ ঘুম আমার চোখের পাতায় ভর করেছে।
আপার হাত মাথায় টেনে নিয়ে বললাম,
—মাথায় হাত বুলিয়ে দাওনা আপা,খুব ঘুম পাচ্ছে।
আপা যত্ন করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
আবেশে আমার চোখ বুজে এলো।
তবে ঘুমিয়ে পরার আগে শুনলাম আপা আস্তে আস্তে বলছেন,
—চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে।
এতটুকু কথাতেই বুকটা শীতল হয়ে এলো আমার।কি জানি,কথাটার ভেতর কি এমন ছিলো?তবে এতোটুকু আশ্বাস পেয়ে মনের হারিয়ে ফেলা জোরটা আবার ফিরে এলো আমার।
আমি শক্ত করে আপাকে জড়িয়ে ঘুমালাম।
দুদিনের পরিচয়ে কেউ এতোটা আপন হতে পারে তা আপাকে না দেখলে বুঝতামই না!আমার কখনো মনেই হয়না আপা আমার নিজের কেউ হয়না,বরং ভেতর থেকে আওয়াজ আসে, ইনি তোর আপনজন,খুব খুব কাছের মানুষ।
,
সকাল সকাল রুবিকে এ বাড়িতে দেখে আমার মেজাজ চড়া হলো।এতো ভোর ভোর এ বাড়িতে তার কি কাজ?বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছে?তাও এতো সকালে?
কেনো?
আমি দরজা খুলেই ভ্রু কুঁচকে দাড়িয়ে রইলাম।রুবি ভেতরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—শুভ বাড়িতে নেই?
আমার খুব বলতে ইচ্ছে হলো,কেনো?শুভকে দিয়ে কি কাজ?যা বলার আমাকে বলে বিদেয় হোন।
তবে বলতে পারলাম না।মুখের ওপর এভাবে কটু কথা বলা যায়না।
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আমি বললাম,
—আছে,আপনি ভেতরে আসুন।
রুবি হেলেদুলে ঘরে ঢুকলো।
ড্রয়িং রুমের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে স্টাইল করে বসলো।
পরনে তার ছোট ছোট জামা।পা থেকে হাটু পর্যন্ত খোলা।
চুলও স্ট্রেট করে রাখা।
দেখতে মনে হচ্ছে কোন পুতুল বসে আছে।
আমার গা জ্বলে উঠলো।
এতো সুন্দর মেয়ে শুভর বন্ধু কেনো হবে?কেনো তার সামনে এভাবে সেজে গুজে ঘুরবে?আমি মেয়ে হয়েই রুবির সৌন্দর্য দেখে জ্বলে যাচ্ছি, আর শুভ?তার কি চোখে পরে না?
এমন সুন্দর মেয়েকে দেখলে তার কি আমায় আর ভালো লাগবে?
হঠাৎ ই আমার কান্না পেয়ে গেলো খুব।
নিজের দিকে ভালো মতো তাকিয়ে মুখটা ফুলে উঠলো।
আমার গায়ের রং ও তো রুবির মতো ওতোটা উজ্জ্বল নয়।
নিজেকে রুবির সাথে তুলনা করতে গিয়ে আমি ভেঙে গুড়িয়ে পরলাম।
মনে হলো শুভর মতো ওমন সুদর্শন পুরুষের পাশে হয়তো রুবিকেই মানায়।আমাকে নয়,একেবারেই নয়।
হয়তো শুভও বুঝেছে কথাটা।তাই আমাকে এড়িয়ে চলছে।
আমি কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা আপার রুমে গিয়ে বিছানায় বসে পরলাম।
সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে রুবির চেহারা ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
আমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠলাম।এই মুহুর্তে সবকিছু আমার কাছে বিষের মতো লাগছে।
আশেপাশের সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
দুপুর পর্যন্ত আমি দরজা আটকে বসে রইলাম।সকালে নাস্তার জন্য আপা কয়েকবার ডাকতে এসেছিলো,কিন্তু আমি যাইনি।
খেতে ইচ্ছে করেনি একটুও।
কিন্তু এখন দুপুরের খাবার জন্য আপা আবার ডাকতে এসেছে।
আমি মিনমিন করে বললাম,
—আমার খিদে নেই আপা,আমি খাবোনা।
ওপাশ থেকে আপা কড়া গলায় বললেন,
–ক্ষিদে নেই বললেই হলো,সকালেও খাসনি, এখন আবার এসব বলছিস?তাড়াতাড়ি বাইরে আয় নয়তো দরজা ভেঙে বের করবো বলছি!
—সত্যি বলছি আপা,খেতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা!
আপা মোলায়েম সুরে বললেন,
—কেনো ইচ্ছে করছেনা?আমি খাইয়ে দেবো তোকে,আয় বোন।
তুই না খেলে আমিও কিন্তু খাবোনা!
আমি উঠে দাড়ালাম।এতোটা মমতামাখা ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আমার নেই।
চোখমুখ মুছে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম।
কেমন বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে আমাকে।চোখ মুখ ফুলে একাকার হয়ে আছে।
ধীরপায়ে হেটে দরজা খুলে দাড়ালাম।আপা আমার দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলেন।
তড়িঘড়ি করে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
—কি হয়েছে পিহু,এমন দেখাচ্ছে কেনো তোকে?শুভ কিছু বলেছে?কোন খারাপ কিছু বলেছে?কি হয়েছে তোর?
—কিচ্ছু হয়নি আপা,তুমি এতো ব্যস্ত হইওনা তো!চলো,খেতে চলো।
আপা আমার দিকে মমতাভরা চোখে তাকিয়ে বললেন,
—চল।
,
খাওয়ার টেবিলে শুভও বসে আছে।তার পাশের চেয়ারে বসেছে রুবি।
আমি সেদিকে না বসে আপার পাশে বসলাম।
শুভ আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছিলো।
আমি সেদিকে নজর না দিয়ে আপাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
—আমায় খাইয়ে দাও আপা।
আপা মৃদু হেসে প্লেট নিয়ে বসলেন।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বারবার শুভ গলা খুকখুক করলো।
আপা বললেন,
—তোর আবার কি হলো শুভ?
শুভ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—কিচ্ছু হয়নি,কিছুই হয়নি আমার।কি আবার হবে?আমি রাগলে কি কারো যায় আসে?নাকি রাগ ভাঙানোর কেউ চেষ্টা করে?আমি কারো কিছুই তো হইনা।
আমাকে ফেলে পালিয়ে যেতেও তো কারো যায় আসে না।
কথাটা বলেই প্লেট রেখে উঠে দাড়ালো সে।
আমি চোখ বড়বড় করে তার দিকে তাকাতেই আমার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
হনহন করে চলে গেলো।।সিড়ি বেয়ে ওঠার পথে আবার থমকে দাড়িয়ে বলে উঠলো,
—আমার রুমে যেনো কেউ না আসে,কেউ না।
কথাটা বলেই আবার হাটা শুরু করলো।
আমি আহম্মকের মতো তাকিয়ে দেখলাম।কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই আমার মাথায় আসছেনা।আপা শুভকে কি প্রশ্ন করলো,আর শুভ কি উত্তর দিলো?কোথাকার কথা কোথায় গিয়ে পৌছালো?
আমার ভাবনার ছেদ ঘটলো কারো হাসির শব্দে।
তাকিয়ে দেখি রুবি হাসছে।শব্দ করে হাসছে।পাশে আপার মুখেও মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে।
আমি চোখ কুঁচকে তাকে বলে উঠলাম,
—হাসছেন কেনো?
রুবি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলোনা।বরং পাল্টা প্রশ্ন করলো।
—আচ্ছা তোমার ভেতর হিংসা বলে কোন বস্তু নেই?
আমি চোখটা কিন্ঞ্চিত তীক্ষ্ণ করলাম।
—মানে?
রুবি হাসতে হাসতেই বললো,
—কাল থেকে তোমাকে এতো জেলাস ফিল করাতে চাইলাম,আজও ভাবলাম শুভর আশেপাশে থেকে তোমায় জালাবো।কিন্তু তুমি তো জ্বললেই না উল্টো ঘরে দরজা আটকে বসে রইলে?
তোমার জন্য আমাদের এতো কষ্ট করে ভেবে রাখা প্লানটাই মাটি হলো।
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম।কথাগুলো আমার মাথার উপর দিয়ে সুড়ুৎ করে উড়ে গেলো।আমার অবস্থা হয়তো আপা বুঝতে পারলেন।
তিনি রুবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—মানে এসব কিছু তোর আর শুভর প্লান ছিলো?পিহুকে জেলাস ফিল করানোর জন্য?
রুবি মৃদু হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়লো।
আমি ধীরগতিতে বললাম,
—আর ক্লাব থেকে নেশা করে আসা,সেটা?
—সেটাও তো প্লানেরই অংশ।শুভর মতো ছেলে কখনো নেশা করতে পারে নাকি?
যদিও তুমি ওকে ফেলে বাড়ি ছেড়ে প্রিতমের কাছে গিয়েছিলে শুনে ও এতোটা ভেঙে পরেছিলো যে তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবে ভেবেছিলো।
কিন্তু তোমার উপর রাগ করে থাকতেই পারেনি।
তাই আমার সাথে মিলে এই প্লান করলো।
আমরা ভাবলাম শুভর পাশে আমাকে দেখে হয়তো তুমি জেলাস ফিল করবে,ওকে জরিয়ে টরিয়ে ধরে নিজের মনের কথা বলবে।অথচ তার কিছুই হলোনা।
আমি বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
আনন্দে আমার কান্না পেয়ে গেলো।
শুভ আমার উপর রেগে নেই,আমাকে ভালবাসার উপলব্ধি করাতেই এসব করেছে ভাবতেই খুশির শিহরণ বয়ে গেলো।
আমার চোখের কোনে জল দেখে আপা বলে উঠলেন,
—আরে পাগল মেয়ে,এখন আবার কাঁদছিস কেনো?
আমি তাড়াতাড়ি জল মুছে নিলাম।মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়লাম।বোঝালাম,কাঁদছি না আপা।
রুবি আমার দিকে ঝুকে বলে উঠলো,
—এখনো এখানে বসে আছো কেনো পিহু?যাবেনা?
—কোথায়?
—শুভর রুমে,ও যে যেতে বললো?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—উনি তো কাউকে ওনার ঘরে যেতে নিষেধ করলো!
—আরে বোকা তুমি কি ইশারাও বোঝো না?
আমি চমকের উপর চমকে উঠলাম।
মুখে নিষেধ করে মনে মনে যেতে বলে?এ আবার কিরকম ইশারা রে বাবা?
,
,
চলবে…..