সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -০২+৩

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০২

তারকা খচিত হোটেলের ছাদের এক কর্নারের টেবিলে নিশ্চুপ বসে আছে ইভানা। সামনে প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকেই দেখছে আবরার। ইভানা উসখুস করছে কথা বলতে। মনের ভেতরের গিজগিজ করতে থাকা কথাগুলো একটাও মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
আবরার নরম গলায় বলল,
“ইভানা, কোনো সমস্যা? দেখা করতে চাইলে অথচ কিছু বলছো না৷ কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলো।”

ইভানা তবুও কিছু বলছে না। কেবল হাত কচলে যাচ্ছে অনবরত। আবরারের মনটা উচাটন করতে শুরু করল। ধক করে উঠল বুকের ভেতরটায়।
ভয়ার্ত কণ্ঠে মৃদু আওয়াজে বলল,
“ইভানা, তুমি কি কাউকে ভালবাসো? সেজন্য বিয়ে করতে চাইছ না?”
ইভানা চোখ বড় বড় করে তাকাল। তার নীরবতাকে আবরার যে এই দিকে ঘুরিয়ে নেবে ঘূনাক্ষরেও টের পায় নি সে। অন্যদিকে আবরার প্রশ্নটা করার পর মনে মনে হাজার বার বলছে -উত্তরটা যেন না হয়।
তার আশায় আঘাত না করে এবং মনের অগোচরে করা দোয়াটা কবুল করে ইভানা মন খারাপ করে বলল,
“সেটাই তো আমার আফসোস । প্রেম! হায়!একটা প্রেম করলেই ভালো হতো। তার হাত ধরে পালিয়ে যেতাম এই বিয়ে থেকে। কিন্তু কপাল আমার। একটা প্রেম ও করিনি জীবনে। তার আগেই আপনি ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। এই আপনি আমার বাবা মা’কে কি জাদু করেছেন বলুন তো? আপনি ছাড়া কিছু ভাবতেই পারছে না তারা। আপনি সত্যি জাদুটাদু জানেন নাকি?”
আবরার ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। মুখ এগিয়ে মৃদুস্বরে ফিসফিস করে বলল,
“জানলে তোমাকেই আগে জাদু করতাম। একেবারে প্রেমের বান মেরে দিতাম। শয়নে স্বপনে জাগরণে কেবল আমাকেই দেখতে। আফসোস!”
ইভানাও আবরারের স্টাইল কপি করে নিচু গলায় বলল,
“আমি ইহজীবনে আপনার প্রেমে পড়ব না।”
আবরার পুনরায় হাসল। হেসে হেসেই বলল,
“প্রেমে পরতে হবে না। ভালবাসলেই হবে।”

কিয়ৎক্ষণ মৌনতা পালন করার পর ইভানা ধীরেসুস্থে বলল,
“আমার একটা শর্ত আছে।”
ইভানার কথা শুনে আবরার আহ্লাদিত হয়ে বলল,
“তার মানে বিয়েটা হচ্ছে?”
ইভানা চোখ পিটপিট করে বলল,
“শর্ত মানলে।”
“তোমার হাজারটা শর্ত আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।”
“আমাকে কোনো ব্যাপারে জোর করা যাবে না। না আপনার সাথে দেশ ছাড়ার ব্যাপারে। আর না অন্য কোনো ব্যাপারে। আমি স্বাধীন চেতা মানুষ। আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না।”
আবরার মৃদু হেসে বলল,
“ব্যাস?”
ইভানা মাথা নাড়াল। সামনের ধোঁয়া উঠা কফির দিকে নজর দিয়ে বলল,
” বাকিগুলো সময় সাপেক্ষ।”
আবরার মাথা নেড়ে সায় জানাতেই দু’জন যুবক হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলের উপর। ঘটনার আকষ্মিকতায় ইভানা হকচকিয়ে গেল। টেবিলের উপর লেপ্টে থাকা আবরারের বা হাত ডান হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে নিজেকে সামলালো। আবরার চমকে উঠে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। ইভানা বুঝতে পেরে তড়িৎ গতিতে হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল।

সামনে বসা দুইজন যুবকের দিকে তাকিয়ে আবরার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সন্ধিগ্ন গলায় বলল,
“তোরা এখানে, এভাবে? জানলি কি করে আমি এখানে এসছি? আমার যতদূর মনে হচ্ছে আমি তোদের বলিনি। কে বলল ?”
চারজন যুবকের মধ্য থেকে শ্যামল নামের শ্যামা ছেলেটি বলল,
“তোর নাম্বার ট্র্যাক করে খুঁজে বের করেছি। তুই নির্দিষ্ট সময় থেকে আধঘন্টা দেরি করে ফেলেছিস। তারওপর ফোন তুললি না। তাই বাধ্য হয়ে ট্র্যাক করেছি। এখানে এসে তো দেখছি পরিস্থিতি ভিন্ন। মজনু এখানে লাইলির মুখ দর্শন করছে। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে তুমি এখানে প্রেম মারাচ্ছো শালা ডাফার।”
আবরার কিছু বলার আগেই ইভানা অবাক হয়ে বলল,
“ভাইয়া আপনি এখানে?”
শ্যামল এবার ভাল করে তাকাল ইভানার দিকে। অতঃপর সে নিজেও অবাক হয়ে বলল,
“আরে ইভানা যে। তুমি ওর সাথে কি করছো?”
উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার নিজেই বলল,
“এটা বলো না যে ওর সাথেই তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল।
আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল, ,
“তোর আপত্তি আছে নাকি?”
শ্যামল কিছু বলার আগেই আবরার পুনরায় বলল,
“কিন্তু তুই ইভানা কে কিভাবে চিনিস?”
শ্যামল আমতা আমতা করল। স্পষ্ট কিছুই বলতে পারল না।
ইভানা তা দেখে মৃদু হেসে বলল,
“শ্যামল ভাইয়া আমার ফ্রেন্ড সায়মার বয়ফ্রেন্ড। তাদের প্রেমের ঘটক আমি। ভাইয়া আমার ফ্রেন্ডের জন্য তার পেছনে না গিয়ে আমার পেছনে পেছনে আসতো আমার বাসা পর্যন্ত। যাতে আমি ম্যানেজ করে দেই। সায়মার সামনে সে ভেড়া হয়ে থাকত। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হতো না। বেচারা এখনো ভালবাসি বলতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। অথচ সম্পর্কের তিনবছর চলে।”

আবরার ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকাল। শ্যামল হাসল না। আবার বাঁধাও দিল না। কেবল চাপা সুরে বলল,
“তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই বোন। তোমার কপালে যে বিদেশী ভেড়া জুটেছে তা তুমি সারাজীবন ঘষেমেজেও মানুষ করতে পারবে না। যেদিন জানবে কোন হাই লেবেলের ভেড়ার খপ্পরে পরেছো সেদিন তুমি নিজেই ভেড়া হয়ে যাবে। ওহ সরি সরি। ভেড়া নয় ভেড়ি।”

ইভানা ভ্রু কুঁচকে আবরারের দিকে তাকাল। বিরবির করে বলল,
“এ আসলেই ভেড়া?” আমিও যদি এর সংস্পর্শে ভেড়া হই তবে বাচ্চাগুলো কি ভেড়া হয়েই জন্ম নেবে? পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে চিৎকার না করে ভ্যা ভ্যা করবে? ও মাই গড। নাআআআ।”

পুরো কথাটা বিরবির করে বললেও শেষের চিৎকারটুকু জোরসে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকাল ইভানার দিকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর স্বপ্নাদর্শন করেছে সে।
আবরার মৃদুস্বরে বলল,
“কোনো সমস্যা?”
ইভানা অসহায় মুখ করে বলল,
“আমি বিয়ে করব না প্লিজ।”
এবার রাগ হলো আবরারের। ঠিক রাগ নয় মৃদু অভিমান। সে কি ফেলনা? এত টালবাহানা কিসের তার? দেখতে ভাল, ক্যারিয়ার ভাল, চরিত্রটাও বাঁধাই করার মত, নেশাদ্রব্য ছুঁয়ে দেখেনি কখনো। কেবল ভার্সিটি জীবনে বন্ধুদের সাথে দু-এক টান সিগারেট, এই যা। মেয়েলি কেলেঙ্কারির কোনো বালাই নেই। একদম পত্নীপ্রতা স্বামী হওয়ার পণ করেছে সে। তবুও কিসের এত দ্বিধা তার?

অভিমানটুকু গিলে ফেলল সন্তর্পণে। মুখটা স্বাভাবিক করে বলল,
“আর কোনো অপশন নেই তোমার। ভাল মেয়ের মত বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও। হাতে কিন্তু মাত্র দুদিন। মাথায় আছে তো? তারপর রাত দিন শয়নে স্বপনে জাগরণে কেবল আবরার ফাইয়াজ আর আবরার ফাইয়াজ।”

ইভানা চোখ বড় বড় করে তাকাল। বিরবির করে বলল,
“দেখে যতটা ভাল মনে হয় ততটাও নয়। ভেতরে ভেতরে আস্ত একটা হারামি। ভেড়া নয় ভেড়াদের সম্রাট সে। ঠিক আছে আমিও ইভানা আফরোজ। নরকের দরজা যদি দেখিয়ে না এনেছি নাম বদলে ফেলব নিজের। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।”

শ্যামল গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমাদের দিকেও একটু নজর দে ভাই। আমরাও জলজ্যান্ত দুইজন মানুষ বসে আছি তোর সামনে। আমাদেরও তো কত বছর পর দেখলি। একটু অ্যাটেনশন তো আমাদেরও প্রাপ্য।”
আবরার ঠোঁট কামড়ে হেসে ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কানে আঙুল দাও তো।”
ইভানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল,
“কেন?”
আবরার পুনরায় হাসল। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এখন আমি অ্যাডাল্ট কথা বলব। আমি চাই না আমার বউ এত তাড়াতাড়ি পেকে যাক। ছোট্ট বউ তো আমার।”

ইভানা ফট করে চোখ ঘুরিয়ে নিল। অন্য দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে সত্যি সত্যি কানে আঙুল দিল।
মনে মনে বলল,
” আমি ছোট্ট? তেইশ বছরের একটা মেয়ে কি করে ছোট্ট থাকতে পারে? ছোট্ট বউ? মাইগড। একে সামলাতে আমার জীবনটা মরুভূমির চোরাবালিতে না ডেবে যায়। আল্লাহ রক্ষা করুন।”

আবরার সামনে বসা শ্যামল ও রিফাতের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল,
“আমি বলার আগে যদি ও ঘূনাক্ষরেও টের পায় যে ও আমার পূর্ব পরিচিত তবে তোদের বউদের বিয়ের আগে বিধবা করার দায়িত্ব আমার। তবে ভয় নেই। তাদের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে দেব। নিজের বউয়ের বিয়ে দেখতে না চাইলে চেপে যাবি। কেমন?”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ০৩

ফেরার পথে ‘রূপকুমারী’ নামে একটা পার্লারের সামনে এসে ইভানা থেমে গেল। আবরার আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“এখানে দাঁড়ালে? কোনো দরকার?”
ইভানা মাথা নিচু করে বলল,
“আপনি চলে যান। আমার দেরি হবে।”
“সেটাই তো। কি করবে এখানে? আমিও সঙ্গ দেই নাহয়।”
ইভানা চোখ পিটপিট করে বলল,
“আমি পার্লারে যাব। সেখানে ছেলেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।”
আবরার অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“আচ্ছা! বিয়ে করবে না করবে না বলে আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছো। অন্যদিকে প্রস্তুতি পুরো দমেই চলছে। ভাল ভাল। মাঝখান থেকে আমাকে প্যারার উপর রেখেছো।”
ইভানা ভ্রুকুটি করে বলল,
“শুরু হয়ে গেল খোঁচা দেওয়া। এজন্যই আমি পশ্চিমা ছেলেদের বিয়ের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলাম। এরা সোজা কথা সোজাসাপটা বলতে পারে না। বাই দি ওয়ে, আমি বিয়ের জন্য মানা করলে আপনি প্যারায় থাকবেন কেন? কতশত মেয়ে আছে ধরার বুকে। অন্তরীক্ষের ন্যায় বিশাল বিশাল মন নিয়ে অপেক্ষা করছে তারা। আপনি চাইলেই টুক করে ডুবে যেতে পারেন তাদের মাঝে । স্বাদ নিতে পারেন বিয়ের, ভালবাসার। সেক্ষেত্রে আমিও বেঁচে যেতাম।”

আবরার মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে বলল,
“আমাকে বিয়ে করা তোমার কাছে মৃত্যুসম?”
ইভানা চমকে তাকাল। এটা সে কখন বলল?
অবুঝের মতো বলল,
“আমি এটা কখন বললাম?”
আবরার তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“বলেছো বলেছো। মনে করে দেখো। আমার সাথে বিয়ে নাহলে তুমি বেঁচে যাও। তারমানে বিয়ে হলে মরে যাওয়ার মত যন্ত্রণা পাবে। যে লাউ সে-ই তো কদু, তাই না?”
ইভানা মাথায় হাত দিল। এ তো তিলকে তাল না ডিরেক্ট তরমুজ বানিয়ে ফেলছে।
হাস্যরসাত্নক ভাবে বলল,
“বেঁচে যেতাম আর মরে যাব। দিস ইস নট সেম ব্রো।আপনি যে পরিমাণ কথা পেচানোর ওস্তাদ। আমার সারাজীবন কথার প্যাচ ছাড়াতেই চলে যাবে। সংসার আর হয়ে উঠবে না। পয়েন্ট টু বি নোটেড, বিদেশী সাহেবের মুখে বাংলা প্রবাদ। ইম্রেসিভ।”
“আচ্ছা! আমাকে বিয়ে করবে না। অথচ মনে মনে আমার সংসার সাজিয়ে নিচ্ছো। আসলে তুমি কি চাও বলোতো? আর আমি মোটেই সাহেব নই। পিওর বাঙালি। একসঙ্গে থাকতে শুরু করো। তবেই বুঝতে পারবে।”
“আপাতত ছুটি চাই। অনেকটা সময় লাগবে আমার। ভেতরে যেতে পারি প্লিজ?”
আবরার মৃদু হেসে মাথা নাড়াল।

প্রায় দু’ঘন্টা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ইভানা বের হলো পার্লার থেকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিক্সা খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভর দুপুরে আশানুরূপ কিছু পেল না। দু’একটা রিক্সার দেখা মিললেও তাতে যাত্রী বোঝাই। বিরক্ত ভঙ্গিতে মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করতেই তীব্র ঝাঁঝালো পুরুষালী কণ্ঠ কানে বাজল।
“এভাবে আঘাত করলে পায়ে জখম হয়ে যাবে যে।”
ইভানা চমকে পেছনে তাকাল। তাকিয়ে চমকানো চাহনিটা পরিবর্তিত হলো মুগ্ধতায়।
আবরার দু’হাত পকেটে গুঁজে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা শার্টের বুকের উপরিভাগে ঘামে ভেজার ছিটেফোঁটা অংশ দেখা যাচ্ছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আবৃত গালে মুচকি হাসির তোড়ে বিন্দুসদৃশ টোল নজরে পড়ল ইভানার। ইভানার তাকিয়ে থাকা দেখে বা হাতে গাল চুলকে মাথা নিচু করে হাসল আবরার।

ইভানা চোখ ফিরিয়ে নিল। নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবল,
“এই শেষ হেমন্তের সময়ও লোকটা এভাবে ঘেমে গেছে। ভেতরে কি আগুন নিয়ে বসবাস তার? নাকি আমিই বরফের নদীতে বিচরণ করি? আগুন আর বরফ পাশাপাশি হলে আগুন নিভবে নাকি বরফ গলবে?”

ইভানার ভাবনার রেশ কাটলো আবরারের গলা খাঁকারির আওয়াজে। ইভানা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এখনো যাননি?”
আবরার মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে যায় নি।
ইভানা প্রশ্নাত্নক দৃষ্টি মেলল।
আবরার উত্তর দিল না। কি’বা বলবে সে? এটা বলবে যে, তোমাকে একা রেখে আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই দু’ঘন্টা বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলাম। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?
প্রসঙ্গ পাল্টাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“বাসায় ফিরবে কিভাবে?”
ইভানা মৃদুস্বরে বলল,
” রিক্সা করে। কেন?”
“রিক্সা তো দেখতে পাচ্ছি না। তুমি দাঁড়াও আমি দেখছি ওদিকটায় আছে নাকি। আসার সময় তো অনেকগুলো দেখলাম এখন নেই কেন ?”
ইভানা মুচকি হেসে বলল,
“তখন সময় বারোটা ছিল আর এখন দুটো। ভরদুপুরে আমার জন্য তারা এদিকে বসে থাকবে?”
আবরার অবুঝের মত বলল,
“থাকবে না, না?”
ইভানা মাথা নাড়ালো। আবরার চলে গেল রিক্সার খোঁজে। কিন্তু রাস্তা পার হতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তি। ছয় বছর পর দেশে ফিরে ঢাকার মত ব্যস্ত শহরে রাস্তা পার হওয়াটা সত্যিই কষ্টসাধ্য।
আবরার রাস্তা পার হতে গিয়ে বিপাকে পড়ায় ইভানা এগিয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে হাতে হাত রেখে সামনের দিকে পা চালালো। আবরার অবাক হয়ে ইভানার ধরে রাখা হাতের দিকে দেখে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
ইভানা নিচু গলায় বলল,
“বিয়ে যখন হবে, আমাকে দেখার অনেক সময় পাবেন।এখন আপাতত রাস্তা দেখুন। একটু এদিক সেদিক হলে সোজা উপরে। আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না কিন্তু। এখনো অনেক স্বপ্ন পূরণ করা বাকি।”
আবরার তবুও ইভানার দিকেই বেহায়ার মত তাকিয়ে রইল। রাস্তার কিনারায় পৌঁছে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই হাতে চাপ অনুভব করল ইভানা। হাতের দিকে পরখ করে আবরারের মুখের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলল,
“কি?”
আবরার মাথা নাড়াল। অর্থাৎ কিছু না।
“তাহলে হাত ছাড়ুন।”
আবরার বশীভূত কণ্ঠে বলল,
“ধরে রাখলে খুব ক্ষতি হবে?”
ইভানা ফোঁত করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“বিয়ে হয়নি এখনো। আর হলেও নিব্বি নিব্বাদের মত রাস্তায় হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াতে পারব না। সেই বয়স অনেক আগেই পার করে চলে এসেছি। আপনার দূর্ভাগ্য আপনি সেসময় আসেন নি আমার জীবনে। তাই অনেক কিছু মিস করতে হবে আমাকে বিয়ে করে।”
আবরার হাত ছেড়ে দিয়ে ভাবল- সে কি আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলল? নাকি পুনরায় জানিয়ে দিল সে বিয়েটা করতে চায় না?

রিক্সায় উঠে মাঝখানটায় বসে আবরারকে বাই বলার আগেই আবরার চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“মাঝখানে বসেছো কেন? সরে বসো। আমি কোথায় বসব?”
ইভানা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি কোথায় যাবেন?”
“তোমাকে পৌঁছে দিতে।” আবরারের ভাবলেশহীন উত্তর।
ইভানা গা ছাড়া ভাবে বলল,
“কোনো দরকার নেই। আমি যেতে পারব। আপনি বাসায় যান।”
“তুমি সাইডে চেপে বসো। কথা দিচ্ছি মাঝখানে জায়গা রেখে বসব। একদম ঘেঁষাঘেঁষির চেষ্টা করব না। আমি জানি আমাদের বিয়ে হয় নি। হলেও নিব্বা নিব্বিদের মত আমরা রিক্সা করে ঘুরতে পারব না। আমি জানি এসব।”

ইভানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার জীবনের অনাগত দিনগুলোর কথা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে তার। খুব সহজ সাবলীল যে কাটবে না তা একদিনেই বুঝা হয়ে গেছে। আবরার ফাইয়াজ নামের শান্ত সুন্দর পুরুষটি যে শান্তি হরণ করতে চলে এসেছে তা তার ব্যবহারই স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে।

“কি হলো সরো?”
প্রায় ধমকের সুরে বলল আবরার। ইভানা তবুও নিজের জায়গায় অবিচল রইল। আবরার চোখ বন্ধ করে পুনরায় খুলে বলল,
“আচ্ছা। সরবে না। আমার সমস্যা নেই। আমি এভাবেই বসতে পারব।”
বলেই প্রায় লাফিয়ে রিক্সায় উঠে পড়ল। ইভানা ঘটনার আকষ্মিকতায় চমকে পেছনে সরে গেল। বেখেয়ালে সরতে গিয়ে রিক্সার একদম সাইডে চলে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু আবরার দ্রুত হাতে সামলে নিল। ইভানা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল আবরার কড়া চোখে তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। ইভানা এই প্রথম বার ভয় পেল। এতক্ষণ মনে মনে যত যাই বলুক ভয় পায় নি। কিন্তু এবার ভয় হচ্ছে।
ভয়ে ভয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাল ইভানা। তাকাতেই চমকে উঠল। রক্ত বের হচ্ছে হাত থেকে। রিক্সার হুডে লেগে কখন কেটে গেছে বুঝতেই পারে নি।

সামান্য ছিলে যাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারা মেয়েটা মুখ বন্ধ করে হাতে ড্রেসিং করাচ্ছে। যন্ত্রণাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিচ্ছে। আবরার চেয়ারে বসে চুপচাপ তাকিয়ে আছে ইভানার দিকে। ইভানা আড়চোখে তাকিয়ে আবার হাতের দিকে নজর দিল।

আবরার ইভানার অবস্থা বোধহয় বুঝতে পারল। তাই ডাক্তারের হাত থেকে তুলো আর ঔষধ নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“বাকিটা আমি করে নিচ্ছি। থ্যাংক ইউ ।”
প্রবীণ ডাক্তার মাথা নেড়ে চলে গেলেন নিজের চেয়ারে।

“জ্বলছে?” আদুরে কণ্ঠে শুধালো আবরার।
এতক্ষণ শক্ত হয়ে বসে থাকলেও এত সময় পরে আদুরে কণ্ঠ শুনে মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে উঠল ইভানা। দাঁত মুখ কামড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে সে। এভাবে স্বল্প পরিচিত একটা মানুষের সামনে এই টুকু ব্যথার জন্য কেঁদে ফেলাটা সমীচীন নয়।
আবরার পুনরায় নরম গলায় বলল,
“খুব বেশি জ্বলছে?”
ইভানা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
“কেন এত ছটফট করতে গেলে? আমি পাশে বসলে কি তোমাকে খেয়ে নিতাম? নাকি আমি পাশে বসলে তোমার জাত যেতো?”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল। কি বলবে সে? এটা বলবে যে, আবরার পাশে বসলে তার অস্বস্তি হয়। দুদিন পর থেকে যার সাথে দিন রাতের প্রতিটি সেকেন্ড অতিবাহিত করতে হবে তাকে এটা বলা শোভনীয়?

“মুখ আড়াল করে রেখেছো কেন? তাকাও আমার দিকে।”
ইভানা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
“আপনি আমাকে বকছেন। ধমকাচ্ছেন।”
আবরার অবাক হয়ে বলল,
“আমি কখন বকলাম? ধমকালামই বা কখন? এই মেয়ে তুমি আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো কেন?”
“এখন কিভাবে কথা বলছেন? কি করছেন? আদর করছেন? এগুলোকে ধমকানো বলে না তো কি আদর করা বলে?”
আবরারের এবার বোধহয় ভারী মজা হলো।
নিচু গলায় বলল,
“আদর চাই তোমার?”
ইভানা রিক্সার মত করেই ছিটকে দূরে সরে গেল।
আবরার হেসে উঠল গা কাঁপিয়ে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here