সেদিন বসন্ত ছিল ২ পর্ব – ১৩+১৪+১৫

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১৩

হাট করে খুলে রাখা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ধুরুধুরু বুকে এদিক ওদিক দেখল ইমরান। পুরো ঘর জুড়ে ছড়ানো ছিটানো আছে বিভিন্ন জিনিসপত্র। এলোমেলো হয়ে আছে বিছানাটাও। বালিশগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝের মাঝ বরাবর। ফুলদানিতে থাকা কিছু তাজা ফুল পায়ের তলায় পিষে প্রায় থেঁতলে গেছে। সেগুলোও পড়ে আছে অযত্নে, অবহেলায়।

গোছানো কামরার এহেন পরিবর্তনীয় রুপ দেখে ইমরান বাম হাতে মাথার চুল টেনে ধরল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল লাগোয়া ওয়াশরুমের দিকে। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ তুলে বলল,
“ইভানা; আপনি ভেতরে আছেন?”

এতক্ষণ ভয়ের শহরে বিচরণ করে থাকা ইভানা দেহে প্রাণ ফিরে পেল যেন। দ্রুত হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বন্দীদশা থেকে। নিজের পরিচিত ঘরের এই অপরিচিত রূপ দেখে অবাক হলো ভীষণ। একটা ইঞ্চিও বোধহয় লোকগুলো বাদ দেয় নি খুঁজতে। সেজন্যই তো এত অগোছালো।

উল্টে থাকা একটা টি-টেবিল সোজা করে হাতের ফোনটা রেখে ছোটখাটো জিনিসগুলো গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করল ইভানা। ইমরান বুকে হাত গুঁজে ইভানার দিকে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। ইভানা কিয়ৎকাল বাদেই টের পেল এই চাহনির আভাস। খানিকটা নড়েচড়ে বসে বলল,
“কি?”
ইমরান মাথা নিচু করে সন্তর্পণে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“কতটা মনোবল এই ছোট্ট দেহে?”

ইভানা মৃদু হাসল। থেঁতলে যাওয়া ফুলগুলো তুলতে তুলতে বলল,
“মনোবল দেহে থাকে না; তা মনের গহীনে বিরাজমান।”

সময় গড়ালো নিজেদের নিয়মে। বিকেল গড়িয়ে হলো সন্ধ্যা; সন্ধ্যা শেষে রাত। অগোছালো ঘরটার সমস্ত অগোছালো সত্বা ঘুচিয়ে রূপ পেল ছিমছাম গোছানো এক কামরার। ইভানার হাতে হাতে কাজ এগিয়েছে ইমরানও। অতঃপর রাতের যখন প্রথম প্রহর ; ঘড়ির কাটা আটটার ঘরে ঘুরছে, ঠিক সেই সময়টায় এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে গম্ভীর গলায় বলল,
“ফর্মুলা কোথায় ইভানা?”

হঠাৎ থমথমে গলায় বলা বাক্য শুনে ইভানা বেশ খানিকটা চমকাল। তবে নিজেকে সামলেও নিল তৎক্ষণাৎ। কাপটা একহাতে শক্ত করে ধরে বলল,
“আছে, নিরাপদে।”

ইমরান সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“নিরাপদ জায়গাটা কোথায়?”

ইভানা মুচকি হেসে পাশে থাকা ফোনটা উঁচিয়ে ধরে বলল,
“এখানে।”

ইমরান অবাক দৃষ্টি মেলল। বিস্ময়ের সহিত বলল,
“আপনি ফোনে ফর্মুলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান? পাগল টাগল হয়ে গেছেন নাকি? ফোনটা যদি চুরি হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়?”

ইভানা ঠোঁটের কোণের হাসি বজায় রাখল। মিহি গলায় বলল,
“ফোনে নিয়ে ঘুরে বেড়াই বলেই আজ বেঁচে গেছে। আর চুরি বা নষ্ট হয়ে গেলে আরও এক জায়গায় আছে। অতি যত্নে আড়াল করে রেখেছি। আপনি ভাববেন না। তার আবিষ্কার আমি বৃথা যেতে দেব না। তার সাফল্য তার ঝুলিতে ধরা দিতেই হবে।”

“কিন্তু ইভানা, আপনি ফোন নিয়ে ওয়াশরুমে কি করছিলেন?” খানিকটা কৌতুকে গলায় বলল ইমরান।

ইভানা সরু দৃষ্টি মেলে বলল,
“আপনি কি আমায় পঁচাতে চাইছেন? মজা করছেন আমাকে নিয়ে?”

ইমরান হেসে বলল,
“আমার সেই স্পর্ধা কোথায়? একটু আগে যেভাবে চমকে গেলেন, মনে হচ্ছিল যেন সন্দেহ তালিকায় আমিও বেশ উপরের সারিতেই আছি।”

প্রায় ঘন্টা খানেক সময় ধরে মৃত্তিকা বসে আছে ইমরানের সামনে। পাশে ইভানাও বসে আছে নির্বিকার। সরকার বাড়ির পারিবারিক অ্যালবাম থেকে শুরু করে ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করল। এর মাঝে রয়েছে এহসানের আবরার কে অপছন্দ করার ঘটনাও। এই অদ্ভুত যুক্তি শুনে ইমরান খানিকটা ভাবল। অপছন্দ করার কারণটা কি হতে পারে! এই কারণটাই কি হতে পারে খুনের কারণ! মন সায় দেয় না ;আবার শান্তিও দেয় না। খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার চেষ্টা যেন আরও খানিকটা জটিল হয়ে পড়ে। তবে কি আহনাফ, এহসান দু’জনেই জড়িয়ে কোনো ঘৃণ্য চক্রান্তে!

“আমার ছেলের বউ হবে, মা?”

প্রায় অচেনা একজন মায়ের বয়সী মহিলার কাছে এহেন প্রস্তাব পেয়ে ইভানা চমকাল। মাথার উপর দিয়ে গেল তার সবটা। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল সে। যার কোনো ভাষা নেই। মিশ্র প্রতিক্রিয়া বলা যায়।

শেলী সরকার পুনরায় বলল,
“আমার আহনাফের বউ হবে?”

ইভানা এবার মুখ খুলল। বেশ ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“দুনিয়ায় কি মেয়ের অভাব পড়েছে? একজন বিবাহিত মহিলাকেই আপনার ছেলের বউ করতে ইচ্ছে হলো?”

“আবরার তো আর নেই।”
শেলী সরকারের বলতে দেরি হলো। কিন্তু ইভানার তেলে বেগুনে জ্বলতে দেরি হলো না। তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে।
“কে বলেছে আবরার নেই? হয়তো তার শরীরটা নেই। কিন্তু আমাদের মনে সে আজীবন বেঁচে থাকবে। আপনি ভাবলেন কি করে, আপনার খুনি ছেলেকে আমি বিয়ে করব? আপনাদের পুরো পরিবারই খুনি। আপনি খুনি, আপনার সন্তানেরা খুনি। আপনারা সকলে মিলে খুন করেছেন আমার আবরার কে। বিধবা করেছেন আমাকে। এতিম করেছেন আমার সন্তানকে। সন্তান হারা করেছেন আমার শ্বাশুড়ি মা’কে।”

শেলী সরকার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মুখে তার ভাষা নেই আর। স্থান কাল পাত্র ভুলে সে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন ইভানার মুখপানে।

পেছন থেকে পুরুষালী কর্কশ কণ্ঠে কেউ চেঁচিয়ে বলল,
“ইভানা!”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১৪

আহনাফের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে পেছন ফিরে তাকাল ইভানা। চোখে তার রাজ্যের ঘৃণা। অপর প্রান্তের মানুষটির চোখে জলন্ত আগুন। রাগে রি রি করতে থাকা আহনাফ ইভানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্রোধান্বিত গলায় বলল,
“কে খুনি? কাকে খুনি বলছেন আপনি ? আমাকে? আমার মা’কে? একজন মা তার সন্তান কে মেরে দিল, রাইট? এটাই বলতে চাইছেন তো?”

ইভানা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল শেলী সরকারের দিকে। তিনি তখন নত মস্তকে দৃষ্টি মেলে রেখেছেন মেঝেতে।
আহনাফ পুনরায় বলল,
“যাকে আপনি আজ সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, সে ছাড়া একসময় আপনার স্বামীর সকাল হত না, রাত্রি আসত না। একেকটা দিন অতিবাহিত করতে হলে তার এই শেলী সরকার কে প্রয়োজন হত। কারণ সে ছিল মা। এই দূর দেশে যখন আপনার স্বামী অসুস্থতা নিয়ে ওঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলত, তখন সামলাতো এই শেলী সরকার এবং আহনাফ সরকার। অথচ আজ! আজ তাদেরই আপনি সন্দেহের তালিকায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। বাহ মিসেস ফাইয়াজ, বাহ! এই না হলো ভালবাসার প্রতিদান।”

শেলী সরকার আহনাফ কে ধমকে চুপ করিয়ে দিলেন। কঠোর হতে চেষ্টা করে বললেন,
“আহনাফ, চুপ করো তুমি। ইভানা কিছু জানে না;তাই বলে ফেলেছে এভাবে। ইভানা আবরারের জীবনে আসার আগেই তো দুরত্ব চলে এসেছিল সম্পর্কে। তাহলে ও কিভাবে জানবে? ওর কি দোষ?”

ইভানা মর্মাহত হলো। নির্দোষ মানুষ কে এতগুলো কথা শুনিয়ে ফেলল! কি করলো এটা সে!
নরম গলায় বলল,
“আমি কি জানতে পারি কিছু বছর আগের সেই সত্যিগুলো? কেন দুরত্ব চলে এলো মা ছেলের সম্পর্কে?”

শেলী সরকার আহনাফের দিকে তাকালেন। কিঞ্চিৎ সময় পর ধীর গলায় বললেন,
“আবরার আমার কাছে আহনাফ, এহসান থেকে আলাদা ছিল না কখনোই। সমান চোখে দেখতাম তিনজনকেই। প্রায় নয় বছর আগে আহনাফ আবরার কে নিয়ে আসে আমার কাছে। বন্ধু ছিল তারা। তথাকথিত বন্ধু নয়। একেবারে জানের দোস্ত। এমনিতেই আমরা বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ পেলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাই। তারওপর ছেলের বন্ধু। কিছুদিনেই আপন হয়ে ওঠে সে। একসময় গিয়ে হয়ে ওঠে নিজের ছেলে। ও যে ভালবাসার জন্যই জন্ম নিয়েছিল। না চাইতেও যেন সবাই ভালবেসে ফেলে। আদায় করে নেয় ও নিজের গুণ দ্বারা। আমরাও বাইরে নই। ভালবেসে ফেলি। কিন্তু আমার ছোট ছেলে এহসান; ও সহ্য করতে পারতো না এই ভালবাসা। বেজায় হিংসে হত তার। হিংসুটে ছেলেটা আবরার এলে বাড়িই থাকতো না। ওর ভালবাসায় নাকি ভাগ বসায় আবরার। কিন্তু দেখো আবরার চলে যাওয়ার পর অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে। হয়তো ভেতরে ভেতরে পছন্দই করতো। চলে যাওয়ার পর বুঝেছে। এভাবে বেশ ভালোই চলছিল সময়। কিন্তু আবরার প্রথমবার দেশে যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে আমাদের। বাড়ি আসতো না, খোঁজ খবর নিলেও শুধু আমার সাথে কথা বলেই কেটে দিতো কল। অথচ একসময় আহনাফের সাথে তার ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো। এভাবে চলতে চলতে একসময় সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও আমার সাথে মাঝেসাঝে দু এক মিনিট হলেও হতো কথা। সেটাও আর আগের মত ছিল না।”

ইভানা কিঞ্চিৎ সময় মৌন থেকে বলল,
“সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ?”

শেলী সরকার অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল আহনাফের দিকে। আহনাফ মায়ের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব দেখতে পেয়ে নিজে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার মিসেস ফাইয়াজ। এ ব্যাপারে আপনি নাক না গলান।”

ইভানা সরু দৃষ্টিতে তাকাল। তাচ্ছিল্য গলায় বলল,
“নাক যখন আছে গলাতে তো হবেই। যদি সেটা হয় আমার স্বামীর ব্যাপারে। খুন করা হয়েছে তাকে ; বুঝতে পারছেন?”

আহনাফ ধীর গলায় বলল,
“আপনার স্বামীর খুনে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণের কোনো যোগাযোগ নেই। আর না আছে আমাদের হাত। আপনি অযথা তেল পুড়াচ্ছেন। জায়গা বুঝে বুদ্ধি খরচ করুন।”

ইভানা থামল না। নিজের ভাবনায় স্থির থেকে বলল,
“এক টুকরো কাগজ নিয়ে আসুন।”

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ইভানা সেসবে পাত্তা না দিয়ে পুনরায় বলল,
“যান!”

আহনাফ গেল না। উঁচু বাক্যে বলল,
“মৃত্তি এক টুকরো কাগজ লাগবে।”

মৃত্তিকা যেন অপেক্ষাই করছিল। দ্রুত পায়ে কাগজ, কলম নিয়ে এসে ইভানার হাতের ধরিয়ে দিল। ইভানা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানে অভিনন্দন লিখুন।”

আহনাফ ভ্যাবলাকান্তের ন্যায় তাকিয়ে রইল। ইভানা জোর দিতেই গটগট করে ইংরেজি বানানে কংগ্রাচুলেশনস লিখে ফেলল।
ইভানা কপাল চাপড়ে বলল,
“বাংলা লিখুন।”

আহনাফ খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ল বোধহয়। চেহারায় খানিকটা লজ্জা ভাবও ফুটে উঠল। ইভানা অবাক হলো।
মনে মনে বলল- আশ্চর্য! আমি কি তাকে প্রেমপত্র লিখতে বলছি নাকি! নাকি বলেছি ফার্স্ট নাইটের গল্প শোনাতে! বিরক্তিকর।

আহনাফ কিছু বলার আগেই শেলী সরকার বললেন,
“ওরা বাংলা লিখতে জানে না ইভানা। পড়তে পারে। কিন্তু লিখলে সেটা আর পড়ার জো থাকে না। দেখছো না লজ্জা পাচ্ছে।”

ইভানা অতি দুঃখেও মুখ টিপে হাসল। কিন্তু মনের ভেতর খুত খুঁতে ভাব রয়েই গেল।

হঠাৎ করেই আহনাফ কিছু মনে পড়ার মত করে বলল,
“ইমরান কি গোয়েন্দা বিভাগের লোক?”

ইভানা চমকে উঠল। বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
“মানে?”

আহনাফ মুচকি হেসে বলল,
“এটা ওপেন সিক্রেট মিসেস ফাইয়াজ। সবাই জানে অথচ কেউ কিছু বলে না। সাবধান হোন দু’জনেই। যে আবরার কে মেরেছে সে কিন্তু চাইলে আপনাকেও সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার ওপর আপনি সেই ফর্মুলা নিয়েই কাজ করছেন।”

ইভানা চট করে বলল,
“আপনি কি করে জানলেন আবরার কে ফর্মুলার জন্য মারা হয়েছে?”

আহনাফ হেসে ফেলল। ধীর গলায় বলল,
“আপনি বোধহয় আমাকে সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ দিতে পারছেন না। কিন্তু এটা হবে আপনার মিস টার্গেট। টার্গেট করতে শিখুন। অন্ধকারে ঢিল ছুড়লে যে তা সবসময় লক্ষ্যের দিকেই যাবে তা ভাবা বন্ধ করুন।”

ইভানা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“তবে বলুন আপনাদের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ?”

আহনাফ মায়ের দিকে তাকাল। কি বলবে সে! এটা বলবে যে, ভাই হয়ে ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দিয়েছে! এটা যে পাপ। ঘৃণ্য অপরাধ। আহনাফ তাকে বিয়ের আগে থেকেই পছন্দ করতো; এটা যদি জানতে পারে তবে কি পারবে তার চোখে চোখ মেলাতে? পারবে না। এখন তো সন্দেহ করছে। কিন্তু তখন? তখন তো ঘৃণা করবে। নোংরা তকমা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেবে। এখনই’বা কাছে কোথায়! তাচ্ছিল্য হাসে আহনাফ। ভাগ্যের কি নিয়তি!

বহু বছর আগে আবরারের সাথে বন্ধুত্ব হয় তার। যখন তারা অল্প বয়সী যুবক। বয়সের দোষে একজন নিজের ভালবাসা জাহির করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। আরেক জন স্বাচ্ছন্দবোধ করে তা গোগ্রাসে গিলতে। একসময় গেলার পরিমাণটা এতটাই বেশি হয়ে যায় যে, না দেখেই অচেনা রমণীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে আহনাফ। সেটাও বন্ধুর দীর্ঘ সময়ের সাধনার প্রেম। আবরার দেশে ফেরার কিছু মাস আগে কোনো ভাবে টের পায় এই দুর্বলতা। হয়তো তার ব্যবহারই জানিয়েছিল নিজের ভুল, অন্যায়, পাপ। অতঃপর ভাঙন ধরে সম্পর্কে।

ইভানা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। মুখ খুলল না আহনাফ। শেলী সরকার ইভানার হাত ধরে বলল,
“কারণটা যাই হোক মা, আহনাফ আবরারের ক্ষতি করার মত সাহস সাহস রাখে না। তুমি অকারণ ভুল বুঝো না ওঁকে।”

ইভানা নিজেকে বোঝালো। তার ধারণা ভুল। কিন্তু হাজার বার বুঝিয়েও মনটা খুতখুত করতে ছাড়ল না। তবুও বেরিয়ে এলো সে হাসিমুখে। সন্দেহটা নাহয় মনের কোণেই থাক।

ফিরে আসার পথে তার চোখে প্রথম দিনের ঘটনাগুলো ভেসে উঠল। এই কারণগুলোই তবে ছিল ওই ব্যবহারের কারণ। আবরারের নাম শুনতেই কাছে টেনে নেয়া, মমতা মাখা আদর দেয়া। তবে কেন বলল সেই কথাগুলো? সেই হাপিত্যেশ? আবরারের সুইসাইড করা নিয়ে অবজ্ঞা? শুধু কি তাকে ছেলের বউ হিসেবে পাওয়ার জন্য? কিন্তু এটাই বা কেন চাইছে? একজন বিবাহিত নারীকে কেন চায় বিয়ে করতে! কি কারণে!

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পর্বঃ১৫

ইমরান বিহীন দ্বিতীয় দিবস অতিক্রম করছে ইভানা। জরুরী কাজের পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত ফ্লোরেন্সের বাইরে অবস্থান করছে সে। গবেষণাগারে একঝাঁক ব্যস্ত গবেষণাবিদের মাঝে ভাবলেশহীন ভাবে বসে আকাশকুসুম ভাবনায় মত্ত ইভানা। অনেকটা সময় এভাবে অতিক্রান্ত হওয়ার পর ঘোর কাটে গৌতম বিশ্বাসের ভারী কণ্ঠ কানে আসাতে।

“মিসেস ফাইয়াজ!”

প্রথমবার কানে ভারী কণ্ঠের আওয়াজ এসে ঠেকলেও কোনো ভাবাবেগ দেখাল না ইভানা। পরবর্তীতে পুনরায় ডাকল,
“মিসেস ফাইয়াজ; আর ইউ ওকে?”

ইভানা এবার হকচকিয়ে গেল। চকিতে তাকিয়ে শুধালো,
“কিছু বললেন?”

গৌতম বিশ্বাস পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। মুচকি হেসে বললেন,
“কিছু হয়েছে আপনার? ঠিক লাগছে না দেখতে।”

ইভানা সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি বলবে সে! নতুন করে আর কি হবে? যা হওয়ার তা তো তিন বছর আগেই হয়ে গেছে। সব কেড়ে নিয়ে শূন্য করে দিয়েছে বিধাতা তাকে। যেটুকু বাকি আছে সেটুকুও কেড়ে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ধরণী।

গতকাল গোধুলী লগ্নে আসা একটা ফোনকলে তার ভেতরটা ভয়ে জর্জরিত হয়ে আছে। ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে আরও কয়েকগুণ বেশি।

নোভা গিয়েছিল মাসিক চেক-আপ করাতে। কাছাকাছিই একটা হাসপাতালে। সঙ্গে ছিল রিফাত। হসপিটাল এরিয়া থেকে বের হতেই একটা অল্পবয়সী ছেলে হাতে একটা সুসজ্জিত প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। নোভা বিস্ময়ে তাকায় রিফাতের দিকে। মাঝ রাস্তায় কে দেবে এমন রংচঙে পার্সেল! কৌতূহলী নয়নে প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ছেলেটা এক ছুটে হারিয়ে যায় লোকজনের ভীড়ে।
নোভা আর অপেক্ষা করে না। সেখানে দাঁড়িয়েই খোলস মুক্ত করে। ভেতরে থাকা বস্তুটার উপর নজর পড়তেই হাত থেকে ফেলে চেঁচিয়ে রিফাত কে আঁকড়ে ধরে। রিফাতও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে পিচঢালা রাস্তায় পড়ে থাকা বস্তুটার দিকে।

ছোট্ট একটা মেয়ে পুতুল। সোনালী রঙা লম্বা হালকা কোঁকড়ানো চুল। ক্লিপ দিয়ে আঁটকে রাখা দু’পাশে। সোনা রঙা মুখশ্রী ভেসে যাচ্ছে রক্তে। রক্তের উৎপত্তি মাথার অগ্রভাগে। ডানপাশ থেকে এখন অবধি লাল রঙা তরল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। মুখের একপাশও থেঁতলে গেছে।

নোভার চোখে ভেসে ওঠে বছর তিনেক আগের সেই দৃশ্য। প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের শেষ যাত্রার করুণ কিছু সময়। ফুঁপিয়ে ওঠে সে। খামচে ধরে জড়িয়ে রাখা মানুষটার বুকের কাপড়টুকু।
রিফাত চেষ্টা করে সামলাতে। দু’হাতে মুখ তুলে নয়নে নয়ন মিলিয়ে বলে,
“এটা পুতুল, দেখো ওগুলো রক্ত নয়; রং। কেউ তোমার সাথে মজা করেছে। ভয় নেই। আমি আছি তো, দেখো। তোমার কোনো বন্ধু হয়তো ইয়ার্কি মেরেছে। কেউ ভয় পাইয়ে দিতে চাইলেই তুমি ভয় কেন পাবে?”

নোভা কান্নারত গলায় বলল,
“দাদাভাই!”

রিফাত তাকে পুনরায় চেপে ধরল বক্ষপিঞ্জরে। তার বুকটাও যে পুড়ছে ক্রমাগত।

“নতুন ছেলেটা কে মিস করছেন?”
গৌতম বিশ্বাসের এহেন কথায় ইভানা ভ্রুকুটি করে তাকাল।বলল,
“নতুন ছেলে?”

“ইমরান।” স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল গৌতম বিশ্বাস।

ইভানা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি কেন তাকে মিস করব?”

গৌতম বিশ্বাস হেসে ফেললেন ইভানার চাহনি দেখে। মৃদু হেসেই বললেন,
“সারাক্ষণ যেভাবে আপনার লেজ ধরে থাকে, তাই ভাবলাম মিস করছেন।”

ইভানার হাসি পেল না এই রসিকতায়। গম্ভীর কণ্ঠেই বলল,
“নতুন এসেছে, তার ওপর একই দেশের বাসিন্দা। সেজন্য আত্মিক টানটা রয়েছে।”

গৌতম বিশ্বাস মাথা নাড়ালেন। বললেন,
“তা তো অবশ্যই।”

যখন মন খারাপের প্রবল বন্যা হয় তখন লোকজন ছুটে মন ভালো করার তাগিদে। কিন্তু এই মেয়েটা মন খারাপ জিয়িয়ে রাখতেই পছন্দ করে। সকাল থেকে রাত অবধি, আবার রাত থেকে সন্ধ্যা। মন খারাপে জর্জরিত মেয়েটি আর্নোর জলে দৃষ্টি মেলে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“যার স্মৃতির পাতায় আজীবন সন্ধ্যা, তার জীবনে উষা আবার কি? তার তো আজীবন সন্ধ্যা। ঘুটঘুটে আঁধারে ঢাকার ঠিক আগ মূহুর্ত।”

ঘুটঘুটে আঁধারে আরাবী এসেছে তার জীবনে আবছা আলো হয়ে। প্রদীপের সলতে হয়ে নিভু নিভু জ্বলছে। তাই তো জীবনটা সন্ধ্যায় এসে ঝুলে আছে। নইলে তো কবেই নিমজ্জিত হত নিকষ কৃষ্ণ আঁধারে।

সন্ধ্যা নামার মূহুর্ত কয়েক আগে ইভানা ওঠে আসে আর্নোর তীর থেকে। পা ফেলে নিজ আলোয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাঁধা প্রাপ্ত হয় মৃত্তিকার ফোনকলে। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে পায়ে পায়ে এগোতে এগোতে বলতে থাকে দিবসের ঘটে যাওয়া একেকটা ঘটনা। একেক রকম অভিজ্ঞতার গল্প। তন্মধ্যে রয়েছে কিছু উপদেশ বাক্যও।

ফোন কানে রেখেই ব্যাগ হাতড়ে চাবি বের করে। কিন্তু দরজার দিকে তাকাতেই ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো তার। দরজা খোলা! খানিকটা ভয় আর সংকোচ নিয়ে ভেতরে পা ফেলে। এদিক ওদিক করে সবটা দেখে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ভাবল, হয়তো লক করতে ভুলে গেছে সে। আনমনা হয়ে আজকাল অনেক কিছুই ঠিকঠাক করতে পারছে না সে।

কিন্তু তার ভুল ভাঙে কিচেনে পা ফেলতেই। আয়েস করে একজন বসে আছে। শুধু বসে নেই, ছুড়ি দিয়ে ফল কেটে তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে সে। যেন নিজের ঘরের ড্রয়িংরুম।

পিপাসায় গলা শুকিয়ে থাকা ইভানার যেন আত্মা পর্যন্ত শুকিয়ে এলো। কম্পিত গলায় বলল,
“কে আপনি?”

হাতে ধরে রাখা ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে পুনরায় চেঁচিয়ে বলল,
“কথা বলছেন না কেন? কে আপনি? বের হন আমার বাসা থেকে।”

বসে থাকা মানুষটা একজন ইতালিয়ান। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। দেবে যাওয়া চোখ। কিন্তু তাতে চতুরতা বিরাজমান।

দৃষ্টিতে হিংস্রতা দেখে ইভানা এক পা পিছিয়ে এলো। এ পর্যায়ে ওঠে দাঁড়াল লোকটি। তার দিকে এগিয়ে আসতেই ইভানা পেছনে ছুটে দরজা বন্ধ করে ফেলে। আঁটকে রইল লোকটি রান্নাঘরেই।

দিকবিদিকশুন্য হয়ে সদরদরজা খুলে বেরিয়ে আসতে চাইলে বাঁধা প্রাপ্ত হলো আরও একজন লোকের কাছে। সেও একজন ইতালিয়ান। শক্ত হাতে ইভানার গালে থাপ্পড় বসিয়ে ইতালিয়ান ভাষায় গড়গড় করে কিছু বলল। ইভানা সবটা না বুঝলেও যতটুকু বুঝতে পারল, তাতে লোকটা নিঃসন্দেহে ফর্মুলা চাইছে। পুনরায় পিছু হটল সে। একছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আল্লাহ নাম জপতে আরম্ভ করল। যদি খোদাতায়ালা সাহায্যের জন্য কাউকে পাঠায়।

ফোনের কথা মনে পড়তেই হাতের দিকে তাকাল সে। কিন্তু হাত দুটো যে শূন্য। থাপ্পড়ের তাল সামলাতে না পেরে সিটকে পড়েছিল সে। সঙ্গে ফোনটাও। তখনই পড়ে গেছে কোথাও। হয়তো ভেঙেও গেছে।

দিশাহীন ইভানা এই মূহুর্তে এসে নিজেকে সবচেয়ে অসহায় আবিষ্কার করল। বিরবির করে বলল,
“আবরার; আবরার কোথায় তুমি! একটি বার এসো।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here