“শুনুন,আমি শাড়ির কুঁচিগুলো ঠিক গোছাতে পারছিনা। একটু হেল্প করে দেবেন প্লিজ!”
সোফাতে বসে বসে ল্যাপটপে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা করছিল সায়াহ্ন।ঐশীর মুখে এমন কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকালো সে।
তাকাতেই তার দৃষ্টিগোচর হল ঐশীর অগোছালো শাড়ির ফাঁক গেলে বেড়িয়ে থাকা উন্মুক্ত উদর,উন্মুক্ত কোমড়।সায়াহ্ন তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নত করলো।ভীষণরকমের বিরক্তিতে ফিরিয়ে নিল মুখ।এত বড় মেয়ে শাড়ি সামলাতে পারেনা,এটা ভেবেই মাত্রাতিরিক্ত অসহ্যকর অনুভূতি হল তার।যদি শাড়িই পড়তে না পারে তবে বিয়েটা করতে গেল কেন,যে মেয়ে একটা শাড়ি গোছাতে জানেনা,সেই বা একটা গোটা সংসার গোছাবে কিকরে?মিছিমিছি বিয়েটা করে তার জীবনে অশান্তি ডেকে না আনলেই হত।
কথাগুলো ভাবতেই সায়াহ্ন ফিরে গেল অতীতে।
গতকালকেই ঐশীর সাথে সায়াহ্নর পরিবারের ইচ্ছেতে বিয়ে হয়েছে।যদিও বিয়েতে তার মোটেও ইচ্ছে ছিল না।একপ্রকার মা-বাবার চাপে পড়েই বিয়েটা করতে হয়েছে তাকে।
তাই গতকালকে বাসররাতেই সে পরিষ্কারভাবে ঐশীকে জানিয়ে দিয়েছে যে তার পক্ষে এ বিয়ে মেনে নেয়াটা সম্ভব না।তারপরেও ঐশী কোন অধিকারে তাকে নিজের শাড়ির কুঁচি গোছাতে ডাকে কে জানে?
সায়াহ্ন ঐশীর ডাকের উত্তর না দেয়ায় ঐশী দ্বিতীয়বার তাকে ডাকলো।এবার সায়াহ্নর বিরক্তি লাগলো,সাথে রাগ।রাগটা বরাবরই একটু বেশি তার।তবে আপাতত সে বাড়িভর্তি আত্মীয়ের সামনে সিন ক্রিয়েট করতে চায়না,তাই একপ্রকার রাগটাকে দমিয়ে রেখে বিরক্তির স্বরে বলে উঠল,
“আপনি কি নিজেকে সত্যি সত্যি আমার বউ ভাবছেন?দেখুন কাল রাতেই তো আপনাকে বলে দিলাম যে…!”
ঐশী পূর্ণদৃষ্টিতে সায়াহ্নের দিকে তাকলো।নিতান্তই সহজ এবং স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,
“আমার তো নিজেকে আপনার বউ ভাবার কিছু নেই।আমি আপনার বউই সায়াহ্ন। তিন কবুল বলে ধর্মমতেই বিয়েটা হয়েছে আমাদের।তাই আপনি না মানলেও বিয়েটা মিথ্যে নয়।”
সায়াহ্ন কিছুটা থমকালো।ঐশীর স্পষ্ট উত্তরে কিছুটা অবাকও হলো।খানিক ফ্যালফ্যাল নয়নে ঐশীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ধমকানো স্বরে বলে উঠলো,
“গো টু হেল উইথ ইওর বিয়ে।স্টুপিড গার্ল।মিনিমাম আত্মসম্মান নেই তোমার?একটা ছেলে বলছে যে সে তোমাকে নিজের স্ত্রী বলে মানেনা।তারপরেও তোমার কোন লজ্জা নেই।নির্লজ্জের মতো শাড়ির কুঁচি ধরতে ডাকছো আমায়?”
সায়াহ্নর কথা শুনে ঐশী হালকা হাসলো।রাগের মাথায় ছেলেটা কখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে তা হয়তো সে খেয়াল করেনি।
ঐশীকে এভাবে হাসতে দেখে আবারো এক পশলা অবাক হল সায়াহ্ন। তার মনে হতে লাগলো এই মেয়েটা পাগল।নইলে এমন অপমানজনক কথা শুনে কেউ কি হাসে?সে কাল রাতেও খেয়াল করেছে,বিয়ে না মানার কথা টা শোনার পরেও ঐশীর ঠোঁটজুড়ে এমন স্বাভাবিক হাসিই বিস্তৃত ছিল।এমনকি তাকে বিছানা ছেড়ে নেমে যেতে বলার পরেও তার এই প্রশস্ত হাসির কোনরুপ নড়চড় হয়নি।
সায়াহ্ন বলতে চাইলো,
“এই মেয়ে,তুমি কি পাগল।এত কটু কথা শোনার পরেও এভাবে হাসছো কিকরে?”
কিন্তু বলতে পারলোনা।কোন এক অজানা বাঁধা তাকে বেঁধে দিল,আটকে দিল কন্ঠে থাকা শব্দগুচ্ছ।
তবে ঐশী হয়তো সায়াহ্নর মনের ভাব ধরতে পারলো।তাই সহাস্য বদনেই স্বগোতক্তি করে উঠল,
“আমি পাগল নই সায়াহ্ন। তবে আমি কেঁদেকেটে জীবনের সুন্দর মুহুর্ত গুলোকে নষ্ট করতে বাধ্য নই।একটাই তো জীবন আমাদের।এই একটা জীবন তো হাসার জন্য,ভালো থাকার জন্যই কম পড়ে যায়।সেখানে কারণে অকারণে মন খারাপ করে,কষ্ট পেয়ে,কেঁদে কেটে অস্থির হবার মতো সময় কোথায়?তাই আমি হাসি।বেঁচে থাকার জন্য হাসি,কারণে অকারণেই হাসি।আমার জীবনে কষ্ট-কান্নার কোন স্থান নেই,যেকোন পরিস্থিতিতেই তাই আমার মুখের হাসি অক্ষয় থাকে।কখনো বিলীন হয়না।”
সায়াহ্ন মুগ্ধ হয়ে কেবল শুনেই গেল তার সামনে দাঁড়ানো এক আশ্চর্য রমণীর কথা। জীবণ সম্পর্কে যার ধারণাটা একদম আলাদা।একেবারে ভিন্ন।তবে এত মুগ্ধতার ভীড়ে সায়াহ্ন নিজেকে জড়িয়েও জড়ালো না।নারীজাতির মায়ায় একবার জড়িয়ে পড়ে বড্ড বেশি ভুগেছে সে।আর না।
তাই ঐশীর কথার উত্তর না দিয়েই ল্যাপটপ ব্যাগটা নিয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
ঐশী এবারেও হাসিমুখেই চেয়ে রইল সায়াহ্নর যাবার পথে।সায়াহ্ন চলে যেতেই সে আবার শাড়ির কুচি ঠিক করার বৃথা চেষ্টায় লেগে গেল।
.
ল্যাপটপে কিছু ফটো চেক করার আছে সায়াহ্নর।অফিসের খুব বড় একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব পড়েছে তার ওপর।তারই জন্য ফটো সিলেক্ট করতে হবে প্রজেক্ট স্লাইড তৈরির জন্য।
সে উদ্দেশ্যেই ল্যাপটপ স্ক্রিনে একের পর এক ফটো দেখতে দেখতেই সায়াহ্নর চোখ আটকে গেল একটা ছবিতে।
মুখের ভাষা নিমেষেই পরিবর্তন হয়ে গেল তার।চোখ জ্বলে উঠল।
ল্যাপটপ স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে রিধী আর তার হাস্যোজ্জল একটি ছবি।
তাতে রিধীকে পেছন থেকে জাপটে ধরে তারঁ কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে সায়াহ্ন।
ছবিটা দেখে সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলোনা।ভিজে আসা চোখজোড়া আবার ভয়ানক কাঠিন্যে ভরে উঠল। এক ঝটকায় সামনে থাকা ল্যাপটপটা ছুড়ে ফেলল সে মেঝেতে।ঝনঝন আওয়াজে চোখের পলকেই তা খন্ড বিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়লো সারাটা মেঝে জুড়ে।
সায়াহ্ন ধপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ঘর কাঁপানো চিৎকার করে বলে উঠল,
“তুমি আমাকে ঠকিয়েছ রিধি।তুমি তোমার কথা রাখনি।প্রমিস ব্রেক করে আমার মনটাকেও এভাবে হাজার টুকরোয় ভেঙে দিয়েছ।আই হেট ইউ রিধি।আই জাস্ট হেট ইউ।”
পরক্ষণেই মেঝেতে হাটু মুড়ে বসে পড়লো,ছড়িয়ে থাকা কাচের কিছু টুকরোও ফল স্বরুপ বিঁধে গেল পায়ে।সায়াহ্ন সেদিকে ধ্যান দিল না।দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
“আমাকে কেন এভাবে একা ফেলে চলে গেলে রিধি কেন??তোমাকে ছাড়া যে থাকতে পারিনা আমি। খুব কষ্ট হয় আমার।আই লাভ ইউ আ লট রিধি।আই লাভ ইউ!”
.
নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে পাশের রুমেই গিয়েছিল সায়াহ্ন। দুই রুমের ব্যালকনি অ্যাডজাস্ট।মাঝে একটি বিশাল গ্রিলের বেড়া ছাড়া আর কোন দেয়ালের বাঁধ নেই সেখানে।সেই ব্যালকনিতে বসেই হয়তো কাজ করছিল সায়াহ্ন। এই রুমের ব্যালকনির দরজাটা লাগানো হয়নি বলেই হয়তো সে রুমের সব আওয়াজ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে এসে বারি খেল ঐশীর কানে।
প্রথমবারে ল্যাপটপ ভাঙার আওয়াজে হঠাৎ চমকে গিয়ে প্রায় আয়ত্তে আনা শাড়ির কুচিগুলো হাত ফসকে পড়ে গেছে তার।
সেগুলো যখন মাটিতে লুটোপুটি খেতে ব্যাস্ত তখনই সায়াহ্নর হঠাৎ চিৎকারে আবার আরেকদফা চমকেছে সে।
অবাধ্য শাড়ির কুচিগুলো দুহাতে জড়িয়ে তুলে নিতেই সায়াহ্নর হাউমাউ করা ক্রন্দন ধ্বনীতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ায় আবার হাতের বাঁধন ছেড়ে খসে পড়েছে কুচি গুলো।
ঐশীর হঠাৎ করেই ভীষণ অদ্ভুত লাগলো সায়াহ্নর ব্যবহার।এই রাগছে,রেগে বলছে ঘৃণানকরে আবার এই কাঁদছে,কেঁদে বলছে ভালোবাসে।এসব কোন কথা!!
সায়াহ্ন র কি হয়েছে তা জানার জন্য, এলোমেলো শাড়ির কুচি গুলো কোনরকম কোমড়ে গুজে পাশের রুমের দিকে হাঁটা দেবে তারঁ আগেই আবার চতুর্থবারের মতো সবগুলো কুঁচি খুলে পড়লো মেঝেতে।
তাতেই পা বেঁধে ধুপ করে মেঝেতে উপর হয়ে লুটিয়ে পড়লো ঐশী।ব্যাথায় মুখচোখ কুচকে এলো তার।
হঠাৎ কোন এক কচি হাতের অবয়ব তার চোখের সামনে ভাসতেই চোখ তুলে তাকালো সে।
ফুটফুটে একটা বাচ্চা,বয়স এই চার কি পাঁচ বছর হবে,পরনে হালকা গোলাপি রঙা ফ্রক,মাথার চুল দুদিকে ঝুটি করা,ঠোঁটে ঝোলানো ভুবনমোহিনী হাসি।
ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার এমন মিষ্টি হাসিতেই যেন ঐশীর সব ব্যাথা কর্পুরের মতো উবে গেল।
বাচ্চাটার বাড়িয়ে দেয়া হাতটাকে আকড়ে ধরে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো সে।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শাড়ির কুচি দেখে ঠোঁট উল্টে বাচ্চাটার দিকে তাকাতেই দঁজন মিলে বাচ্চাসুলভ হেসে উঠল।
বাচ্চাটা হাসি থামিয়ে বলে উঠল,
“আমি পারি কুঁচি ধরতে দাঁড়াও,আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। ”
ঐশী মাথা নেড়ে সায় জানালো।
ছোট্ট মেয়েটি তার ছোট ছোট আঙুলের ভাজে নিদারুণ দক্ষতার সাথেই গোছাতে লাগলো ঐশীর শাড়ির কুচিগুলো।
অবিন্যস্ত শাড়ির প্রতিটা ভাজে নিপুণভাবে হাত চালিয়ে শাড়ির কুচি গুলো সাজিয়ে নিয়ে ঐশীর হাতে ধরিয়ে দিল সে।
ঐশী আবার বিস্তর হাসলো।বাচ্চা মেয়েটির মুখেও সেই একইরকম ছড়ানো হাসি।
শাড়ির কুঁচি টা ঠিকঠাক মতো গুজে নিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো ঐশী
একগাল হেসে বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি না এলে যে কি হত!আমি তো শাড়ি পড়তেই জানিনা।ভাগ্যিস তুমি ছিলে!”
বাচ্চা মেয়েটাও হাসিমুখে জবাব দিল,
“ব্যাপার না।আমরা আমরাই তো।”
ঐশী আবার খিলখিল করে হেসে উঠল।তার সাথে পুনরায় তাল মেলালো বাচ্চা মেয়েটা।খানিক বাদে হাসি থামিয়ে ঐশী জিজ্ঞেস করলো ,
“আচ্ছা, তুমি কে গো?কাল তো তোমাকে দেখিনি আমি।তুমি আমার কি হও?”
বাচ্চা মেয়েটা আবার হাসলো।হাসি বজায় রেখেই উত্তর দিল,
“আমি তো এতদিন বোর্ডিং স্কুলে থাকতাম।কালকে ছুটি পাইনি তাই আসতে পারিনি।আমার কত্ত ইচ্ছে ছিল ইভিনিং স্টারের বিয়ে দেখব।বাট হলইনা।আজ ছুটি পেয়েছি তাই সকাল সকাল চলে এলাম আর দেখ এসে তোমার হেল্পও করে দিলাম।”
কথাটুকু বলেই আবার বিস্তর হাসলো বাচ্চাটা।ঐশীও হাসলো।তার বাচ্চাটিকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।যদিও বাচ্চা মানেই আস্ত একটা ভালোবাসার ঝুলি।তাই তাদের পছন্দ না হয়ে উপায় নেই।তবে এই বাচ্চাটা বেশিই আলাদা।তার হঠাৎ করেই মনে হল,এই বাচ্চা মেয়েটা যদি তার মেয়ে হত?তাঁকে সর্বক্ষণ মা মা বলে ডাকতো,কি ভকলোই না হত।
পরক্ষণেই মনে হল এ অসম্ভব। যেখানে স্বামী বিয়ের প্রথম রাতেই বলে দেয় যে সে বিয়ে মানে না।সেখানে মা হবার স্বপ্ন দেখা নিছকই অরণ্যে রোদন,নিষ্ফল আবেদন।
তবে এতকিছুর মাঝেও সায়াহ্নর ইভিনিং স্টার নামটাও বেশ মনঃপুত হল ঐশীর।সে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা, নাম কি তোমার?আর বললে না তো আমাদের কি সম্পর্ক। কি বলে ডাকবে তুমি আমায়?”
বাচ্চা মেয়েটা জবাব দিল,
“আমি রায়া।সিদরাত রহমান রায়া।আর দাদীমা তো বললো তুমি আমার মা হবে।আমি তোমাকে মা বলে ডাকি?ইভিনিং স্টার তো আমাকে ওনাকে বাবা ডাকতে দেয়না।তবে তুমিও কি আমায় মা ডাকতে দেবেনা?”
রায়ার মুখে এমন কথা শুনে চরম অবাক হল ঐশী।এসবের কি মানে তার কিছুই বোধগম্য হল না তার।রায়া তাকে মা ডাকবে মানে?আর সায়াহ্নকেই বা কেন বাবা ডাকতে যাবে সে?
সায়াহ্নের যে কোন মেয়ে আছে তা তো ঐশী জানতো না।এতবড় কথাটা কি ইচ্ছে করেই জানানো হয়নি তাকে।এতবড় সত্যিটা লুকানোর কি খুব প্রয়োজন ছিল তার থেকে।তাকে কি এক প্রকার ঠকানো হলনা!!
কথা গুলো বারবার মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুতে বাহিত হতে থাকলো ক্রমাগত।আর বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে।অনড়,নিষ্পলক ভাবে।
#চলবে
#হতে পারি বৃষ্টি❤️
#পর্ব-১
#লেখনীতে- মৌশ্রী রায়