হাওয়ায় ভাসা উড়ো চিঠি পর্ব -১৫ ও শেষ

#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (১৫ – সমাপ্ত)

খুব ভোরে সমুদ্রে এসেছে উষা। বালির আস্তরণ গুলো পায়ের সাথে মিশে গিয়ে গিজ গিজ করে। আবার ধুয়ে যায় সমুদ্রের জলে। ভালো লাগে ওর। হাল্কা সমীরণ গুলো স্পর্শ করে যায় গাল চিবুক সহ সর্বাঙ্গ। অনেক ভোর হওয়াতে মানুষ জন নেই একদম। আসার পথে কাউকেই দেখে নি এদিক টায়। হঠাৎ ই একজন কে আসতে দেখল। একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। তবে ছেলেটা যেন ওর দিকেই আসছে। উষা পায়ের গতি বাড়ায়। এবার ছুটে আসছে ছেলেটা।
“ভয় পেলেন?”

জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল উষা। অদ্ভুত লোক! উষার সাথে তালে তাল মিলিয়ে পায়ের গতি বাড়াল। উষা তখনি বলল,”কি সমস্যা?”

“অনেক সমস্যা।”

“তো আমার কাছে কি?”

“আপনার কাছেই তো সব।”

“হোয়াট!”

“এই তো আমি এসেছি আপনার কাছে আপনাকে চাইতে।”

“পাগল নাকি!”

“হু একদম পাগল। শুধু আপনার জন্য।”

“সরেন সামনে থেকে।”

“আমি আপনাকে পছন্দ করি উষা।”

ধুক করে উঠল উষার হৃদয়। ছেলেটা ওর নাম ও জানে? মেয়েটি তৎক্ষণাৎ সরে এল। পেছন থেকে ছুটে এল রিদ।
“শুনেন না।”

“চাচ্ছি না শুনতে। আর মাথায় রাখবেন ভা ঙা গ্লাস কখনো জোড়া লাগে না।”

“কথাটা অনেকাংশেই ভুল।”

বিস্ফোরিত হয়ে তাকায় উষা। রিদ হেসে জবাবে বলল,
“ভা ঙা গ্লাস কে জোড়া না লাগিয়ে বরং সেটা কে গলিয়ে পুনুরায় গ্লাস বানানো যায়।”

বোকা বনে যায় উষা। এমন ভাবে তো ভাবে নি কখনো। তবে এই মুহূর্তে সে যেতে চায়। কোনো কথা শুনতে চায় না। একদম ই না।

বিকেলে হিমছড়িতে এল ওরা। উষা এল না মাথা ব্যথার অজুহাতে। ওরা যখন জলপ্রপাতের পথে যাচ্ছে তখনি ব্যাঙের মতো লাফিয়ে এল রিদ। এক চিলতে হাসি ফুটল উন্মেষের অধরে।
“ভালো আছিস রিদ?”

“খুব ভালো। একদম ফুরফুরে।”

“ফোনে কথা বললি কাল রাতে,আর আজ ই চলে এলি!”

“মন যে মানছিল না ভাই।”

“বাসায় সবাই ঠিক ঠাক? আর রিয়াদের কি খবর?”

“বউ নিয়ে আসবে সামনের মাসেই। তোমার বন্ধু তো আবার বিদেশী বউ পেলেছে।”

হেসে উঠে উন্মেষ। আবৃত্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রিদ হচ্ছে উন্মেষের ফ্রেন্ড রিয়াদের ছোট ভাই। খুব চঞ্চল, কিছুটা দুষ্টু প্রকৃতির। এক সময় উন্মেষ পড়াত ওকে। কাল হঠাৎ ই ফোন করল। বলল উষার কথা। মেয়েটিকে খুব ছোট দেখেছে। ঐ তো ক্লাস ফোর ফাইভ। বিদেশ যাওয়াতে অনেক টাই যোগাযোগ ছিন্ন ছিল। উন্মেষ যখন উষার ঘটনাটা বলল তখন রিদ যেন খুশিই হলো। চট করেই বলে দিল নিজের মনে জমিয়ে রাখা অনুভূতির কথা। উন্মেষ বিশেষ কিছু বলে নি। তবে রিদের আগ্রহটা খুব বেশি। অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল উন্মেষ,”অনুভূতি থাকাটা ভালো। তবে এই অনুভূতিটা টেনে ধরে জীবন চলবে তো রিদ? আমার বোন কিন্তু ডিভোর্সী।”

“ভাই তুমি জানো আমি কেমন। আমার কাছে এসব ম্যাটার করে না।”

“নিষেধ করছি না। তবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু। উষার পড়াশোন না শেষ হওয়া অবধি ওকে বিয়ে দিব না।”

“আমার কোনো প্রবলেম নেই ভাই। আমি শুধু উষাকে জীবন্ত করতে চাই। ছোট ছোট অনুভূতির বীজ বপন করতে চাই।”

স্নিগ্ধ হয়ে এল উন্মেষের দু চোখ। ছেলেটা চট করে আবৃত্তি আর ওর ছবি তুলে দিল। সেই ফটোটা বের করে বলল, “ভাবি এটা আপনার গিফ্ট। কি করব বলেন ভাই তো আর দাওয়াত দিল না। তবে চাচা হওয়ার মিষ্টি টা চাই খুব দ্রুত।”

লজ্জায় পড়ল আবৃত্তি। ছেলেটা ওর সমবয়সীই হবে। তবে লাজ লজ্জা নেই একটু ও।

ঝরনার পানিতে হাল্কা ভিজে গেছে আবৃত্তির শাড়ি। ফুটে উঠেছে পেটের অংশটা। টুক করে চিমটি কেঁটে দিল উন্মেষ। রাগল আবৃত্তি। লাল করেছে নাক।
“কি হলো এটা?”

“যা হবার তাই হয়েছে।”

“জ্বলছে খুব।”

“ওয়েট।” কথা শেষ হতে না হতে পে টে সিক্ত ঠোঁট স্পর্শ করায় উন্মেষ। শীতল পানিতে এমনি তেই শিরশির অনুভূতি হচ্ছিল। এবার যেন সমস্ত অনুভূতি আবৃত্তিকে স্পর্শ করে গেল। আলগোছে নিজের দিকে জড়িয়ে নিল উন্মেষ।
“একটা জিনিস দেখবে?”

“কি?”

“চিঠি।”

“কিসের চিঠি?”

“আমার লেখা তোমার জন্য চিঠি। গত চার বছরে জমায়েত করা অব্যক্ত সব চিঠি।”

কথা শেষে বাক্সটা নিয়ে এল উন্মেষ। আবৃত্তি খুলতেই দু চোখ ডুবে এল জলে। উন্মেষ বলল “গুনো।”

গুনতে লাগে আবৃত্তি। মোট ১৪৬১ টা চিঠি। হেসে উঠল উন্মেষ। আবৃত্তি দেখে শেষ চিঠিটা কাল রাতের লেখা। মুগ্ধ নয়নে মেয়েটা কে অবলেকন করল উন্মেষ। ততক্ষণে আবৃত্তি ওর কাছে চলে এসেছে। চার বছর আগে যেমন নিজ থেকে উন্মেষ কে চুমু খেত ঠিক তেমনি ভাবে ছেলেটার পায়ের উপর পা রেখে উষ্ণ ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। অবাক হয় নি উন্মেষ। তবে ভালো লাগাটা ভীষণ ভাবে জেগে বসেছে।
“লজ্জা দিবে না প্লিজ।”

“দিব না। তাকাও একবার।”

আবৃত্তি তাকাল। উন্মেষ কেবল হাসল। তারপর বলল, “আজ থেকে তোমার জন্য সমস্ত চিঠি লেখা বন্ধ হলো। শেষ যেদিন চুমু দিয়েছিলে তারপরের দিন থেকেই এই চিঠি লেখা শুরু। সমস্ত ভালোবাসা মান অভিমান আজ ভেঙে গেছে। হাওয়ায় উড়িয়ে দাও আমার অভিমান। উড়ে যাক উড়ো চিঠি।”

তাই করল আবৃত্তি। সব গুলো চিঠি নিয়ে উড়িয়ে দিল হাওয়ায়। চিঠি গুলো ভাসতে লাগলো হাওয়াতে। আবৃত্তি দেখতে পায় সমস্ত অভিমান ভেঙে ডানা মেলে হাওয়ায় ভেসে যায় উড়ো চিঠি। তবে উন্মেষের চিঠি লেখা কি বন্ধ হবে আদৌ? বুকের ভেতর আরেকটি নারী খুব করে ডানা মেলে দিয়েছে। সেই নারীর জন্য অন্তত জীবন চিঠি লিখতে হবে। তবে সেই চিঠি কি কখনো লেখার নিকট পৌছাবে? এর কোনো উত্তর নেই। উন্মেষ হতাশ হয়ে শ্বাস ফেলল। আবৃত্তির জন্য বুকটা যেমন পু ড়ে তেমনি পু ড়ে লেখার জন্য। কি অদ্ভুত তার জীবন। দুনিয়া বলে একই সাথে একাধিক মানুষকে ভালোবাসা যায় না। অথচ উন্মেষ তার নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে এক জীবনে দুই নারীই তার হৃদয়ের দখল নিয়েছে। আসলেই ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় না।

ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে কলি। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে যেন। লেখা চা বসাল চুলোয়। এক চামচ চিনি দুই চামচ গুড়ো দুধ। তারপর এল মেয়েটির নিকট।
“কাঁদিস কেন?”

“আমি চাকরি ছাইড়া দিছি ভাবি মনি। আমি আর থাকতে পারতাছিলাম না ঐ বাড়ি তে। আমার দিলে খুব ব্যথা হয়। খুব যন্ত্রণা লাগে। আপনের লাইগা বুক পুড়ে।”

“পাগলি মেয়ে। ঠিক আছে আর বলব না যেতে। এখন কান্না থামা।”

“আপ্নে কেন এমন করলেন ভাবি মনি। কেন করলেন এমন। সুখের সংসারটা কেন ছাইড়া দিলেন। সবার থেকে কেন আলাদা হইলেন। সবাই জানে আপ্নে মৃ ত অথচ আপ্নে জিন্দা আছেন। কেন এমন করলেন।”

কলির এত কেন’র উত্তর আজ দিবে লেখা। তার আগে ওভেন থেকে কেকটা নামাল। ফ্রুট কেক। উন্মেষের ভীষণ প্রিয়। নিজ হাতে ডিজাইন করল লেখা। তারপর বলল, “দেখ তো কেমন হয়েছে। তোর ভাই জানের পছন্দ হবে না?”

বিস্মিত হলো কলি। লেখা নিজ হাতে ফ্রুট কেক বানিয়েছে সেটা নাকি যাবে উন্মেষের কাছে! উপরে আবার লিখেছে হ্যাপি ফোর্থ এনিভার্সারি। সব এলোমেলো হয়ে এল কলির নিকট। লেখা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। পা টা ভালো হয়েই গিয়েছিল তবে আট তলা থেকে দ্রুত নামার সময় আবার চোট লাগে। ডাক্তার বলেছেন এটা হয়ত আর ভালো হবে না। অবশ্য ভালো হলেই বা কি? বুকে থাকা ভারী নিশ্বাস গুলো বাষ্পের মতো বেরিয়ে এল। জীবন আর কদিন! ডেলিভারী ম্যানের হাতে কেকের পার্সেলটা দেওয়ার আগে লেখা সাবধান করল,”কেকের যেন কিছু না হয়।”

“হবে না ম্যাম। আপনি চিন্তাহীন থাকুন।”

কলি তখনো নিশ্চুপ। চা এগিয়ে দিল লেখা। চোখের জল মুছে কলি। “আপ্নে খান ভাবি মনি।”

“তোর জন্যেই বানিয়েছি। খেয়ে দেখ ভালো লাগবে।”

চা নিল কলি। লেখা বলতে শুরু করল, “উন্মেষের সাথে আমার বিয়েটা হলো পারিবারিক ভাবে। তবে এর আগের ঘটনা গুলো আমি জানতাম না। ওকে হঠাৎ করেই এক দেখাতেই অতিরিক্ত ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আর ভালোবাসাটা মারাত্মক হয়ে উঠে। একটা পর্যায় আমি পাগলের মতো হয়ে যাই কারণ উন্মেষ আর আমার বিয়েটা প্রায় ভেঙেই যাচ্ছিল। কারণটা অবশ্য তখনো অজানা। আবার হুট করেই সব ঠিক হয়ে গেল। ঝড় পেরিয়ে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরেরদিন ই চলে যায় উন্মেষ। কেন যায় সত্যিই আমি জানি না। তবে সাত দিন পর এসে আমায় স্ত্রীর মর্যাদা দেয়। বিশ্বাস কর কলি তখন আমি ওর চোখে ভীষণ ভালোবাসা দেখেছি। ছেলেটা নিঁখুত অভিনেতা। এভাবেই দিন যেতে থাকে। তুই তো জানিস আমার অসুস্থ হওয়ার কথাটা। আমি বার বার আল্লাহর কাছে চাইতাম অসুখটা মিথ্যে হয়ে যাক। আমি আবার ফিরে পেতে চাই উন্মেষকে। রোগটা আসার পর, ও যেন আমায় আরো বেশি আকড়ে ধরে। আমি তখন আরো ডুবে যাই। বাঁচতে চাই। আল্লাহ কিছুটা শুনেছিল আমার কথা। আমার রোগটা তখনো অতোটা গভীর ছিল না। তবে ভুলে গেলে চলবে না আমি ক্যান্সারের রোগী। কিছুটা সুস্থ হতে শুরু করেছিলাম। খুব বেশি খুশি ছিলাম। নতুন রিপোর্ট দেখানোর জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান ও করি। তবে সেদিন ই সামনে আসে সত্যটা। উন্মেষ তো বই খুব ভালোবাসে। তাই আমি কিছু বই কিনে এনেছিলাম। লাইব্রেরিতে রাখতে যেতেই দেখি অগোছালো হয়ে আছে বেশ কিছু বই। গোছাতে যেতেই চোখে পড়ে একটা ডায়ারি। সেটায় কিছু লিখা ছিল আবৃত্তি কে নিয়ে। আমি তো উন্মেষের লেখা চিনতে পারি চোখ বন্ধ করেও। আমার আগ্রহ জাগে। তখন ই খোঁজ পাই আরো কিছু চিঠির। সবটা পরিষ্কার হয়ে আসে আমার কাছে। আবৃত্তি আর উন্মেষ দীর্ঘদিন প্রেমে আবদ্ধ ছিল। আমার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছিল। উন্মেষের বিয়ের জন্যে ও বাসা থেকে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছিল। তো সেই ভাবেই আসে সমন্ধ টা।”
উত্তেজনা দমাতে না পেরে কলি বলল,
“ভাই জান কেন আপ্নেরে দেখতে গেল আবৃত্তি আপা মনির লগে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও।”

হাসল লেখা। বলল, “চা ঠন্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

চা কাপে চুমুক দিল কলি। লেখা ফের বলা শুরু করল। “উন্মেষ ভেবেছিল আবৃত্তিকেই দেখতে যাচ্ছে। কারণ ও জানত আবৃত্তি একা। তখনো জানত না মেয়েটা যে এতিম।সেহেতু একই বাড়ির ঠিকানা হওয়াতে উন্মেষ ভেবেছে চমকে দিবে আবৃত্তিকে। তাই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু ঘটনা ঘটে ভিন্ন। চমক দিতে গিয়ে নিজেই চমকে বসে। আমাকে দেখে ওর মাথা খোলসা হয়ে আসে। সেদিন দ্রুত ই চলে যায় ওরা। খোঁজ নেই এক সপ্তাহতেও। আমি উন্মেষকে মন দিয়ে বসি। খুব বেশি অনুভব করে ফেলি। কেন কিভাবে জানি না শুধু মনে হচ্ছিল ওকে ছাড়া বাঁচব না। সকলের সামনে কত পাগলামিও করেছি। ম র তে বসেছিলাম। এত অশান্তি শুরু করেছিলাম। বাবা,মা, আবৃত্তি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তখন আমি বুঝি নি। বার বার নিজেকে শেষ করার ইচ্ছে হচ্ছিল। এত বেশি পাগলাটে হয়ে যাই যে হসপিটালে এডমিট করাতে হয়। আর সেসব আবৃত্তিকে দহন দিতে থাকে। চেয়েও পারে নি নিজের ভালোবাসার কথা বলতে। ঐ যে নিজের মা বাবা নেই। জানিস তো এই পৃথিবীতে মা বাবা ছাড়া সত্যিই কেউ আপন নয়। আমরাও পারি নি আবৃত্তির নির্ভরতা হতে। ওর মাঝে বড়ো হয়েছে এক দায়বদ্ধতা। ও যদি এতিম না হতো তবে গল্পটা ভিন্ন হলেও হতে পারত। সব কিছু মিলিয়ে আমার জান বাঁচানোর জন্য আবৃত্তি উন্মেষকে ফোর্স করে বিয়ে করার জন্য। সত্যি বলতে মেয়েটা আমায় খুব ভালোবাসে। ছোট থেকেই ওকে আগলে রেখেছিলাম। সেই প্রতিদান দিতেই হয়ত নিজের ভালোবাসাটা লুকিয়ে এমনটা করেছিল। তবে ওদের জন্যে এটা খুব বেশি বেদনার ছিল। বিয়ের প্রথম সপ্তাহ মিথ্যে কাজের বাহানা দেয় উন্মেষ। মূলত বিয়েটা মেনে নিতে পারে নি তখনো। আবৃত্তি বলেছিল কখনোই উন্মেষকে বিয়ে করতে পারবে না। যদি আমায় বিয়ে না করে তবে নিজেকে শেষ করে দিবে হয়ত। কারণ ও চায় না আমার পরিবার ভাবে ওর জন্য আমার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে। এতিম প্রেমিকার দোহাই রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবনটাই এলোমেলো করে ফেলল ছেলেটা। আর আমি তখন সুখ নিয়ে খেলছিলাম। কি স্বার্থপর ভাবতে পারিস। উন্মেষ আর আমার সম্পর্কটা হয়ত কখনোই স্বাভাবিক হবার ছিল না। নিজের মনের ব্যর্থতা জানান দিতেই আবৃত্তি’র সাথে দেখা করে উন্মেষ। আবৃত্তি ওকে আবার ফোর্স করতে থাকে,আমাকে ভালোবাসার জন্য। আর শুরু হয় একাধিক নিষ্ঠুর প্রেমের কাহিনী। তারপর থেকে আবৃত্তি আর উন্মেষের কখনো কথা হয় নি। দুজন নিজেদের আলাদা করে ফেলে অথচ মনটা সেসব লজিক মানে। আমার আর উন্মেষের সমঝোতার সম্পর্কটা তবু ভালোই যাচ্ছিল।”

গলা ধরে আসে লেখার। একটু পানি খেয়ে নেয়। “বাধ্য পাখির মতো সব করল উন্মেষ। ওর জীবনে আবৃত্তির জায়গা ছিল সবার শীর্ষে। সেই জন্যেই সবটা চুপ করে মেনে নিতে থাকে। প্রেমিকার চোখের জল ওকে পু ড়াচ্ছিল কীনা। অন্যদিকে মা বাবা হারা আবৃত্তির সবটা জুড়ে তো আমরাই। তাই এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেদিন। জানিস তো আমার না এখন খুব লোভ জাগে। যার ভালোবাসার অভিনয়টাই এত সুন্দর,না জানি তার ভালোবাসাটা কতটা সুখকর।”

লেখার দু চোখে জল। চোখের জল মুছে ফের বলল,”ভাগ্য বড়ো অদ্ভুত। আমি কিছুতেই আমার জায়গাটা ছাড়তাম না। বিয়েটা হয়েছে এটা তো সত্য। ভালোবাসা না থাকুক, হোক সেটা অভিনয়। তবে সেসব তো আমি সত্য বলে ই জানতাম। তবে যেদিন জানলাম আমায় ভালোবাসে না উন্মেষ সেদিন থেকে আমার দুনিয়া আলাদা হতে শুরু করল। আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি রে। সব কিছুই বেরঙিন তখন। আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন আমি কতটা ভালোবাসি ওকে। এত কিছুর পরও আমি আমার জায়গাটা ছাড়তাম না। তাছাড়া আমি তো মা ও হতে পারব না কোনোদিন। রোগটা কতটা ঠিক হবে এটাও জানি না। আর সব সময় আমিই কেন ঋণী হয়ে থাকব আবৃত্তির কাছে? আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ ঠিক। তবে যথা সম্ভব আমি ফিরিয়ে দিলাম। মিথ্যে অপারেশনের নাটক আর আ গু ন লাগিয়ে নিজেকে মৃত বানালাম সবার নিকট। এমনিতেও কিছু দিন পর আমি ম রে গেলে ওদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে থাকত। ওরা কখনোই এক হতো না। আমার জন্য দুজন ব্যক্তি কেন কষ্ট পাবে বল তো। সত্যি বলতে আমার ভুল অনুভূতি আর আবৃত্তির সেক্রিফাইজে সকলের জীবনটাই বদলে গেল। সেদিন যদি উন্মেষের জন্য পাগল না হতাম তবে গল্পের শেষটা এত দুঃখের হতো না। আবৃত্তি নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে আমার সুখ কিনেছিল। আর উন্মেষ নিজের ভালোবাসাকে খু**ন করে আমায় ভালোবাসার চেষ্টা করেছে। অথচ সফল ছিল না সে। ভালোবাসার চেষ্টা করেও পারে নি ভালোবাসতে। আর সব যখন বিপরীত হয়েও ঠিক ঠাক ভাবে চলছিল তখন এই রোগটা এসে সব করে দিল এলোমেলো। ঠুনকো হয়ে রইল আমার ভালোবাসা। জীবনের কাছে হেরে গেলাম আমি।”

কথা শেষ করে লেখা দেখল অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কলি। ঠোঁটের কোণ বেয়ে নেমে যাচ্ছে তরল। দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল লেখার চোখ থেকে। কলির চোখ দুটো বুজে এসেছে। মেয়েটিকে চায়ের সাথে বিশেষ এক ধরণের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে সে হারিয়ে ফেলবে পুরনো স্মৃতি। কলির পাশে পড়ে রইল রেকর্ডার। লেখা দু হাতে সেটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,”আমায় মাফ করিস কলি। তোর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখলে তুই সবটা উন্মেষ কে বলে দিতি। আর উন্মেষ দ্বিধায় ভুগত। শান্তি পেত না ওরা। ওদের সম্পর্কটা পুনরায় ভেঙে যেত। তুই বড্ড বেশি ভালোবাসিস আমায়। আমি ও বাসি বোন। তবে ভালোবাসা মানেই এক একটা উৎসর্গ। আমায় ভালোবেসে তোর অতীতের সব স্মৃতি উৎসর্গ করতে হলো। বড্ড নিষ্ঠুর আমি। সবাই ভালোবাসার কাঙাল। আমি চাই আমার ভালোবাসার মানুষ টি ও ভালো থাকুক ভালোবাসায়। অথচ আমার গল্পে সবার চোখে নিজের অজান্তেই ভিলেন হয়ে রইল ওরা দুজন। আজ থেকে আমার চিঠি লেখা শুরু। যে চিঠি কখনো হাওয়ায় ভেসে পৌছাবে না আমার ভালোবাসার কাছে। যে চিঠি পড়ে থাকবে শূন্য বুকে অব্যক্ত অক্ষরে।”

কলিং বেজে উঠল। আবৃত্তি সবে গোসল করেছে। উন্মেষ ওকে জড়িয়ে ছিল। দু একটা দুষ্টুমি করছিল। ঠিক এমন সময় পার্সেলটা দিতে এল ডেলিভারী ম্যান। কাল ই কেকটা অর্ডার করেছিল উন্মেষ। লেখার প্রতি ওর একটা ভালো লাগা জন্মেছিল। আলাদা মায়া কাজ করে এখনো। দীর্ঘ দিনের বিবাহিত জীবনের সবটা তো অভিনয় নয়। কিছু হলেও সত্য। আর এই সত্য হলো ভালোবাসা। এক সাথে থাকতে থাকতে লেখাকে অজান্তেই ভালোবেসেছে উন্মেষ। অথচ লেখা জানতেই পারল না। সেই মায়া,ভালোবাসা ধরেই চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন। আবৃত্তি আর উন্মেষ এক সাথে কেকটা কাটল। দুজনের বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। ব্যলকনিতে এসে দাড়াল। বাস্তবতায় উন্মেষ আর আবৃত্তিদের মিলনে লেখারা হারিয়ে যায়। তবে ওদের গল্পটা ভিন্ন। ওদের গল্পে লেখা হারিয়ে যায় নি আর না কখনো যাবে। প্রতিটা স্পন্দনে লেখা থাকবে এক দীর্ঘশ্বাসময় ভালোবাসা হয়ে। যার কোনো ব্যাখা নেই। কারণ লেখা এমনই একজন যাকে চাইলেও ভোলা যায় না। আজকের আকাশের চাঁদ যেন একটু বেশিই সুন্দর। রূপালি রঙা থালার মতো বিশাল চাঁদ যেন বলছে ভালোবাসায় সিক্ত হোক আরেকটা প্রহর।

পরিশিষ্ট : লেখা কে দাফন করে এল ডাক্তার জোহান। তিনটে বছর ধরে চলল মেয়েটির চিকিৎসা। লেখা একদম ই হাল ছেড়ে দিয়েছিল। মানসিক শক্তির একটা ঘাটতি ছিল। জোহান ছিল লেখার বন্ধু। হসপিটালের মিথ্যে অভিনয় করতে সাহায্য করেছিল জোহান ই। খুব আশা ছিল মেয়েটিকে বাঁচাতে পারবে। তবে যে নিজেই বাঁচতে চায় না তাকে কে বাঁচাতে পারে? আবৃত্তি আর উন্মেষের ফুটফুটে সন্তান হয়েছে আজ। ফুটফুটে এক মেয়ে বাবু। লেখাকে স্মরণে মেয়েটির নাম লেখার নামের সাথে মিল রেখেই রাখা হয়েছে। রিদ এখনো চেষ্টা করছে উষাকে ভাঙা থেকে পুনরায় নতুন করে তৈরি করার। সবটাই এখন পরিপূর্ণ। সে কথা ভেবেই এক দলা হাহাকার এসে চেপে ধরল জোহানকে। ছেলেটার কাছে জমা হয়েছে অনেক চিঠি। লেখার নিজ হাতে লেখা সব গুলো। এক একটা চিঠি এক একটা চরিত্রের জন্যে ব্যক্ত করা। হিমছড়ির পাহাড়ে এল জোহান। বাক্স ভরা চিঠি গুলো একটা একটা করে উড়াতে লাগল। লেখার ভুলে ভরা জীবনের সমস্ত পূর্ণতা অপূর্ণতার দলিল হয়ে হাওয়ায় ভাসতে লাগল চিঠি গুলো।

~সমাপ্ত~
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here