হাওয়ায় ভাসা উড়ো চিঠি পর্ব -০৪

#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (৪)

বিকেলে ছাঁদে বসে কাজ করেছে উন্মেষ। বেখেয়ালে ব্লুটুথটা হয়ত ফেলে এসেছে। সেটা নিতেই এসেছিল। বৃষ্টির ফোঁটা বড়ো হতেই ফিরে যাচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে আবৃত্তিকে দেখতে পেল হঠাৎ। শাড়ি ভিজে একাকার। পাতলা শাড়ি হওয়াতে দৃশ্যমান শরীর। চুল গুলো খোঁপা করা থাকাতে স্পষ্ট পিঠের ঢেউ। কোমরে লাগানো চেইনটা ও চিক চিক করছে। উন্মেষ খেপে গেল হঠাৎ। মেয়েটি বার বার ওর জীবনে ঝড় তুলে। ভরা বৃষ্টিতে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে আছে। জ্বর হলে সেবা করবে কে? এসব তো ওর ঘাড়ে এসেই পড়বে।

অতিরিক্ত ঘোরে চলে গিয়েছিল আবৃত্তি। তাই হয়ত উন্মেষের কণ্ঠ শুনতে পায় নি। ছেলেটি যখন বাহুতে স্পর্শ করল তখনি সমস্ত ঘোর কেটে গেল। বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার সে। কপালে কিছু চুল লেপ্টে আছে। খোঁপা আলগা হয়ে আছে। সামনের চুল বেয়ে পানি গুলো কপাল থেকে নাকে ঠোঁটে লাগছে। মৃদু স্বরে বলল উন্মেষ,”হুট করেই বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক না। এমনিতেই সমস্যায় আছি।আর সমস্যা করো না। ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিও। দ্রুত আসো।”

বিয়ের পর এই প্রথম ওর সাথে কথা বলল উন্মেষ। কেমন করে উঠল বুক। ধক করে উঠল পুরো শরীর। বৃষ্টির জলের সাথে নোনা জল পড়ল কয়েক ফোঁটা। হেলদোল না দেখে বিরক্ত হলো উন্মেষ।
“দ্রুত আসো, বিপদে ফেলে দিও না যেন আবার।”

বিয়ের আগের দিন ই নিজের ঘর ব‍দল করেছে লেখা। উন্মেষের ঘরটা এখন আবৃত্তির। তবে ভুলেও সে ঘরে প্রবেশ করছে না উন্মেষ। বার বার ওর কাছেই চলে আসে। লেখা বিস্মিত চোখে তাকানো। বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়ল পাশে। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে মেয়েটি, “তুমি এখানে কেন?”

“তাহলে কোথায় থাকব?”

“না মানে তোমার তো ঐ ঘরে থাকার কথা। তুমি কেন এমন করছ বলো তো।”

“শুয়ে পড়ো।”

“উঠো তুমি। আবৃত্তি নিশ্চয়ই খারাপ ভাবে নিবে। তাছাড়া তোমাদের সম্পর্কটা সহজ হওয়া প্রয়োজন।”

“খারাপ ভাবে নিবে না। তুমি বেশি ভাবো সব সময়। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

“উঠবে তুমি। নাকি টেনে তুলব?”

“বিরক্ত কেন করছ বলো তো? এক কথা কত বার বলতে হয়। তুমি কেন ঘর বদল করলে?”

“কারণ এখন থেকে ঐটা আবৃত্তির ঘর।”

“পাগল করে দিবে আমায়।” বালিশ নিয়ে ব্যলকনিতে এল উন্মেষ। মেঝেতে রেখে শুয়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ। লেখা কিয়ৎক্ষণ ঋজু ভঙ্গিতে বসে থেকে ক্র্যাচে ভর করে আগাতে লাগল। ক্র্যাচের শব্দ কানে এলে ও শব্দ করল না উন্মেষ। নিশব্দে শুয়ে রইল সে। লেখা নিচু হয়ে বসল পাশে। চুলে হাত গলিয়ে দিল। স্পর্শ পেয়ে আরেকটু আদুরে হয়ে পড়ে ছেলেটা। লেখার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটের মধ্য নাক ঘষে। “কি হলো তোমার?”

“উহু। কিছু হয় নি। তুমি শুধু আমার থেকে পালাতে চাও।”

“আমি পালাতে চাই না। ভাগ্য আমায় পালাতে বাধ্য করছে। আর তার থেকে বড়ো কথা আমি আমার বোনকে নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। জানি বিষয়টা লোকজন খুব ই খারাপ ভাবে নিয়েছে তবে আমি আমার ভালোটা দেখব এটাই স্বাভাবিক।”

“কোন ভালোটা হয়েছে এতে?”

“নিশ্চিন্তে ম র তে পারব আমি। কারণ আমি জানি আবৃত্তি তোমায় সবটা দিয়ে সুখে রাখবে। আর তোমার পাশে অন্য কোনো মেয়েকে যে আমার সহ্য হবে না।”

চুপ করে রইল উন্মেষ। লেখাই আবার বলা শুরু করল, “উন্মেষ। আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসা দিয়েছ তুমি। কখনো চোখের পানি পড়তে দাও নি। সেবার যখন জ্বর হলো সারা রাত পাশে বসে রইলে। পেট ব্যথা হলেই কেমন বিষন্ন দেখাত তোমায়। জানো বিয়ের পরের দিন ই যখন কাজের জন্য দেশের বাইরে যেতে হলো তোমায়,সেদিন আমি খুব কেঁদেছি। পুরো এক সপ্তাহ পর এলে। এর মাঝে কখনো ফোন ও দাও নি। রাগ অভিমান সব যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ফিরে এসে এত ভালোবাসা দিলে যে সেই দিন গুলোর জন্য বড়ো আপসোস হয় আমার। আমি কখনোই হারাতে চাই নি তোমায়। তবে অবিনশ্বর আমায় সুযোগ দিলেন না। বড় ভালোবাসি যে। আর ভালোবাসার মানুষকে বেশি কাছে পেতে নেই।”

“কিচ্ছু হবে না লেখা। কান্না করিও না প্লিজ।”

লেখাকে বুকে জড়িয়ে ধরল উন্মেষ। ধীরে ধীরে চুমু খেতে লাগল পুরো মুখ জুড়ে। খুশি তে ম রে যেতে ইচ্ছে করছে লেখার। মানুষটা এত কেন ভালোবাসে ওকে?

সেদিনের পর কেঁটে গেছে একটা সপ্তাহ। এক সপ্তাহে বদল ঘটে নি কোনো কিছুর ই। আবৃত্তি ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টায়। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। অকস্মাৎ উষা এসে বলল,”আমি ও যাব ছোট ভাবি।” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল আবৃত্তি। উষার কণ্ঠে স্মিত হাসল সে। “আমার তো প্রবলেম নেই উষা। তবে তোমায় কি যেতে দিবেন আন্টি?”

“কেন যেতে দিবে না? মা নিজ থেকেই বলেছে তোমার সাথে যেতে।”

“আন্টি নিজে বলেছে?” অনেকটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করল আবৃত্তি। উষা মিষ্টির বাটিটা রেখে বলল, “হ্যাঁ মা যেতে বলেছে। আর মিষ্টি পাঠাল তোমার জন্য। তুমি নাকি ল্যাংচা খেতে খুব ভালোবাসো। ”

“হুম। তুমি সত্যি বললে উষা? আন্টি পাঠাল আমার জন্য?”

“মিথ্যে কেন বলব? তাছাড়া মা তো তোমায় ভালোবাসে। শুধু ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়েটা….।”

থেমে গেল উষা। কথা ঘুরিয়ে বলল, “এখন বলো তো আমায় নিবে নাকি। তাহলে আমি তৈরি হব।”

“না নেওয়ার কি আছে। আমি তো ক্লাস করব না কোনো। কিছু কাগজ পত্রের জন্য যাচ্ছি।”

“তাহলে আমি তৈরি হই গিয়ে। আচ্ছা বলো তো কি রঙের কামিজে মানাবে আমায়। গোলাপী নাকি বেগুনী?”

“যেটা পরবে সেটাতেই সুন্দর লাগবে তোমায়। তুমি কি কম সুন্দর নাকি?” বলে ইষৎ হাসল আবৃত্তি। উষা ব্যগ্র হয়ে বলল, “এটা কোনো কথা হলো নাকি।”

“আমি সত্যি বলছি। তুমি তো খুব সুন্দরী। যে কোনো রঙ খুব মানায় তোমায়।”

খুশি হয়ে গেল উষা। সাথে মুখের লজ্জাটা ও ফুটে উঠেছে। সত্যি বলতে মেয়েরা প্রশংসা পেতে ভালোবাসে। এদের একটু প্রশংসা করলেই গলে জল হয়ে যায়। উষার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবৃত্তি। মিষ্টির বাটিটার দিকে তাকাতেই বুকটা কেমন মোচড় দিতে শুরু করেছে। সত্যিই কি তাঁর জন্য মিষ্টি পাঠানো হয়েছে?

আবৃত্তির সাথে কয়েক ঘন্টায় বেশ মিশে গেল উষা। এই মুহূর্তে আবৃত্তিকে ভীষণ আপন মনে হলো ওর। প্রথম দিকে বেশ মন খারাপ হলেও আজ মনে মনে কেন যেন খুশি হলো। মানুষ বোধহয় এমনি হয়। সময়ের সাথে তাল মেলাতে, মানিয়ে নিতে পছন্দ করে। রিক্সা করে ঘুরল ওরা। উষা পরিবারের ছোট মেয়ে। তাই কখনো বাবা মা কিংবা পরিজন মিলে ঘুরাঘুরি হয় নি। আবৃত্তির সান্নিধ্য সেই জন্যেই বোধহয় ওকে আনন্দ দিচ্ছে। হৈ হুল্লোড় হওয়া শহরটা কে ভীষণ ভালো লাগতে শুরু হলো ওর। রিক্সার হুড তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,”ছোট ভাবি একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“তুমি কিছু মনে করবে না তো।”

“মনে করব কেন? তুমি নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”

“আমি জানি এই প্রশ্ন করা ঠিক না তবু জানতে ইচ্ছে করছে। যতটা জানি ভাবি তোমার আপন বোন নয়। মানে তোমরা একই মায়ের অংশ নও।”

“সত্য এটা। আপু আমার খালামনির মেয়ে। মানে হচ্ছে আমরা খালাতো বোন।”

“সেটা জানি। তাহলে তুমি কি ছোট থেকেই এখানে থাকতে?”

“ঠিক তা নয়। ঘটনাটা ঘটেছে দশ বছর আগে। আমি তখন নাইনে উঠেছি সবে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল শহরে পড়ার। আর পড়াশোনাতে ও বেশ ভালো। বাবা মা দুজনেই একই অফিসে সরকারি জব করতেন। সেই জন্য স্থান বদল তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমাকে খালামনির কাছে রাখা হলো। মাস দুয়েক পর ই খবর এল বাবা মা মা রা গেছেন। রোড ক্রস করতে গিয়ে দুজনেই চাপা পড়েছেন ট্রাক এর নিচে। হসপিটালে নেওয়ার সুযোগ হয় নি। স্পটেই শেষ।”

কতটা শান্ত ভাবে কথা গুলো বলল আবৃত্তি। উষার শরীরের লোম জেগে উঠেছে। চোখ দুটো থৈ থৈ। ইষৎ শব্দ করে হাসে আবৃত্তি।
“প্রথম প্রথম এসব কথা বলতে গেলে আমার গলা ধরে আসত। খুব খারাপ লাগত। তবে এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। বাবা মা মা রা যাওয়ার পর আমার জীবন নিশ্চিত হয়ে গেল খালামনির বাসায়। খুব ভালোবাসত আমায়। ছোট থেকেই মামুনি বলে ডাকতাম। আর আঙ্কেলকে বাবা বলে সম্মোধন শুরু হলো। সব মিলিয়ে লাইফ ইজ হিজিবিজি।”

পুনরায় শব্দ করে হাসল আবৃত্তি। উষার মন খারাপ হলো। ক্ষণিক আগেই যার সঙ্গ ওকে আনন্দ দিচ্ছিল এখন সেই সঙ্গ ওর ভালো লাগছে না। উষার মনের অবস্থা বুঝতে পারল আবৃত্তি। তাই বলল, “ভয় পাচ্ছ তুমি? আমি বুঝতে পারছি এসব বিষয়ে তুমি খুব ই ইমোশনালফুল। তবে জানো তো প্রতিটা গল্পের পেছনেই আরো কিছু গল্প থাকে। সময়ের স্রোতে সেসব হারিয়ে যায়। তাই এখন আর কষ্ট হয় না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে বাবা মা কে খুব একটা মনে ও পড়ে না। মানিয়ে নিতে শিখে গেছি। এই দেখো কথা বলতে বলতে এসে ও গেছি আমরা।”

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

**আমি গল্পটার কিছু মিনিং নিশ্চয়ই রেখেছি। যেমনটা দেখা যাচ্ছে আসলেই তেমন নয় কাহিনী। সমালোচনা করার হলে গল্প শেষ হলে করার অনুরোধ।**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here