হৃদমাঝারে পর্ব -১৯

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(১৯)

নতুন সকাল নতুনত্ব নিয়ে আসে। সকালের রোদের আলো চোখে মুখে পড়তেই ঘুম হালকা হয়ে যায় শুভ্রতার। উঠে বসতে গেলেই কাঁধের একপাশ ব্যাথায় টনটন করে উঠে। উঠতে গিয়েও আবার শুয়ে পড়লো। পাশেই মেঘ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শুভ্রতা হাত দিয়ে মেঘের কপালে হাত দিলো,জ্বর চেক করার জন্য। নাহ জ্বর অনেকটা নেমে গেছে। শরীর স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। শুভ্রতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। উঠে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো। মেঘের জন্য নাস্তা বানানো প্রয়োজন। ওয়াশরুমে থাকার মাঝেই কলিংবেলের আওয়াজ এলো। শুভ্রতা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। মেঘের দিকে এক পলক তাকালো,না ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে নি। শুভ্রতা নিঃশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই মেঘের মা’কে চোখে পড়ে। শুভ্রতা অবাক হলো না,কারণ কালকেই সে সব জানিয়ে দিয়েছে। শুভ্রতা সালাম দিয়ে বলে,,’মা ভেতরে আসুন!’
‘আপা আসুন।’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরো কে এসেছে নাকি? শুভ্রতা উঁকি দিয়ে দেখে। কিন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দেখে চমকালো। কারণ,পাশেই তার মা দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত চোখে তাকালো।
‘ভেতরে আসুন।’ বলে সে সাইড দিলো। দু’জনেই রুমে প্রবেশ করে।
‘বউ’মা মেঘ কই? কেমন আছে? কিভাবে হলো এসব?’
‘হ্যাঁ রে। এখন কি অবস্থা ছেলেটার।’ শুভ্রতা দু’জনের দিকে একপলক চেয়ে বলে,,’উনি ঘুমাচ্ছেন এখন। রাতের জ্বর এসেছিলো। এখন ছেড়ে গিয়েছে। আপনারা জার্নি করে এসেছে, ফ্রেশ হন। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি!’
‘হ্যাঁ ঠিক বলেছ। নোংরা কাপড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আপা আসুন!’ কথাটা বলে মেঘের মা শুভ্রতার মাকে নিয়ে পাশের রুমে যায়। শুভ্রতা নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়। নিজের মায়ের চোখে আজ তীব্র অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে। মা যেনো তার সাথে চোখ মেলাতেই পারছে না। শুভ্রতা নিঃশব্দে আবারও রুমের দিকে যায়। ফ্রেশ হওয়া দরকার।

‘শুভ্রা!’ মায়ের ডাকে শুভ্রতা একবার তার দিকে তাকিয়ে চায়ে দুধ দিতে দিতে বলে,,’হ্যাঁ বসো তুমি। নাস্তা দিচ্ছি।’
‘আমি এখানে খেতে আসি নি।’
‘আচ্ছা। উনাকে দেখেছো? বাসার সবাই ভালো আছে?’
‘তুই খবর নিস? না দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিস?’
‘কি যে বলো। যার থেকে মুক্তি চেয়েছো আবার তার থেকে খবর আশা করছ? ব্যাপারটা হাস্যকর লাগছে না?’
‘শুভ্রা আ..’ আর কিছু বলার আগেই মেঘের মা সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,,’কি মা মেয়ের গল্প হচ্ছে?’
‘ওই আরকি। আপা আসুন আমরা বসি।’ শুভ্রতার মা উনাকে নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে যায়। শুভ্রতা সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

‘কিরে বাবা কেমন আছিস? শরীর কেমন?’ মাত্রই ঘুম থেকে উঠে হয়তো নিজের মা,শাশুড়িকে আশা করে নি মেঘ। তাই শুভ্রতার দিকে তাকালে শুভ্রতা ইশারায় চোখে আস্বস্ত করে। শুভ্রতা মেঘকে ধরে হেলান দিয়ে বসায়।
‘মা চিন্তা করো না,আমি ঠিক আছি। তুমি একা আসতে গেলে কেনো?’
‘একা কই আমি আর আপা একসাথে এসেছি।’

‘মা আপনিও বা এতো কষ্ট করে এসেছেন। আমি তো ঠিক আছি।’
‘আচ্ছা বাবা তুমি এতো কথা বলো না। রেস্ট নাও। আমরা তো আছি। আর ছেলের অসুস্থতায় মা না এসে থাকতে পারে?’
‘আপনারা খেয়েছে? নাস্তা দিয়েছো ওদের? (মেঘ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে।)
‘হ্যাঁ আমার নাস্তা হয়ে গেছে। এক্ষুণি দেবো।’
‘আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা খেয়ে নিচ্ছি।’
‘হ্যাঁ আসুন।’ কথাটা বলে শুভ্রতা ওদের নিয়ে নাস্তার টেবিলে যায়।

‘আপনার তো ফ্রেশ হওয়া দরকার। একটু অপেক্ষা করুন।’ কথাটা বলে শুভ্রতা এক বালতি পানি,ব্রাশ,পেস্ট নিয়ে আসে। তারপর মেঘকে ফ্রেশ করিয়ে দেয়।
‘ওয়াশরুমে যাওয়া লাগবে।’ মেঘ মিনমিনিয়ে কথাটা বলে। মেঘের বলার স্টাইল দেখে শুভ্রতা ফিক করে হেসে দেয়।
‘এভাবে বলছে কেনো? আমি হেল্প করলে যেতে পারবেন?’
মেঘ মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়,শুভ্রতা সাবধানে নিজের উপর ভর দিয়ে মেঘকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। তারপর আবার বের করে এনে খাটে বসিয়ে দেয়।
‘বউমা আমি মেঘকে খাইয়ে দি?’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতা মুচকি হেসে বলে,,’এভাবে বলছেন কেনো মা? খাইয়ে দিন। নিন (খাবারের প্লেটটা হাতে দিয়ে) খাইয়ে দিন।’ মেঘের মা শুভ্রতার হাত থেকে প্লেট টা নিয়ে যত্ম সহকারে ছেলেকে খাওয়াতে লাগে। মেঘও এতোদিন পরে নিজের মায়ের হাতে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।
‘ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তুমিও তো নিশ্চয়ই খাও নি। এসো একসাথে খাইয়ে দেই।’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকায়। মেঘও ইশারায় আসতে বললে,শুভ্রতা মেঘের পাশে বসে। মেঘের মা দু’জনকেই খাইয়ে দেয়।

‘শু..’ শুভ্রতার মা কিছু বলতে বলতে রুমে ডুকছিলো। কানে মোবাইল,হয়তো কারো সাথে কথা বলছে। উনার উপস্থিতিতে রুমের সবাই উনার দিকে তাকায়।
‘আপা আসেন না, আসলে মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছি তাই শুভ্রাকেও খাইয়ে দিচ্ছি। আপনার মেয়ের উপর কিন্ত আমারও ভাগ আছে। হিংসে করবেন না!’ মেঘের মায়ের কথায় শুভ্রতার মা কিঞ্চিৎ হাসলো শুধু কিছু বললো না। শুভ্রতা নিজের মায়ের দিকে তাকালো। চোখটা কেমন ছলছল করছে। হয়তো এতোদিন মেয়েকে অবহেলা করার জন্য খারাপ লাগছে। শেষ কবে মেয়েকে ভালোবেসে খাইয়ে দিয়েছে সেটাও মনে নেই। শুভ্রতা আর ভাবতে চাইলো না। তার মা যখন তার কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছে সে মুক্তিই দিবে, সারাজীবনে মাকে কিছুই দিতে পারে না,কষ্ট ছাড়া তাই সে তার মাকে মুক্তিই দেবে।
__________________
মেঘের পাশেই একধ্যানে কিছু ভেবে চলেছে শুভ্রতা। আজ মেঘ আর শুভ্রতার মা দুজন মিলে রান্না করবে বলে ঠিক করেছে। শুভ্রতা এতোক্ষণ ওখানে বসে ছিলো। একটু আগে উঠে মেঘের কাছে এসেছে।
‘কিছু ভাবছো শুভ্র?’ মেঘের কথায় ঘাড় কাত করে মেঘের দিকে তাকায় শুভ্রতা। মেঘ উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা মাথা নাড়িয়ে ‘কিছু না বুঝায়!’
‘আমি বলেছিলাম না,তুমি হা করলে আমি সব বুঝে ফেলি।’
‘এই জন্যই আমি এখন হা করি নি!’ শুভ্রতা ভেংচি কেটে বলে। শুভ্রতার উত্তরে মেঘ হাওয়া ছাড়া বেলুনের মতো চুপসে যায়। বেশ অহংকার করে বলেছিলো এখন শুভ্রতা ঠুস করে পাটিয়ে দিলো।
‘আচ্ছা হইছে। এবার বলো কি হয়েছে?’
‘এখনও খবর পাই নি,হবে কি করে? হলে আপনি দেখতেন নাহ?’
‘আমি ওই হওয়ার কথা বলি নি ইডিয়েট,আমি তোমার মুড অফের কারণ জানতে চাইছি।’
‘আমি ঠিকই আছি। আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে? সেটা বলুন আমায়।’
‘নাহ আমি ঠিকই আছি।’
‘আচ্ছা। আপনি তাহলে রেস্ট করুন আমি আসছি।’
কথাটা বলে শুভ্রতা আর কাল বিলম্ব না করে উঠে চলে যায়। শুভ্রতার হঠ্যাৎ উঠে যাওয়ায় মেঘ কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রয়।
______________
‘রুহিপু। সেদিনের অসমাপ্ত কথাটা আজ পূরণ কর।’
‘আহ শুভ্র। তুই আগে বল মেঘ ভাই কেমন আছে?’
‘আছ ভালো। এবার তুই আমাকে বল সবটা।’
‘আচ্ছা।’ শুভ্রতা একটু আগে রুহিকে ফোন দেয়, ওইদিনের কথাগুলো জানার জন্য।

‘আসলে শুভ্রা মেঘ তোকে প্রায় ছয়বছর আগে থেকেই চিনে।’ রুহির কথায় শুভ্রতা চমকে উঠে।
‘কি বলছিস কি?’
‘আগে পুরো কথাগুলো শুন,তারপর চমকাবি।’
‘আচ্ছা বল।’

‘মেঘ ভাইয়ের বাবা আর তোর বাবা পূর্ব পরিচিত ছিলো। একদিন মেঘ ভাইয়ের বাবাকে কোনো একটা বিপদ থেকে চাচ্চু বাঁচায়,আমি যতদূর জানি জমি সংক্রান্ত কিছু। তো ওখানের কোনো একটা দলিল দেওয়ার জন্য মেঘ ভাই প্রথম আমাদের বাসায় আসে। সেখানেই মেঘ ভাই প্রথম তোকে দেখে। তুই তখন হয়তো সেভেন/এইটের ছাত্রী। মেঘ ভাই কলেজের স্টুডেন্ট। তোর ওই খরগোশের কথা মনে আছে,যেটা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়? ওই খরগোশের বাচ্চার সাথে তুই ছিলি। মেঘ ভাইয়ের ওখানে তোকে দেখে ভালো লেগে যায়। মেঘ ভাই তখন ঢাকায় পড়াশুনো করতো। নিছক ভালো লাগা ভেবে সে আর পাত্তা দেয় না। কিন্ত সেটা গাড়ো ভাবে ভালোবাসায় রুপ নেয় যখন সে তোকে আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে গ্রামের মেলায় দেখে।
ভার্সিটি বন্ধ থাকায় গ্রামে এসেছিলো মেঘ ভাই। আমি,তুই,আরো কিছু বন্ধু মিলে মেলায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। মেঘ ভাই সেখানে তোকে আবার দেখেছিলো। পুরনো ভালো লাগা কাজ করা শুরু করে। দিন গড়াতে গড়াতে সেটা ভালোবাসায় রুপান্তর হয়ে যায়। মেঘ ভাইয়ের সাথে আমার ফেইসবুকে আলাপ হয়। সেখানে থ
ভাইয়া আমার থেকে তোর ব্যাপারে টুকটাক ইনফরমেশন নেয়। আমিও তাকে দেই। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম মেঘ ভাই সত্যি তোকে ভালোবাসে। কিন্ত এর মাঝেই তুই স্বপ্নের সাথে একটা রিলেশনে জড়িয়ে পড়িস। মেঘ ভাই তা জানতে পেরে প্রচন্ড কষ্ট পায়। উনি সিদ্ধান্ত নেন, তোর জীবন থেকে সরে যাবে। কিন্ত সে তো কোনোদিন তোর জীবনে ছিলোই না। এরপর যখন স্বপ্নের সাথে তোর রিলেশনের এই ঘটনা ঘটে,আমি মেঘ ভাইকে জানাই। সব জেনে উনি প্রস্তাব পাঠান চাচ্চুর কাছে। এরপরের টা তো তুই জানিসই। মনে আছে তোর গায়ে হলুদের দিন তোকে শাড়ি পড়িয়ে আবার খুলে ফেলেছিলাম। মেঘ ভাইকে আমি ছবি পাঠানোফ জন্যই পড়িয়েছিলাম। আমি প্রথম থেকে সবটা জানতাম। আমি চেয়েছিলাম তুই সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে নিস,তাই এতোকিছু।’

চলবে…?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ।?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here