#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_২৮
#মোহনা_হক
মাঝরাতে তীব্র জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে রুয়াতের। প্রায় এক ঘন্টার মতো বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। আর তার ফলে এখন জ্বর এসেছে। পাশেই আয়াজ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। সে একদম পুরো ফিট। কোনো মতে রুয়াত উঠে বসে শোয়া থেকে। মাথা ব্যাথা করছে ভীষণ। আর জ্বর ও কমছে না। আয়াজ রুয়াতের থেকে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে শুয়েছে আজ। অপাশে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে লোকটা। হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যাবে। রুয়াত আয়াজের দিকে হাত বাড়ায়। জ্বর আসার কারণে শরীর দূর্বল হয়ে গিয়েছে। কথা বলতে গিয়েও যেনো থেমে যাচ্ছে বারবার। বহু কষ্টে আয়াজ কে বললো-‘
-‘শুনছেন?
অপর পাশের মানুষটার থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে তার মতোই ঘুমাচ্ছে। কোনো হেলদোল নেই। রুয়াত আয়াজের হাত ধরে নাড়াচাড়া করে। কারো হাতের তীব্র গরম ছোঁয়া পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে আয়াজ। রুয়াতের হাত ধরে। অনেক গরম। কপাল ও গালের দু’পাশ চেক করে।
-‘জ্বর এসেছে তো তোমার। আমি মানা করেছি বৃষ্টিতে ভিজতে না। তাও ভিজেছো। এখন যে জ্বর এসেছে। আচ্ছা তুমি বসো। আমি মেডিসিন নিয়ে আসছি।’
আয়াজ মেডিসিন নেওয়ার জন্য উদ্যত হলো তখনই রুয়াত তার হাত ধরে। আয়াজ ভ্রু কুচকে তাকায় সেদিকটায়।
-‘মেডিসিন পরে। আমায় একটু ওয়াশরুমে নিয়ে চলুন। মাথায় পানি দিবো। শরীর দূর্বল হয়ে গিয়েছে যার জন্য যেতে পারছি না একা।’
আয়াজের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়ায় রুয়াত। আয়াজ নিজ দায়িত্বে রুয়াতের মাথায় পানি দিয়ে দেয়। একে তো শরীরে এমন জ্বর তারউপর ঠান্ডা পানি। বারংবার কেঁপে ওঠছে রুয়াত। রুয়াত কে রুমে এনে আয়াজ তার প্রেয়সীর চুলের পানি মুছে দেয়। পিঠের পিছন একটা বালিশ দেয় সেখানে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে রুয়াত। কক্ষ থেকে বের হয় আয়াজ। খালি পেটে মেডিসিন দেওয়া যাবে না। কিছু একটা খাইয়ে তারপর দিতে হবে। আয়াজ রুয়াতের জন্য পাউরুটি আর এক গ্লাস দুধ গরম করে আনে। একটু খেয়েই রুয়াত বলছে খাবে না। কিন্তু আয়াজ ধ’ম’ক দিয়ে পুরোটা শেষ করায়।
রুয়াতের হাতে আয়াজ মেডিসিন তুলে দেয়। স্বাভাবিক স্বরে বলে-
-‘মেডিসিন খাওয়ার পর ঠিক হয়ে যাবে। বৃষ্টিতে না ভিজলে তোমার এমন জ্বর আসতো না আর আমাকে ও এতো রাতে উঠে তোমাকে ধ’ম’ক দিতে হতো না।’
চুপচাপ রুয়াত মেডিসিন খেয়ে শুয়ে পড়ে। আয়াজের চোখমুখে ভয়ংকর রাগ। কিন্তু প্রকাশ করছে না মাঝেমধ্যে একটু উচ্চস্বরে কথা বলতে গিয়েও যেনো চোখ বুজে হজম করে নিয়েছে। এসব বিষয় ভালো করেই খেয়াল করেছে রুয়াত। রুয়াত আবারও ঘুমিয়ে যায়। আয়াজের চোখে ঘুম নেই। চিন্তা হচ্ছে ভীষণ! এক রাতের জ্বরে কিভাবে মেয়েটা কে কাবু করে ফেললো। আয়াজ রুয়াতের পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কিছুক্ষণ। আবার এসে নিজ স্থানে শুয়ে পড়ে। এপাশ অপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঘুম আসেনি। প্রেয়সীর পাশে আধশোয়া হয়ে শুয়েছে।
.
আজ আর রুয়াত সকালে উঠতে পারেনি। ইনিমা এসে কিছুক্ষণ তার বোনের মাথায় জলপট্টি দেয়। আয়াজ নিচে বসে আছে। সাতসকালে রুম থেকে বের হয়েছে এখনো আসেনি।
-‘আপু ওনি আজ অফিস যাবেন?’
ইনিমা রুয়াতের চুলের পানি মুছে দিচ্ছে। আর বোনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
-‘হ্যাঁ শুনেছি যাবে। কাল তো ইলেকশন আজ যেতেই হবে। অবশ্য মা মানা করেছিলো।’
রুয়াত আর কিছু বললো না। শুধু শুনে গেলো। কাজ থাকলে তো যেতেই হবে। ইলেকশন আসবে আসবে করে কতো ব্যস্ততা লোকটার। রুয়াত চুপ করে শুয়ে আছে। ফজলুল চৌধুরী আর মায়া চৌধুরী এর ফাঁকে একবার দেখা করে যায় রুয়াতের সঙ্গে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আয়াজ আসে তার রুমে। পুরো শরীর কাঁথা দিয়ে ঢেকে শুয়েছে রুয়াত।
-‘ঘুমিয়ে গিয়েছো?’
আয়াজের কন্ঠস্বর শুনে রুয়াত তার মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে দেয়।
-‘না। ঘুমোয়নি।’
দু পকেটে হাত পুড়ে আয়াজ। মাথাটা একটু নিচু করে নজর দেয় রুয়াতের দিকে। শরীর পুরো সটান হয়ে আছে।
-‘কাজ আছে বাহিরে যেতে হবে। নাহয় থেকে যেতাম আজ।’
ছোট্ট করে রুয়াত বলে-
-‘ওহ্।’
-‘রাগ করেছো?’
অবাক চিত্তে রুয়াত আয়াজের দিকে তাকায়। সে একদমই রাগ করেনি কিন্তু। কেনো যে আয়াজ তা বললো।
-‘না রাগ করিনি।’
আয়াজ মাথাটা নিচু রুয়াতের কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে রুয়াত অনুভব করছে এমপি সাহেবের ভালোবাসা। পরক্ষণেই আয়াজ আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। রুয়াতের চুলে হাত বুলায়।
-‘ভাবি কে বলেছি তোমার খেয়াল রাখতে। দুপুরে আমি আসবো। ততক্ষণে খাওয়া হয়ে যাবে তোমার। মোটেও মেডিসিন নিয়ে হেলাফেলা করবে না। আসছি আমি।’
মাথা নাড়ে রুয়াত।
-‘শুনুন সাবধানে যাবেন।’
মুচকি হেসে আয়াজ বের হয়ে আসে। আয়াজের হাসিতে রুয়াত ও হাসছে। মনে মনে বলছে ইশশ কি সুন্দর হাসি লোকটার।
(*)
-‘কাল কোনো ঝামেলা চাই না। আমি শুধু চাই সুষ্ঠু নির্বাচনের। আশাকরি তোমরা বুঝেছো। নাহয় অযথা আমায় চিল্লাতে হবে।’
আয়াজ তার গার্ডদের বলে দিয়েছে কিভাবে কি করতে হবে কাল। গতবারের মতো যেনো অবস্থা না হয়। মারামারি হয়েছিল। আর ছেলের জন্য চিন্তা মায়া চৌধুরী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। সব ঠিকঠাক থাকলেও গতবার এমন বিশ্রী কাহিনী ঘটেছিল। তবে সেখান থেকে আগেই আয়াজ বের হয়ে এসেছিলো। ভাগ্যক্রমে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে।
-‘স্যার আপনার মনেহয় এদের বাদ দিয়ে অন্য ভালো কয়েকজন গার্ড রাখা উচিৎ ছিলো। এখন সবাই মাথা নাড়ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছু করে না।’
মফিজ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাহেদের দিকে। এটা তাদের কে অপমান করেই বলেছে কিন্তু। তা আর বোঝার বাকি রইলো না মফিজের। আয়াজ সাহেদের কথায় কোনো রিয়েক্ট করলো না। সে খুব ভালো করেই বুঝেছে সবকিছু।
-‘স্যার এবার একদম পুরো দমে ভরসা দিয়ে বলছি। আমরা আমাদের কাজ ঠিকঠাক পালন করবো। আর তেমন ঝামেলা হবে না এবার।’
-‘হ্যাঁ তা তো দেখতেই পেয়েছি গতবার।’
ভাবলেশহীন সাহেদ কথাটি বললো। মফিজ রেগে গিয়েছে এবার। মাত্রই হাঁ করেছে কিছু বলবে তার আগেই আয়াজ গম্ভীর স্বরে বলে-
-‘এসব কথা বন্ধ করো। তোমাদের ঝগড়া দেখার জন্য এখানে আসিনি।’
মফিজ চুপ হয়ে গেলো সাথে সাথে। আজ পর্যন্ত স্যারের জন্য কিছু বলতে পারেনি এই সাহেদ ব্যাটা কে। সেজন্য খুব বিরক্ত হচ্ছে আজকাল। আর সাহেদ ও খুঁচিয়ে কথা বলা বন্ধ করে না। প্রতিনিয়ত শুধু খোঁচা দিয়ে কথা বলবে। সাহেদ মিটমিট করে হেসে আয়াজের পেছনে দাঁড়ালো। মফিজ তার দিকেই চেয়ে আছে।
(*)
ইনিমা রুয়াতের জন্য খায়নি দুপুরে। বোনের অসুখ আর সে তো তার বরের জন্য অপেক্ষা করছে। এদিকে না খেয়ে অপেক্ষা করছে ইনিমা।
-‘আয়াজ কিন্তু বলেছে
ইনিমার কথাটি শেষ হতে দিলো না রুয়াত। বিরক্তিকর সুরে রুয়াত বলে-
-‘আমি বলেছি ওনি এলে খাবো। তুমি গিয়ে খাও সমস্যা নেই। আমার জন্য অপেক্ষা করো না।’
এমন মুহুর্তে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেলো বাহির থেকে৷ রুয়াত তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। নিশ্চয়ই আয়াজ এসেছে। ইনিমা আর কিছু বলেনি। রুয়াতের পাশে বসে পড়ে। আয়াজ তার কিছু কাগজপত্র ফজলুল চৌধুরীর কাছে দিয়ে আসে। তিনি আজ বাসায়ই ছিলেন। তারপর নিজের রুমে আসে। রুয়াতের পাশাপাশি ইনিমা কে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। হাতে থাকা ঘড়ি খুলে ফেলে।
-‘আপনারা দু’জন যে এভাবে বসে আছেন?’
অসহায় চোখে ইনিমা আয়াজের দিকে তাকায়।
-‘তোমার বউ না খেয়ে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। সাথে আমি ও না খেয়ে আছি।’
কথাটি শোনার পর আয়াজ বিরক্তিকর শব্দ করে। কাল খুব করে রুয়াত বলেছিলো আমি আপনার কথার অবাধ্য হবো না কখনো আজ ঠিকই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখিয়ে দিলো।
-‘ওর আর আমার খাবারটা কষ্ট করে উপরে পাঠিয়ে দিবেন। আর আপনি গিয়ে খেয়ে আসুন।’
ইনিমা চলে যায়। আয়াজ কোমড়ে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ রুয়াতের দিকে তাকায়। রুয়াত সেদিকটায় পাত্তা না দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াজ ফ্রেশ হতে চলে যায়। এসে দেখে ইনিমা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে। রুয়াতের সামনে টুল টেনে বসে। খাবার রুয়াতের মুখের সামনে ধরে বলে-
-‘হাঁ করুন। আপনি যে কেনো আমায় এতো জ্বালাচ্ছেন বুঝতে পারছি না।’
মুচকি হেসে রুয়াত মুখে খাবার তুলে। বিয়ের পর এই প্রথম আয়াজ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মনে বেশ আনন্দ হচ্ছে। রুয়াত কে খাওয়ানোর পর আয়াজ নিজেও তার খাবার খেয়ে ফেলে।
-‘তুমি ঘুমাও এখন। আমি বাবার রুমে যাচ্ছি। আমার কাজ আছে।’
আবারও রুয়াত শুয়ে পড়ে। চেয়েছিলো আয়াজের সাথে কিছু সময় কথা বলবে। কিন্তু জ্বর তা হতে দিলো না। ফের জ্বর আসছে। রুয়াত কিছু না বলেই শুয়ে পড়ে। আয়াজ চলে যায় রুম থেকে। ফজলুল চৌধুরীর সাথে কালকের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। মায়া চৌধুরী ও সেখানটায় উপস্থিত। আজ আরহাম তাড়াতাড়ি তার অফিস থেকে চলে এসেছে। কালকে কাজের চাপ তার উপর ও কম যাবে না। মুলত আয়াজ টেক্সট করেছিলো আজ তাড়াতাড়ি আসার জন্য। সে কারণেই সন্ধ্যার আগেই আরহাম বাসায় চলে আসে।
রাত আটটা পর্যন্ত আয়াজ আলোচনা করেই চলেছে। বাহির থেকে বেশ কিছু মানুষজন এসেছে। তারা তার বিশ্বস্ত কাছের মানুষ। আর তাদের সাথেই কথা বলতে বলতে এতো বেশি দেরি হয়েছে।
(*)
আয়াজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে মোবাইলে কথা বলছে। আজও বৃষ্টি হচ্ছে। রুম থেকে আয়াজের অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুয়াত উঠে গিয়ে আয়াজের পাশে দাঁড়ায়। কথা বলার মাঝে আয়াজ একবার তার প্রেয়সীর দিকে তাকায়। একদিনের জ্বরে একদম চেহেরা পাল্টে গিয়েছে প্রেয়সীর। কথা বলা শেষে আয়াজ মোবাইল তার হাতে রাখে। রুয়াতের পাশের গ্রিলে এক হাত রেখে হেসে বলে-
-‘চলো বৃষ্টিতে ভিজবে আবারও।’
রুয়াত আয়াজের দিকে তাকায়। অন্যমনষ্ক হয়ে বলে-
-‘চলুন তবে।’
আয়াজ একপাশে হাতে রেখেছিলো রুয়াতের এমন ত্যাড়া উত্তর শুনে অপর পাশের গ্রিলেও হাত রাখে। আয়াজের মাঝেই রুয়াত বন্দী এখন। ভ্রু কুচকে আসে রুয়াতের এমন কথা শুনে।
-‘জ্বরে পুড়ে যাচ্ছ। অথচ বৃষ্টিতে ভিজার শখ এখনো গেলো না?’
-‘আপনিই তো বলেছেন। শুরুটা কে করেছিলো শুনি একটু।’
-‘তাই বলে এমন উত্তর? উহু এমপির বউয়ের থেকে এমনটা আশা করিনি। চেহেরা দেখেছো একবার? কেমন হয়ে গিয়েছে একদিনের জ্বরে।’
রুয়াত হাসে আয়াজের কথায়।
-‘ইশশ জ্বর নাহলে তো জানতাম না বা বুঝতাম না আপনি আমায় এতো বেশি ভালোবাসেন?’
ঠোঁট কামড়ে হাসে আয়াজ।
-‘তাই তাহলে আমার ভালোবাসা দেখোনি তুমি? ওই সময়গুলোর কথা মনে করিয়ে দিবো প্রেয়সী?’
লজ্জায় আয়াজের বরাবর মুখ সরিয়ে নেয় রুয়াত।
-‘আমি অসুস্থ। আর আপনি এসব বলে চলেছেন?’
-‘তুমি না বললে আমিও এসব বলতাম না।’
রুয়াত ভালো করে তার ওড়না জড়ায় শরীরে। আয়াজ তার দিকেই চেয়ে আছে।
-‘কি হয়েছে?’
ঠোঁট কাঁপছে রুয়াতের। ঠান্ডা লাগছে অনেক। আয়াজের প্রশ্নের উত্তর দেয়।
-‘খুব ঠান্ডা লাগছে।’
রুয়াতের হাত ধরে আয়াজ।
-‘রুমে চলো। তোমার আবার ও জ্বর আসছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আরও ঠান্ডা লাগবে।’
কন্ঠস্বর নিচু করে রুয়াত বলে-
-‘জড়িয়ে ধরুন। ঠান্ডা লাগবে না আর।’
আয়াজ হেসে জড়িয়ে ধরে তার প্রেয়সী কে। সে হালকা ভাবে ধরলেও রুয়াত খুব শক্ত করে ধরেছে। প্রেমিক পুরুষের শরীরের উষ্ণতা অনুভব করতেই রুয়াতের ঠান্ডা উধাও।
#চলবে….#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_২৯ [প্রমাংশ]
#মোহনা_হক
বিপুল ভোটে এবারও জিতে গিয়েছে আয়াজ ত্বায়ীম চৌধুরী। আরেকবার এমপি হয়েছে। মাত্রই আরহাম কল দিয়ে জানায় ফলাফল পাওয়ার পর। সারাদিন রুয়াত খুব টেনশনে ছিলো। কাল রাতে মনেহয় আয়াজ এক ঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। সে শুধু আজকের দিনটার জন্য চিন্তায় ছিলো। বাড়িতে আবার উৎসবমুখোর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রুয়াত ও ভীষণ খুশি। বাসার সবাই খুব খুশি হয়েছে। হান্নান মজুমদার আর মেহরুবা সকালে চলে আসে। মায়া চৌধুরী অনেক অনুরোধ করেছে আজকের দিনটা তাদের সাথে কাটানোর জন্য। তাই মেহরুবা আর হান্নান মজুমদার চলে আসে সকালেই। সব ঠিক থাকলেও কেনো জানি রুয়াতের মন বারবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অজান্তেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে শুধু। এই মন খারাপের কোনো কারণ নেই।
আরহাম বাসায় এসেই চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে রুয়াত দৌড়ে এসেছে। সাথে ইনিমা ও এসেছে। হাতে অনেকগুলো ফুল। রুয়াত ভেবেছে আয়াজ এসেছে। কিন্তু নাহ্ আরহাম এসেছে শুধু।
-‘বাসায় এসেই চেচামেচি শুরু করে দিয়েছো?’
আরহামের মেজাজ গরম আজ। কতো কষ্ট করেছে। সে খেয়াল কি ইনিমার আছে? শুধু কিভাবে ঝগড়া করবে সেটা নিয়েই ভাবে।
-‘কথা বলো না তো। গাড়ি থেকে মিষ্টি নামানোর ব্যবস্থা করো। আর রুয়াত মা কে ডাকে দাও।’
রুয়াত মায়া চৌধুরী কে ডেকে আনে। ছেলের এতো বড় একটা খুশির সংবাদ শুনে বিছানায় গেলো একটু আগে। চিন্তায় চিন্তায় কাটছিলো আজকের দিন। আবার আরহাম এসেছে শুনে নিচে আসে। সোফায় শরীর হেলিয়ে শুয়ে আছে আরহাম। মাগরিবের আযান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মেহরুবা নামাযে থাকাতে আর আসেনি। মায়া চৌধুরী আরহামের পাশে বসে।
-‘আয়াজ আসেনি? আর তোর বাবা কোঁথায়?’
কন্ঠে অস্থিরতা মায়া চৌধুরীর। একবার ছেলে কে একটু দেখতে চাচ্ছে। মনটা কাতর হয়ে আছে একটি নজর ছেলেকে দেখার জন্য। আরহাম শান্ত স্বরে বলে-
-‘বাবা আর আয়াজ পরে আসবে। তোমার ছোট ছেলেকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কতো মানুষ ওয়েট করছে। তাদের সাথে কথা বলেই চলে আসবে বাসায়। বাবা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। খেয়েছো দুপুরে তুমি?’
মাথা নাড়ায় মায়া চৌধুরী।
-‘পরিস্থিতি ঠিক ছিলো তো? আয়াজ কি মাথা গরম করেছে আজ?’
-‘নাহ্। সবকিছু ঠিকই ছিলো। তুমি টেনশন করো না আর।’
আরহাম তার মায়ের দুটো গাল ধরে হাসিমুখে কথাটি বলে। রুয়াত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। মেহরুবা আসে তাদের মাঝে। রুয়াতের পাশাপাশি দাঁড়ায়। আরহাম কথা বলে কিছু সময় মেহরুবার সাথে। যেহেতু সে অনেক সকালে বের হয়েছিলো তাই আর কথা হয়নি দেখাও হয়নি। ফজলুল চৌধুরী ও এসেছেন। মায়া চৌধুরী তার আসার পর পরই জিগ্যেস করে আয়াজ কেনো আসেনি? কিছু কাজ থাকার কারণে ফজলুল চৌধুরী চলে আসে। মুলত আয়াজ পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে। রুয়াতের অস্থিরতা বেড়েই চলছে। হাজারো ভয় এসে জমা হচ্ছে শুধু। চেয়েও সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে পারছে না। স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। শুধু মনেহচ্ছে কি যেনো হবে!
(*)
রাত আটটা বাজতে চললো। আয়াজের আসার নাম নেই। রুয়াত ইনিমা কে জিগ্যেস করছে কেনো আসছে না এখনো। ইনিমার সহজসরল উত্তর আজ খুব বেশি ব্যস্ত থাকায় আসতে পারছে না। নিচে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। রুয়াত উপরে বসে আছে আয়াজের রুমে। কারো হাসিঠাট্টা যেনো ভালো লাগছে না। তাই উপরে চলে আসে। আলমিরা থেকে শাড়ি বের করেছে। গাঢ় লাল রঙের শাড়ি। আয়াজের খুশিতে একটু খুশি করা যাক তাকে। আয়নার সামনে বসে নিজে নিজে সেজেছে। রুয়াত একবার আয়াজের কাছে কল দিয়েছে। সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলছে। তাই কল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ইনিমা রুমে এসে দেখে বোনের কান্ড। মুচকি মুচকি হাসে।
-‘আজ বরের জন্য সাজা হচ্ছে বুঝি?’
রুয়াত পিছন ফিরে চায় বোনের দিকে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। ইনিমা আরও সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে রুয়াত কে। মোটেও রুয়াতের শাড়ি পড়া হয়নি। কেমন জানি হয়েছে। ইনিমা আবারও সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দেয় রুয়াত কে।
-‘সুন্দর লাগছে খুব তোকে।’
হাসে রুয়াত। হঠাৎ বাড়ির হাসির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। ইনিমা আর রুয়াত নিচে আসে। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরে যেনো বাড়িটি নিরবতায় শুনশান আওয়াজ করছে। মায়া চৌধুরীর চোখ থেকে পানি পড়ছে। মেহরুবা চুপ করে পড়ে আছে। আরহাম আর ফজলুল চৌধুরী তাড়াতাড়ি করে কোঁথায় যেনো চলে গেলো।সবার এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকায় রুয়াত। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি বোধগম্য হলো না তার। ইনিমা মায়া চৌধুরী কে জিগ্যেস করে-
-‘কি হয়েছে মা? বাবা আর আরহাম কোঁথায় গিয়েছে?’
মায়া চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মেহরুবার সামনে হাটু গেড়ে বসে ইনিমা। তার মায়ের হাত ধরে। তিনিও একদম চুপ হয়ে আছেন।
-‘মা কি হয়েছে? কিছু তো বলো। চুপ থেকো না মা।
কিছু অন্তত বলো।’
মেহরুবা একবার তার ছোট মেয়ের দিকে তাকায়। থেমে থেমে বলে-
-‘আয়াজের এক্সিডেন্ট হয়েছে। বড় গাড়ি ধাক্কা মেরে দিয়েছে। সেখানেই গিয়েছে আরহাম আর ফজলুল সাহেব।’
সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি যেনো নেই রুয়াতের। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে৷ প্রথম যেবার আয়াজের এক্সিডেন্টের খবর শুনে সেদিন ও ঠিক এমন হয়েছিলো। মেহরুবা দৌঁড়ে আসে রুয়াতের কাছে। মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। ইনিমা সেখানটায় বসে আছে। মস্তিষ্ক যেনো থমকে গিয়েছে। মেহরুবা রুয়াত কে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বলে-
-‘আয়াজের কিছু হবে না। সে ঠিক ফিরে আসবে। এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না।’
পুরো কথাটি শ্রবণ হতেই না হতেই নিস্তেজ হয়ে যায় রুয়াতের শরীর। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। স্বামীর এমন খবর সহ্য করতে পারছে না। মায়া চৌধুরী এসে আঁকড়ে ধরে রুয়াত কে। চেষ্টা করছে জ্ঞান ফিরানোর। কোনো মতেই জ্ঞান আসছে না রুয়াতের।
.
চৌধুরী বাড়ির সামনে লাশের খাট। বাড়ি জুড়ে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যারা লোকটি কে শুভ কামনা জানানোর জন্য এসেছিলো এখন তারাই লাশ দেখে চলে যাচ্ছে। পুলিশের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। বাসার ভিতরে মাঝ বরাবর রাখা হয়েছে আয়াজের লাশ। একপাশে রুয়াত জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে। আরহাম বারবার তার বুকে আঘাত করছে। মায়া চৌধুরী জ্ঞান হারিয়েছেন ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে। মেঝেতে একপাশে বসে ফজলুল চৌধুরী অঝোরে চোখের পানি ফেলছেন। অবুঝ বাচ্চা জাফরি তার চাচ্চুর লাশের উপর মাথা রেখে কাঁদছে। রুয়াতের জ্ঞান আসার পর এমন বিকৃতি পরিবেশ দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। মেহরুবার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আয়াজের মুখ দেখে থমকে যায়। মুখের একপাশ থিতলে গিয়েছে। মুখটি ধরার পর তার হাত ও রক্তে ভরে যায়। সাদা পাঞ্জাবী রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। আয়াজের মুখটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। সকালের জলজ্যান্ত মানুষটা এখন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে তার। ভিতর থেকে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে বারবার। সবার মুখে একটাই কথা ‘কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে এখনই স্বামী ছাড়া হয়ে যাবে।’ আয়াজের হাত ঘষে দিচ্ছে রুয়াত। নিজের কোলের উপর স্বামীর মাথা রেখে ইচ্ছেমতো অধর ছোঁয়ায়।
-‘একবার উঠুন না আয়াজ। আমার দিকে তাকান। চোখ খুলুন। আমি সহ্য করতে পারছি না আপনার এমন অবস্থা। কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন কষ্ট পাচ্ছি আমি। আপনি এভাবে শুয়ে আছেন কেনো? উঠুন আয়াজ উঠুন। আপনাকে এভাবে মানায় না। আপনার প্রেয়সী কষ্ট পাচ্ছে। ভালোবাসি তো আয়াজ আপনাকে। কেনো চোখ খুলছেন না বলুন তো? আপনার তো আজকে খুশির দিন তাহলে কেনো এভাবে শুয়ে আছেন? আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন আমি সেজেছি আপনার জন্য। একবার তাকিয়ে দেখুন।’
এসব কথা বলে চিৎকার করছে রুয়াত। আরহাম রুয়াতের কান্না সইতে পারছে না। ইনিমা রুয়াতের পাশে বসে। অপর পাশে আরহাম বসে। রুয়াতের মাথায় হাত দিয়ে বলে-
-‘ও আর চোখ খুলবে না রুয়াত। সে চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে। ওকে সুস্থ করে বাসায় নিয়ে আসতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করো বোন। তার আগেই সে দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করে।’
আরহামের দিকে রুয়াত তাকিয়ে বলে-
-‘ভাইয়া আমি কিছু শুনতে চাই না। ওনাকে বলুন চোখ খুলতে। আমার কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। কষ্ট হচ্ছে আমার। ভাইয়া একটু বলুন ওনাকে চোখ খুলতে।’
ওড়না দিয়ে ইনিমা তার চোখের পানি মুছে নিচ্ছে। আয়াজের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছে না। সকালেও কি সুন্দর হেসেছিলো। এখনো চোখে ভাসছে। দূর থেকে সাহেদ কাঁদছে। স্যারের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে। তার ও এখন মন চাচ্ছে স্যারের সাথে না ফেরার দেশে চলে যেতে।
-‘এমপি সাহেব উঠুন। রুয়াত কাঁদছে। দেখুন না। একটু দেখুন। আজ আপনার সব পছন্দের খাবার রান্না করা হয়েছে৷ খাবেন না? আমিও খাইনি। আপনার জন্য বসে আছি। আমায় এভাবে কষ্ট দিবেন না আপনি। দয়া করে উঠুন।’
বেঘোরে কাঁদছে রুয়াত। মুখের সাজ চোখের পানিতে যেনো চলে গিয়েছে। মেহরুবা সেখান থেকে চলে আসে। এতো ছোট বয়সে মেয়েটা স্বামী হারা হলো। এ যেনো সহ্য করতে পারছে না। হান্নান মজুমদার দরজার এক পাশে বসে আছে। মেয়ের আর্তনাদে বুক ছিড়ে আসছে বারবার।
-‘আপু মা কোঁথায়? মা বলেছিলো ওনার কিছু হবে না। এখন মা কে জিগ্যেস করো তো কেনো উঠছে না ওনি? আয়াজ আপনাকে বলছি উঠুন। আর কতোবার বলবো আমি কষ্ট পাচ্ছি? আপনি দেখতে পারছেন না? কেনো সব বুঝেও চোখ বন্ধ করে আছেন? আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। দম বন্ধ হয়ে যাবে আমার।’
কিছু মহিলা এসে জোর করে আয়াজের থেকে রুয়াত কে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। রুয়াত আসতে চাইছিলো না। শুধু বলছে ‘ওনার থেকে আমায় নিয়ে যাবেন না। একা থাকতে পারবো না আমি। আয়াজ কে চাই আমার।’ রুয়াতের কথা যেনো কারো কানে যাচ্ছে না। একদিকে আয়াজের লাশ ধোঁয়া হচ্ছে। অন্যদিক দিয়ে রুয়াত কে তার লাল শাড়ি পাল্টে সাদা শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কানের দুল, হাতের চুড়ি, গলার স্বর্ণের চেইন খুলে ফেলা হয়েছে। বাড়ির সামনে আয়াজের লাশ রাখা হয়েছে কিছুক্ষণ পর নিয়ে যাবে। শেষবারের জন্য মায়া চৌধুরী তার ছেলে কে দেখে আসে। আর চাইলেও ছেলের মুখখানা দেখতে পারবে না। রুয়াত আবার জ্ঞান হারিয়েছে। এতো কম বয়সে এমন শোক সইতে পারেনি। আয়াজের লাশ নিয়ে গিয়েছে। রুয়াত ঘুমিয়ে আছে তারই বেডে। কালকেও রুয়াত কে কতো যত্ন করেছিলো আজ সেই মানুষটা চলে গিয়েছে তার প্রেয়সী কে একা ফেলে রেখে। রুয়াত কে বুকে জড়িয়ে কেঁদে চলছে ইনিমা। সে রুমেই অনেক মানুষ জন দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখের কার্ণিশে নোনাপানি। গড়িয়ে পড়ছে গাল থেকে।
#চলবে…