হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব -০৮+৯

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৮
সকাল থেকে বিশালভাবে তোড়জোড় চলছে।আজ আরাবী আর জায়ানের গায়ে হলুদ।দুজনের গায়ে হলুদ একসাথেই হবে এটা জায়ানের আদেশ।এর জন্যে একটা কমিউনিটি সেন্টার বুক করা হয়েছে।জায়ানের পাগলামিতে সে-কি হাসাহাসি ওর পরিবারের।কিন্তু এতে অবশ্য জায়ানের কোন ভাবাবেগ দেখা যায়নি।সে সর্বদার মতো নির্বিকার। নূর এসব আরাবীকে জানাতে সেও হেসেছে।তাকে ঘিরে যে লোকটার কতোশতো পাগলামি।আরাবী এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায় রাখা জায়ানদের বাড়ি থেকে হলুদের যাবতীয় সব কিছু দিয়ে গিয়েছে। সবকিছু কেমন যেন লাগছে।মনের মাঝে অন্যরকম একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। কালকের পর থেকে জায়ান নামন ব্যাক্তিটার সাথে ওর অস্তিত্ব আজীবনের জন্যে জুড়ে যাবে। হলুদের লেহেঙ্গাটায় হাত ছোয়ালো আরাবী। ভীষণ সুন্দর লেহেঙ্গাটা।ওর বিয়ের যাবতীয় সবকিছু না-কি জায়ান নিজে পছন্দ করে কিনেছে। কারো পছন্দের মত নেইনি।হাসলো আরাবী জায়ানের কথা ভেবে।গালদুটো লজ্জায় গরম হয়ে উঠলো। এতে শ্যামবর্ণের আরাবীকে লজ্জাবতী অবস্থায় কিযে সুন্দর লাগে।এইজন্যেই বুঝি জায়ান বারে বারে আরাবীকে লজ্জা দেয়।আরাবীর ঠোঁটের কোণে মুঁচকি হাসি।
আরাবী যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত।তখন আলিফা এসে তারা দিলো আরাবীকে।
-‘ কিরে? তৈরি হবি নাহ? সময় বেশি নেই তো।’

ভড়কে গেলো আরাবী।তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকালো।আসলেই সময় বেশি নেই।জলদি কমিউনিটি সেন্টারে পৌছাতে হবে। আরাবী দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসলো। আলিফা এইবার আরাবীকে মেক-আপ করে দিতে লাগলো।আলিফা একজন মেক-আপ আর্টিস্ট।তবে ওর কোন পার্লার নেই।মাত্র কয়েকমাস হলো মেক-আপ কোর্স করেছে।ভীষণ সুন্দর করে সাঁজায় মেয়েটা। এটা অবশ্য শখের বসে শিখা।আরাবী বলে উঠলো,
-‘ কতো করে বললাম একটা পার্লার দে।কি সুন্দর সাঁজিয়ে দিস তুই।’

আলিফা হেঁসে বলে,
-‘ এইটা তো এমনি শখের বসে শিখেছি।আচ্ছা দেখি ভবিষ্যতে ইচ্ছে হলে খুলবো নেহ। এখন চুপচাপ থাক।নড়িস নাহ মেক-আপ নষ্ট হয়ে যাবে। পরে জায়ান ভাইয়া আমাকে দোষ দিবে।’

আরাবী হেসে দিলো।আলিফার কথার ধরনে হেঁসে দিলো।আলিফা আরাবীকে সুন্দর করে সাজানো শেষ করলো। আরাবীকে সসম্পূর্ণ রূপে সাজিয়ে আরাবী মুগ্ধ হয়ে বলে,
-‘ ইস,কিযে সুন্দর লাগছে না তোকে।ভাইয়া দেখলে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে।’

আরাবী হাসলো।বললো,
-‘ তুই কি কম সুন্দর নাকি।আমাকে সুন্দর বলছিস।তাহলে তো তুই সাজলে তোকে পুরো হুরপরি লাগবে।তাড়াতাড়ি সেজেগুজে নেহ।’

আলিফাও তৈরি হতে চলে গেলো।আলিফা পরেছে সারারা ড্রেস।ওকেও কোন অংশে সুন্দর লাগছে না।
ওরা তৈরি হতেই দরজায় টোকা পরলো।শোনা গেলো ফাহিমের কণ্ঠস্বর,
-‘ কিরে হলো তোদের?বের হবো আমরা।’

আরাবী গিয়ে দরজা খুলে দিলো।ফাহিম বোনকে দেখে মুগ্ধ হলো।আরাবীর গায়ের রঙ শ্যামলা বলে অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।তবে তারা তো আর জানে না শ্যামবর্ণের এই মেয়েটাকে ঠিক কতোটা মায়াবতী লাগে।ফাহিম বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
-‘ মাশা-আল্লাহ। খুব সুন্দর লাগছে তোকে।’

আরাবী মিষ্টি হাসলো।পাশ থেকে আলিফা এসে বলে,
-‘ আমাকে কেমন লাগছে ফাহিম ভাইয়া?’

ফাহিম হেসে বলে,
-‘ তোকেও খুব সুন্দর লাগছে,মাশা-আল্লাহ! ‘

আলিফা খুশি হয়ে গেলো।আরাবী আর আলিফাকে নিয়ে বসার ঘরে আসলো ফাহিম।আরাবী সোজা হেটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।জিহাদ সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।আরাবীর চুলে চুমু দিয়ে বলেন,
-‘ একদম আমার মায়ের মতো সুন্দর লাগছে।একদম একটা মিষ্টিপরি লাগছে।’

আরাবীর চোখ ভরে আসলো।আর মাত্র একটাদিন আছে এই মানুষগুলো কাছে।এইসব ভাবলেই আরাবীর বুক ভার হয়ে আসে।বুকের মাঝে আপনজনদের ছেড়ে চলে যাবার হা’হাকারের ঝড় উঠে। আরাবীর কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা দেখে আরাবীর জোড়পূর্বক হেসে বলে,
-‘ আরে কি করছিস। কান্নাকাটি করে আমার এতো কষ্ট করে দেওয়া মেক-আপ নষ্ট করিস নাহ।ফ্রিতে সাজিয়ে দিয়েছি।কেঁদেকেটে তা নষ্ট করলে টাকা দিতে হবে বলে দিলাম।’

জিহাদ সাহেব হেসে দিলেন।আরাবীকে বুক থেকে তুলে নিলেন।মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
-‘ কোন কান্নাকাটি করা যাবে নাহ।তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন এগুলো।মন ভরে উপভোগ করবে।দিনশেষে এইগুলোই সুন্দর কিছু স্মৃতি হয়ে থাকবে।’

আরাবী চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু মুছে নিলো।তারপর লিপি বেগমের কাছে গেলো।মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।লিপি বেগম অবাক হলেন।তবে কিছু বললেন নাহ।তিনিও আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে দিলেন।আরাবী যেন এটুকুতেই খুশিতে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছে।
এদিকে ফাহিম হাতের ঘড়িতে সময় দেখে সবাইকে তাড়া দিতে লাগল,
-‘ আর দাঁড়িয়ে থেকো নাহ।জলদি চলো।নাহলে লেট হয়ে যাবে।চলো চলো।নিচে গাড়ি দাঁড়িয়ে সেই কখন থেকে।’
————
গাড়ি এসে পৌছালো সুসজ্জিত ঝলমলে একটা বিল্ডিংয়ের সামনে।সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো।ফাহিম এসে আরাবীকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করছে। আরাবী কমিউনিটি সেন্টারের গেটের সামনে একটা বিশাল বোর্ড দার করানো দেখলো। সেখানে লিখা ” আজ জায়ান,আরাবীর হলুদ ছোঁয়া “।

কমিউনিটি সেন্টারের ভীতরে প্রবেশ করলো সবাই।প্রায় সংখ্যক মেহমান এসে পরেছে।জায়ান’রা এখনো আসেনি।তাদের একটু দেরি হবে।ফাহিম আলিফাকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলে আরাবীকে নিয়ে এখানে অপেক্ষা করতে।জায়ান ওরা আসলেই যেন বের হয়। আলিফা আরাবীকে নিয়ে সেই রুমে চলে গেলো।

বিছানায় বসে হাঁসফা’স করছে আরাবী। সেইযে সকাল থেকে বুকটা ধ্বুকপুক করা শুরু করেছে তো করেছেই।থামাথামির নাম গন্ধ নেই।হাতপা ঘেমে যাচ্ছে বার বার।এখানে আসা অব্দি কতো গ্লাস পানি খেয়ে নিয়েছে আরাবী।তাও যেন বার বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।আলিফাটা সেইযে ওয়াশরুমে গিয়েছে আসার নামগন্ধ নেই।হঠাৎ বাহির থেকে শোরগোলের আওয়াজ ভেসে আসলো।আরাবী বুঝলো জায়ান’রা এসে পরেছে।বুকের মাঝে এইবার কাম’ড়ে ধরলো যেন।ইস, কিরকম সুখময় যেন এই যন্ত্র’না।আরাবী শক্ত হয়ে বসে রইলো। আরাবীর ভাবনার মাঝেই হঠাৎ আরাবীর ফোন বেঁজে উঠলো।আরাবী ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে ‘ জায়ান’ নামে সেভ করা নাম্বার থেকে কল আসছে।কলিজাটা ছ্যাৎ করে উঠলো।এই লোক এখানে এসেও কেন কল করছে ওকে?এখন আরাবী কথা বলবে কিভাবে? ওর গলা দিয়ে তো কথাই বের হবে না। যেই অবস্থা ওর।আকাশসম চিন্তার মাঝেই প্রথমবার কলটা ধরতে পারলো না আরাবী।দ্বিতীয়বার ফোন বেঁজে উঠতেই আরাবী কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে করলো।কাঁপা গলায় নিজেই আগেই সালাম দিলো।ওপাশ থেকে জায়ান সালামের জবাব নিয়ে নরম গলায় বলে,
-‘ ফিলিং নার্ভাস?’

আরাবী সময় নিয়ে উত্তর দিলো,
-‘ হু।’
-‘ আমিও নার্ভাস।’

অবাক হলো আরাবী।জায়ান ছেলে হয়েও নার্ভাস হচ্ছে?এমন একটা কথায় আরাবী হাসবে নাকি জায়ানকে শান্তনা দিবে ভেবে পেলো না। ওপাশ হতে জায়ানের শান্ত কণ্ঠ,
-‘ ছেলে হয়েও আমি কেন নার্ভাস জিজ্ঞেস করবে নাহ?’

আরাবী মিনমিন করে বলল,
-‘ কেন?’
-‘ তোমার জন্যে!’

অবাক আরাবী।
-‘ আমার জন্যে?’
-‘ হ্যা।’
-‘ আমি কি করেছি?’
-‘ বলো একটু পর আমার সাথে কি কি করবে! এইযে তুমি এখন সুন্দরভাবে সেজেছো।নিশ্চয়ই তোমাকে একেবারে হলুদপরি লাগছে।এখন তোমাকে এই রূপে দেখবো একটু পর আমি।তখন আমার কি হবে ভাবতে পারছো তুমি?আমি পাগ’ল না হয়ে যাই।মাথা টাথা খারাপ হয়ে যাবে আমার।পরে সবার সামনে কন্ট্রোললেস হয়ে গেলে তোমাকে চুমু টুমু না খেয়ে বসি।পরে তুমিই আর কালকে বাস’র রাতে আমার কাছেই আর আসবে না।তখন আমি কি করবো বলো তো। কতোটা নার্ভাস আমি জানো তুমি এসব ভেবে? চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

আরাবী হা হয়ে গিয়েছে।ও আরো কতো কি ভাবলো।কিন্তু জায়ান ওর সবকিছু উল্টেপাল্টে দিয়ে কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছে।খামোখা কি আর আরাবী লোকটাকে ‘ অস’ভ্য’ উপাধি দিয়েছে। ওর ভাবনার মাঝে ফোনের ওপাশ হতে জায়ানের অস্থির কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
-‘ আরাবী কথা বলছো না কেন? আমার কষ্টটা অনুভব করো।আমি কতোটা চিন্তিত। কোথায় আমাকে প্রেম প্রেম কথা বলে শান্তনা দিবে তা না করে চুপ করে আছো।জানো আমি কাল রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি।জেগে জেগে তোমায় নিয়ে কতো কি করেছি।তোমাকে কতো যে আদর করেছি। ইস,কালকের দিনটা আসছে না কেন?এতো দেরি কেন লাগছে।এইসব হলুদের ফাংশান কে আবিষ্কার করেছে? তাকে গু*লি করে মে*রে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কোন হ্লুদ টলুদের অনুষ্ঠান না করে ডিরেক্ট বিয়ে করে নিবে এতেই না আমার মতো অস্থির মানুষ শান্ত হবে।এসব অপেক্ষা ভালো লাগে না।আমি তো অনেক বেশি অস্থির।কাল না জানি কবুল বলেই ডিরেক্ট বাসর ঘরে নিয়ে ঢুকে চুমু টুমু খেয়ে….. ‘

জায়ানের এইসব ভয়ংকর কথাবার্তা সহ্য করতে না পেরে আরাবী চেঁচিয়ে উঠলো,
-‘ বন্ধ করুন আপনার এসব অস’ভ্য কথাবার্তা।’
-‘ তুমি তো আমার কথা শুনলেই… ‘

জায়ানের কথা পুরোটা শোনার আগেই আরাবী ফোন কেটে দিলো। লজ্জায় পুরো শরীর গরম হয়ে গিয়েছে আরাবীর। সারা শরীর লজ্জায় ভয়া’বহভাবে কাঁপছে।এমনিতে তো অন্যকারো সামনে বো’ম মারলেও সহজে কথা বের হয় না।আর ওর কাছে আসলেই যেন তার টকিং মেশিন অবিরাম চলতে শুরু করে।কোন বাধানিষেধ নেই।এমন এক নির্লজ্জ লোকের সাথে আরাবী থাকবে কিভাবে?এমন ভয়ংক’র কথাবার্তা যে কেউ এমন অনায়াসে বলতে পারে কাশ্মিনকালেই ভাবেনি।আর সেটা যে ওর কপালেই এসে জুটবে।আরাবী বিরবির করলো,
-‘ অস’ভ্য ঠোঁটকা’টা লোক।লাগাম নেই লোকটার।একদম নেই।’

আরাবী দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো।ভীষণ গরম হয়ে আছে সারা মুখশ্রীর আরাবীর।লজ্জায় চোখ ভিজে উঠেছে আরাবীর।
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৯
জায়ানের সেই উল্টাপাল্টা কথা শুনে আরাবী ধ্যান মেরে বসে রইলো কতোক্ষণ।তারপর কিছু একটা ভেবে জায়ানকে মেসেজ করলো,
-‘ আমি ওখানে আসলে প্লিজ এমন কিছু করবেন নাহ।যাতে আমি মানুষের সামনে লজ্জায় পরি।প্লিজ, একটু বুঝুন।আমি একটা মেয়ে।আপনি এমন করলে আমার কি পরিমান লজ্জা লাগে আপনি বুঝতে পারবেন নাহ।আপনি এমন করবেন নাহ প্রমিস করুন।আর যদি করেন তাহলে আমি আমার সাজসজ্জা সব নষ্ট করে ফেলবো।তখন দেখবো আপনি কি করেন!’

মেসেজটা সেন্ড করেই লম্বা শ্বাস ফেললো আরাবী।যদি এইবার লোকটার একটু মতিগতি ঠিক হয়।কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে জায়ান মেসেজ দিলো,
-‘ আমি এভাবে তোমার সাথে কথা বললে কি তোমার বিরক্ত লাগে?অসহ্য লাগে আমায় আরাবী?’

আরাবী মেসেজটা পরে থমকে গেলো।ঠিক কি বলবে ও ভাষা খুঁজে পেলো না।ওর জায়ানকে কোনকালেই বিরক্ত বা অসহ্য লাগে নাহ।বরং লোকটার পাগলামিগুলো ওর ভালো লাগে।সব মেয়েরাই এমন একটা স্বামি চায়।যারা নাকি তাদের স্ত্রীদের জন্যে পাগল থাকে।শতো শতো পাগলামি করে।তার কেয়ার করে, ভালোবাসে।আর আরাবী তো ভাগ্য করে জায়ানকে পেয়েছে।সেখানে লোকটাকে বিরক্ত লাগবে কেন? জায়ান যখন ওকে লজ্জা দেওয়ার জন্যে দুষ্টু কথা বলে আরাবীর ভালোলাগে।যখন জায়ান আরাবীর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায় তখন আরাবীর ভালোলাগে।মোট কথা গোটা জায়ানকেই তার ভালোলাগে।বিগত ১৪,১৫ দিনের মাঝে জায়ানের সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে আরাবীর।দুজনে একসাথে টাইম স্পেন্ড করেছে।তখন জায়ান আরাবীর অনেক খেয়াল রাখতো।একবার আরাবী রাস্তায় ইটের পা বেজে পরে যেতে নিয়েছিলো।জায়ানের কারনে বেঁচে গিয়েছিলো ও।তবে পায়ের একটু ব্যাথা পেয়েছিলো।ওর ওই একটুখানি ব্যাথার জন্যে লোকটার কতোশতো পাগলামি।যেন ব্যাথাটা ও না জায়ান পেয়েছে।যে ওর একটুখানি কষ্টে এমন ডেস্পারেট হয়ে পরে সেই মানুষটিকে ওর বিরক্ত বা অসহ্য লাগবে কেন? আরাবীর মন খারাপ হলো।লোকটা কি ওর কথায় রাগ করেছে? আরাবী মুখ গোমড়া করে মেসেজের রিপ্লাই দিলো,
-‘ আমি কখনও বলেছি এসব? তাহলে এভাবে বলছেন কেন?আপনি কি আমার কথায় রাগ করেছেন?’

জবাব আসলো সাথে সাথে জায়ানের,
-‘ নাহ রাগ করেনি।আমি নিজেই দুঃখিত।আসলে তোমাকে আর একটা দিন পরেই নিজের করে পাবো সারাজীবনের জন্যে।তাই অনেক ডেস্পারেট হয়ে পরেছিলাম।সেই থেকেই ওই কথাগুলো বলেছি।আমি অনেক সরি।ভয় পেও নাহ।আর এমন কিছু করবো না।যা তোমার ভালো লাগে নাহ।’

আরাবী চোখ ভরে আসলো। জায়ানের মেসেজে বুঝায় যাচ্ছে স্পষ্ট। লোকটা রাগ করেছে।
-‘ এমন করে বলছেন কেন? আমি কি বলেছি আমার ভালো লাগে নাহ? আমি শুধু বুঝাতে চেয়েছি যে আপনি একটু আগে যেসব কথা বলেছেন।ওরকম যদি সত্যি সত্যি সবার সামনে করেন। তাহলে এতোগুলো মানুষের সামনে আমি অনেক লজ্জা পাবো।আমি মেয়ে মানুষ বুঝেনই তো।’
-‘ বুঝতে পেরেছি।আমি আসলে অস্থির হয়ে ওসব বলে ফেলেছি।কিন্তু আমি এতোটাও বোকা না যে তোমার অসম্মান হবে তা তোমার ভালো লাগবে না। এমন কোন কাজ আমি তোমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে করবো।জায়ান সাখাওয়াত এতোটাও খারাপ মানুষ না।’
-‘ রাগ করে কথা বলছেন কেন?রাগ করবেন না।আচ্ছা,আমি সরি।’

আরাবী মেসেজটা করে চুপ করে বসে রইলো।কিন্তু এরপর আর জায়ানের কোন রকম মেসেজ আসলো না।আরাবী বসেই রইলো ফোন হাতে নিয়ে।এতোক্ষণের সব আনন্দ আর ভালোলাগা যেন মাটি হয়ে গেলো।মন খারাপে’রা এসে ভীর জমালো আরাবীর কাছে।
——————-
দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে নামছে নূর।আরাবীকে খুজঁতেছিলো ও।পরে জানতে পারলো আরাবী নিচের ফ্লোরের রুমে আছে।আলিফাও সাথে যাচ্ছে।তবে আলিফা আগে আগে নেমে গিয়েছে।নূরও এই কারনে তড়িঘড়ি করে নামার জন্য পা বাড়ালো।হঠাৎ করে সারারায় নিচের পার্টে পা আটকে পরে যেতে নিতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠে নূর। কিন্তু শরীরে কোনরকম ব্যাথা অনুভব করতে না পেরে পিটপিটিয়ে তাকায় নূর।তাকাতেই ওর চোখের সামনে ফাহিমের মুখশ্রী ভেসে উঠে।নিজেকে ফাহিমের বাহুডোরে দেখে তাড়াতাড়ি করে সোজা হয়ে দাঁড়ায় নূর।ফাহিম নূরকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
-‘ আর ইউ ওকে?’

নূর নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
-‘ হ্যা,ঠিক আছি আমি।’

-‘ এতো তাড়াহুড়ো করার কি আছে?আস্তে ধীরে নামা যায় নাহ?নাকি কোন ট্রেন ছুটে যাচ্ছে তোমার?এখনি তো মুখ টুখ পরে ফাটি’য়ে ফেলতে।বাচ্চাদের মতো খালি দৌড়াদৌড়ি।’

ফাহিমের কড়া কথাটুক সব হজম করলেও।নূর ফাহিম ওকে বাচ্চা বলায় সেটা মানতে পারলো না।রেগে দু-কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
-‘ এই আপনি আমায় বাচ্চা বললেন কেন?’

নির্বিকার ভঙিতে দাঁড়ানো ফাহিম বাঁকা হেসে বলে,
-‘ বাচ্চাদের বাচ্চা বলবো নাতো কি বলবো?’
-‘ খবরদার আমায় বাচ্চা বলবেন না।ভালো হবে না কিন্তু।’
-‘ আচ্ছা তাহলে বুড়ি দাদু বলি।’

নূর এইবার ভয়া’নক রেগে গেলো।তেড়েমেরে আসলো ফাহিমের দিকে।আঙুল উঁচু করে বলে,
-‘ এই এই কি বললেন আপনি?আমাকে দেখে কি আপনার বুড়ো মনে হয় হ্যা?আমি মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।আপনি আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিলেন।’

ফাহিম দু আঙুলের সাহায্যে নূরের উঁচু করে রাখা আঙুলটা ধরে নামিয়ে দিলো।কেমন যেন করে উঠলো নূরের মনের ভীতর।কেঁপে উঠলো শরীর ফাহিমের এই একটুখানি ছোঁয়াতে।দ্রুত দু পা পিছিয়ে গেলো নূর।ফাহিম ভ্রু-কুচকে বললো,
-‘ বাচ্চা বললেও দোষ,বুড়ো বললেও দোষ।কি বলবো তাহলে?’

নূর কেমন যেন দমে গিয়েছে।কো জবাব না দিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নামা ধরলো।ফাহিম হাসলো। তবে কিছু বললো না।ফাহিম চলে যেতে নিতেই হঠাৎ একটা ডাকে থেমে গেলো,
-‘ এইযে শুনুন।’

ফাহিম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নূর ধীর আওয়াজে বলে,
-‘ আমার নাম নূর।নূর সাখাওয়াত। পরেরবার মনে রাখবেন।’

নূর এটুকু বলেই দ্রুত পায়ে ছুটে চলে গেলো।ফাহিম নূরের যাওয়ার পাণে তাকিয়ে হেসে দিলো।মেয়েটা এতো বড় দেখলে বুঝাই যায়না। স্বভাবও কেমন ছটফটে বাচ্চাদের মতো।ফাহিম বিরবির করলো,
-‘ নূর!’
—————–
নূর আর আলিফা আরো কয়েকজন মেয়ে মিলে আরাবীকে নিতে রুমে প্রবেশ করলো।নূর গিয়ে ঝাপ্টে ধরলো আরাবীকে।আরাবী মলিন হাসলো।নূর ছটফটে কন্ঠে বলে,
-‘ ইস, ভাবি কি সুন্দর লাগছে তোমাকে।আমি তো পুরো ফিদা।’

আরাবী মিষ্টি করে হাসলো।নূরের গালে হাত দিয়ে বলে,
-‘ তোমাকেও সুন্দর লাগছে।একেবারে পুতুলের মতো।’

আলিফা ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আরাবীর দিকে।তবে নূরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ নূর আরাবীর মাথার উপর যে ওড়না ধরতে হবে সেটা ওই ব্যাগটায় আছে বের করো তো। ‘

নূর ‘ আচ্ছা আপু ‘ বলে চলে গেলো।আলিফা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আরাবীকে ফিসফিস করেজিজ্ঞেস করলো,
-‘ আরাবী কি হয়েছে তোর?মন খারাপ কেন?এই একটু আগেই তো ভালো ছিলি।’

আরাবী নিজের মন খারাপ লুকানোর চেষ্টা করতে লাগলো।কথা ঘুরানোর জন্যে বলে,
-‘ কোথায় গিয়েছিলি? আমি এখানে একা বসে থেকে কি বোর হচ্ছিলাম।’

আলিফা জিহবে কামড় দিয়ে বললো,
-‘ ইস,আমিই ভুলেই গিয়েছিলাম।ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই শুনতে পেলাম।জায়ান ভাইয়ারা এসে পরেছে তাই সেদিকেই ছুট লাগিয়েছি।জায়ান ভাইয়াকে যা লাগছে না।তুই দেখলে পাগল হয়ে যাবি।’

আরাবী হালকা হাসলো আলিফার কথায়। তবে কিছু বললো না।এরপর নূর ওড়না নিয়ে আসতেই সবাই আরাবীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।
——-
মিউজিক বক্সে জোড়েশোড়ে গান বাজছে।তার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে আরাবীর অনেক আলিফা, নূর ও আছে সাথে রয়েছে আরো মেয়েরা।আরাবীর কাজিন আর জায়ানের কাজিনরা। আরাবীর সেন্টারে প্রবেশ করতেই চারপাশ থেকে ফুল ছিটাতে লাগলো সবাই।তবে আরাবীর নজর স্টেজের উপরে রাখা চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা মানুষটার উপর।সাদা পাঞ্জাবী,পায়জামা,উপরে নীল কোটি পরিহিত জায়ানকে কি সুদর্শন যে লাগছে আরাবী বলে বুঝাতে পারবে না।আরাবী আর জায়ানের ড্রেসও সেম সেম।আরাবীর হলুদ লেহেঙ্গায় নীল রঙের স্টোন, জারি সুতো আর সিকুয়েন্সের কাজ করা।সেই হিসেবেই জায়ানও এরকম ড্রেস-আপ করেছে।আরাবী যেন চোখ সরাতেই পারছে না।অথচ দেখো লোকটা কিভাবে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।যার জন্যে এতো সাজসজ্জা এতোকিছু করলো আরাবী।সেই তো ফিরে তাকাচ্ছে না।চোখ ভিজে উঠতে চাইলো আরাবীর। তাও নিজেকে সামলে নিলো।

আরাবীকে স্টেজের কাছাকাছি আসতে দেখেই ইফতি জায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ ভাই ভাবি এসে পরেছে।এরকম করছো কেন? একটু আগেই না তুমি ভাবিকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলে?এখন এমন করছো কেন? যাও ভাবিকে হেল্প করো স্টেজে উঠার জন্যে।’

জায়ানের কোন হেলদোল দেখা গেলো না।ইফতি এইবার জায়ানের বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
-‘ ভাই উঠো না।ভাবিকে হেল্প করো।যাও।’

জায়ান চোখ মেলে তাকালো ইফতির দিকে।ইফতি জায়ানের চোখ দেখে অবাক হয়ে গেলো।চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে জায়ানের।ইফতি ভাবলো জায়ান কি কোন কারনে রেগে আছে?কিন্তু কেন?একটু আগেও তো জায়ান স্বাভাবিক ছিলো।ইফতি অস্থির গলায় বলে,
-‘ ভাই কি হয়েছে তোমার?এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?’

জায়ান কপালে আঙুল ঘষে বলে,
-‘ নাথিং সিরিয়াস।জাস্ট একটু হেডেইক হচ্ছে লাউডস্পিকারের জন্যে।’
-‘ কফি খাবে ভাই?’
-‘ হু?নাহ, দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।’

ইফতি কিছুই বললো নাহ।তবে,ভীতরে ভীতরে বেশ চিন্তা হচ্ছে ওর ভাইয়ের জন্যে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাবী।

এদিকে জায়ান গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে এগিয়ে গেলো স্টেজের সামনে।আরাবী তাকালো জায়ানের দিক।লোকটার দৃষ্টি অন্যদিকে।একটাবার ভুলেও তাকাচ্ছে না আরাবীর দিকে জায়ান।আরাবী বহুকষ্টে নিজের কান্না ধরে রেখেছে। জায়ান হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আরাবী ওর হাত ধরছে না দেখে জায়ান এইবার দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
-‘ হাত ধরছো না কেন?’

চমকে উঠলো আরাবী।জায়ানের কন্ঠে যেন রাগ ঝড়ে পরছে।এতো রাগ লোকটার। আরাবী কাঁপা হাতটা জায়ানের হাতে রাখলো।জায়ান বেশ শক্তভাবে ধরেছে আরাবীর হাত।তারপর আরাবীকে প্রায় টেনে উঠালো স্টেজে।বেশ ব্যাথা পেলো আরাবী হাতে।তাও কিছু বললো না। জায়ান আরাবীকে নিয়ে স্টেজে বসিয়ে দিলো।ক্যামেরাম্যান তাদের ছবি তুলছে।সে বললো,
-‘ আপনারা একটু হাসুন।’

আরাবী জোড়পূর্বক হাসলো।তবে জায়ান সেইযে গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে।একটুও হাসলো না।ইফতি বলে উঠে,
-‘ আমার ভাই এমনিই।আপনি ছবি তুলুন।’

ক্যামেরাম্যান বেস কয়েকটা এইভাবে ছবি তুললো।এইবার বললো তাদের দাঁড়াতে বলে।দুজনকে নানানভাবে পোজ দেওয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দিলো।জায়ান এগিয়ে এসে আরাবীর কোমড়ে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে আনলো।জায়ানের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো আরাবী।তবে জায়ান সোজা সামনে তাকিয়ে।জায়ান আরাবীকে নিয়ে নানা রকম পোজ দিচ্ছে ছবি তোলার। তবে আরাবীর দিকে তাকাচ্ছে না কোনভাবেই।মুখশ্রী পাথরের মতো শক্ত করে রেখেছে।আরাবী আর সহ্য করতে পারলো না।ধরা গলায় বললো,
-‘ আমাকে কি এতোটাই বাজে লাগছে?’

জবাব নেই জায়ানের।আরাবী আবারও বলে,
-‘ অনেক বাজে লাগছে নাহ?ছাড়ুন আপনি আমায়।সাজসজ্জার কোন দরকার নেই। সব ধুয়ে মুছে আসি।’

আরাবীর কথা শুনে জায়ান চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-‘ চুপচাপ এখানে থেকে আমি যেভাবে যা করছি তার সাথে তাল মেলাও।বেশি বাড়াবাড়ি করো নাহ।মাথা এমনিতেই ঠিক নেই আমার।’

আরাবীর কান্না পাচ্ছে প্রচুর।তবে চাইলেও কান্না করতে পারছে নাহ।মূলত ও চাইছে না।আরাবী হাঁপানোর মতো করে বলে,
-‘ এমন করছেন কেন?তাকাচ্ছেন নাহ কেন আমার দিকে?আমি সরি তো।আর কখনও আপনাকে কষ্ট দেয় এমন কথা বলবো নাহ।’
-‘ আমি বলেছি তোমাকে সরি বলতে।’
-‘ এভাবে বলবেন নাহ। আমি কষ্ট পাচ্ছি।’
-‘ সেটা আগে ভাবা উচিত ছিলো তোমার।’

জায়ান গম্ভীর গলায় বললো।আরাবী নিচু স্বরে বলে,
-‘ আপনি যে আমার কথায় এতো কষ্ট পাবেন ভাবিনি আমি।আপনি রাগ করে থাকবেন নাহ। আমাদের জন্যে আজ একটা স্পেশাল দিন।আপনি এমন করলে কিভাবে হবে?’

জায়ান কোন উত্তর দিলো না।আরাবী আবার বলে,
-‘ আমার দিকে কি কোনদিন আপনি তাকাবেন নাহ?’
-‘ নাহ!’
-‘ সত্যি?’

জায়ান চুপ।আরাবী বললো,
-‘ বিয়ে কেন্সেল করে দেই।আপনি যেহেতু আমার দিকে আর কোনদিন……!’

বাকি কথা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না আরাবী।তার আগেই জায়ান থামিয়ে দিলো।জায়ানের হাত আরাবীর কোমড়ের দুপাশে ছিলো।জায়ান আরাবীর কোমড় স্বজোড়ে চেপে ধরে।প্রায় একপ্রকার খামছে ধরেছে।আরাবী ব্যাথায় আর্তনা’দ করে উঠলো। জায়ান রাগি গলায় বলে,
-‘ আর একবার এইসব ফালতু কথা বললে মে’রে ফেলবো একদম।’

আরাবী এইবার নিজের কান্না থামাতে পারলো নাহ আর।জায়ানকে সরিয়ে দিলো তৎক্ষনাত।চলে যেতে নিতেই আলিফা আর নূর জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছে ও?আরাবী ওয়াশরুমের কথা বলে চলে গেলো।কান্না থামাতে না পেরে আরাবী মুখে হাত চেপে ধরলো।দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।কেউ ওর কান্নারত মুখশ্রী দেখার আগেই ওর এখান থেকে যেতে হবে।
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#বোনাস_পর্ব
ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আরাবী।ভীষণ খারাপ লাগছে ওর।ও বুঝতে পেরেছে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে ও।এমন একটা মেসেজ দেওয়া ওর উচিত হয়নি।জায়ান এমন কোন কাজ করবে না যাতে ওর অসম্মান হয়।সেটা ও ভালোভাবেই জানে।কিভাবে যে পারলো এমন একটা মেসেজ করতে।চোখ লাল হয়ে গিয়েছে আরাবী।মেক-আপ ওয়াটার প্রুফ হওয়ায় সমস্যা হয়নি কোন।আরাবী ট্যিসু দিয়ে চোখ মুছে।হাতে পানি নিয়ে হালকাভাবে চোখ দিলো যাতে ওর মেক-আপ নষ্ট না হয়।এতে সবাই নানান প্রশ্ন করবে।নিজেকে স্বাভাবিক করে বেড়িয়ে আসলো ওয়াশরুম থেকে আরাবী।ধীর পায়ে হেটে এগিয়ে যেতে লাগলো স্টেজের দিক।হঠাৎ করে কেউ ওকে হেঁচকা টান দিয়ে একটা রুমে ঢুকিয়ে নিলো।ভয়ে, আতংকে চিৎকার করতে নিবে তার আগেই জায়ান তার শক্তপোক্ত হাত দ্বারা আরাবীর মুখ চেপে ধরলো।ধীরে বললো,
-‘ হুশ,চেচাবে না। এটা আমি।’

জায়ানকে দেখে আরাবী চোখ আবারও ভিজে উঠলো।ফুঁপিয়ে উঠলো আরাবী।জায়ান দ্রুত হাত সরিয়ে দিলো আরাবীর মুখ থেকে। আরাবী ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,
-‘ আমি অনেক সরি।আর করবো না তো।আমার কষ্ট হচ্ছে আপনি এমন করায়।আর করবো না তো। ‘

আরাবী কান্নারত অবস্থায় আরো কিছু বলতে নিবে তার আগেই জায়ান টেনে আরাবীকে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে আসলো।আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বলে,
-‘ তোমার সরি বলতে হবে না আর।আমি সরি।তোমাকে শুধু শুধু এতো কাঁদালাম।কান্না করেতো।এইযে এখন আমি তোমার কাছে আছি।’

আরাবী জায়ানকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। করুন গলায় বলে,
-‘ আর রেগে নেই?’
-‘ নাহ আর রেগে নেই।’
-‘ সত্যি?’
-‘ হ্যা,তবে আর কখনো এমন বোকামো করবে না।আমি মানুষটা খুব রাগি।রাগলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।তুমি আমাকে এমন একটা মেসেজ করেছো বোকার মতো।মেসেজটা পরে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি।সাথে ভীষণ রেগেও গিয়েছি।তুমি ভাবলে কি করে আমি তোমাকে কষ্ট দিবো এমন কিছু করবো?’

জায়ানের শীতল কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ যেন আরাবীর বুকে তোলপাড় সৃষ্টি করছে।ও আসলেই অবেক বোকা।জায়ান আরাবীকে ছেড়ে দিয়ে আরাবীকে সোজা করে দার করালো।তারপর নিজের হাতের মুঠো খুলে একটা মলম সামনে ধরলো ওর।আরাবী অবাক চোখে তাকালো।জায়ান নরম স্বরে বললো,
-‘ তখন বিয়ে কেন্সেল করে দিবে শুনে রেগে গিয়েছিলাম।তাই তোমার কোমড় খামছে দিয়েছি।এটা লাগিয়ে নেও।সেরে যাবে।’

জায়ান উল্টো দিকে ফিরে গেলো।যাতে আরাবীর অসস্থি না হয়।জায়ান ধীরে বলে,
-‘ চলবে নাকি আমি চলে যাবো?’

আরাবী কাচুমাচু হয়ে বললো,
-‘ ন..নাহ ঠিক আছে।’

আরাবী লেহেঙ্গার উপরের পার্টটা উঠালো।দেখলো জায়ান খামছে ধরায় একপাশ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।আরেক জায়গায় দেবে কেছে জায়ানের হাতের নখ।আরাবী জায়ানের দেওয়া মলমটা লাগিয়ে নিলো।তাড়াতাড়ি নিজেকে ঠিকঠাক করে নিয়ে বললো,
-‘ হয়েছে।’

জায়ান এইবার দ্রুত আরাবীর দিকে ফিরে গেলো।তারপর আরাবীর কাছে এসে ওর গালে হাত দিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,
-‘ ভীষণ সুন্দর লাগছে।অনেক অনেক সুন্দর।যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।’

জায়ানের কথা শুনে আরাবী হালকা অভিমানি কণ্ঠে বলে,
-‘ তখন তো তাকালেনই না।’
-‘ কে বলেছে তাকাইনি?’

চমকে উঠলো আরাবী,
-‘ মানে?’
-‘ তুমি সেন্টারে আসার সাথে সাথেই তোমাকে আমি দেখেছি।বিশ্বাস করো তোমাকে দেখে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।হ্যাং হয়ে গিয়েছিলাম আমি।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা বড্ড কঠিন হয়ে পরেছিলো।তাই তো তাড়াতাড়ি করে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম।’

কথাগুলো মুচঁকি হাসলো জায়ান।আরাবী মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখলো।হাসলে কি সুন্দর লাগে লোকটাকে।জায়ান আরাবীর একটা হাত ওর বুকের বা-পাশে রাখলো। আরাবী প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরবর্তীতে জায়ানের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে লাগলো।জায়ান নেশালো কণ্ঠে বলে,
-‘ অনুভব করছো?তোমাকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন কতোটা তীব্রভাবে করছে।’

তারপর হুট করে আবার আরাবীকে জড়িয়ে ধরে অস্থির গলায় বলে,
-‘ তোমাকে দেখলেই আমি আর আমার মাঝে থাকিনা আরাবী।নিজের সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলি।আমি আগে এমন ছিলাম না আরাবী।তুমি আমায় পালটে দিয়েছো।আমি পালটে গেছি।আমাকে সবাই ভয় পেলেও।আমি শুধু তোমার কাছেই হেল্পলেস।তোমার কাছে আসলেই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।’

আরাবী জায়ানের আবেগঘন প্রতিটা বাক্য শুনে কেঁপে উঠছে।একটা মানুষ ঠিক কতোটা ভালোবাসতে পারে কাউকে।তা জায়ানকে না দেখলে আরাবী জানতো না।আরাবীর ভীষণ লজ্জাও লাগছে এইভাবে জায়ানের বাহুডোরে থাকতে।তাই জায়ানকে ঠেলে সরিয়ে দিলো।মাথা নিচু করে নিলো লজ্জায়।জায়ান আরাবীকে লজ্জা পেতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। আরাবীর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
-‘ এতো লজ্জা পেও না।এরপর না আবার দ্বারা ভুল টুল হয়ে যায়।পরে তুমি আবার আমাকে কতোশতো কথা শুনিয়ে দেবে। শুধু আজকের রাতটুকু আরাবী।এরপর এরপর কাল আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না।একটুও না।নিজেকে তখন কোথায় লুকাবে? এতো লজ্জা পেলেও হবে না। আমি সব লজ্জা ভেঙ্গে দিবো।’

আরাবী শ্যামবর্ণের মুখশ্রীও যেন জায়ানের লাগামহীন কথাবার্তায় লাল হয়ে গিয়েছে।আরাবী দ্রুত উলটো দিকে ফিরে গেলো।লজ্জায় হাসফা’স করে বলে,
-‘ প্লি..প্লিজ থামুন না।দোহাই আপনায় আমায় আর লজ্জা দিয়েন নাহ।ম’রে যাবো।’

জায়ান বাঁকা হাসলো আরাবীর কথায়।তারপর নিজেকে দ্রুত জেন্টেলম্যান রূপে এনে আরাবীর হাত ধরে বলে,
-‘ চলো সবাই অপেক্ষায়।’

অতঃপর জায়ান আরাবী হাসিমুখে অনুষ্ঠানে হাজির হলো।সবাই বেশ খুশি।হলুদের অনুষ্ঠান বেশ আনন্দ উল্লাশে মেতে উঠলো।জায়ান আরাবীকে এর মাঝে একটু আধটু লজ্জা দিতে ভুলে নি।তাদের দুষ্টুমিষ্টি খুনশুটি আর সবার আনন্দ উল্লাশের মাধ্যমে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো আরাবী আর জায়ানের।

#চলবে_________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here