চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা নুপূর দাঁড়িয়ে আছে তার দ্বিতীয় স্বামীর প্রথম স্ত্রীর সামনে।ভয়ে সে ঘেমে একাকার।নুপূর বুঝতে পারছে না এই পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো উচিত।সে কিছু বললে এখন উল্টো হতে পারে।তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলো।
স্বার্থক প্রথম স্ত্রীকে বললো,”আলো,তুমি ভুল বুঝো না..”
আলো কিছু না বলে অশ্রুসিক্ত চক্ষু নিয়ে দৌঁড়ে রুমে চলে গেল।নুপূরের মনে হলো সে আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে বড্ড অন্যায় করেছে ফেলেছে।অবশ্য ছোট বেলা থেকেই সে অপরাধী।জন্মের আগে বাবা মারা গেল।জন্মের সময় মা মারা গেল।তাইতো চাচি সবসময় বলে সে অভিশাপ।আসলেই নুপূর অভিশাপ।
স্বার্থকের বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে।তার বাবা উঠে এসে কথা ছাড়া স্বার্থকের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,”তুমি এতটা নিচ?ছিঃ,লজ্জা হচ্ছে আমার।”
নুপূর খেয়াল করলো বৈঠক ঘরের সবাই একে একে চলে যাচ্ছে।তাকে কেউ স্বাগতম জানাচ্ছে না।কিন্তু একজন মহিলার চেহেরার কোনো ক্রোধ, দুঃখ নেই বরং বেশ হাসি হাসি।নুপূরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বুঝে নিলো এনি স্বার্থকের মা।তার পাশে দাঁড়ানো অন্য মেয়েটি হয়তো স্বার্থকের বোন হবে।
সবাই চলে গেলে তিনি তাদের দু’জনের সামনে এসে বললেন,”স্বার্থক বাবা,তুই ওদের কথায় কান দিস না।নুপূর মেয়েটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।তোরা ঘরে যা।”
স্বার্থক দ্বিধায় পড়ে গেল।তার রুম একটাই যেখানে বর্তমানে আলো আছে।নুপূরকে নিয়ে একই ঘরে যাবে?
তখন স্বার্থকের ছোট বোন বললো,”উনাকে আমি আমার ঘরে নিয়ে গেলাম।আসো আপু..”
.
আলো মুখে পানি দিচ্ছে অনবরত।সে কিছুতে মানতে পারছে না স্বার্থকের দ্বিতীয় বিয়ে।চার বছর প্রেমের পর বিয়ে করেছে দু’বছর হলো।স্বার্থকের জন্য সে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েছে।আর আজ…আজ সেই স্বার্থক তাকে ধোঁকা দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করলো?নাহ বিয়েটা তো আজ করেনি,করেছে ছয়মাস আগে।চার মাসের প্রেগন্যান্ট মেয়েটি।
হু হু করে কেঁদে উঠলো আলো।কিসের কমতি ছিল তার সংসারে?সব পুরুষ এমন কেন হয়?
বাঙ্গালী নারীরা আর যাই হোক নিজের স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দেয় না।আলো দু ক্ষণ ভাবলো।কিন্তু তার ভাবার আগা-মাথা নেই।সব উল্টো পাল্টা হয়ে যাচ্ছে।সমীকরণ কিছুতেই মিলছে না।বরং থেমে থেমে কান্না আসছে।
আলো মুখে পানি দেওয়া থামিয়ে দিলো।আজ সে কাঁদবে,অনেক কাঁদবে!
.
স্বার্থক গলা থেকে টাই খুলে ফেললো।তার মাঝে কোনো অপরাধবোধ নেই।সে জানে যা করেছে উচিৎ করেছে।এখানে দোষটা বরং আলোর।সে কেন ভুল বুঝবে তাকে?
স্বার্থক ঠিক করে রেখেছে।যতক্ষণ না আলো নিজ থেকে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে সে কিচ্ছুটি বলবে না।তার কর্ণে স্পষ্ট আসছে আলোর কাঁদার শব্দ।বাথরুমে ডুকরে কাঁদছে মেয়েটা।এতে স্বার্থক ভেবে পেলো না তার কী রিয়াকশন হওয়া উচিৎ।
কোনো শব্দ না করে স্বার্থক বাথরুমের দরজার ঠক ঠক আওয়াজ করলো।ওপাশে কান্নার গতি কমে আসলো।স্বার্থক অপেক্ষা করলো দরজা খুলার।
.
নুপূরের পরণে ছিল সুতির শাড়ি।এই গরমে তার গোসল দরকার।কিন্তু অপরিচিত এই বাসাতে গোসল সেরে কী পড়বে?
নুপূর দেখলো স্বার্থকের ছোট বোনটা খাটে বসে নিশ্চিন্তে ফোন টিপছে।অদ্ভুত মেয়ে তো!বাড়িতে এত অঘটন ঘটে গেল আর মেয়েটার মধ্যে কোনো রকম চিন্তা নেই!নুপূর ফিসফিস করে বললো,”এই;”
শব্দটা নুপূর নিজে শুনলো কি’না সন্দেহ।সে আবার ডাকলো।দ্বিতীয়বারে মেয়েটা উত্তর দিল।
-“কিছু বলবে?”
-“মা..মানে বলছিলাম যে..”
-“হ্যা বলো।”
চুপসে গেল নুপূর।কী বলবে মেয়েটাকে?’আমার কোনো কাপড় নেই,তুমি কাপড় দিবে?’খুব বাজে লাগলো নুপূরের কাছে বাক্যটা।তাছাড়া তার চেয়ে বয়সে বড় কী ছোট তাও জানেনা।হুট করে অচেনা কাউকে ‘তুমি’ বলা অভদ্রতা।
নুপূর মেয়েটাকে কিছু বলতে পারলো না।অসহায় ভঙ্গিতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।আপাতত হাত-মুখ ধুয়ে ফেলা যায়।
স্বার্থকের ছোট বোন নুপূরের এমন কর্মে ভ্যাবাচেকা খেল।সে এতদিন মনে করতো পৃথিবীতে সে একজনই অদ্ভুত সত্তার অধিকারী।এখন দেখলো ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রীও তার দলের।ডাকলো অথচ কিছু বললো না?আজব!
.
স্বার্থক আলমারি থেকে আলোর একটা শাড়ি নিয়ে নুপূরকে দিতে চাইলো।মেয়েটা এক কাপড়ে চলে এসেছে।শপিং করাতে পারেনি।শাড়ি নেওয়ার সময় আড়চোখে আলোর দিকে তাকালো।আলোর চোখ দু’টো লালা হয়ে আছে।
স্বার্থক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে যাওয়ার পর পা বাড়ালে আলো বললো,”তোমরা বরং এ রুমে থাকো।আমি স্বর্ণার কাছে যায়।”
আলো এ কথা বললো ঠিকই কিন্তু বিছানা থেকে উঠলো না।স্বার্থক কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেল।আলোর গাল বেয়ে আবারো জল গড়িয়ে পড়লো।
.
নুপূর হাত-মুখ ধুয়ে অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে নখ কামড়াচ্ছে।আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।মুখ দেওয়া পর তার চেহেরায় নতুন ঝলক এসেছে।আগের থেকে সুন্দর লাগছে।কিন্তু কী হবে এমন রুপ দিয়ে?যদি সে রুপই ধ্বংসের কারণ হয়!
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজে নুপূর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো স্বার্থক কক্ষে প্রবেশ করার অনুমতি চাইছে।নুপূর দেখলো ভাইয়ের আগমনে স্বর্ণা রুম ছেড়ে চলে যাচ্ছে।অদ্ভুত মেয়ে তো!
স্বার্থক কমলা রঙের শাড়িটি নুপূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,”গোসল করে এটা পরে নিন।অনেক ধকল গেলো আপনার উপর।”
নুপূর নিরুত্তর।স্বার্থক কী শুধু শাড়ি এনেছে?ব্লাউজ আর পেটিকোট?
প্রশ্নটা করতে চেয়েও নুপূর থেমে গেল।তার স্বামী হলেও স্বার্থক এখনো আপন মানুষ নই।সে চুপচাপ শাড়িটি নিলো।
স্বার্থক বললো,”আপনি মোটেও গিল্টি ফিল করবেন না,এটা আপনারও বাড়ি।”
-“আপনার স্ত্রী..”
-“আলো এখন কষ্ট পেয়েছে কিন্তু সকাল হতেই দেখবেন সবকিছু মেনে নিবে।আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস অনেক দৃঢ়।”
নুপূর কিছু বললো না।স্বার্থক আবারো বললো,”স্বার্ণা;মানে আমার ছোট বোন,একটু অদ্ভুত টাইপের।ওর ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না।আপনি গোসল সেরে খেতে আসেন।বেলা হলো।”
নুপূর উত্তর স্বরুপ ‘হু’ বললো।স্বার্থক চলে গেলে সে শাড়িটা খুলে দেখলো।এর মধ্যে পেটিকোট আর ব্লাউজ দুটাই আছে।সবকিছু আলোর হয়তো।শাড়ি থেকে পুরনো একটা গন্ধ আসছে।অনেকদিন আগে ব্যবহার করা হয়েছে মনে হয়।ভাবা বাদ দিয়ে সে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।প্রচন্ড খুদা লেগেছে।ঝটপট গোসল সেরে নেওয়া দরকার।
.
স্বার্থকের মা আসমা সিদ্দিকা তার নিজের স্বামীর অতন্ত্য বিরক্ত।আলো মেয়েটাকে তিনি নিজের মেয়ের মতো দেখেন।কী দরকার ছেলের বউকে নিজের মেয়ে মনে করার?বিয়ের দু’বছর হয়ে গেল অথচ এখনো নাতির মুখ দেখতে পারলো না।
বিড়বিড় করেই আসমা সিদ্দিকা নিজের আলমারির সামনে গেল।এই আলমারির শেষ কোণে দুটো লাল রঙের শাড়ি,সোনার বালা আছে।এগুলো আলোর জন্য কেনা হয়েছিল।কিন্তু মেয়েটাকে কোনো কারণ ছাড়া তিনি পছন্দ করেন না।তাই আর দেওয়া হয়নি।তবে নুপূর মেয়েটাকে প্রথম দেখায় বেশ পছন্দ হয়েছে।এটাও কারণ ছাড়া!
স্বার্থক তার মায়ের কাছে কোনো কিছু গোপন রাখে না।অথচ বিয়ের ছয় মাস পর জানলেন তিনি!এর জন্যও আসমা সিদ্দিকা দোষারোপ করলেন আলোকে।মেয়েটা তার ছেলের মাথা খাচ্ছে।
শাড়ি আর বালা নিয়ে রুম থেকে বের হতে চাইলে তার স্বামী শারদ ক্রোধ হয়ে বললেন,”তুমি শাড়ি-গয়না ঐ মেয়েটাকে দিতে যাচ্ছ?”
মেজাজ সপ্তম আকাশে চড়ে গেল আসমার।গলার স্বর উঁচু করে তিনি উত্তর দিলেন,”ও আমার ছেলের বউ,গর্ভবতী তার উপর।শাড়ি-গয়না তো নুপূরই পাবে।”
-“লজ্জা করে না তোমার আসমা?ছেলের এত বড় অন্যায় করেছে আর তাকে তুমি প্রশ্রয় দিচ্ছ?”
-“আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি বরং আলোকে বিয়ে করে যা অন্যায় করেছে তার… ”
-“চুপ করো আসমা।”
আসমা সিদ্দিকা আর কথা না বাড়িয়ে নুপূরের কাছে চলে এলো।নুপূরকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে তিনি বললেন,”শাড়ি?শাড়ি কোথায় পেয়েছ?”
নুপূর মাথা নিচু করে বললো,”উনি এনে দিয়েছেন।”
ছেলের এমন কান্ডে আসমা সিদ্দিকা অধিক খুশি হলেন।যাক!ছেলেটা তাহলে আলোর আঁচল থেকে নুপূরের আঁচলে বেঁধে থাকবে।
তিনি নুপূরকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখলেন।নুপূরকে বিয়ে করে স্বার্থক কেন যে এত দেরি করে আনলো…মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর!নুপূরের হাতে বালা পরিয়ে দিয়ে বললেন,”আজ থেকে এই সংসার তোমার।তোমার নিজের কোনো কাজ করতে হবে না।শুধু আরাম করবে,গর্ভবতী হলে কাজ করতে হয় না।এই শাড়ি দু’টো পছন্দ হয় কি’না দেখ তো..”
নুপূর দেখলো শাড়ি দুটিই লাল রঙের।খুব অপছন্দ করে এই রঙটি।তবুও শাশুড়ীর মন রক্ষার্থে বললো,”পছন্দ হয়েছে।”
দুঃখী দুঃখী মন নিয়ে আসমা বেগম বললেন,”কী আর বলবো!ছেলেটাকে আলো একদম নিজের করে ফেলে ছিলো।আমার কথা তো শুনতোই না উল্টো দোষ ধরতো তোমার শ্বশুর।আলোর বিয়ের দু’বছর হয়ে গেল এখনও নাতির মুখ দেখলাম না….”
আসমা সিদ্দিকা নিজের মতো করে আলোর বদনাম করতে ব্যস্ত।নুপূর মনে মনে শুধু বললো,”আমাকে নিয়ে আশা কেন করছেন?আমি তো অলক্ষী!আমার গর্ভে যে ছোট প্রাণটি পৃথিবীর আলো দেখার অধীর অপেক্ষায় বেড়ে উঠছে সে তো স্বার্থক বাবুর সন্তান নই।অন্য কারো অংশ সে!যাকে স্বার্থক বাবু নিজের পরিচয় দিচ্ছেন।”
@হৃদয় হরণী
#পর্ব_০১
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু