অখণ্ড তুমি পর্ব ২

#অখণ্ড_তুমি পর্ব ১
শারমিন আক্তার সেজৌতি

আজও বাইরে ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে, হুট করে কোথ থেকে একটা মাতাল, পাগলাটে দমকা হাওয়া এসে ঝড়ের বেগে বাইরের সব উড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মের তাপদাহে অঙ্গার হওয়া রাতের আকাশ বেয়ে এমন হুটহাট বৃষ্টি হয়, ঝড় আসে! এসে কালবৈশাখীর মতো সব উলটেপালটে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে নিমিষেই কেটে পড়ে। এরপরে ক্ষতির মাত্রা মোতাবেক মানুষ হাহাকার করে, পশুপাখি ও বোবা কান্নায় শোক কাটিয়ে উঠতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। দিনশেষে ক্ষতটা শুধু ক্ষতিগ্রস্তের মনেই দাগ কেটে বসে যায়, সময়ের প্রবাহে বাকিরা ঠিক সব ভুলে বসে ।

হাসপাতালের করিডোরে একটা ভাঙ্গা হাতলের চেয়ারে দু-হাত দিয়ে নিজের চোখমুখ জেঁতে ধরে বসে আছে ঈশিতা। বুকের মধ্যে একটা রেডিয়ামের ঘড়ি যেন টিকটিক করে প্রতি সেকেন্ডের হিসেব নিতে ব্যস্ত, এই ভারী বর্ষণের মধ্যেও ঈশিতার গলা বেয়ে ঘাম ঝরছে, ক্ষণিক পরপর ও নিজের চোখমুখ উলটে খুব কষ্ট করে একটা করে ঢোক গিলছে আর ওর চোখ বেয়ে গরম জলের ফোয়ারা পড়ছে। ঈশিতা বারবার নিজের হলদে পারের শাড়ির আঁচলটা টেনে এনে চোখের জলটুকু শুষে নিচ্ছে, ওর হাতের মেহেদীর রঙ ধুয়ে শাড়ির হলদে রঙটা নিজের রঙ বদলে ভিন্ন এক খাপছাড়া রঙে রাঙা হয়ে আছে।

হাসপাতালে জরুরি বিভাগ থেকে একজন পাতলা গড়নের, গোলগাল মুখের মধ্যবয়সী নার্স এসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুষ্ক মুখে জুয়েলের পরিবারের কাছে কী সব বলছে, ঈশিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিক্ষিপ্ত পায়ে এগিয়ে গেলো সবার দিকে, নার্সটা বলছে–

–“দেখুন অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। বা পায়ের হাঁটুর উপর দিয়েই ট্রাকের চাকাটা চলে গেছে। পায়ের পুরোটা একেবারে থেঁতলে গেছে, এই অবস্থায় পা’টা কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এই ঘটনা আপনাদের একটু আগেই ডাক্তার জানিয়ে গেছে কিন্তু আপনারা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানান নি উলটে জেদ ধরে আছেন অন্যভাবে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। এটা আসলেই সম্ভব না, এভাবে করে রুগীর অবস্থা আরো খারাপ হবে তখন কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। প্লিজ অপারেশনের জন্য ফর্ম সাইন করে দিন আপনারা, এত ডিলে করবেন না।”

নার্সের মুখ থেকে আসা শব্দগুলো ঈশিতার কানের পর্দায় বারি খেতেই ও নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারালো, যে মানুষটা সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায়, হাসিঠাট্টায় মজে থাকে সেই মানুষটার একটা অঙ্গহানি হতে যাচ্ছে, তাও এত আয়োজন করে! এ যেন কিছুতেই বিশ্বাস হবার নয়। ঈশিতা ছুটে গিয়ে নার্সের হাত জেঁতে ধরলো, ভেজা গলায় কাকুতি করে বলল,

— “পা’টা কি না কাটলেই না? আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলবো!”

নার্স ঈশিতার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলেন, এরপরে হাত দিয়ে জুয়েলের বাবাকে দেখিয়ে বললেন,

–“ওনারা এর মধ্যে কয়েকবারই কথা বলেছেন বোন, আপনি শান্ত হউন। প্লিজ বি সিটেড, ওখানে গিয়ে বসুন একটু। ডাক্তার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে কিন্তু আর বিলম্ব করা সম্ভব না।”

বলেই নার্স পেশাদারী ভঙ্গিতে করিডোর ছেড়ে জরুরি বিভাগে ঢুকে পড়লো। ঈশিতার কণ্ঠরোধ হয়ে আছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে। দু’টো শব্দও যেন মুখ-থেকে বার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তার জন্য শুধু চোখ বেয়ে নোনা জলের অস্তিত্বই টের পাচ্ছে সে। জুয়েলের মা হাসপাতালের করিডোরের মেঝেতে ছন্নছাড়া হয়ে বসে আছেন, তার চোখেমুখে কোনপ্রকার আবেগ নেই। ভাবলেশহীন ভাবে সে পাথরের মত মেঝেতে স্থির হয়ে আছে। জুয়েলের বাবা অস্থির হয়ে পায়চারী করছে সাথে জরুরি বিভাগের আশপাশে জুয়েলের যৌথ পরিবারের এক বিশাল সমাগম। এর মধ্যে কে ভাই, কে বোন বোঝা ভার। হাসপাতালের এদিক দিয়ে যে-ই যাচ্ছে সে এক পলক ঈশিতার দিকে চেয়ে থমকে যাচ্ছে, ওর সাজগোজ আর মুখচ্ছবি দেখেই খারাপ কিছুর আঁচ পাওয়া সম্ভব, অনেকটা সেজন্যই কৌতূহলি হয়ে ওকে ঘুরে দেখার চেষ্টা তাদের।

ঈশিতার চোখের সামনে একের পর এক স্মৃতি হাতড়াচ্ছে। জুয়েলের হাসিখুশি,প্রাণবন্ত মুখটা বারবার ওর দু চোখের সামনে ভেসে উঠছে, জীবনটাকে এই মুহূর্তে একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না ওর। মুহূর্তের মধ্যেই তিলেতিলে গড়া পূর্বোক্ত সমস্ত খুশি আর স্বপ্নের পাপড়িগুলো চোখের সামনেই ঝরে ঝরে আস্তাকুঁড়ে আছড়ে পড়ছে, সমস্তটা টের পেয়েও ওর এখানে কিছুই করবার নেই, ও এখানে নিতান্তই দর্শক অথচ যে মানুষটার জীবনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেই মানুষটা কত কাছের, কত আপন! ভাবতেই ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। জীবন যে বড় অদ্ভুত এক রহস্যের চাদর সেটা যেন আজ ঈশিতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

জুয়েলের অপারেশন শুরু হয়ে গেছে দেড় ঘণ্টা হল, এই পুরো সময়ে জরুরি বিভাগের বাইর থেকে শুধুমাত্র চাপা কান্নার আওয়াজই ভেসে এসেছে ঈশিতার কানে। ওর দু’চোখ এখন শান্ত, মুশলধারা বৃষ্টির পরে প্রকৃতি যেমন চুপ হয়ে যায় তেমনি থমকে আছে ঈশিতা ।

কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার ওটি থেকে এসে জানালেন,

–“বাম পায়ের অর্ধেকটাই কেটে ফেলতে হয়েছে আলিম সাহেব, আর কোন ওয়ে ছিল না আমাদের হাতে৷ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন যেন কোন প্রকার ইনফেকশন না হয়। বুকের ডান সাইডেও বেশ আঘাত পেয়েছে পেশেন্ট, মাথার পিছনের দিকের অনেকটা অংশ ছুলে গেছে। কাল সকালের মধ্যে সেন্স আসবে আশা করি আর এখন কারও ভিতরে না যাওয়া ই ভালো। পেশেন্টকে একটু পরেই বেডে শিফট করা হবে।”

কথাগুলো ঈশিতার কানের কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছে। ও তখনই বুঝে গিয়েছিলো জুয়েলের বা’পা টা আর রাখবেন না ডাক্তারেরা। সেটা বুঝেই ঈশিতার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা আসছে না। ডাক্তারের সাথে জুয়েলের বড় চাচা কথা বলছেন, জুয়েলের বাবা- মা একে অন্যের উপর লুটিয়ে অঝোরে কাঁদছে। বুকটা ধকধক করছে ঈশিতার।

পাশ থেকে আরও একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, কণ্ঠটা ঈশিতার বাবার–

–“বাসায় চল মা, এখানে জটলা পাকিয়ে আর কি হবে বল। চল বাসায় চল, কাল এসে দেখে যাস।”

মেঝেতে পা ফেলতেই ঈশিতা কোনো বল পাচ্ছিলো না, চোখের সামনের সব কেমন ঘোর লাগানো অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিলো তার। মানসিক অসুস্থতা তার সমস্ত দৈহিক শক্তিই যেন শুষে নিয়েছে। এলোপাতাড়ি পায়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে কোনক্রমে বাবার দিকে চেয়ে বলেছে-

–“আমি ওকে না দেখে যাব না,বাবা।”

ঈশিতার জড়ানো কথাগুলো শুনে বাবা মোটেও আশ্চর্য হন নি, তিনি ওকে আস্তে করে ধরে নিয়ে গেলেন জুয়েলের কেবিনের সামনে। কেবিনের সামনের দরজার কাঁচ দিয়ে ঈশিতা এক পলক দেখলো জুয়েলকে। ওর কোনো জ্ঞান নেই এখন, পা দুটো দু’দিকে সরানো আর একটা হালকা আকাশী রংয়ের কাপড় দিয়ে ঢাকা, বাইরে থেকে জুয়েলের অঙ্গহানির চিহ্নটা তাই বোঝা যাচ্ছে না। জুয়েলের মাথায়, হাতে ভারী ব্যান্ডেজ করা। ওর মুখটা কাত হয়ে বালিশে ঘেঁষে আছে।

ওই আকাশী রং এর কাপড়ের নিচেই জুয়েলের একটা পা এখন অসম্পূর্ণ, জুয়েল নিজেও সেটা জানে না। জ্ঞান ফিরতেই যখন ও নিজের এই অবস্থার কথা জানবে তখন ঠিক কি রিয়েক্ট করবে সেটা মনে হতেই ঈশিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুহূর্তেই দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতালের বাইরে। বাবা ওকে জোর করে টেনে গাড়িতে তুললেন, বাসায় ফিরতেই ঈশিতা নিজের ঘরে লক করে শাওয়ারের নিচে মেঝেতে বসে রইলো ঘণ্টাখানেক। শাওয়ারের পানির সাথে ওর চোখের কান্নার জল মিলেমিশে এক হয়ে মেঝেতে ঝরছে, পানির শব্দে ওর কান্নার আওয়াজটাও চাপা পড়ে গেছে।

সকালে দরজার লক ভেঙ্গে যখন ঈশিতার ঘরে বাবা মা আসলেন, দেখলেন মেয়ে ওয়াশরুমের মেঝেতে ভেজা কাপড়ে শুয়ে আছে।

————————————————————–

জুয়েলের এক্সিডেন্টের আজ চারমাস হতে চললো, সেদিন সকালে চোখ খুলেই ঈশিতা হাসপাতালে আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলো কিন্তু ওর শরীর তখন ভীষণ জ্বরে আচ্ছন্ন ছিল। শত চেষ্টা করেও অসুস্থ শরীরে বাসা থেকে বার হওয়ার অনুমতি আর সুযোগ কোনটাই মেলে নি তার। সপ্তাখানেক পরে ঈশিতা যখন জুয়েলের কাছে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল, জুয়েল তখন এক অপ্রত্যাশিত, নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল তার সাথে।

অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে রেখেই কাটা কাটা শব্দে বলেছে,

–“তুমি চলে যাও ঈশিতা। আমার কাছে আর কখনোই আসবা না, আমি আর সেই আগের মানুষটা নাই, আমি এখন পঙ্গু একজন মানুষ। আমার জীবনে প্রেম থাকতে নেই, ভালোবাসা আমার জন্য না। তুমি চলে যাও ঈশিতা, শুধুশুধু আমার আশপাশে এসে আর মায়া বাড়িও না, চলে যাও।”

ঈশিতা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে নি, যে মানুষটা ঈশিতা বলতেই অজ্ঞান ছিল! একটা ঝড় সেই মানুষটাকে ওর থেকে কতটা দূরে নিয়ে গেছে সেটা ভেবেই ও ফুঁপিয়ে কেঁদেছে জুয়েলের পাশে দাঁড়িয়েই কিন্তু জুয়েল একবারের জন্যও ওর দিকে ঘুরে তাকায়নি পাছে ও আরও ভেঙ্গে পড়ে তাই, পাছে জুয়েল নিজের কান্না সামলাতে ব্যর্থ হয়! সেই ভয়ে জুয়েল ঈশিতার দিকে তাকায়নি। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে নার্সের ইশারায় ঈশিতা চলে যেতে বাধ্য হয়।

বাসায় ফিরতেই ড্রয়িং রুমে লোকজনের সমাগম টের পায় ঈশিতা, একটু এগোতেই দেখা যায় বেশ আট দশজন মানুষের সাথে বাবা এক ভীষণ আলোচনায় ডুবে আছেন, আর আলোচনার বিষয়বস্তু ঈশিতার বিয়ে এবং ডাক্তার সুপাত্রকে নিয়ে!

ঈশিতা আরেক দফা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, এক ছুটে গিয়ে ড্রয়িংরুমে সকলের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপরে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে পাগলের মত বলে যায়,

–“আমি জুয়েলকেই বিয়ে করব। ওকেই বিয়ে করব। আমার জন্য অন্যকোনো ছেলে দেখার চেষ্টা করলে সেটা আমি কিছুতেই মেনে নিব না বাবা বলে দিলাম।”

ঈশিতার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই বাবা শান্ত গলায় বলে উঠলেন,

–“একটা ছাপোষা ঘরের পঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করবে? বিয়ের পরে নিজে কি খাবে? আর সন্তান মানুষ করবে কে? তুমি? একা! যে এখনো ভাত বেড়ে খেতে পারে না সে কোন সেন্সে একটা পঙ্গু ছেলেকে বিয়ের স্বপ্ন দেখে? ঈশিতা জীবন কোন ফিল্ম না, রূপকথার অংশ ও না। স্বপ্ন ছেড়ে বাইরে আসো, জুয়েলের সাথে তোমার বিয়ে কোনদিন ও সম্ভব না। আমি বেঁচে থাকতে এমন তো কখনোই হতে দিব না।”

ঘরভর্তি লোক ঠাণ্ডা চোখে ঈশিতার দিকে চেয়ে আছে। মনে হচ্ছে জুয়েলের সাথে বিয়ে ভাঙ্গার ব্যাপারটা এনারা সবাই ই জানেন, নতুন বিয়েতে এনাদের উৎসাহ ও বেশ। খুব সম্ভবত এনারা পাত্র পক্ষ!

সোফায় বসা এক ভদ্রলোক গ্লাসের পানিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন,

–“টেইক ইওর টাইম। মোস্ট প্রবাবলি ইউ উইল চেঞ্জ ইওর ডিসিশান উইলিংলি। বি প্রাকটিকাল মাই চাইল্ড!”

সাথেসাথে বাকিরাও তার সাথে সুর মিলিয়ে ঈশিতাকে উদ্দেশ্য করে জীবনের বাস্তবতা আর ড্রিমল্যান্ডের পার্থক্য নিয়ে কয়েক কথা বোঝাতে চেষ্টা করলেন। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঈশিতা উন্মাদের মত ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো, এসেই পিছন থেকে দরজাটা লক করে দিল আবার।

এদিকে বাবা ড্রয়িংরুমের আড্ডায় ঈশিতার সাথে রুম্মন নামের এক সদ্য বিদেশ ফেরত ডাক্তার ছেলের বিয়ের পাকা কথা সেরে ফেললেন ।

অখণ্ড তুমি
২য় পর্ব
শারমিন আক্তার সেজ্যোতি

আর এক পর্বেই শেষ করে দিব, বেশি হলে দুই পর্বে।🙂

———————————

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here