“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ৮
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালে তাকে বেতন দেওয়া হলো চার হাজার টাকা। থাকার জায়গা, খাওয়াদাওয়ার পরও চার হাজার টাকা পেয়ে ভীষণ খুশি শ্রাবণ। সে বুঝতে পারছে, এখন সাদাফের কাছে বোধহয় ভালো টাকা আছে তাইতো এতো দিলো। সাদাফ বেরিয়ে যাওয়ার পর শ্রাবণও বের হলো বাজারের উদ্দেশ্যে। এদিকের পথঘাট তার অচেনা। তাই আজ একটু ঘুরবে, নিজের জন্য কিছু কেনাকাটাও করবে। ভালো কোনো জামাকাপড় নেই তার। আধ পুরনো গুলো তুলে রেখেছে, কোথাও বের হলে পরে। আর বেশি পুরনো কিংবা ছেঁড়াকাটা সেলাইকরা জামাগুলো নিত্য পরে থাকে। আজ কিছু নতুন জামা কিনে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করবে। আধ পুরনোগুলো পরবে বাসায়। আশপাশ দেখতে দেখতে হাটছে সে। বাদাম দেখে বাদাম খেতে ইচ্ছে হলো তাই বাদামওয়ালাকে বললো,
“চাচা, পাঁচ টাকার বাদাম দেন তো।”
“পাঁচ টাকার বাদাম বেচি না গো খালা।”
“কয় টাকার বেঁচেন?”
“দশ টাকার বেশিতে।”
“আচ্ছা, দেন। দশ টাকারই দেন।”
বাদামওয়ালা বাদাম দিতেই বললো,
“এই কয়টা দশ টাকা! গণে গণে দশটাও তো হবে না!”
“নিলে নেন, না নিলে যান।”
টাকা দিয়ে কিনছে তা-ও কি দাপট! শ্রাবণ চোখ মটকে তাকিয়ে টাকা দিয়ে বাদাম নিয়ে চলে গেলো। হাটতে হাটতে বাদামগুলো গণে দেখলো একুশটা বাদাম উঠেছে দশ টাকায়। তাহলে পঞ্চাশ পয়সা করে পড়লো একটা বাদামের দাম। আর একটা ফ্রি এসেছে। খেতে খেতে দেখলো দুইটা পঁচা! তাহলে তো উনিশটা হলো! এখন একটার জরিমানা দিবে কে! পেছনে ফিরে দেখলো অনেকটা পথ চলে এসেছে, তাই জরিমানা আদায়ের চিন্তা বাদ দিয়ে সামনে হাটতে লাগলো। কাপড়ের দোকানে গিয়ে দুই সেট জামার জন্য কয়েক গজ কাপড় কিনে নিলো। একজোড়া সেন্ডেলও নেওয়া দরকার। সে জুতার দোকানে গিয়ে একজোড়া সেন্ডেল কিনে আবার বাড়ির দিকে হাটতে লাগলো। মিষ্টির দোকানে জিলাপি ভাজছে। গরম গরম জিলাপি দেখে শ্রাবণের খেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু দোকানের সামনে মোটামুটি ভীড়, সবই পুরুষলোক। কেউ ভীড় জমিয়েছে মিষ্টির দোকানের কারণেই, কেউ ভীড় জমিয়েছে একপাশে থাকা ডাবের ভ্যানের পাশে। একজন মহিলা মানুষের যাওয়ার মতো সুযোগ নেই এখানে। এই ভীড় ঠেলাঠেলির চেয়ে না খাওয়াই ভালো মনে করলো সে। বাজারের শেষ মাথায় এসে হঠাৎ একটা দোকান থেকে সাদাফকে বের হতে দেখা গেলো। সাদাফও তাকে দেখেছে। তাই এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি এখানে কেন?”
শ্রাবণ মুচকি হেসে বললো,
“পোশাকাশাক দরকার ছিলো তো, তাই একটু কেনাকাটা করতে আসছিলাম।”
“শেষ কেনাকাটা?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, যাও।”
“আপনি কি একটা কাজ করতে পারবেন?”
“কি?”
“ওইপাশের দোকান থেকে বিশ টাকার জিলাপি এনে দিতে পারবেন? খুব ইচ্ছে করছিলো খেতে। দোকানের সামনে অনেক লোকজন। তাই আমি যেতে পারিনি।”
সাদাফ ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানের দিকে তাকালো। তারপর বললো,
“আচ্ছা, টাকা দাও।”
শ্রাবণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললো। আঁচলে বাঁধা টাকা থেকে বিশ টাকার নোটটা নিয়ে তার হাতে দিলো। সাদাফ চলে গেলো আর শ্রাবণ মনে মনে তাকে আবারও খচ্চর লোক বললো। বিশটা টাকাও তার নিতে হবে! কেমন ছোটলোক! রাস্তাঘাটে আবদার করলে তো স্বেচ্ছায়ই কিনে দেওয়ার কথা! আবার টাকা কেন নিবে! পরিচিত লোক দেখলে তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করার কথা, কিছু খাবে কি-না! উল্টো কিনে দিতে বললো, তা-ও আবার টাকা নিয়ে গেলো! হৃদয়হীন ব্যক্তি। সৌজন্যতা বলতে কিচ্ছু বুঝে না।
সাদাফ ফিরে এসে তার হাতে প্যাকেট দিলে সে নিজেই সৌজন্যতার খাতিরে তাকে বললো,
“আপনি নিন, খান।”
“না। যাও।”
“বিশ টাকার এত্তোগুলা দিলো!”
“বিশ টাকার দেখলাম দুইটা উঠে। তোমার নাকি খুব ইচ্ছে করছে খেতে। দুইটায় কি হবে? তাই পঞ্চাশ টাকায় হাফ কেজি নিলাম।”
“ও… আচ্ছা। দাঁড়ান, ত্রিশ টাকা দিচ্ছি।”
“লাগবে না। যাও।”
মুহুর্তেই এতোক্ষণের ভাবনা পাল্টে গেলো শ্রাবণের! সে কৃতজ্ঞতার সাথে বললো,
“একটা অন্তত খান?”
“বাসায় রেখে দিয়ো, পরে খাবো।”
শ্রাবণ হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে চলে এলো। ফেরার সময় বাদাম ওয়ালাকে দেখে ইচ্ছে করছিলো জরিমানা নিতে। কিন্তু প্রমাণ তো নেই তার কাছে। পঁচা বাদাম তো ফেলে দিয়েছে! তাই জরিমানা না নিয়েই চলে এলো। ঘরে এসে প্রথমে জিলাপি খেলো। তারপর আবার কাপড়গুলো মেলে দেখতে লাগলো। নিজের কাছেই মনে হচ্ছে তাকে বেশ ভালো মানাবে এই কাপড়ে। এখন দর্জির কাছে দেওয়া প্রয়োজন। বাজারেই দোকানে দিয়ে আসতে পারতো কিন্তু পুরুষ লোকের কাছে দিবে না। দোতলায় বোধহয় একটা দর্জি মহিলা আছে, প্রায়ই মেশিনের খটখট শব্দ পাওয়া যায়। সে গোসল সেড়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দোতলায় এসে এক মহিলার কাছে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে সেলাই কাজ করে কে?”
মহিলা নিজেই জবাব দিলো,
“আমিই করি। কেন?”
“আমি দুইটা পোশাক দিতাম।”
“আসেন, ভেতরে এসে বসেন।”
শ্রাবণ পোশাকের মাপ দিয়ে চলে এলো। সাদাফ দুপুরে গোসল ও খাওয়াদাওয়ার জন্য বাড়ি এলেই শ্রাবণ জিলাপি নিয়ে গেলো তার রুমে। সাদাফ একটা রেখে বাকিগুলো তাকে দিয়ে দিলো। খাওয়া দাওয়া করে প্রতিদিনকার মতো আবার বেরিয়ে গেলো। মধ্যরাতে ফিরলো মাতাল হয়ে। আবারও মনটা খারাপ হয়ে গেলো শ্রাবণের। চাবি নিয়ে হেলেদুলে রুমের দিকে যেতে লাগলেও হোচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো লোকটা। শ্রাবণের বুকটা কেঁপে উঠলো। সে যাচ্ছিলো ধরতে কিন্তু সাদাফ নিজেই দেয়ালে ভর করে রক্ষা করেছে নিজেকে। রুমে এসে দরজাটা সজোরে লাগিয়ে দিলো। শ্রাবণ বুঝতেই পারছে আজ আর ভাত খাবে না সে। প্রায়ই এমন না খেয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। আর খাবারগুলো নষ্ট হওয়ার পথে যায়। কখনো বাসি খাবার খেয়ে নেয় শ্রাবণ, কখনো বা নষ্ট করে ফেলে দিতে হয়। সামর্থ্য থাকতেও খেয়ে না খেয়ে কাটায় দিন। এভাবেও কি কারো জীবন চলে? ভাবতে গেলে তার ভীষণ কষ্ট লাগে। এমন ভেবে ভেবে কষ্ট পেয়ে পেয়েই দিনদিন লোকটার প্রতি মায়া বাড়ছে তার।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর শ্রাবণ লক্ষ্য করলো সাদাফের চোখ লালচে হয়ে আছে। রাতে ঘুমাতে পারেনি নাকি ঠিকমতো? খাবার দিতে দিতে ভাবছে সে। সাদাফের রুমে খাবার নিয়ে গেলে সাদাফ প্লেটে দুমুঠো পরিমাণে ভাত রেখে বাকিগুলো ফিরিয়ে দিলো। শ্রাবণ ভাতের বাটি এগিয়ে ধরে বললো,
“এটুকু কি নিলেন! আরও কিছু নিন। রাতেও খাননি।”
বিপরীতে সে ঠেলে দিয়ে বললো,
“না, আর নিবো না। এটুকুই খাবো। যাও। ভালো লাগছে না খেতে।”
শ্রাবণ ফিরে এলো। রান্নাঘরে এসে নিজে খেয়ে নিলো। সাদাফ সপ্তাহে দুদিন মাছভাত খাবে বললেও তা করছে না। যখন ইচ্ছে হচ্ছে নিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে একটু বেশি পরিমাণে আনলে শ্রাবণ পাশের ঘরের ভাড়াটিয়ার ফ্রিজে সংরক্ষণে রেখে আসে। নিত্যদিনকার মতো খেয়েদেয়ে লোকটা সাথে সাথেই বের হয়েছে। কিন্তু আজ কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এসেছে বাসায়। এসে এসময় গোসল করলো। তারপর দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শ্রাবণ কাপড় নাড়তে এসে জানালা দিয়ে দেখতে পেলো তাকে। এসময় ঘুম! আজ হঠাৎ কি হলো, খটকা লাগছে শ্রাবণের। ইচ্ছে করছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে আসতে। কিন্তু কোন অধিকারে জানতে যাবে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। সাদাফ কি দিবে নাকি তার দাসীকে ভালোমন্দের জবাব! যদি বিরক্ত হয়ে উল্টো ধমকে দেয় তখন কি হবে!