অজানা তুমি পর্ব ১৯+২০

#অজানা_তুমি
#রুবাইতা_রুহি (ছদ্ননাম)
#পর্ব -১৯

আমাকে টানতে টানতে জেলের ভিতরে ছুড়ে মারলো ওরা।ভিতরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার।আমার পাশের জেলগুলোতেও অনেক মহিলা আসামীরা আছে।তাদের মাঝে বিভিন্ন ঝগড়া,মারামারি,কাটাকাটি লেগেই রয়েছে।এদের দেখে সারা শরীর শিউরে উঠছে।এরা যে কতোটা হিংস্র সেটা তাদের আচরণ এবং চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।হাটু ভেঙে বসে পড়লাম।বুক ফেটে কান্না আসছে কিন্তু চোখ থেকে এক ফোটাও পানি পড়ছে না।ভিতর ভিতর গুমড়ে মরছি।আজ মা-বাবা থাকলে এই পরিস্থিতিতে আমাকে দেখে সহ্য করতে পারতেন না।ভালোই হলো ওনারা চলে গেছে নাহলে নিজেদের সন্তানের এই চরম পরিহাস দেখতে হতো।আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।নিঃশ্ব হয়ে গেছি।আর কিচ্ছু নেই আমার কাছে।মাঝে মাঝেই মাথায় প্রশ্ন আসে এখনো কেনো বেচে আছি?আল্লাহ তায়ালা কেনো আমাকে তার কাছে নিয়ে যান না!এই সার্থপর পৃথিবীতে একা একা কিভাবে বেচে থাকবো আমি?কিভাবে?এই গভীর অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসছে।মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি ওয়ালের একদম উপরে ছোট্ট একটা জানালা আছে।সেখান থেকে মৃদু আলো ভেসে আসছে।ফ্লোরের এক সাইডে সাদা একটা চাদর বিছানো।সেইটা থেকে খুব দূর্গন্ধ বের হচ্ছে।ময়লায় চাদরটি কালো রূপ ধারণ করেছে।ভ্রু কুঁচকিয়ে মাথা সোজা বরাবর তাকালাম।আমার ঠিক সামনে জেলের মধ্যে আরেকটি মহিলা পরনে সাদা শাড়ি খুলছে আর পাগলের মতো নিজের শরীরে নখের আছড় দিচ্ছে।কোনো সময় দেয়ালে কপাল ফাটাচ্ছে তো কোনো সময় নিজের চুল ছিঁড়ছে।তখনই মহিলাটি আমার দিকে হীংস্র দৃষ্টিতে তাকালো।আমি সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলাম।আর বসে থাকতে পারছি না।শরীর প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।চোখের সামনে কালো পর্দা নেমে আসতে চাইছে তবুও জোর করে খুলে রাখার চেষ্টা করছি।এক সময় ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লাম।

_______________________

বড় একটি অন্ধকার রুমে লাল রংয়ের তীব্র পাওয়ারের লাইট জ্বলছে।মাথার উপরে মাঝারি গতিতে ফ্যান চলছে।রুমটি বলতে গেলে একদম খালি।কিন্তু তাকালে অস্ত্র আর বিভিন্ন ধারালো ছুড়ি ছাড়া কিছুই চোখে পড়বে না।রুমের ঠিক মাঝখানে একটি রকিং চেয়ারে বসে আছে একজন।চোখে মুখে তার তীব্র হীংস্রতা যেন ছুঁয়ে দিলেই ধ্বংস করে দেবে সবকিছু।রাগে ফোস ফোস করছে সে।সেই সাথেও চোখ দুইটা ছলছল করে উঠছে।ভিতরে চলছে প্রতিশোধের তীব্র নেশা।প্রতিশোধ খুবই খারাপ যা কোনো মানুষকে নিমেষেই নিংশ্বেষ করে দিতে পারে,ভেঙে দিতে পারে নিজের প্রিয় মানুষগুলোর সাথে গভীর সম্পর্ক। নিজেও বুঝতে পারে না রাগে,ক্ষোভে দিক বেদিক ভুলে কোন পথে চলে যাচ্ছে সে।তার ভিতরে জ্বলতে থাকে শোধ নেওয়ার আগুন।বসে থাকা মানুষটি টেবিল থেকে একটি সিগারেট নিয়ে মুখে পুড়ে নিজের কষ্টগুলো ধোয়ায় উড়িয়ে দিলো।এরকমই কতো রাতের সঙ্গী হয়েছে এই ধোয়া তার কোনো হিসেব নেই।ধীরে বলে উঠলো

-“”দেখ এখন নিজের প্রিয় মানুষটা দূরে চলে গেলে কতটা কষ্ট হয়।সেটা এখন হারে হারে টের পাবি তুই।আমাকে কষ্ট দিয়েছিলি না?এতিম বানিয়ে দিয়েছিলি।এখন তুইও বুঝবি এর কষ্ট কতোটা।””

বলে বিস্রিভাবে হাসিতে ফেটে পড়লো রিদ্রিশ।চোখ অজানা এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।ভিতর ভিতর কষ্টে মরে যাচ্ছে সে।পৃথিবীর সবাই খারাপ কেউ ভালো না।তাই তো এইখানের খারাপ মানুষগুলো তাকে এতিম বানিয়ে দিয়েছে।যাকে ভাই বলে সারাদিন পাগলামি করতো।তার ভাই কি করতো না করতো সব খেয়াল রাখতো।সেই ভাই কিভাবে পারলো এটা করতে?কিভাবে তার মা-বাবাকে মেরে ফেললো?ফ্লোরে বসে পড়লো রিদ্রিশ তারপর ওয়াইনের বোতল দিয়ে নিজের পিঠে একের পর এক আঘাত করতে লাগলো।

____________________________

হঠাৎ ঠাস করে কিছুর সাথে কপালে লেগে ধীরেধীরে চোখ খুললাম।সামনে বাসি রুটি আর সবজির থালা সেটাই মাথায় লেগেছে।একটি মহিলা ছুড়ে ফেলেছে হয়তো।আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে খেতে ইশারা করলো তারপর আবার গড়গড় গ্রিল লাগিয়ে পুনরায় ঘুট ঘুটে অন্ধকার বানিয়ে চলে গেলেন।এখন দিন কি রাত কিছুই বুঝতে পারছি না।উঠে বসার বসার মতো শক্তিটুকু শরীরে পাচ্ছি না।খাবার থেকে গন্ধ বের হচ্ছে।দুই হাত মুখে দিয়ে ডুকরে কেঁদে দিলাম।পেটেও প্রচুর ক্ষিদে লেগেছে।এই সবই খেতে হবে।নাক সিটকে রুটি ছিঁড়ে ভাজি লাগিয়ে মুখে দিলাম।ওমনি বমি চলে এলো।থালাটাকে সরিয়ে আবার লুটিয়ে পড়লাম ফ্লোরে।জানি না কতোদিন এভাবে থাকতে হবে। আদেও ছাড়া পাবো কি না।হয়তো এর জন্য কোটে মামলা হবে।মনে হচ্ছে কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি।

দীর্ঘ ৮ ঘন্টা পর,

একটি মহিলা এসে জেলের গ্রিল খুলতে লাগলেন।চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলাম।উনি আমাকে বের হতে ইশারা করছেন।আমাকে কি বের হতে বলছেন?ছাড়া পেয়ে গেছি?তাহলে সবাই বুঝতে পেরেছে যে আমি নির্দোষ?আশ্বানিত হয়ে ধীরেধীরে উঠে বসলাম।

__#অজানা_তুমি
#রুবাইতা_রুহি (ছদ্ননাম)
#পর্ব – ২০

আমি পুলিশটার ভাবভঙ্গি লক্ষ করতে করতে বেরিয়ে এলাম।পুলিশটি এখন তুই থেকে আপনি করে কথা বলছে এবং খুব সম্মানও করছে।ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

-“”ম্যাম চলুন।আপনার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে।এবং আমরা প্রচন্ড দুঃখিত খারাপ বিহেভের জন্য।পারলে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।””

ওনার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম।সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো আমার জীবনে এই দশ ঘন্টার ব্যবধানে।ধীর
পায়ে হেটে হেটে জেলের বাইরে বের হচ্ছি।মনে হচ্ছে অনেক বছর পর ছাড়া পেয়েছি।আমার মুক্তি দেখে আশেপাশে বন্দি থাকা মহিলারা বিভিন্ন খারাপ কথা বলছে।জেলের গ্রিল হাত,পা দিয়ে লাথি দিচ্ছে আর আমার দিকে বিক্ষিপ্ত নজরে তাকাচ্ছে।আমি মাথা নুইয়ে নিলাম।ঝাপসা দেখছি সবকিছু।হঠাৎ হোচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই মহিলা পুলিশটি আমাকে ধরে নিলেন।মাথায় বিভিন্ন চক্কর বক্কর চলছে।বের হয়ে ইন্সপেক্টরের রুমে ঢুকতেই উনি দাড়িঁয়ে গেলেন।এবং বিভিন্নভাবে ক্ষমা চাইতে লাগলেন।এখানে পরিচিত কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছি।মাথা উঠিয়ে তাকাতেই বুকে ধুক করে উঠলো।চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।হৃদয় ভয়ংকরভাবে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো।গলা কেপে কেপে উঠছে।আর বেশিক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।অভিমানের তীব্র কালো মেঘ জমে গেছে মনে।কারণ সামনে আয়রান অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে আছে ভিন্ন ধরনের অনুতপ্ততা।আমি মাথা নামিয়ে রাখলাম আর তখনই আমার পায়ের কাছে এক ফোটা পানি টপ করে পড়লো।উনি আবার কেনো এলেন?কেনো?সবতো নিজ হাতে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম।আবার কেনো?এক মিনিট আমি কি ওনার আসাটাই চাইছিলাম না?কিন্তু আমি বাইরে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখালেও ভিতরে তো ওনাকেই চাই আমার পাশে।একটু জায়গা পেতে চাই ওনার বুকের এক কোণায়।দেবেন কি!কেনো এতো দেরি করলেন আপনি?আমার মনের অবস্তাটা কি একবারো বুঝতে পারেন নি?

আয়রান ইন্সপেক্টরের সাথে কিছু কথা বলে আমার হাত ধরে বাইরে চলে এলো।তাহলে কি উনিই আমাকে ছাড়িয়েছেন?আমাকে ভুল বুঝলো নাতো?নির্লিপ্তভাবে হেটেই চলেছেন।কোনো কথা বলছেন না।কিন্তু এতে তো আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।গাড়ির কাছে এগিয়ে হাত ছেড়ে দিলেন।

চারপাশে নিভু নিভু আলো।ভোর ৪,৫ বাজে হয়তো।রাম্তাঘাট একদম খালি।অদ্ভুত একটি শীতল বাতাস এসে আমার লোমকূপকে বরফ করে দিচ্ছে।একদম নিস্তব্ধ, নিরব পরিবেশ।চারদিকে মৃদু আওয়াজ তুলে পাখিরা কিচিরমিচির করছে।দুইজন চুপ করে মাথা নিচু করে দাড়িঁয়ে আছি।আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে।তাই মাঝে মাঝে কেপে উঠছি।আয়রান আমার দিকে পিঠ দিয়ে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে।হঠাৎ করেই আয়রান ঘুরে আমাকে ঝাপটে ধরলো।আচমকা এরকম হওয়ায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম।আয়রান আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে দাড়িঁয়ে আছে।বুকের ভিতর এক ধরণের প্রশান্তির বাতাস বয়ে যাচ্ছে।তবুও পাথরের মতো দাড়িঁয়ে রইলাম।আয়রান আমাকে জরিয়ে কাধে মুখ ডুবিয়ে প্রায় অনেকক্ষণ দাড়িঁয়ে রইলো।তারপর ধীরেধীরে মুখ তুলে আমার চোখের দিকে তাকালো।আমি মাথা নিচু করে দাড়িঁয়ে আছি।আয়রান হাত দুটো আমার গালের উপর রেখে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলো।তখন এক ফোটা পানি আমার গাল বেয়ে পড়ে গেলো।চমকে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি উনি চোখ বন্ধ করে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন।গাল,নাক ফুলে টকটকে লাল হয়ে গেছে।এই মুহুর্তে ওনাকে প্রচন্ড মায়াবী লাগছে।আমি শক্ত হতে চেয়েও দূর্বল হয়ে পড়ছি।আয়রান চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে ডেকে উঠলো

-“”নুরিপাথর!””

ছলছল চোখে ওনার দিকে তাকালাম।উনি করুণ দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন।আমাকে আবার নিজের বুকের সাথে ঝাপটে ধরে ধরা গলায় বললেন

-“”আই এম সরি নূরিপাথর!আমি!আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি।আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গিয়েছে।অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না?””

হাত,পা কাঁপছে আমার।আয়রান আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে।আয়রান আমাকে আরো শক্ত করে ধরে বললো

-“”আর কোনো দিন কষ্ট পেতে দেবো না আমি তোমাকে।কোনোদিন না।চলো আমার সাথে।আজকেই তোমাকে আমি বিয়ে করবো।””

_____চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here