অজানা তুমি পর্ব ৩১+৩২

#অজানা_তুমি
#রুবাইতা_রুহি (ছদ্ননাম)
#পর্ব -৩১

রিদ্রিশ মাতাল হয়ে আবোল তাবোল বকছে আর পিস্তল রুহির মাথায় ত্যাক করে রেখেছে।রিদ্রিশ তার মসৃন চুলগুলো পিছনে নিয়ে বলতে লাগলো

-“জানো তোমার জানেমান নিজের হাতে আমার ভালোবাসা আর আমার মা,বাবাকে মেরে ফেলেছে।কবে আমার বুড়ি দাদুটাকেও মেরে ফেলে ঠিক নেই।তার আগেই ওকে আমার মারতে হবে।”

আমি হতবাক হয়ে বসে আছি কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার।তখনই রুমের দরজাটা কেউ ঠাস করে খুললো।চেনা কারো গন্ধ নাকে আসতেই মাথা ঘুরিয়ে দেখি আয়রান।আয়রান পা টিপে টিপে আসতে লাগলো যাতে রিদ্রিশ টের না পায়।এসে আমার হাতে পায়ের দড়িগুলো খুলতেই রিদ্রিশ টের পেলো।ভয়তে পিলে চমকে উঠলো আমার।রিদ্রিশ চোখ বড় বড় করে পিস্তল দিয়ে ভুল বশত আয়রানের পায়ে গুলি করতেই আয়রান লাফ দিয়ে সরে গেলো।রিদ্রিশ চিল্লিয়ে বলতে লাগলো

-“পেয়েছি আজ তোকে।মেরে গুম করে দেবো।প্রস্তত হ।1,2,3!”

ট্রিগার চাপ দেওয়ার আগেই রিদ্রিশ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো আমি অবাক হয়ে আয়রানের দিকে তাকিয়ে দেখি সে পকেটে হাত গুঁজে দাড়িঁয়ে আছে।যেনো এটা হবে সে জানতো।আমি বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম

-“এটা কি হলো?রিদ্রিশ মানে এরকম সেন্স হারালো কিভাবে?আর আর আপনি নাকি খুনি?নি নিজের মা বাবাকে মেরেছেন?প্রিমা কে?ওকেও নাকি মেরেছেন?কি হলো উত্তর দিন!আপনি কি করেছেন রিদ্রিশের সাথে?ও কেনো এরকম বলছে আপনার নামে?”

আয়রান রুহির লাফালাফি দেখে দুই হাত রুহির কবজি ধরে বললো -“সাট আপ।ঠান্ডা হও।আগে রিদ্রিশকে হসপিতালে নিতে হবে।তারপর সব বলছি তোমাকে।লেটস গো।”

আয়রান রিককে কল করে এখানে আসতে বললো।রিক এসে রিদ্রিশকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো।আয়রান রুহির হাত ধরে বললো -“চলো।”

গিয়ে বসে পড়লাম আয়রানের পাশে।মাথায় আকাশ সমান প্রশ্ন।পিছনে রিদ্রিশ অচেতন হয়ে পড়ে আছে।আয়রান পিছনে রিদ্রিশের দিকে একবার স্থির চোখে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।এদিকে মাথা আমার ভনভন করে ঘুরছে।বুক ফেটে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে।কি হয়েছিলো আমার সাথে এতোদিন?রিদ্রিশ কেনো আসতো রাতে আমার কাছে?আমি পিছনে দৃষ্টি দিয়ে রিদ্রিশকে দেখতেই ওনার কানের দিকে নজর পড়লো।এক কানে ছোট এয়াররিং আছে।যেটার একটা আমার কাছে।তারমানে ওইদিন আমি স্বপ্ন দেখি নি।রিদ্রিশ সত্যি আমাকে কলেজ থেকে ওই অচেনা জায়গায় নিয়ে মারতে চেয়েছিলো।আয়রানও সব জানে কিন্তু আমাকে মিথ্যা বলছে।সবকিছু ক্লিয়ার হচ্ছে ধীরেধীরে আমার কাছে।আয়রানের দিকে তাকিয়ে দেখি সে স্থীর দৃষ্টিতেই গাড়ি চালাচ্ছে।খয়েরী চোখগুলোর দৃষ্টি একদম সামনের রাস্তায়।হসপিটালে পৌছে আয়রান রিদ্রিশকে কাধে তুলে ডক্টর ডাকলো।ডক্টর রিদ্রিশকে চেক আপ করে বললো

-“ওনার অবস্থা তো খুবই শোচনীয়।উনি তো প্রচুর পরিমাণে ড্রাগস নিয়েছেন।আর একটু হলে তো ওনার মৃত্যুও হতে পারতো।তারাতারি ওনাকে ভর্তি করাতে হবে।”

-“তো করুন না।এতো দেরি করছেন কেন?আমার ভাইয়ের জীবন বাচান। নইলে আমি আপনার চাকরি খেয়ে ফেলবো।”

রিদ্রিশের হাতে ছোট ছোট ইন্জেকশনের দাগ।প্রচুর ড্রাগ নিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।ডাক্তার তারাতারি ভর্তি করালো।আয়রান মাথায় হাত চেপে বসে পড়লো চেয়ারে।আমি গিয়ে ওনার পিঠে হাত রাখলাম।আমি তো অবাক হচ্ছি।জমজ হয় শুনেছি কিন্তু সবকিছু এতোটা নিখুঁত হুবুহু দেখতে কিভাবে হয়?শুধু রিদ্রিশের খয়েরি চোখ নেই।আয়রান বলা শুরু করলো

-“শোনো তাহলে।”

ফ্লাসব্যাক

রিদ্রিশ পিঠে ব্যাডমিন্টনের ব্যাগ নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে বেরোচ্ছিলো।মিসেস রুমি মানে রিদ্রিশ আর আয়রানের মা বললেন -“ওই বাদর ছেলে খেয়ে যা।খেয়ে না খেয়ে সারাদিন ব্যাঙের মতো লাফায়।এই তারাতারি খেতে আয়।আমাকে আর তোর বাবাকেও বের হতে হবে।”

রিদ্রিশ -“মা পরে খেয়ে নেবো।আমার দেরি হচ্ছে।আমি যাই।”

বলে বের হতে নিলেই দাদি এসে কান চেপে ধরলো রিদ্রিশের।বাধ্য হয়েই খেতে বসতে হলো।তখন দুই বাপ বেটা মানে আয়রান আর মি. নওয়াজ হাতের ঘড়ি ঠিক করতে করতে দুই বিজন্যাসম্যান নামলো সিঁড়ি থেকে।

মিসেস রুমি -“ওই নামলো দুই বাপ বেটা আসেন আপনারা খেতে।”

রিদ্রিশ -“ব্রো জানো আজকে আমাদের ফাইনাল রাউন্ড।”

আয়রান -“তাই নাকি?ভালো করে খেলবি কিন্তু।ট্রফি আনতে হবে।”

রিদ্রিশ -“হ্যা ভাই।তোমার মতো কোচ আমাকে ট্রেইন করেছে না পেরে থাকা যায়?”

আয়রান -“শয়তান ছেলে খা জলদি।”

রিদ্রিশ হেসে মাংসের এক টুকরা আয়রানের প্লেটে তুলে দিয়ে কানে কানে বললো -“ভাই এইটা খেয়ে নে না।আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।এত্তগুলে খাওয়ার সময় নেই।”

আয়রান -“বাদর ছেলে।”

তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো।মিসেস রুমি খুলে খুশি হয়ে বললেন -“আরে প্রিমা যে!এসো এসো।”

প্রিমা -“জ্বি আন্টি।”

রিদ্রিশ তাকিয়ে দেখে বললো -“আরে প্রিমা তুমি!এখন?তোমার হাতে লাগেজ কেনো?কোথায় যাচ্ছো?”

প্রিমা লাগেজ নিয়ে ঢুকে বললো -“তোমরা খাচ্ছো?মনে হয় ডিস্টার্ব করে ফেলেছি।আসলে রিদ আমি কয়েকদিনের জন্য লন্ডন যাচ্ছি।ইম্পরট্যান্ট কাজ পড়ে গেছে।তোমাকে কল দিচ্ছি তুমি ধরছো না।তাই সোজা দেখা করতে তোমার বাসায় চলে এলাম।”

রিদ্রিশ -“কিহ?লন্ডন যাচ্ছো?আমাকে তো একবারও বললে না?”

প্রিমা -“আরে ফোন তো দিচ্ছিলাম তুমিই তো ধরো নি।”

মি.নওয়াজ -“আচ্ছা তোরা থাম।প্রিমা মা এসো আমাদের খেতে বসো।”

প্রিমা -“না আংকেল খেয়েই এসেছি।রিদ্রিশ তুমি কি আমার সাথে একটু এয়ারপোর্ট যেতে পারবে?”

রিদ্রিশ তো মুশকিলে পড়ে গেলো।
রিদ্রিশ -“কয়দিনের জন্য যাচ্ছো?”

প্রিমা -“ওইতো দুইদিনের জন্য।”

রিদ্রিশ -“আমি তো মনে হয় যেতে পারবো না প্রিমা।আসলে আমাদের ফাইনাল রাউন্ড চলছে।জরুরি যেতে হবে।এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।”

আয়রান -“হেই তুমি দাড়িঁয়ে আছো কেন?বসো?”

প্রিমা -“না না ভাইয়া আমারও লেট হয়ে যাচ্ছে।”

রিদ্রিশ -“আচ্ছা ভাই তুই প্রিমাকে একটু এয়ারপোর্ট ড্রপ করে দিতে পারবি?”

আয়রান -“হ্যা অবশ্যই পারবো না কেন?”

প্রিমা -“তুমি গেলে ভালো হতো।”

মিসেস রুমি -“তুই যাবি নাকি?মেয়েটা এতো কষ্ট করে এলো।”

রিদ্রিশ -“না মা।আমি অবশ্যই নিয়ে যেতাম।ওকে আমি প্রতিবারই এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দেই আজকে আর পারবো না।”

প্রিমা মুখ গোমড়া করে রইলো।রিদ্রিশ উঠে প্রিমার হাত ধরে বললো -“শোনো সুইটহার্ট আমি পারলে অবশ্যই নিয়ে যেতাম।এরকম কোনোদিন হয়েছে বলো যে আমি তোমাকে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাই নি?সরি সুইটি।আজকে ভাইয়ার সাথে চলে যাও?”

প্রিমা -“বাদর ছেলে।লন্ডন থেকে আসি তারপর তোমার খবর আছে বলে দিলাম।হুহ!”

রিদ্রিশ হেসে দিয়ে বললো -“আচ্ছা বেবি।আমি এখন যাই।ভাইয়ার সাথে চলে যেও।গিয়ে কল দিও ঠিক আছে?”

প্রিমা -“আচ্ছা।”
#অজানা_তুমি
#রুবাইতা_রুহি (ছদ্ননাম)
#পর্ব -৩২

মিসেস রুমি -“ওই প্রিমাকে ড্রপ করে আমাকেও ড্রপ করে দিবি।রাকিবের তো খোজ নাই।”

আয়রান -“আচ্ছা আচ্ছা দেবো।বাবা,আম্মু,প্রিমা তোমাদের হয়ে থাকলে চলো।”

সবাই বেরিয়ে পড়লো।প্রিমা পিছনের সিটে বসলো।তার সামনের সিটে মিসেস রুমি আর মি. নওয়াজ আর ড্রাইভিং সিটে আয়রান পাশের সিটটা খালি।ওই সিটটা রিদ্রিশের জন্মগত প্রোপার্টি। ওইখানে কেউ বসতে পারে না।তঁবে সুযোগ পেলে বসেই যায়।আয়রান গাড়ি স্টার্ট দিলো সবাই বিভিন্ন গল্প করছে।হাসাহাসি করছে মজা করছে।আয়রান ফোনে কথা বলছিলো।হাইওয়ে তো উঠে গেলো আয়রান।আগে এয়ারপোর্টে যাবে।রাস্তায় আয়রানের এক বন্ধু অনিকের সাথে দেখা হলো।

আয়রান -“হেই ডুড!তুই এখানে?অফিসে যাবি না?”

অনিক -“আরে হ্যা।দেখিস না গাড়ি পাচ্ছি না একটাও।বাইকটাও রিপেয়ার করতে দিয়েছি।”

আয়রান -“তো উঠে আয়।আমার পাশে সিটে বসে পড়।”

অনিক বসতে নিলেই প্রিমা বলে উঠলো -“এই এই ওইটা আমার রিদ্রিশের সিট।”

অনিক কিছুটা অপমানের দৃষ্টিতে আয়রানের দিকে তাকালো।আয়রানও ভ্রু কুঁচকে প্রিমার দিকে তাকিয়ে রইলো।প্রিমা মেকি হাসি দিয়ে বললো -“আরে আমি মজা করছিলাম।আসলে ওইখানে ও কেউকে বসতে দেয় না তো তাই বললাম।আপনি বসতে পারেন।”

বলে প্রিমা লুকিয়ে মুখ ভেংচি দিলো।সেটা মিসেস রুমি খেয়াল করলেন।মেয়েটা মাঝে মাঝে কেমন কেমন যেনো হয়ে যায়।ভালো মনে হলেও আবার কোথা থেকে যেনো খারাপ মনে হয়।রিদ্রিশ তো পাগলের মতো ভালোবাসে তাই কিছু বলেন না।অনিক ইতস্তত করে বাধ্য হয়েই বসে পড়লো।এখন এই হাইওয়ে তো কাহিনী করলে এক্সিডেন্ট হতে পারে।এছাড়া নিজেরও বিপদ।তাই উঠেই বসলো।আয়রান গাড়ি স্টার্ট দিলো।আবারও ফোন বেজে উঠলো।

মিসেস রুমি -“কিরে?হাইওয়ে তে গাড়ি চালাচ্ছিস।এতো ঘনঘন ফোনে কথা বলিস না!বিপদআপদ একটা হয়ে গেলে।”

কথাটা হয়তো আয়রানের কান পর্যন্ত যায় নি।ফোন ধরতে গিয়ে ব্রেক হারিয়ে ফেললো।একটুর জন্য পাশের ওয়ালগুলোতে ধাক্কা লাগেনি।মিসেস রুমি পিছনে তাকিয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।সাথে মি.নওয়াজ আর প্রিমা তাকিয়ে চিৎকার করতে নিলেই বড় মাপের একটি বাস পিছন থেকে ওদের ধাক্কা মারলো।আয়রান সামলে নেওয়ার আগেই গাড়ির স্টেয়ারিং এর সাথে মাথায় আঘাত পেলো।মুহুূর্তেই সবাই এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলো।সেকেন্ডেই সবকিছু ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো।একটু অসতর্কতার জন্য হারিয়ে গেলো অনেকগুলো প্রাণ।ধুলোয় মিশে গেলো কারো সবথেকে প্রিয়,ভালোবাসার মানুষগুলো।রাস্তাটায় বড় একটি বিষ্ফোরণ হয়ে নিরব হয়ে গেছে চারদিক।

এইটুকু বলেই আয়রান রুহির হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।রুহি অবাক হয়ে আয়রানের মাথাটা নিজের কাধে চেপে ধরলো।ছেলেরা কাঁদলে এতো কষ্ট হয় কেনো?সহ্য করা যায় না কেনো?তারা কাঁদে না এরজন্য?আর সেখানে যদি সে তার ভালোবাসার মানুষ হয় তাহলে তো কথাই নেই।আয়রান কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে বললো

-“বাঁচাতে পারি নি আমি রুহি। কিভাবে পারলাম আমি এটা করতে…..?”

আয়রানের শরীর কেপে কেপে উঠছে।সেটা দেখে আমার চোখের কোণেও তরল কিছুর অনুভব করলাম।হসপিতালের লোকগুলো আয়রানের অবস্থা দেখে হাই হুতাশ করছে।কয়েকজন মজা নিচ্ছে।আয়রানের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।সে আবার বলা শুরু করলো:

আয়রান লোকদের চিল্লা চিল্লিতে পিটপিট করে তাকালো।মাথা তার প্রচন্ডভাবে ঘুড়ছে সাথে ব্যাথা আর রক্তক্ষরণ তো আছেই।তখন মৃদুভাবে শুনতে পেলো

-“আরে আরে এতো বেচে আছে।তারাতারি হসপিটালে ভর্তি করাতে হবে।”

আয়রান ভাঙা গলায় বলার চেষ্টা করলো -“ম মা!বাব বাবা কোথায়?”

কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না।আয়রানের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।আবার সেন্সলেস হয়ে গেলো।

জ্ঞান ফেরার পর চোখের সামনে ঝুলন্ত ক্যানোলার ব্যাগ আর ঝাপসা চোখে অনিনকে ক্ষত অবস্থায় দেখতে পেলো।অনিকের মাথায় আঘাত লেগেছে সেখানে সাদা ব্যান্ডেজ করা।উপর থেকে স্বল্প রক্তের ছাপ ভেসে আছে।আয়রানের হাতে পায়ে তীব্র ব্যাথা হওয়ার সত্তেও উঠে বসলো।অনিক ধরে বসিয়ে দিলো।

অনিক -“ব্যাটার ফিল করছিস?”

আয়রান -“আম্মু বাবা কোথায়?প্রিমা?”

অনিক -“ওনারা আছেন!তোর কেমন লাগছে বল?!

আয়রান -” আমি ওনাদের সাথে দেখা করবো।নিয়ে যা একটু আমাকে।”

অনিক -“আরে যাবি।আগে একটু রেষ্ট নে।আমি ডাক্টারকে ডেকে আনছি।”

বলে আয়রানকে আশ্বস্ত করে উঠে বেরিয়ে গেলো।দরজার সামনে আড়চোখে একবার আয়রানের ক্ষত হওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো।

আয়রান মাথায় হাত দিয়ে ব্যাথা অনুভব করলো।শরীর প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।আয়রান নিজের দিকে তাকিয়ে নীল রংয়ের হসপিটাল ড্রেস দেখতে পেলো।বাম হাতের আঙ্গুলগুলোতে প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে।শেষের সবথেকে ছোট্ট আঙ্গুলটাতে কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না।আয়রান হাত উঁচিয়ে ওই ছোট্ট আঙ্গুলে বড় মাপের একটা ব্যান্ডেজ দেখতে পেলো।কি হয়েছে এখানে?এতো অস্বস্তি আর ব্যাথা কেনো করছে?আয়রান ব্যান্ডেজ ধরে একটু টান দিতেই পুরোটা খুলে গেলো।আর বেরিয়ে এলো রক্তাক্ত অর্ধেক হয়ে যাওয়া আঙুল।দেখেই আয়রানের পিলে কেপে উঠলো।সারা শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো।নিজের হাতের দিকে তাকাতে নিজেরই বাজে লাগছে।ভেঙে গেছে আঙুলের উপরের অংশ।আয়রান হাত নামিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকালো।সহ্য করতে পারছে না এসব।

আয়রানের কথা মাঝখানেই রুহি ফট করে আয়রানের বাম হাত ধরে দেখে সত্যি ওই ছোট্ট আঙুলটা নেই।ছলছল চোখে আয়রানের দিকে তাকাতেই রুহিকে জরিয়ে ধরলো আয়রান।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো রুহি।আয়রানও জীবনে কম কষ্ট ভোগ করে নি।রুহি ভাবতো শুধু ওর জীবনটাই মা-বাবা ছাড়া কষ্টের।কিন্তু এখন ধারণাটা সম্পূর্ণই বদলে গেছে।আয়রান রুহিকে চেপে ধরে বলতে লাগলো

-“জানো?যখন অনিকের কথা বিশ্বাস না করে কেবিন থেকে উঠে বাইরে বের হয়েছিলাম তখনই নিজের মৃত মা বাবার মুখের সামনাসামনি হয়েছিলাম।সাদা কাপড় দিয়ে মা বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।তারপরই প্রিমার খুবলে যাওয়া মুখটা দেখে ফ্লোরে বসে পড়লাম।নার্সরা আমাকে বাইরে বের হতে দেখে দৌড়ে এসে উঠিয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে চাইলেই আমি তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে মাকে জরিয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে চুপচাপ বসে ছিলাম।মনে মনে ভাবছিলাম মা আমার এখনো বেচে আছে।এখনই রিদ্রিশকে ধমক দিতে বলবে,কান মুলে দিতে বলবে।সারাদিনের ব্যাস্ততার পর মায়ের হাটু জরিয়ে বসে রইতাম সব ক্লান্ত দূর হয়ে যেত।জানো মজার কথা কি ছিলো?মা প্রতিদিন আমাকে জিগ্যেস করতো অফিসে বা অন্য জায়গায় কেউকে পছন্দ হয়েছে নাকি?তখন আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম।সেই মা চুপচাপ শুয়ে রয়েছে।ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না।কান্নাও পাচ্ছিলো না।অনুভূতিহীন হয়ে মাকে ঝাপটে ধরে ছিলাম।সবাই আমাকে জোর করে উঠাতে চাইছিলো।কিন্তু আমি তো তাদের সাথেই যাবো।তখন অনিক এসে আমার সাথে জোরজবরদস্তি করতে লাগলো।আমি পাগলের মতো চিৎকার করে সবাইকে লাথি,কামড়,ধাক্কা দিচ্ছিলাম।শেষে অনিক আর না পেরে আমার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় মেরেছিলো।হুশ আসতেই চিৎকার কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে পড়েছিলাম।মা বাবা হারানোর কষ্ট যে কতোটা বেশি সেটা একমাত্র যার নেই সেই বোঝে।তাও তারা আমার ভুলের জন্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে।কিভাবে ক্ষমা করি নিজেকে?আজও স্বপ্নে তাদের কে দেখি।কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আর পাই না।জানো রিদ্রিশ প্রিমাকে কতোটা ভালোবাসতো?আমার!আমার জন্য রিদ্রিশ তার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে।রিদ্রিশ ঠিকই তো বলে কোনো অধিকার নেই আমার এই পৃথিবীতে বেচে থাকার।আমি কারো ভালোবাসার মূল্য দিতে পারি না।রিদ্রিশ যখন এসব শুনে হসপিটালে এসেছিলো।তখন আমার সামনে দাড়িঁয়ে ইচ্ছেমতো আমাকে চড় মেরেছিলো।আমি বাধা দেই নি।তারপর থেকেই ও খেলাধুলা বাদ দিয়ে খারাপ কাজে জরিয়ে পড়ে ঠিক আমার উপর রাগ,অভিমান আর প্রতিশোধের জন্য।ড্রাগসের ব্যাবসা করতো।মানুষ খুন করতো।আমি জানতাম সবকিছু তবুও পুলিশকে এসব ব্যাপারে কিছুই জানাতাম না।কিন্তু আমি এটা জানতাম যে ও নিজেও ড্রাগস নেয়।আমার জন্যই আজকে ওর এই অবস্থা।কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না নিজেকে।কোনোদিন না!

বলতে বলতে আয়রান নিজের চুলগুলো খামচে ধরলো।আয়রানের কাধে হাত রেখে বললাম

-“নিজেকে দোষ দিও না।তোমার কোনো দোষ নেই এখানে।তুমি তো ইচ্ছে করে ওনাদের মারো নি!তোমার অসতর্কতার জন্য প্রিমা আর ওনারা মারা গেছেন।তুমি রিদ্রিশকে বলো নি যে তুমি ইচ্ছে করে এটা করো নি?”

-“বলেছিলাম অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু ওতো আমার কথা বিশ্বাস করবে না।তখন ওর মাথায় শুধু প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিলো।তোমাকে প্রিমা ভেবে প্রতিরাতে যেতো তোমার কাছে।যেদিন এটা আমি জানতে পারি ঠিক সেদিনই তোমার রুমে গিয়ে দরজা,জানালার সবকিছু তালা লাগিয়ে দেই।”

-“ওহহহহহহ!এর জন্যই আমাকে আসামীদের মতো বন্দি করেছিলেন!”

-“তো কি করতাম?আমাদের এই শত্রুতার হিতে তুমিও তো জরিয়ে যাচ্ছিলে।রিদ্রিশ তোমার কোনো ক্ষতিও করতে পারতো।

-“নিজের ভাইয়ের উপর বিশ্বাস নেই?

-“ছিলো।কিন্তু এটা সেই আগের রিদ্রিশ না সে এখন সম্পূর্নই হিংস্র একজন মানুষ।ওর ধারে কাছে যে যাবে সেই শেষ হয়ে যাবে।”

-“আচ্ছা ওইদিন আমি স্বপ্ন দেখি নি তাই না?ওইযে ওই সাদা বিল্ডিয়ের নিচে রিদ্রিশ আমাকে মারতে চেয়েছিলো তাই না?আপনি আমাকে মিথ্যা কেনো বলছেন?”

-“আমি চেয়েছিলাম কথাগুলো লুকিয়ে যেতে কিন্তু তুমি কিভাবে যেনো যেনে গেছো।ও তোমাকে মারতে চেয়েছিলো কারণ ও জানতো আমি তোমাকে ভালোবাসি।তাই প্রিমাকে মারার প্রতিশোধ ও তোমার উপর দিয়ে নিতে চেয়েছিলো।তোমাকে মেরে ও আমার উপর প্রতিশোধ মেটাতে চেয়েছিলো।কিন্তু ভাগ্যের জোরে তোমাকে ওইদিন আমি বাচাতে সখ্যম হই।”

-“ওওও তারমানে আপনিও আমাকে ভালোবাসেন তাই না?”

আয়রান চোখের জল ফেলছিলো আর কাপাকাপা গলায় কথা বলছিলো আমার কথা শুনে যেনো চেহারার রং বদলে গেছে।খয়েরি চোখগুলো আরো গভীর হচ্ছিলো।আয়রান চোখ ঘুরিয়ে কথা কাটিয়ে বললো

-“ওইসব কথা বাদ দাও।”

-“না না!তুমি এখনই বলবে।”

-“এটা এখন ওই কথা বলার জায়গা নয় নুরিপাথর।এটা হসপিটাল এখানে কতো দুর্গন্ধ,ময়লা,কতো মানুষ অসুস্থ।এতো মুল্যবান এই শব্দটা এইখানে বলে তার মুল্য আমি কমাতে চাই না।”

আমি ঠোঁট চেপে হেসে কথা ঘোরাতে চেষ্টা করছি কারণ আয়রানের এই কষ্টেভরা কথাগুলো আর শুনতে ইচ্ছে করছে না।আগের সেই ‘হেইহেই’ করা আয়রানকে খুজছি আমি। দেখো কাঁদতে কাঁদতে চেহারার কি অবস্থা করেছে।আমি আয়রানের মুখটা ওরনা দিয়ে মুছে হসপিটালের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।চারদিকে আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে।হসপিটালের সাদা লাইটগুলো জ্বলে উঠছে।তখন ডাক্টার আসলেন।আয়রান উত্তেজিত হয়ে দাড়িঁয়ে জিগ্যেস করলো

-“রিদ্রিশ কেমন আছে?”

ডাক্টার তার টাক মাথা চুলকে বললো
-“উনি এখন ব্যাটার আছেন।কিন্তু ওনাকে এই ড্রাগস থেকো ১০০ মাইল দূরে রাখতে হবে।ওই ড্রাগসের গন্ধও এখন ওনার মৃত্যুর কারণ হতে পারে।এতে উনি প্রচুর পাগলামি করবেন।কারণ আমি যা বুঝেছি ওনাকে রাতে ড্রাগস দেওয়া হতো।তাই ওই ঠিক সময়ই উনি পাগলামি শুরু করবেন।ইনজেকশন নিতে চাইবেন।উনাকে সামলাতে আপনাদের একটু কষ্ট করতে হবে বটে।কিন্তু ঠিক হয়ে যাবেন উনি।ওনাকে একটু যত্ন করে রাখবেন,ঠিক মতো খেতে দেবেন।মাথায় বেশি চাপ দিবেন না।এছাড়া উনি এক ধরণের মানসিক ডিপ্রেশনে আছেন।ওইখান থেকে বের করে আনতে হবে।ওনার অতীতে ঘটে যাওয়া মানে উনি যাদেরকে ঘৃণা করেন তাকে ওনার সামনে যেতে দেওয়া যাবে না।তাতে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি ওইগুলো খাওয়াতে হবে প্রতিদিন।আশা করি বোঝাতে পেরেছি।”

-“জ্বি।আমি কি ওকে একটু দেখতে পারি?”

-“হ্যা!কিন্তু বাইরে থেকে।ভিতরে যাওয়া যাবে না।”

আয়রান বাইরে থেকে তার প্রাণপ্রিয় ছোট্ট ভাইটাকে এই অবস্থাতে দেখে বুকে তীব্র আঘাত অনুভব করলো।রিদ্রিশের এই অবস্থার জন্য শুধু সে দায়ী।সে আজকে না থাকলে সবাই খুশি থাকতো।না কোনো এক্সিডেন্ট,না যেতো কোনো প্রাণ,রুহিও ভালো থাকতো।

___চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here