অজানা তুমি পর্ব শেষ

#অজানা_তুমি
#রুবাইতা_রুহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব -৩৫ (শেষ)

(একদম শেষের কথাগুলো পড়ার অনুরোধ রইলো।দয়া করে পড়বেন।)

ভোর পাঁচটার সময় দাদি আর নুরানি এসে হাজির। মানে এখনো সকালই হয় নি তার আগেই চলে এসেছে। রাতে মনে হয় ঘুমাতেও পারে নি। আয়রান বাইরে চেয়ারে বসে আমার কাধে মাথা রেখে ঝিমাচ্ছে। সারা রাত ছোট ভাইকে পাহাড়া দিয়েছে। এখন তো ঘুমাবেই স্বাভাবিক। রিদ্রিশ উঠে গেছে। বাইরে থেকে গ্লাস ভেদে ওকে দেখতে পাচ্ছি। চুপচাপ কাত হয়ে শুয়ে আছে। আর সারারুমে চোখ বুলাচ্ছে। ইস মনে হচ্ছে আমি আয়রানকে দেখছি। কিন্তু আমার জামাইটা তো আমার কাধেই মরার মতো ঘুমাচ্ছে। বেচারাদের জন্য সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। দাদি আর নুরানি আসতেই আয়রান উঠে গেলো। ঢুলছে তবুও দাড়িঁয়ে গেলো। আমি দাদিকে বললাম “তোমরা এতো ভোরে চলে এসেছো যে?”

নুরানি -“আরে দাদিই তো আসার জন্য পাগল হয়ে গেছে। একদম ছোটকে বাসায় নিয়ে তারপরই শান্ত হবে।”

দাদি -“ইস তোরা এতো কথা বলসি কেন?দাদুভাই কি করছে ভিতরে?নিশ্চই একা একা বসে আছে। তোরা বাইরে কেন?ভিতরে গিয়ে ওর সাথে বসতি।”

বলে দাদি ভিতরে চলে গেলো। ফস করে শ্বাস ফেলে আয়রানের দিকে তাকিয়ে দেখি সে মাথা নিচু করে ঢোক গিলছে। রিদ্রিশ আবার দাদিকে দেখে চোখ বন্ধ করতে নিলেই দাদু হরহর করে বলে উঠলো

-“এই এইইই একদম না। একদম চোখ বন্ধ করবি না। আমার সাথে কথা বল। সারারাত ঘুমানো ছিলি। তোর সাথে একটু মন খুলে কধাও বলতে পারি নি। তা দাদাভাই এখন কেমন লাগছে?”

রিদ্রিশ শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো -“ভালো।”

দাদি মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। তারপর রিদ্রিশের হাত ধরে বললো
-“দাদাভাই!তোর আমাকে মনে আছে?”

রিদ্রিশ দাদির হাসিমুখখানা দেখে বললো
-“মনে থাকবে না কেন?”

-“নাহ তুই তো কতোদিন আমাকে দেখিস নি। কিন্তু তুই এটা কিভাবে করতে পারলি দাদাভাই?”

-“কি করেছি?”

-“তুই এভাবে কি যেনো ইনজেকশন নিয়ে নেশা করতি। ওইগুলো করলে নাকি মানুষ অসুস্থ হয়ে যায় মারাও যায় নাকি! বল তুই এটা কেনো করলি?এইযে তোর হাতে কত্তগুলো ফুটো।”

রিদ্রিশ কিছু বললো না। মনের অজান্তেই দাদুর সাথে কথা বলতে তার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে।

সবাই মিলে রিদ্রিশকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। এইটুকু সময় দুই ভাই একই গাড়িতে এসেছে এমনকি আয়রানের কাধের সাহায্য নিয়েই রিদ্রিশ গাড়ি পর্যন্ত এসেছে। তবুও দুই ভাইয়ের মুখে কোনো কথা নেই। একটিবার তাকায়ও নি। এসব দেখে দাদি নিরবে চোখের জল ফেলেছে। রিদ্রিশ একমাত্র নুরানি আর দাদির সাথেই কথা বললো। নুরানিকে নিয়ে তার কি কথা কতো আদর,যত্ন করলো দুই ভাই বোন। ওদিকে আয়রান গাড়িয়ে চালিয়েছে একদম গম্ভীর মুখে চোখ মুখ একদম শক্ত ছিলো। কিন্তু আমি তো তার অবস্থা কিছু হলেও আচ করতে পারছি। বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে আয়রান আবার রিদ্রিশকে ধরতে নিলে রিদ্রিশ এড়িয়ে চলে গেলো। আয়রান চুখ মুখ লাল বানিয়ে দাদি আর নুরানিকে বের করলো। তারপর গাড়ি গ্যারেজে রেখে আমাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো।

ওদিকে এতোদিন পর নিজের বাড়িতে পা রাখতেই রিদ্রিশের আবার সেই ছোটবেলার সৃতিগুলো মাথায় চাড়া দিয়ে উঠলো। মনে মনে ভালো লাগছে প্রচুর। নিরাপদ আর শান্তির স্থান যেনো এটাই। মিসেস রুমি আর মি. নওয়াজ এর কথা মনে পড়তেই রিদ্রিশের চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। নুরানি দৌড়ে এসে রিদ্রিশকে জরিয়ে ধরে বললো -“ভাই চল পুরো বাড়িটা তোকে ঘুরে দেখাই। আর তোর রুমটা দেখিয়ে দেই। চল!”

বলে দুই ভাই বোন সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। দাদি সব সার্ভেন্টেদর এই সকালে উঠিয়ে রান্নার কাজে লেগে পড়লো। তার ছোট নাতিটা ফিরে এসেছে!ভালো মন্দ খাওয়াতে হবে না?তাই রিদ্রিশ যা যা পছন্দ করে সব রান্না করতে প্রস্তুত হতে লাগলেন।
হঠাৎ আয়রানের কথা মনে পড়তেই পিছনে তাকিয়ে দেখি সে নেই। আরে গেলো কোথায়?আমাদের সাথে তো আসছিলো। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি মহাশয় নায়কের পাট নিয়ে সুইমিংপুলে দুই হাত পকেটে গুঁজে দাড়িঁয়ে আছে। আমি দৌড়ে আসতে আসতে বললাম -“এই তুমি এখানে?চলো ভিতরে!বাইরে অনেক রোদ। সুইমিংপুলের সামনে দাড়িঁয়ে আছো কেন?পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে নাকি?”

আয়রান পকেটে হাত গুঁজেই আমার দিকে গম্ভীর মুখ করে বললো -“তোমাকে যদি এখন এই পানিতে ছুড়ে ফেলে দেই। উঠতে পারবে?”

রুহি হাসতে হাসতে আয়রানকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে ভো দৌড় দিলো।

বিকালে রিদ্রিশ খেয়েদেয়ে বিছানাতে শুয়ে আছে। তখন নিচে কলিংবেলের আওয়াজ শোনা গেলো। দাদি দরজা খুলতেই অনিককে দেখতে পেলো।

দাদি -“আরে বাবা তুমি?”

অনিক -“হ্যা আসলাম রিদ্রিশের সাথে দেখা করতে। ওকে নাকি পাওয়া গেছে। তাহলে দুই ভাইয়ের ভিতরকার ভুল বোঝাবোঝি ভেঙেই দেই।”

দাদি -“মানে?”

অনিক -“আয়রান বাসায়?”

দাদি -“নাহ তো। রুহি আর ও বাইরে গেছে।”

অনিক -“ওহ তাহলে রিদ্রিশের সাথে দেখা করতে পারি?”

দাদি -“হ্যা অবশ্যই।”

অনিক মুচকি হেসে চলে গেলো উপরে। রিদ্রিশ বিছানার উপর বসে গেইম খেলছিলো। অনিককে দেখে সোজা হয়ে বসলো।

রিদ্রিশ -“তুমি?”

অনিক -“হ্যা আমি।”

রিদ্রিশ -“বসো।

অনিক বসলো। তারপর রিদ্রিশকে স্ক্যান করে বললো -“এখন কেমন আছো?”

রিদ্রিশ -“আছি ভালো।”

অনিক -“হুম। ভালো হলেই ভালো। শোনো তোমার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।”

রিদ্রিশ -“কি কথা?”

অনিক -“তুমি এই তিন বছর ধরে তোমার ভাইকে ভুল বুঝে আসছো।”

রিদ্রিশ -“এই প্রসঙ্গ নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না।”

অনিক -“কিন্তু তোমাকে শুনতে হবে। ওইদিন আমিও ছিলাম আয়রানের সাথে। আয়রান ইচ্ছে করে এরকমটা করে নি। ভুলে এক্সিডেন্টটা হয়ে গেছে।”

তারপর অনিক রিদ্রিশকে জোর করেই সবটা বলে দিলো। সাথে টুকিটাকি কিছু প্রমাণও দিলো। রিদ্রিশ তো সবকিছু শুনে অবাক!মানে এতোকিছু হয়ে গেলো। রিদ্রিশ শুধু শুধুই এরকমটা করলো ওদের সাথে। মনে মনে গিল্টি ফিল হচ্ছে প্রচুর। সে মনে মনে কোথাও না কোথাও এটা বিশ্বাস করতো যে তার ভাই এসব করতে পারে না। তবুও একটা দিধা রয়েড গেছিলো। আজকে সব ক্লিয়ার। রিদ্রিশ খুশি হয়ে অনিনকে জরিয়ে ধরলো

-“থ্যাংকস ভাইয়া। তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো ভাষা খুজে পাচ্ছি না।”

অনিক -“আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। তুমি গিয়ে আয়রানের কাছে ক্ষমা চাও। তাহলে হয়ে যাবে। তোমাদেরকে আমি হ্যাপি দেখতে চাই আবার আগের মতো।”

রিদ্রিশ চোখ মুছতে মুছতে জলদি আয়রানকে ফোন লাগালো।

আয়রান আর আমি গাড়িতে করে একটা পার্কে এসেছিলাম ঘুরতে। আজকে আর আয়রান অফিসে যায় নি বলে। হঠাৎ আয়রান ফোন বেজে ওঠায় আর আয়রানকে এতো খুশি দেখে অবাক হয়ে গেলাম।

আয়রান -“দেখো রিদ্রিশ ফোন দিয়েছে। নিশ্চই কিছু বলবে।”

রিদ্রিশ -“ভা ভাইয়া আইম সরি। তুমি জলদি বাসায় এসো। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আজকে এর শেষ বিচার হবে।”

আয়রান কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। আমার হাত ধরে টেনে গাড়িতে জোর করে বসিয়ে স্টার্ট দিলো। আমি হ্যাবলার মতো হা করে আছি। হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারছি না।

বাড়ি পৌছে দরজায় কলিং বেল বাজালো। আমিও পিছন পিছন দৌড়ে গেলাম।

রিদ্রিশ কলিংবেলের শব্দ পেয়েই দৌড়ে দরজা খুলে আয়রানকে জরিয়ে ধরে হাউমাই করে কেঁদে দিলো। দাদি আর নুরানি দৌড়ে এসে হা করে তাকিয়ে রইলো। কি হলো আবার এদের? এভাবে জরিয়ে ধরে কান্না করে দিলো কেন? মানে সব ঠিক হয়ে গেছে? মুচকি হেসে দাদির দিকে তাকাতেই সে কিছুটা আচ করতে পেরে আচঁলে মুখ লুকিয়ে কানতে লাগলেন। নুরানিও খুশি।

রিদ্রিশ -“ব্রো আমাকে মাফ করে দে। আমাকে মার। কিভাবে ভুল বুঝলাম তোকে আমি?আমার নিজের উপর নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে।”

আয়রান রিদ্রিশের মাথা তুলে ধরে বললো
-“তুই যে আমাকে ক্ষমা করেছিস এটাই অনেক।”

রিদ্রিশ -“কিসের ক্ষমা?তুমি তো কোনো ভুলই করো নি। ক্ষমার প্রশ্নই আসে না। তুই ক্ষমা কর আমাকে।”

পিছন থেকে সিঁড়ি বেয়ে অনিক নামলো। এসে দাদির কাধে হাত রেখে মুচকি হাসতে লাগলো। দুই ভাইয়ের মিলবন্ধন দেখে সবাই খুশি।

আয়রান রিদ্রিশকে ছেড়ে অনিককে জরিয়ে ধরে কানে কানে বললো -“অসংখ্য ধন্যবাদ তোকে। আমি জানি তুই’ই করেছিস এসব।”

অনিক আয়রানের পিঠ চাপড়ে মুচকি হাসলো। এদিকে আমিঃ খুশিতে নাচছিলাম। হঠাৎই রিদ্রিশ আমার সামনে হাজির। মাথা নামিয়ে করুন সুরে বললো

-“ভাবি এম সরি। যা শাস্তি দেবার দাও।”

চমকে গেলাম। অসস্তি হচ্ছে খুব। কিভাবে ক্ষমা চাচ্ছে দেখো। যাই হোক!অনেক কষ্ট দিয়েছে আমাকে। একটু শাস্তি না দিলে চলে না। তাই রুক্ষ কন্ঠেই বললাম

-“ঠিক আছে ঠিক আছে।”

রিদ্রিশ -“ক্ষমা করেছো আমাকে?”

-“নাহ এতো সহজে না। যাও গিয়ে সবার বাথরুম পরিষ্কার করো।”

রিদ্রিশ -“কিহ?”

আমার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো।

এবং এখানেই শেষ হলো #অজানা_তুমি গল্পটি।

(সমাপ্তি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here