অনপেখিত পর্ব ১৫+১৬

#অনপেখিত
#পর্ব_১৫
লিখা: Sidratul Muntaz

পূর্বিতার কাছে পুরো ঘটনা শোনার পর ওয়াসীম ফারদিনকে বুঝানোর জন্য তার ঘরে গেল। আর আনজীর গেল সুজির কাছে৷ সুজি তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। আনজীর ওর হাত চেপে ধরে বলল,” দাঁড়া, কথা শুনে যা।”
সুজির কঠিন গলা,” সামনে থেকে সর আনজু।”
” তুই ফারদিনের উপর রাগ দেখিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিস? মানে সিরিয়াসলি? ও তো একটা ডিজাস্টার। কখন কি মর্জি হয় কোনো ঠিক নেই। রাগের মাথায় ও মানুষ খুন করলেও অবাক হবো না। আর তুই ওর কথা ধরছিস? তুই ওকে চিনিস না?”
” এতোদিন চিনতাম না। আজকে চিনতে পেরেছি। সেজন্যই তো চলে যাচ্ছি।”
সুজি আর কথা বাড়ালো না। হাতের ব্যাগ চেপে ধরে হাঁটতে লাগল। আনজীর পকেটে দুইহাত গুঁজে সুজির পেছন পেছন চলল। উঠান পেরিয়ে ওরা যখন সরু রাস্তাটি ধরে হাঁটছিল তখন সুজি হঠাৎ বলল,” তোর প্রবলেম কি? আমার পেছন পেছন আসবি না। যা এখান থেকে। ”
” তুইও চল।”
সুজি ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল,
” দ্যাখ, মাথাগরম করবি না। লাথি খাবি।”
” লাথি মেরে দেখা।”
সুজি রাগের মাথায় নিচ থেকে একটা পাথর তুলে আনজীরের গাঁয়ে ছুঁড়ে মারল। আনজীর নিচু হয়ে সরে গেল। পাথর তার গাঁয়ে লাগল না। সুজি আরও একটা পাথর কুড়িয়ে ঢিল মারল। আনজীর এইবারও সরে গেল। পরপর দুইবার সুজিকে হারিয়ে আনজীরের মুখে বিজয়ের হাসি৷ হাত তালি দিয়ে বলল,
” আরও একবার ট্রাই করবি নাকি?”
সুজি ক্রোধে কাঁদতে শুরু করল। আনজীর হতবাক। মশকরা বাদ দিয়ে সিরিয়াস হলো এবার। সুজির কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল,” সুজিতা, এই বোকা। কাঁদছিস কেন? বল আমাকে কি হয়েছে?”
সুজিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে আনজীরের দিকে তাকালো। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,” ফারদিন আমাকে এই কথা কিভাবে বলতে পারলো দোস্ত? আমি মেহেককে জেলাস করে ওর নামে মিথ্যে বলেছি? আমার মনে নোংরা? ও আমাকে এতোটা জঘন্য ভাবে?”
আনজীর ওর চোখের পানি মুছে ভরসা দেওয়ার মতো বলল,” কিছু হবে না। ফারদিন ওর ভুল বুঝতে পারলে ঠিকই তোর কাছে এসে ক্ষমা চাইবে দেখিস। সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে কষ্ট নিস না। আরেকটা কথা, লম্বা চুলের থেকে ছোট চুলেই কিন্তু তোকে বেশি ভালো লাগে। একেবারে কেটি পেরির মতো।”
” কার মতো?”
আনজীর হেসে বলল,” কেটি পেরি।”
এইবার সুজিও হেসে ফেলল। আনজীর সুজির হাত ধরে বলল,” ভেতর চল দোস্ত। আবার বৃষ্টি নামতে পারে।”
” সম্ভব নারে। ফারদিনের ওই কথা আমি যতক্ষণ ভুলতে না পারবো ততক্ষণ আমি এই বাড়িতে ঢুকতে পারবো না।”
” প্লিজ ভুলে যাতো। ও একটা ইডিয়েট। নাহলে বাগানবাড়ি কেনার জন্য কেউ বিয়ে করে?”
” ইডিয়েট হোক আর যাই হোক। ও আমাকে বলেছে আমি নাকি ওকে ডিজার্ভই করি না। আমার পেটে হিংসা। এসব কথা ও কিভাবে বলতে পারলো? যদি সত্যি আমার এতো হিংসা থাকতো তাহলে ওকে ওর বউয়ের সঙ্গে আমি এতো সহজে মেনে নিতাম? আমার জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে হলে কি এসব সহ্য করতো? প্রথমদিনই ওকে জুতার বারি লাগানো উচিৎ ছিল আমার।”
” সুজিতা শোন, আজকে তোকে আমি একটা কথা বলে রাখছি। এই কথা আগেও একবার বলেছিলাম। আবারও রিপিট করছি, ফারদিন তোকে জীবনেও ভালোবাসেনি। এজ এ বিউটিফুল গার্ল, হি লাইকস ইউ। কিন্তু ভালোবাসা অসম্ভব। যদি ও সত্যিই তোকে ভালোবাসতো তাহলে প্রপোজ করার জন্য এতো সময় নিতো না। ও তোর ব্যাপারে কনফিউজড ছিল। ভালোবাসা এতো কনফিউশন নিয়ে হয় না। লভ ইজ অলওয়েজ পিউর। ভালোবাসি মানে শুধুই ভালোবাসি। এর মধ্যে কোনো কিন্তু থাকতে পারে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, যদি ও তোকেই ভালোবাসতো তাহলে বিয়েটা কোনোদিন করতে পারতো না।”
” একজাক্টলি। আমিও এটাই ভেবেছি জানিস? ও কিভাবে এই বিয়েটা করতে পারল? আমি হলে কি পারতাম? বিয়ের সময় ওর কি একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?”
সুজির চোখ থেকে অশ্রুধারা নামলো। আনজীর বলল,” আবার কান্না শুরু! আচ্ছা তোরা মেয়েরা কি কান্না ছাড়া অন্যকিছু বুঝিস না?”
আনজীর পকেট থেকে রুমাল বের করে সুজির চোখ মুছে দিতে লাগল যত্নের সাথে। সুজি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আনজীরের দিকে। ওই গভীর চোখ দু’টির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সুজি হারিয়ে গেল আজ থেকে প্রায় দেড়বছর আগের সময়ে। সেদিন ছিল শ্রাবণ মাস। এমনই বৃষ্টি-বাদলার দিনে ম্যাপল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আনজীর তাকে প্রপোজ করেছিল৷ সেই দিনটি খুবই অস্বস্তিপূর্ণ আর অবিস্মরণীয় ছিল সুজির জন্য। আনজীরের সাথে তখন তার আড়াই বছরের ফ্রেন্ডশীপ। যাকে সবসময় ভাইয়ের মতো দেখে এসেছে তার কাছ থেকে হঠাৎ প্রপোজ্যাল পাওয়া যে কত অস্বস্তিকর ঘটনা, যার সাথে হয়েছে সেই কেবল বুঝবে। সুজি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিল আনজীরকে, সে কখনও তাকে বয়ফ্রেন্ড বানাতে পারবে না। সে ফারদিনকে পছন্দ করে। রিজেকশনের পর আনজীর এই ব্যাপারে সুজিকে আর কোনোদিন বিরক্ত করেনি। কিন্তু সবসময় সুজিকে আগলে রেখেছে। প্রকৃত বন্ধুর মতো সুজির বিপদে সবার আগে ছুটে এসেছে। ভালোবাসার দাবী করেনি। কিন্তু ভালোবেসে দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছে। তাদের এই ব্যাপারটা বন্ধুমহলের কাছে গোপন। কেউ আজও কিছু জানে না।
সুজি হঠাৎ বলল,” একটা কথা বলবো আনজু?”
” হুম বল।”
” দেড়বছর আগে তুই আমাকে প্রপোজ করেছিলি। মনে আছে?”
আনজীরের চোখেমুখে এক মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত ভাব ফুটে উঠলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,” মনে থাকবে না কেন?”
” তোর সেই অনুভূতি কি এখনও আগের মতো আছে নাকি ভুলে গেছিস?”
আনজীর চোখ ছোট করে খুব বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলল,” ভুলে যাওয়া এতো সহজ না। কিন্তু মানিয়ে নিয়েছি।”
” আচ্ছা ধর আমি তোর প্রপোজ এক্সেপ্ট করে ফেললাম। তাহলে কি করবি?”
আনজীর দাঁত বের করে কয়েক সেকেন্ড হাসলো। বোকা বোকা হাসি। সুজি বলল,” কি হলো বল?”
” জানি না কি করবো।”
” চল, আমরা বিয়ে করে ফেলি।”
” আর ইউ লস্টেড সুজিতা? মাথাখারাপ হয়ে গেল নাকি?”
” সত্যি বলছি। আজকে যদি তুই আমাকে বিয়ে না করিস তাহলে আর কখনও আমাকে পাবি না। তোর জন্য জ্যাকপট চান্স। ভেবে দ্যাখ কি করবি।”
আনজীর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। সুজি তাগাদা দিল,” তোর কাছে সময় দশ সেকেন্ড। দ্রুত সিদ্ধান্ত নে। খবরদার কনফিউজড হবি না। কারণ তুই নিজেই বলেছিস, ভালোবাসায় কনফিউশন চলে না। লভ ইজ অলওয়েজ পিউর। ভালোবাসি মানে শুধুই ভালোবাসি। বলেছিস না?”
” হ্যাঁ.. কিন্তু..”
” এর মধ্যে কোনো কিন্তু থাকতে পারে না।”
” কিন্তু সুজিতা, তুই ফারদিনের উপর রাগ করে ঝোঁকের মাথায় এই ডিসিশনটা নিচ্ছিস না তো? ভেবে দ্যাখ, আমি যদি তোর এই হাত একবার ধরি তাহলে সেটা সারাজীবনের জন্য ধরবো। কোনোদিন ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়।”
সুজিতা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ” ধর না প্লিজ। শর্ত হলো কোনোদিন ছাড়তে পারবি না।”
আনজীর হাতটা শক্ত করে ধরল,” তুইও প্রমিস কর!”
” প্রমিস করছি। কোনোদিন ছাড়বো না।”
ওয়াসীমের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলার পর ফারদিনের মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হয়েছিল। সুজির সাথে ওইরকম বিহেভ করা আসলেই ঠিক হয়নি এটা বুঝতে পেরেই ফারদিন ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে সুজির খোঁজ করতে পূর্বিদের ঘরে গিয়ে দেখল সুজি নেই। পূর্বি একাই বসে আছে। ফারদিন জিজ্ঞেস করল,” পূর্বি, সুজি কোথায় রে?”
” সুজি আর আনজীর কোথায় যেন বেরিয়েছে।”
” এতোরাতে কোথায় গিয়েছে ওরা? ”
” আমি জানি না। ফোন দিয়েছিল। শুধু বলল, আমরা কেউ যাতে ডিনার না করি। ওরা নাকি ডিনার কিনে আনবে। সবাইকে ট্রিট দিবে। আর একটা সারপ্রাইজ আছে।”
ফারদিন ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ আবার সারপ্রাইজ কিসের?
আনজীর আর সুজি কাজী অফিস থেকে বিয়ের কাজ সেরে হাজির হলো রাত বারোটায়। বিয়ের চিহ্ন হিসেবে দুজনের গলাতেই রজনীগন্ধার মালা। ওদের এই অবস্থায় দেখে ওয়াসীম আর পূর্বিতা বিস্ময়ে তাক লেগে রইল। কারো এখনও ঘটনা বিশ্বাস হচ্ছে না। উর্মি বার্তাবাহকের মতো দ্রুত গিয়ে মেহেককে সব কাহিনী জানালো। মেহেক এইসব শুনে খুশিতে নাচতে নাচতে পাগল হওয়ার অবস্থা। এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ দুনিয়ায় আর কিছু হতে পারে না। সে রুমে গিয়ে বিছানায় উঠে ধুম ধারাক্কা নৃত্য শুরু করল। বারান্দায় তখন ফারদিন দাঁড়িয়ে ছিল। মেহেক সেটা জানতো না। ফারদিনের হাতে তখন মোবাইল ফোন। সুজির নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে সে দেখল বন্ধুদের নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসডকল এসেছে। আর তার সব বন্ধুদের নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট করা৷ এজন্য কেউ ফোন করলেও সে টের পাচ্ছে না। কিন্তু সে তো কারো নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট করেনি! তাছাড়া আজকে সারাদিন তার ফোন মেহেকের কাছে ছিল। তার মানে এইটা মেহেকেরই কাজ। এখন তো সুজির কথাগুলোই সত্যি মনে হচ্ছে। সুজির চুলে আঠাও কি মেহেক লাগিয়েছিল? নাহলে সে কেন সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ফারদিনকে কথা বলতে দেয়নি? ফারদিনের কাছে ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। রাগে কান দিয়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছিল যেন। মেহেককে পিষে ফেলতে মন চাইল। এমন সময় পূর্বি ম্যাসেঞ্জারে ফারদিনকে ম্যাসেজ করল,” দোস্ত কই তুই? জলদি ড্রয়িংরুমে আয়! মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটসে। সুজি আর আনজু বিয়ে করে ফেলসে। তুই চিন্তা করতে পারতেসিস? দুইটা কতবড় শয়তান? পুরা গভীর জলের মাছ!”
ফারদিনের মস্তিষ্ক যেন ফাঁকা হয়ে গেল। কি হচ্ছে এসব? রাগে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে সে যখন বারান্দা থেকে বের হলো, দেখলো মেহেক বিছানায় উঠে ধেই ধেই করে নাচছে আর গান গাইছে,” চুল কাটা সুজি, বিয়ে করল বুঝি!” এমনিতেও মেজাজটা একশো ডিগ্রি হাই। তার উপর এইরকম উদ্ভট দৃশ্য দেখে ফারদিনের রাগ প্রায় অগ্নিবলয়ের রূপ নিল। বিকট শব্দে গর্জন করে উঠলো,” স্টপ ইট মেহেক!”
ফারদিনের হঠাৎ ধমক শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে মেহেক ধপাশ করে বিছানা থেকে নিচে পড়ে গেল।
#অনপেখিত
#পর্ব_১৬
লিখা: Sidratul Muntaz

ফারদিনের মেজাজ বর্তমানে প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের রূপ ধারণ করেছে। সে মেহেকের কাছে এসে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ” এই মেয়ে, উঠো৷ সমস্যা কি তোমার?”
রাগের দমকে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছিল।কিন্তু মেহেক চোখ বুজে পড়ে আছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। ফারদিন এভাবে আরও কয়েক বার ডাকার পরেও যখন কোনো রেসপন্স পেল না তখন কিছুটা শান্ত হলো। মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে মেহেকের নাকের সামনে আঙুল দিয়ে দেখল শ্বাস আছে কি-না। অনেক সময় উঁচু জায়গা থেকে পড়ে মানুষ দম আটকে ফেলে। ফারদিন মেহেককে পাঁজাকোলায় নিয়ে বিছানায় শোয়াল। মেহেকের শ্বাস আছে। এর মানে শুধু অজ্ঞান হয়েছে সে। ফারদিন উর্মিকে ডাকল। সেকেন্ড না গড়াতেই উর্মি প্রায় দৌড়ে এলো। সে আপাতত ফারদিনকে খুবই ভয় পাচ্ছে। ফারদিনের কণ্ঠে নিজের নামে ডাক শুনলেই জড়োসড়ো হয়ে পড়ছে। যেহেতু সুজির মাথায় আঠা সে ঢেলেছিল অর্থাৎ মেহেকের কুকীর্তির অর্ধেক অংশীদার সে নিজেও। তাই ফারদিন মেহেককে যা শাস্তি দিবে উর্মিকেও সেই একই শাস্তি দিবে। এই ভয়েই উর্মি সদা তটস্থ। ভীত ভীত কণ্ঠে বলল,” জ্বী ভাইয়া,ডাকসেন?”
ফারদিন চিন্তিত হয়ে বলল,
” দেখো তো কি হয়েছে? মেহেক চোখ খুলছে না।”
উর্মি মাথায় দুইহাত চেপে আর্তনাদের সুরে বলল,” হায়হায়, আপায় কি মইরা গেল নাকি?”
” আরে ধূর, মরবে কেন? সেন্সলেস হয়ে গেছে। কিভাবে কি হলো বুঝলাম না। তুমি এক কাজ করো। বাথরুম থেকে পানি এনে ওর নাকে-মুখে স্প্রে করতে থাকো। আমি এক মিনিটে আসছি।”
” আচ্ছা, ঠিকাছে।”
ফারদিন চলে যেতেই মেহেক খিকখিক করে হেসে উঠল। উর্মি অবাক হয়ে বলল,” আপা, আপনের কি হইসিল?”
” কিছুই হয়নি। বরকে বুদ্ধু বানালাম। এটা হচ্ছে বিপদের সময় বকা থেকে বাঁচার এবং ইন্সট্যান্ট বরের কোলে উঠার নিঞ্জা টেকনিক। বুঝেছিস?”
” কি যে করেন না আপনি৷ আমি তো সত্য ভাবসিলাম। মনে করসিলাম ফারদিন ভাই আপনেরে আসলেই তুইল্লা আছাড় মারসে আর আপনে ফিট হয়া গেসেন।”
মেহেক মুখে হাত দিয়ে কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। হঠাৎ দেখল ফারদিন দরজার বাহিরে থেকে রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেকের হাসি মুহুর্তেই বন্ধ হয়ে গেল৷ উর্মি কথা বলেই যাচ্ছিল।
” জানেন আপা, ভাই যখন আমারে ডাকসিল আমি যেই ভয় পাইসি। আমি তো ভাবসি এখন আমারেও তুইলা আছাড় মারবো আপনের মতো। কারণ সুজি আপার চুলে আঠা ফেলার ব্যাপারে তো আমিই আপনারে সাহায্য.. ”
মেহেক চট করে উর্মির মুখ চেপে ধরল। উর্মি থতমত খেয়ে মেহেকের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল। ফারদিন ওদের কিছুই বলল না আপাতত। চুপচাপ হেঁটে চলে গেল। উর্মি নেতিয়ে পড়া কণ্ঠে বলল,” এখন কি হইবো আপা?”
মেহেক ঠোঁট উল্টে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,” জানি না।”
” আপা, আপনি আরেকবার লুকান। এইবার আমিও আপনার সাথে লুকামু।”

সুজি আর আনজীরকে ঘিরে বসে আছে সবাই। পূর্বি আর ওয়াসীম তো হাত তালি বাজিয়ে গান গাইছে। উজান মাঝখানে বসে বাহিরে থেকে কিনে আনা ফাস্ট ফুড খাচ্ছে আরাম করে। ওয়াসীম চাইছে এই বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে একটা জমজমাট পার্টি দিতে। পূর্বি বলল,” অবশ্যই হবে। বড় একটা অনুষ্ঠান তো মাস্ট। কিন্তু সুজিতা, তোরা যে এতোরাতে বিয়ে করেছিস সাক্ষী কিভাবে যোগাড় করলি? আর আমাদের জানাসনি কেন?”
আনজীর বলল,” আমি তো জানাতেই চেয়েছিলাম তোদের। সুজিতা দেয়নি। আর সাক্ষী নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। কাজী অফিসে আরও একজোড়া দম্পতি গেছিল বিয়ে করতে। তাদের কাছেও সাক্ষীর অভাব। পরে আমরা বদলাবদলি করে সাক্ষী হয়েছি৷ আমাদের বিয়ের সময় ওরা ছিল সাক্ষী আর ওদের বিয়ের সময় আমরা ছিলাম সাক্ষী।”
ওয়াসীম বলল,” দারুণ তো। কিন্তু হঠাৎ এতো তাড়াহুড়া কেন করলি বুঝলাম না।”
সুজিতা বলল,” শুভকাজে দেরি করতে নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব কাজ সেরে ফেলেছি৷ তোরা চিন্তা করিস না। আমেরিকা গিয়ে বড় করে পার্টি দিবো।”
” সেটা তো এমনিতেই দিতে হবে। পার্টি না দিলে কি আমরা তোদের শান্তিতে থাকতে দিবো? ফারদিন তো আমাদের ঠকিয়েছে। তোরা কিন্তু সেটা পারবি না।”
সবাই হাসছিল খুব। ফারদিন যে পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কারো হুশ নেই। হঠাৎ ফারদিন এগিয়ে এসে মুখ-চোখ কুচকে হুংকার ছাড়ল,” এই তোরা কি ফাজলামি শুরু করেছিস? এসব কি হচ্ছে?”
তার মেজাজে কারো কোনো ভাবান্তর হলো না। সুজি তো কোনো পাত্তাই দিল না। ওয়াসীম মুখ কালো করে জবাব দিল,” ফাজলামি হবে কেন? ওরা তো বিয়ে করেছে দোস্ত। একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। এইখানে তুই ফাজলামির কি দেখলি?”
” সুজি, ওঠ। আমার তোর সঙ্গে কথা আছে।”
চোয়াল শক্ত করে প্রায় আদেশের মতো বলল ফারদিন।
সুজি আনজীরের হাত চেপে ধরে বলল,” উহুম। তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই৷ তাছাড়া আমি আমার বরকে ফেলে তোর সাথে কেন কথা বলবো? আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে না? তাই আগামী এক সপ্তাহ আমি শুধু আমার বরের সঙ্গেই কথা বলবো। অন্যকারো সঙ্গে না।”
পূর্বিতা বুড়ো আঙুল উঁচু করে লাইক দেওয়ার মতো বলল,” ইটস আ গ্রেইট ডিসিশন। ভেরি রোমান্টিক!”
ফারদিন বহু কষ্টে রাগ সংবরণ করল। আনজীরের দিকে চেয়ে বলল,” আনজু, তুই এদিকে আয়। কথা আছে।”
আনজীর উঠতে নিচ্ছিল। সুজি হাত ধরে টেনে ওকে বসিয়ে বলল,” এই, তুমি কোথায় যাচ্ছো? চুপচাপ বসে থাকো। আগামী এক সপ্তাহ শুধু তুমি আমার পাশে বসে থাকবে এবং আমার কথাই শুনবে। অন্যকারো কথা শুনতে পারবে না। গট ইট?”
আনজীর বাধ্যের মতো বলল,” ওকে। স্যরি ফারদিন।”
সুজি আনন্দে আনজীরের কাঁধে মাথা রেখে গান গাইতে শুরু করল,” আরে ও প্রাণের রাজা, তুমি যে আমার.. পাশে পাশে থেকো মোর, চাই না কিছু আর..”
আনজীরও সুর মিলিয়ে গাইল,”আরে ও আমার রানী, আমি যে তোমার… তুমি ছাড়া জীবনে, নেইতো কিছু আর!”
ফারদিন রাগে শুধু বোমার মতো ফুলছিল। তাকে যেন কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না! বন্ধুরা হাত তালি বাজিয়ে সুজি আর আনজিরের গানে সুর মিলাচ্ছে। সবার আজকে কত আনন্দ! যেন ঈদ চলে এসেছে। অথচ ফারদিনের ইচ্ছে করছিল সেন্টার টেবিলটা লাথি মেরে ভেঙে ফেলতে। সে খুব দ্রুত ওই জায়গা থেকে চলে এলো। পেয়ারা গাছের নিচে এসে বসল। আজ অনেকদিন পর, ফারদিনের চোখ দু’টো অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে আসছে। তার একে একে সব স্মৃতি মনে পড়ছিল। সুজির সাথে প্রথম দেখা, প্রথম ভালো লাগার মুহুর্ত, সুজির জন্য সাজিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো, সবকিছু বিষাক্ত সুচের মতো হৃদয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। ফারদিন পাঞ্জাবীর পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার আর সুজির পুরনো ছবিগুলো দেখতে লাগলো। আহারে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো! আর কখনও ফিরে আসবে না। সুজি আর কখনও তার দিকে তাকিয়ে হাসবে না, লজ্জায় লাল হয়ে বলবে না, ” ফারদিন স্টপ ইট!” আর কখনও সুজির কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখা হবে না। সবকিছু যেন দুঃস্বপ্নের মতো পাল্টে গেল। আর ফারদিনের ঘুম ভাঙল এখন! সবটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল, সে আসলে কতটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। সুজি আজকে পুরোপুরি অন্যকারো। ফারদিন এটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ফারদিন এখন সুজির যন্ত্রণাগুলো হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছে৷ সে মেহেককে বিয়ে করে সুজিকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছিল সুজি যেন সবটুকুর শোধ কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে নিল৷ ফারদিনের গলার কাছে দলা পাকানো একটা কষ্ট কাঁটার মতো আটকে আছে৷ সে না পারছে উগড়ে ফেলতে আর না পারছে নিগড়ে নিতে। মেহেক নীরবে ফারদিনের পেছনে এসে দাঁড়ালো। ফারদিন মোবাইলে সুজির ছবি দেখছে। এইটা দেখে মেহেকের ছোট্ট মন ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল যেন। তার বর এখনও অন্য একটি মেয়ের প্রতি আসক্ত। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও তার ছবি দেখছে। আড়ালে কাঁদছে!এতো ভালোবাসা! তার জন্য কেন এই ভালোবাসা নেই? সে কি একটুও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না? ফারদিন হঠাৎ কি মনে করে যেন পেছনে তাকালো। মেহেককে দেখতে পেয়েই অপ্রস্তুতভাবে চোখের জল মুছল। গলা পরিষ্কার করতে কাশি দিল। মোবাইলটা পকেটে পুরে অস্বস্তি নিয়ে বলল,” তুমি কখন এলে?”
” মাত্র। বসতে পারি?”
” বসো।”
মেহেক ফারদিনের পাশে বসলো। ফারদিন রুক্ষ কণ্ঠে বলল,” সুজির চুলে আঠা তুমি লাগিয়েছো? সত্যি কথা বলো।”
মেহেক মাথা নিচু করে উত্তর দিল,” হুম।”
” কেন?”
মেহেক অপরাধী কণ্ঠে বলল,” বিশ্বাস করুন। আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমার সাথে যে শয়তানটা আছে সে আমাকে বাধ্য করেছে এই কাজ করতে।”
” শয়তান মানে?”
” শয়তান মানে শয়তান! আমাদের সবার সাথেই তো মনে মনে একটা শয়তান থাকে তাই না? ওই শয়তান আমাদের দিয়ে জোর করে ভুলভাল কাজ করায়। আমিও শয়তানের প্ররোচনার স্বীকার। প্লিজ মাফ করে দিন।”
মেহেক দুইহাতে কান ধরল। ওই সময় তাকে সম্পূর্ণ একটা অবুঝ শিশুর মতো দেখাল। বাচ্চারা ভুল করলে তাদের নিষ্পাপ চেহারায় যেমন ভীতি আর অপরাধবোধের এক স্পষ্ট সংমিশ্রণ থাকে মেহেকের চেহারাতেও ঠিক তেমন সংমিশ্রণ দেখা যাচ্ছে। ফারদিন ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল তার ভেতর থেকে। নাহ, সম্ভব না। এই মেয়ের সাথে সংসার করা কিছুতেই সম্ভব না! এই মেয়ে বউ মেটেরিয়াল না, এখনও বাচ্চা মেটেরিয়াল।

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here