আমার প্রাক্তন স্বামীর কাছে বর্তমান স্বামীর হার্টের অপারেশন করাতে হবে তা আমার ভাবনাতেও কোনোদিন ছিলো না। আজ ও মনে আছে আমি যেদিন আমার প্রাক্তন স্বামী ইরাদকে ডিভোর্স করেছিলাম সে খুব কেদেছিলো, আমাকে অনেক আটকানোর চেষ্টা করেছিলো। কতশত লোকের সামনে সে আমার পা পর্যন্ত জড়িয়ে ধরেছিলো কিন্তু নিজের অহংকারের কাছে তার ভালোবাসা আমার খুব তুচ্ছ লাগছিলো। তাকে আমি মানুষই মনে করিনি, তবে আজকে সে এতই বড় হয়ে গেছেন যে তার সামনে আমি খুবই নগন্য হয়ে গেছি সে যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয় তাহলে হয়তো আমার স্বামী আর এই দুনিয়ার আলো দেখতে পারবেন না কোনোদিন। তার চেম্বারের বাইরে বসে আছি আমি অনেকক্ষণ ধরেই, চোখে মুখে অন্ধকার যেনো নেমে এসেছে পুরোনো কথা গুলো একে একে করে সব মনে পরছে, কিভাবে কিভাবে এতো গুলো দিন কেটে গেলো
আমি সেই সিলেট থেকে আজকে প্রায় ১০ বছর পর ঢাকা এসেছি সাহিলের সাথে, শুধু মাত্র সাহিলের চিকিৎসা করার জন্য। আজকে আমার টাকাও আমাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারবে না, ইরাদ ছাড়া আর কেউ এতোটা কাবিল ডাক্তার নেই যে কি না এই অপারেশনটা সাকসেসফুলি হ্যান্ডেল করতে পারবে। কারণ এই অপারেশনে সাহিলের বাচার সুযোগ মাত্র ১% আর এই ক্ষেত্রে আমি চাই বেস্ট ডাক্তারের কাছেই তার ট্রিটমেন্ট করাবো। ইরাদ সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছে মাত্র কয়েক দিনের জন্য, তাও তাকে হায়ার করে আনা হয়েছে শুধুমাত্র বিশিষ্ট কিছু পেশেন্ট দেখার জন্য, সাহিলের বাবার কারণে আমিও সিরিয়াল পেয়ে গেলাম আর প্রথমে আমার খালাতো বোন তার ঠিকানা আমাকে দিয়ে বললো এই সময় অন্য কোনো দেশে গেলেও ইরাদের থেকে ভালো ডাক্তার পাওয়া সম্ভব নয়। আর সাহিলের ডাক্তাররাও তাই বলেছিলো। সে সময় আমি জানতাম না এই ইরাদ সেই ইরাদ যে কি না আমার প্রাক্তন স্বামী। আজকে ভয় হচ্ছে খুব বেশি ভয় হচ্ছে, আমার পাপের সাজা যদি আমার সাহিলের পাওয়া লাগে? তাহলে আমি কি করে বাঁচবো? নাহ এমন যেনো কোনোদিন নাহয়, প্রায় ১ ঘন্টা ধরেই আমি ওয়েট করছি ফাইল নিয়ে কখন আমার সিরিয়াল আসবে এবং তার সাথে দেখা করতে পারবো।
-সিরিয়াল নাম্বার ১৬, মিঃ সাহেল জামান ফাইল দিন
আমি গিয়ে ফাইল দিলাম
– রেডি থাকুন
যেই মাত্র বললো আমার সিরিয়াল এসেছে মনের ভয় যেনো বেড়ে গেলো। কান্না যেনো উপচে পড়তে চাইছে, সাহস হচ্ছে না ভেতরে যাওয়ার। হাত পা একদম ভাড়ি হয়ে গেছে
– ১৬ আসুন
-মিঃ সাহেল জামান আছেন?
-…. জ্বি.. জ্বি…
লোকটা আমাকে দেখে ভ্রু কুচকে তার হাতে সিরিয়ালের খাতাটায় নাম পড়ে দেখলো আর আবার আমার দিকে তাকালো।
– আপনি সাহেল জামান?
– না আমি উনার স্ত্রী, সে এই হসপিটালের ৪র্থ তলায় ভর্তি আছেন তার রিপোর্ট দেখাতে এসেছি
– আসুন ম্যাম
আমি ভেতরে গেলাম, দেখলাম ইরাদ টেবিলে বসে আছেন মাথা নিচু করে ফাইল পড়ছে আর তার দুই পাশে দু’জন ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন বুঝলাম তারা নিশ্চয়ই ওর জুনিয়র হবে। আমাকে তাদের মধ্যে একজন বসতে বললেন
আমি বসলাম
ইরাদ আবছা দেখতে পেলো একজন মহিলা এসে বসেছে। সে ফাইল নিয়ে স্টাডি করতে ব্যাস্ত। তখন অপর পাশে বসা মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করলো
– মিঃ সাহেল আপনার কি হন?
– আমার হাসবেন্ড
আওয়াজটা ইরাদের পরিচিত লাগলো, তখনই সে তাকিয়ে দেখলো
আমার চোখ ভর্তি অশ্রু, আজকে ইরাদ আমাকে দেখে একদমই অবাক হলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– আপনার হাসবেন্ড এর অবস্থা খুবই গুরুতর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার অপারেশন করা লাগবে, নাহলে উনি সার্ভাইভ করতেন না।
– আমরা প্রস্তুত
– আলিফ, চেক করো আমার ফ্রি টাইম কবে আছে?
– স্যার আজ রাত ৩ঃ৩০ থেকে ৫ঃ৩০ পর্যন্ত আপনার শিডিউল ফ্রি।
– পেশেন্ট এর কন্ডিশন কেমন আছে চেক করো সব ঠিক থাকলে আজকেই অপারেশন হবে।
– স্যার লাস্ট সবকিছু চেক আজকেই করা হয়েছে উনার ভর্তির সময়, অপারেশন করা সম্ভব
– ওকে দেন। রেডি করো সবকিছু
ইরাদের কথা গুলো শুনে আমি খুব অবাক হচ্ছি রাতে সে জেগে থাকবে? সে খুব ঘুম কাতুরে ছিলো সবসময় রাত ১০টার মধ্যে ঘুম দিতো আর উঠতো সকালে ৬-৭টায়। তাহলে আজকে কিভাবে জাগবে রাত? নাকি সে অপারেশন করবে না বলে এমন করছে? সে কি আমার ওপরে রিভেঞ্জ নিবে?
আমি না পেরে তাকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম
– আজকেই? তুমি অপারেশন করবে তো?
তখন খুব দৃড়তার সাথে ও ভাব গাম্ভীর্যের সাথে সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো
– আমার যোগ্যতার ওপরে কি আপনার সন্দেহ আছে?
– না, কিন্তু…..
ইরাদ তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে একটু পরের অপারেশন নিয়ে বলতে শুরু করে দিলো অন্য ডাক্তারের সাথে
আমি আর কিছু না বলে বেড় হয়ে এলাম তার কেবিন থেকে।
বেড় হয়ে কাচের গ্লাসের অপর পাশ থেকে একবার ইরাদকে দেখলাম এরপর আমাদের কেবিনে চলে এলাম, সাহিল ঘুমাচ্ছে। আমি আগের থেকে কতটা বদলে গেছে ও। কথা কতটা গাম্ভীর্যের সাথে বলে এখন। দেখতে আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছে ও, এতোটা সাকসেস এতটা সম্মান আজকে ইরাদের কাছে। কেমন যেনো নিজেকে খুব বেশি ছোট মনে হতে শুরু করলো।
এমন আগে কোনোদিনও লাগেনি এতোটা কষ্ট কেনো অনুভব করছি জানিনা, মনের মাঝে একটা শূন্যতা ভালোভাবেই বিরাজ করছে। একটা হাহাকার কাজ করছে, আমি আমার সাহিলের হাতটা ধরলাম খুব শক্ত করে। আজকে দোয়া করা ছাড়া আল্লাহর কাছে আর কোনো উপায় নেই আমার। জানিনা ইরাদ আমার প্রতিশোধ নিতে চাইবে কি না? আমি আজকে কিছুই জানিনা আপাতত বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিলাম আজই অপারেশন হবে। আমার বাবা মা আসতে পারলো না কিন্তু সাহিলের মা বাবা সবাই প্রায় ২ ঘন্টার মধ্যে চলে এলেন। আর আমার ননদ ও তার ক্লাস শেষ করে বাসায় গিয়ে সাহিলের প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র নিয়ে চলে এলো। ও ঢাকাতেই থাকে এবং এই ইনস্টিটিউট এ পড়াশোনা করে। এই মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ও তাই বাবা ওকে ঢাকায় একটা বাড়ি কিনে দিয়েছে এখানে যেনো ও থাকতে পারে এবং পড়াশোনা করতে পারে। মাঝে মাঝে সাহিল, আভা আমাদের মেয়ে ও মা বাবা, সবাই ঢাকায় আসতো কিন্তু আমি কোনোদিন আসতাম না। আমি সব সময় আমার অতীত থেকে পালিয়ে চলার চেষ্টায় ছিলাম আজকে সে অতীত কিভাবে কিভাবে সামনে চলে এসেছে আমিও জানিনা। তারা কেউ জানে না ইরাদ আমার প্রাক্তন স্বামী। আর আজকে ইরাদ আমার সাথে যেমন অচেনা ব্যাবহার করেছে তার প্রেক্ষিতে আমি এইটুকু নিশ্চিত যে হয়তো সেও বলবে না এই জিনিসটা, বা আমাকে তার প্রাক্তন বলতে সেও লজ্জিত তাই হয়তো বা। আমি বসে বসে এসব ভাবছিলাম কখন যে রাত ৩টা বেজে গেছে তার খেয়ালই ছিলো না।আমার ননদের কথায় খেয়াল এলো,
– ভাবী আমি আর মা নফল নামাজ পড়ে নিয়েছি তুমি চাইলে পড়ে নাও আর ভাইয়া কে উনারা নিতে এসেছেন আমি সাথে যাচ্ছি আর বাকি সব ফর্মালিটিস পূরণ করে আসছি।
-ঠিক আছে যা।
সাহিল ঘুমে ছিলো ওকে নিয়ে যাওয়া হলো,
আমি নামাজ পরে ওটির উদ্দ্যেশ্যে গেলাম আর ভাবছিলাম ইরাদ যেনো আসে আমার ওপরের রাগ জেদ যেনো আমার স্বামীর ওপরে ও প্রতিশোধ হিসেবে না নেয়,
ওটির বাইরে গিয়ে দাড়াতেই দেখি ইরাদ এসছে।
উনাকে দেখে বাবা মা সাথে সাথে গিয়ে রিকুয়েষ্ট করতে শুরু করলেন, সবাইকে ইরাদ শুধু বললো
– আল্লাহ ভরসা, ইনশাআল্লাহ আমরা সাকসেসফুল হবো ডোন্ট ওয়ারী
পাকা ৬ ঘন্টা চললো অপারেশন, সারাটা সময় ভয়ে ভয়ে কাটছিলো কি হবে আল্লাহ জানে একমাত্র। ইরাদ বেড় হয়ে এলো একদম ক্লান্ত অবস্থায়, আমরা শুধু একটা ভালো খবর শোনার আশার তার দিকে তাকিয়ে রইলাম
– শুকর আলহামদুলিল্লাহ, অপারেশন সাকসেসফুল, মিঃ সাহিল এখন আউট অফ ডেঞ্জার। উনি দু’দিন আইসিইউ তে থাকবেন তারপর আপনারা দেখা করতে পারবেন
মা কান্না করতে করতে বললো,
– বাবা আমার বুকের ধন তুমি ফিরিয়ে দিয়েছো আল্লাহ তোমাকে জীবনে অনেক সুখী করুক তোমার স্ত্রী সন্তান নিয়ে তুমি যেনো অনেক সুখে থাকো দোয়া করি।
কথাটা শুনে আমি ইরাদের দিক থেকে আমার চোখ নামিয়ে নিয়েছি
নিজেকে অনেক বড় অপরাধী লাগছিলো
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না সেই মুহুর্তে আর না পারছিলাম সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে
ইরাদ শুধু তাদের দেখে একটা স্মাইল দিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।
আমি মনে মনে আল্লাহ কে শুকরিয়া জানালাম।
ইরাদ প্রায় ২দিন পর বাড়ি ফিরলো ঢুকেই দেখলো টেবিলের ওপরে দুটো’ গোলাপ রাখা। নিশ্চয়ই আজকেও সেই অপরিচিত মানুষটাই গোলাপ দুটো দিয়েছে। ইরাদ বাংলাদেশে আসার পর থেকেই প্রতিদিন একটা করে গোলাপ প্রতিদিন সকালে তার বাসায় দিয়ে যায় কেউ। সাথে খুব সুন্দর এক একটা ছন্দ থাকে। যদিও এগুলো তে ইরাদ খেয়াল দেয় না বা জানতেও চায় না কে বা কেনো এগুলো করছে?
আজকে সকালে টানা এতো গুলো অপারেশন আর পেশেন্ট দেখতে দেখতে ও নিজের জন্য কোনো সময়ই পায় না। ঘুমানোর মতো সময়ও তার হয় না, এতো বছর পরে আজকে মেঘাকে দেখে ইরাদের ভিতরটা একদম ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, এটা কি ভালোবাসার জন্য হয়েছে? নাহ ভালোবাসার জন্য নাহ এটা তো হয়েছে পুরোনো ঘা গুলো যেন তাজা হয়ে গেছে এইজন্য হয়েছে। তবে ইরাদ অনেক প্রফেশনাল ধরনের। সে কোনোদিন নিজের পারসোনাল লাইফকে প্রফেশনাল লাইফের সাথে মিলায় না আর আজকেও তাই করে দেখালো ও। নাহলে কেউ বোধহয় এই কাজ করতো না, ইরাদ অনেক সাকসেসফুল একজন কারডিওলজিস্ট। অনেক টাকা আছে, সম্মান আছে এক কথায় বিত্তবান একজন সুপুরুষ ইরাদ। যাকে দেশ-বিদেশের সবাই সম্মান করে সবাই যার সাথে কথা বলতে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। ও দেখতে যতটা আকর্ষণীয় ঠিক ওর চাল-চলন কথার ভাব-ভঙ্গি ও ততটাই আকর্ষণীয়। তবে দিন শেষে এই রকম একটা মানুষই বড় একা। মেঘা ওকে ছেড়ে যাওয়ার পরে ও কোনো দিন আর বিয়ে করে নি, আসলে বিয়ের ইচ্ছাই হয়নি নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে ও এতই ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো যে নিজের আশপাশের অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে নি। বাসায় এসে গোসল করে ইরাদ ঘুমিয়ে নিলো কিছুক্ষণ , আজকে রাতে একটা অপারেশন আছে রাত ১১টার দিকে।
অপারেশন শেষে রাতের ২টা বেজে গেলো ইরাদের হসপিটাল থেকে বেড় হতে হতে পার্কিং এরিয়ায় ইরাদ আসতেই পেছন থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠে
– ডক্টর ইরাদ
বলে একটা ডাক পরে
ইরাদ পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখে অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ে গোলাপি রঙের একটা জামা পরা দাঁড়িয়ে আছে
– জ্বি?
ইরাদকে দেখেই সে একদম সেন্সলেস হয়ে সাথে সাথে ইরাদের বুকে লুটিয়ে পরে যায়। এতো রাতের সময় এমন কিছু হওয়াতে ইরাদ একদম হতভম্ব হয়ে যায়।
(কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন আপনাদের সাড়া পেলে সামনের প্রহর লিখবো)
#অনুতাপ
#পর্বঃ০১
Yasira Abisha