অন্তরালের কথা পর্ব ১০

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১০
.
.
কথাটুকু ভেবেই অতল আনমনে হাসতে থাকে।
এদিকে তানহা ওয়াশরুমে ঢুকেই নীরব কান্নায় ভেঙে পড়ে। ওয়াশরুমের মেঝেতে হাঁটু ভাজ করে বসে তার উপর মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে। তবে এ কান্নার আওয়াজ ওয়াশরুমের দরজা ভেদ করে অতলের কাছে যেতে সক্ষম হয় না। তানহা যে তার মাথার উপর ঝর্না ছেড়ে রেখেছে। সেই ঝর্নার ঝপঝপে আওয়াজের আড়াল থেকে তানহার কান্নার আওয়াজ ঘরের মাঝে অতলের চারিপাশে ছড়িয়ে পড়া যে ভীষণ দায়। তবে এ কান্নাও যে দীর্ঘস্থায়ী নয়। রুমের মাঝে যে তার অপেক্ষায় একজন মানুষ বসে বসে প্রহর গুনছে। এ কথা তো আর তানহা ভুলে যেতে পারে না। তাই তার বুক ফাটা কান্নাকে মাটিচাপা দিয়ে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ায় তানহা। কিছুক্ষণ ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে তার ব্যাথা গুলোকে সান্ত্বনা দিয়ে জামা বদলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
তানহাকে দেখে অতলের যেন যায় যায় অবস্থা। বাসর রাতে যে কোনো মেয়েই শাড়ি পরার কথা! তবে তানহা সেরকম কিছুই করেনি। একটা সিম্পল সেলওয়ার কামিজ পড়েছে। তাও আবার ব্রাউন কালার ও কফি কালারের কম্বিনেশনে। একে তো তানহার গায়ের রঙ ব্রাউন। তারউপর জামাও ব্রাউন। এ দুই’য়ে মিলে যেন তানহার সৌন্দর্য বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিয়েছে। সাথে আবার তানহার ভেজা শীতল চুল। যা গায়ের সাথে লেপ্টে রয়েছে। কি যে এক ভয়ংকর সুন্দর রূপে পরিণত হয়েছে তানহা কেবল অতলই জানে।
অতলকে হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তানহার বেশ অস্বস্তি লাগছিল।না পারছে অতলকে অন্য ঘরে পাঠাতে, না পারছে নিজে চলে যেতে।তাই না পারতে অতলকে তোতলিয়ে তোতলিয়ে বলল,
” ওয়াশরুম খালি আছে। আপনি চাইলে যেতে পারেন। ” কথাটি বলেই নিজের ভেজা চুল মুছতে লাগলো তানহা।
অন্যদিকে অতল নিজের বোকামো দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। আর মনে মনে বলল,
” এভাবে হা হয়ে থাকে নাকি কেউ? যেভাবে হা হয়েছিল মনে হয়েছে, কেউ তাকে এখনি কোন লোভনীয় খাবার দিবে আর সে ওই লোভনীয় খাবারটি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে গপাগপ খেয়ে ফেলবে। তবে এতো সুন্দর মুহুর্তে কি, না তাকিয়ে পারা যায়? আর না, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ! ”
অতলের হাতে থাকা টি-শার্ট ও প্যান্টটি বিছানার উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো। মুখে কোনো কথা নেই। কেবল চোখে রয়েছে প্রবল চাহিদা পূর্ণ স্থির দৃষ্টি। যে দৃষ্টি অতলকে অস্থির করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তানহার কাছে। তানহার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তানহা চমকে উঠল ! আর বলল,
” কিছু…চাই আপনার! ”
” যদি বলি, হ্যাঁ। ”
“কী.. চান? ”
” বলব, তবে তারআগে তোমার এই তোতলানো বন্ধ করো। আর নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলো। আমি এমন কিছুই চাইব না, যার কারণে তোমাকে এতটা ভয়ংকর ভাবে তোতলাতে হবে। ”
তানহা কিছুক্ষণ নীরব থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর অতলকে বলল,
” হুম বলুন। ”
” স্বাভাবিক আছো তো? নাকি আবার স্বাভাবিক হতে গিয়ে স্পেশাল চাইল্ড হয়ে গিয়েছ? ” কথাটুকু বলেই অতল হো হো করে হেসে উঠল। এদিকে তানহা রাগান্বিত স্বরে বলল,
” স্পেশাল চাইল্ড? মানে? কি বলতে চাচ্ছেন আপনি? আর এতো হাসির ই বা কি আছে? ”
” কই হাসছি? আমিতো হাসছি না। ”
” তাহলে কি আমি ভুল দেখেছি? ”
” হয়তো। ”
তানহা আর কোনো কথা বাড়ালো না। ধীর পায়ে এগুতে লাগল ঘরের দক্ষিণ দিক টায়। সেখানে যে বড় একটা জানালা রয়েছে। তাই ভেজা চুল মুছবার জন্য সে ওই জায়গাটা’কেই উপযুক্ত বলে মনে করল। তবে তানহা যে একা এসেছে তা নয়। তানহার পিছু পিছু যে অতল ও এসেছে জানালার ধারে কিন্তু সেদিকে পাত্তা দিল না তানহা। সে নিজের মতো জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে আরম্ভ করল। তার মাঝে অতল জানালার কপাট ধরে বলল,
“জানতে চাইবে না?কি বলতে চেয়েছিলাম ! ”
” হুম , বলুন। ”
” আসলে এ কথাটি আমি কখনোই বলতাম না। কিন্তু মন যে আমার কথা মানে না। সে যে আমার আয়ত্তের বাহিরে চলে গিয়েছে। তাই না বলেও পারছি না। ”
” হুম, বুঝলাম। তবে এতো সংকোচ করার কিছু নেই। যা বলার বলে ফেলুন। ”
তানহা মুখে তো বলেছে সংকোচ করার কিছু নেই কিন্তু তার মনের মাঝে বইছে একরাশ ভয়ের স্রোত প্রবাহ। ভেতরটা তার টুক টুক করছে। অতল কোন জিনিসই বা চেয়ে বসে সেই ভয়ে! মনে মনে তানহা ভাবছিল কথাগুলো। এর মাঝেই অতল বলে উঠে,
” তোমার হাতের ওই তোয়ালেটা দিবে? ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে তোমার ওই ভেজা চুল নিজের হাতে মুছে দিতে। ”
তানহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তবে তার মনের এক অংশও চাচ্ছে না অতলেএ দ্বারা কাজটি করাতে। কিন্তু মনের কথা শুনলে যে চলবে না তার। পারিপার্শ্বিক দিক চিন্তা করেই তাকে এখন থেকে চলতে হবে।
তানহা আস্তে করে তোয়ালেটা মেলে ধরল অতলের সামনে।
অতল কিছুটা অবাক হলেও আবার নিজেকে সামলে নিল এই ভেবে, “তারই তো বউ।সেতো আহামরি কিছু চায়নি যেটা দিতে কি-না তানহা দ্বিধা বোধ করবে। আর স্বামী হিসেবে এতটুকু তো চাইতেই পারে সে।” মুচকি হেসে তোয়ালেটা নিয়ে তানহার পেছনে দাঁড়ালো অতল। খুব আলতো করে তানহার প্রতিটা চুল মুছে দিচ্ছে। তানহার ব্যাথা অনুভূত যেন না হয়। মাঝে মাঝে তানহার অজান্তেই চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে অতল। আর ভাবছে, ” তার বউয়ের চুলের ঘ্রাণ তো মারাত্মক! যেমন লম্বা চুল তেমন তার ঘ্রাণ। এই লম্বা চুলেই তো সে বারবার মৃত্যু বরণ করতে বাধ্য। আর ভেজা চুলের মিষ্টি ঘ্রাণে সেতো অলরেডি মাতোয়ারা হয়েই গিয়েছে। তবে আরও যে কতো মাতোয়ারা হওয়া বাকি সে এক আল্লাহ-ই জানে। ”
এদিকে তানহা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে আর ভাবছে,” আজ না’হয় উনি ছোট একটা জিনিস চেয়েছে। তবে কাল.. কাল যে এর থেকে বেশি কিছু চাবে না তার কি কোন শিউরিটি আছে? নেই তো। কারণ তার সেই অধিকার আল্লাহ তা’য়ালা দিয়েই দিয়েছেন তানহার উপর। তাই তানহার “না বোধক ” শব্দটির কোনো মূল্য নেই। অবশ্য আছে তবে তা নিজের মনের মাঝে জন্য কিন্তু প্রকাশ্যের জন্য নয়। যেমন আজ তার মন এই ছোট্ট ব্যাপারটিকেই সায় দেয়নি। কিন্তু সেকি তার মনের কথা শুনতে পেরেছে? পারেনি তো। শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিক কথা ভেবে। কাল যখন এই মানুষটি তার স্বামীর অধিকার ফলাতে তানহার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তানহা কি পারবে তাকে আটকে রাখতে? পারবে না। মনের মাঝে “না বোধক ” শব্দটি তাকে চাবুক দিয়ে পেটালেও সে পারবে না মুখে না করতে। কারণ ওই যে পারিপার্শ্বিক কথা ভেবে। তবে তার নিত্যদিনের সঙ্গী হবে এই ফোঁটা ফোঁটা নোনা জল। ”
অতল মহানন্দে তানহার মাথা মুছে দেয়ায় ব্যস্ত থাকলেও হঠাৎ করে তার বুকে ধক করে ওঠে। বুকের বাম পাশ টায় চিনচিন ব্যাথা অনুভূত হয়। কেন যেন বারবার তার মনে হচ্ছে তানহা কাঁদছে। তাই তানহার মাথা থেকে হাত নামিয়ে তোয়ালেটা জানালার গ্রিলে রেখে তার দু’হাত দিয়ে তানহাকে নিজের দিকে ঘুরে দাঁড় করায়। তানহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। অতল তার বাম হাত দিয়ে তানহার কাঁধ জড়িয়ে ডান হাত দিয়ে তানহার থুতনি ধরে মাথা উঁচু করে। তানহার মুখটি দেখতেই অতলের বুক ছ্যাঁত করে উঠল। তার ভাবনাই যে ঠিক। তানহা যে নীরবে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। তানহার চোখ জোড়া মুছে অতল বলল,
” কাঁদছ কেন এভাবে? বাড়ির কথা মনে পড়ছে? নাকি আমি চুল মুছে দিয়েছি বলে খারাপ লাগছে? ”
তানহা অতলের কথার কোনো উত্তরই দিল না। এদিকে অতল তানহার নীরবতা দেখে বলল,
” বুঝেছি, কেন তুমি কাঁদছ। আমার ছোঁয়া তোমার ভালো লাগছে না তাই তো?না লাগার-ই কথা। বিয়ে হয়েছে বলে প্রথম রাতেই যে অচেনা এক পুরুষকে ভালো লাগতে হবে তার কোনো যুক্তি নেই। হয়তো অন্য ছেলেদের কাছের এর যুক্তি আছে তবে আমার কাছে নেই। তাইতো সেভাবে তোমার কাছে ঘেঁষছিও না। যতটুকু না ঘেঁষলেই নয় ঠিক ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ আছি। কিন্তু আমি তোমাকে যতটুকুই ছুঁয়েছি খারাপ মনোভাব নিয়ে ছুঁইনি যাতে তোমার খারাপ লাগতে পারে, কষ্ট পাও, কান্না করো। আমিতো জাস্ট চুল টাই মুছে দিয়েছি। অবশ্য তুমি হয়তো এটাই ভেবেছিলে এখন হয়তো চুল মুছার বাহানায় কাছে এসে ব্যাপারটিকে ফ্রি করে কিছুক্ষণ পর হয়তো স্বামীর অধিকার ফলাতে কাছে আসব। ঠিক বলেছি আমি? শোনো তানহা, পৃথিবীতে সবাই একরকম না। একেক জনের চরিত্র একেক রকম। তাই একজনের সাথে অন্যজনের তুলনা কখনোই করবে না। আমার যদি কোনো বাজে মনোভাব থাকত তাহলে চুল মুছে তোমার কাছে যাবার প্রয়োজন ছিল না। কারণ তোমার কাছে যাওয়ার পারমিশন আল্লাহ তা’য়ালাই আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। তার জন্য কোনো প্রকার ছুঁতোর প্রয়োজন অন্তত আমার পড়বে না। সেই অধিকার আমার আছে কিন্তু তোমাকে আমি সময় দিব। তোমার অনুমতি ব্যতীত আমি সেরকম কিছুই করব না। তবে হ্যাঁ, সেই সময়টা যেন সর্ট টাইমের হয়। কারণ আমি কোনো উপন্যাসের নায়ক কিংবা ফিল্মের হিরো না যে, তোমার কাছে না যেয়েও বছরের পর বছর অপেক্ষা করে বসে থাকতে পারব। এটি একটি বাস্তব জীবন। যেখানে সবকিছুরই প্রয়োজন রয়েছে। আশা করব আমার প্রতিটি কথার অর্থ তুমি বুঝতে পেরেছ। ”
তানহা মুখে কিছু না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি জানিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
অতল তানহার সম্মতি পেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
” ও, এতগুলো কথার মাঝে কিছু কথা বলতে তো ভুলেই গিয়েছি। ”
অতলের কথা শুনে তানহা চোখ দুটো বড় করে ফেলল। আর তা দেখে অতল বলল,
” ভয় পেয়েও না। তেমন কিছুই বলব না। শুধু কিছু আর্জি রাখব যেগুলো তুমি না করতে পারবে না। যেমন – ১. তোমার চুল মুছার অনুভূতি থেকে আমায় কোনোদিন বঞ্চিত করতে পারবে না। এই কাজটা শুধু আমিই করব তুমি না। ২. মাঝে মধ্যেই আমার শক্ত দু’হাতের মাঝে তোমার কোমল দুটো হাত মুষ্ঠিবোদ্ধ করব। তখন তুমি মন খারাপ করতে পারবে না। হাসি মুখে আমার স্পর্শ গুলো অনুভব করবে। ৩. রাতে কখনো আমার থেকে দূরে সরে ঘুমাবে না। অবশ্য আমি তোমায় ধরব না। কারণ ঘুমের মাঝে হাত কোথা থেকে কোথায় চলে যায় বলা তো যায় না। তাই তুমিই আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে তাও আবার বুকের উপর শুয়ে। ব্যাস আর কোনো চাওয়া নেই। এই তিনটি চাওয়াই পূরণ কারে দিও তাহলেই হবে। বুঝতেই তো পারছ পুরুষ মানুষ বলে কথা! বউকে কাছে পেয়েও তার কাছে যেতে পারব না। এর থেকে কষ্টের কি কিছু আছে বলো? তাই নাহয় তাকে বুকের উপর ঘুম পাড়িয়েই মনকে সান্ত্বনা দিব। ”
কথাটি বলেই অভিনয়ের কান্না কাঁদল অতল। আর তা দেখে তানহা দুঃখের মাঝেও ফিক করে হেসে দিল। সেই হাসি দেখে অতল বলল,
” যাক বাবা! লাস্টের কথাগুলো তাহলে কাজে দিল। ”
” মানে? ”
” মানে লাস্টের দু’লাইন তোমাকে হাসাবার জন্য বলেছিলাম। আর এই দেখো তুমি ঠিকই হেসেছ। তাহলে লাইনগুলো আমার কাজে দিলো তো? ”
” হুম, দিল। ”
” এবার তাহলে যাও শুয়ে পড়ো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তারপর না’হয় আমার বুকের মাঝে শুয়ে ঘুমাবে! ”
তানহা কিছু না বলে মুচকি হাসি দিয়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। আর অতল পা বাড়ালো ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্যে।
.
শ্বশুর বাড়িতে আজ প্রথম দিন তানহার। আর আজই তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল? উফফ! কি বাজে ব্যাপারটাই না ঘটলো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে নিল তানহা।
.
.
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here