অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -২৫

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৫ (প্রেমপুষ্পের অকাল পতন)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

সকাল সকাল আশা অর্ষার রুমে এলো। ঘুমন্ত অর্ষার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দু’হাতে জড়িয়ে নিল। মায়ের বুকের উষ্ণতা পেয়ে অর্ষা অধর প্রসারিত করে হাসল। বলে উঠল, “গুম্মন্নিং, মাম্মা!”

আশাও তার মতো টেনে টেনে বলল, “গু-ড মর্নিং, প্রিন্সেস!”

“এবার ঘুমাব। গুড নাইট!”

অর্ষার এমন ধূর্ততা দেখে আশা না হেসে পারল না। শক্ত করে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “ওরে দুষ্ট!”

অর্ষা বন্ধরত চোখে বলল, “হয়েএএ!”

“স্কুল আছে তো!”

“যাব না, মাম্মা!”

“তো কী করবে?”

“ঘুমাব।”

“তোমার তনুমা কিন্তু এরকম আলসেমি একটুও পছন্দ করে না, সোনা।”

অর্ষা ‘তনুমা’ শুনেই ত্বরিতে চোখ খুলল। কাল রাতে আশা অর্ষাকে তনুজার গল্প শুনিয়েছে। ছোটোখাটো কিছু বিষয়কে সুন্দর মতো উপস্থাপন করেছে অর্ষার সামনে। যেমন, “একটা তনুশ্রী ছিল। খুব পরিশ্রমী, খুব মেধাবী। সবাইকে কী রকম আগলে রাখত, সবাইকে কত ভালোবাসত, সবার কতটা খেয়াল রাখত! ধৈর্য ছিল মাটির মতন, অভিমান ছিল আকাশের মতন।”
দোষগুলো সব ঢেকে-ঢুকে গুনগুলোকে বিশালাকার বানিয়ে অর্ষার সামনে তুলে ধরেছে। নিজের কাছে রাখা তনুজার বেশ কিছু ছবি দেখিয়েছে। অর্ষা তনুজাকে এর আগেও দেখেছিল। আবার ছবি দেখতে পেয়ে বলেছিল, “মাম্মা! তুমিই তো বলেছিলে, এটা আমার আরেক মাম্মা!”

“হ্যাঁ, তো!”

“কী করে? বাবাইকে বলায়, বাবাই রাগ করেছিল প্রচণ্ড!”

“সে কী! বাবাইকে বলতে গিয়েছিলে কেন?”

“তুমি বলোনি বলেই তো গিয়েছিলাম!”

“আচ্ছা! আসলে তোমার তনু মাম্মার অভিমান অনেক বেশি ছিল।”

“অভিমান কী, মাম্মা?”

“আব্.. রাতে বাবাই তোমার জন্য ডেইজি আনতে ভুলে গেলে, তোমার কেমন লাগে?”

“মন খারাপ লাগে, কান্না লাগে, রাগ লাগে!”

“সেটাই! তনুজারও তেমন লেগেছিল।”

“বাবাইকে কি ওকে ডেইজি দেয়নি? বাবাই পচা কাজ করেছে তো!”

“না না, সেটা না। তোমাকে অভিমান শব্দের মানে বোঝাচ্ছিলাম। বুঝেছ?”

“এটাকে অভিমান বলে?”

“হ্যাঁ, মা!”

“আচ্ছা, এরপর?”

“এরপর, সে একদিন লুকিয়ে পড়ে।”

“কোথায়?”

“জানি না তো! বাবাই প্রচুর খোঁজে। পায় না।”

“সেদিনের মতো? ওই-যে, একদিন ফ্রেন্ডসদের সাথে হাইড অ্যান্ড সিক খেলতে খেলতে আমি বেসমেন্টে লুকিয়ে পড়েছিলাম, এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাবাই অনেক খুঁজেও পায়নি। তারপর যখন পেল, তখন আমাকে কত্ত বকল! বাবাই কি তবে এজন্য রাগ করেছে তনু মাম্মার প্রতি?”

“ধরা যায় তা-ই!”

“তাহলে তো বাবাই একদম ঠিক করেছে! বাবাইয়ের টেনশন হয়নি বুঝি? তনু মাম্মা এরকম কেন করল?”

“তুমি কেন করেছিলে?”

“আমি তো খেলছিলাম, ভুলে হয়ে গেছে।”

“তোমার তনু মাম্মাও খেলছিল। এতকিছু হবে, বোঝেনি।”

“আমি ওকে তনুমা বলি? মাম্মা তো তোমায় ডাকি!”

“আচ্ছা, ডেকো।”

“হ্যাঁ, তো তনুমা এখন কোথায়?”

“অনেক দূরে!”

“লুকোতে লুকোতে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল?”

“হ্যাঁ, মা!”

“ফেরেনি আর?”

“নাহ!”

“বাবাই মারবে বলে ভয় পেয়েছিল? ওকে বলে দিয়ো—আমার বাবাই বেস্ট! সবাইকে বোঝে, সবাইকে ভালোবাসে। তাকে ফিরে আসতে বোলো! আমার তাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমরা একসাথে খেলব! সে আমার সাথে খেলবে তো?”

জবাবে আশা বলতে পারে না—তনুজার ফিরে আসার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে সে নিজে। তাকে ডিঙিয়ে তনুজা সিদ্দিকের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তাকে বলতে পারে না—তার বাবাই সবাইকে বুঝলেও তনুজাকে বোঝেনি, আশাকে বোঝেনি। রমনীদের প্রেম বোঝায় সে বড্ড কাঁচা, এখনও কি নবীন?

“মাম্মা! তনুমার কাছে নিয়ে যাবে?”
ভাবনার মাঝে এখন ঘুমন্ত অর্ষার হঠাৎই জাগন্ত কণ্ঠ শুনে আশা চকিতে চাইল। জবাবে কী বলবে ভাবতে গিয়ে শব্দ খোঁজা লাগল। অর্ষা তাড়া দিলো, “কী হলো! নিয়ে যাবে না?”

আশা কৃত্রিম হেসে বলল, “যাব তো! অবশ্যই নিয়ে যাব। তবে আজ নয়।”

“কবে?”

“যবে তুমি বড়ো হবে!”

“আমি তো বড়োই, মাম্মা! আর কত?”

“আর ততটা বড়ো, যতটা হলে তোমার তনুমাকে দেখার জন্য, আমাদের হেল্পের প্রয়োজন পড়বে না।”

“আমি তো নিজের কাজ সব নিজেই করতে পারি। শুধু জুতোর ফিতেটা বাঁধতে পারি না! আচ্ছা, আমি শিখে নেব। কিন্তু!”

“কী?”

অর্ষা এই ‘কী’-এর উত্তর দিলো না। চোখ পড়ে তার মা মুচকি হাসল। অর্ষাকে বিছানায় বসিয়ে, ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে সে নিজেও বসল। আলতো হাতে তার গাল স্পর্শ করে আশা বলে উঠল, “এখন আপাতত তনুজার সাথে কথা বলতে পারো। তবে বাবাইকে বলা যাবে না।”

“সত্যিই কথা বলতে পারব?”

“হ্যাঁ, পারবে তো!”

“তবে, আমি বাবাইকে একদমই বলব না।”

_____
আকাশের মেঘাচ্ছন্নতার সাথে পাল্লা চালিয়ে যাচ্ছে তনুজার গুমোট-বাঁধা মনটি। কিছুদিন ধরে খুব অসহনীয় লাগছে তার। রোজ-রোজ শুদ্ধর জ্বালাতন, প্রতিদিন নেওয়া খোঁজ, মাঝে মাঝে দেওয়া অনুশোচনা-পত্র, হঠাৎ হঠাৎই পাগলামি, দেখা হলেই মুচকি হাসা, আনমনেই কোঁকড়ানো চুলগুলো চুলকে নেওয়া, গজদাঁত বের করে এক গাল হাসা—বার বার বিরক্ত হলেও, সহ্য করে নেওয়া যেন তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।

মহাপুরুষ ছাড়া কারোরই সাধ্য নেয়, স্ব-অভ্যেসের বহির্ভূত কিছু করা। তনুজাও পারছে না। পারছে না বললে ভুল হবে, পারছে! কিন্তু কিছু একটার ঘাটতি দারুণভাবে ভোগাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে—বুকের মাঝটা শূন্য, অনেকটা আকাশের বুকে যেন নীলিমার অভাব! মনে হচ্ছে—কিছু জ্বালাতন খারাপ না, সুন্দর! অদ্ভুত রকমের প্রশান্তিদায়ক!

কিছু মানুষ থাকে না? যাদের জন্মই হয় একা থাকার জন্য, কষ্ট পাওয়ার জন্য। স্রষ্টা বোধহয় তনুজাকে তেমনই একজন বানিয়েছেন।

তাই তো—তনুজা কাঁদে না, অভিযোগও করে না। আগের মতো অভিমানে গাল ফোলায় না, রাগে রণচণ্ডীও হয় না। কেবল প্রতিপদে চমকে ওঠা মেঘাচ্ছন্ন আকাশটির দিকে তাকায় আর হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে চিৎকার করে বলে ওঠে, “হে, পৃথিবী! তুমি না চাইতেও আমি খুব ভালো আছি। এই দেখো! হাসছি!”

প্রকৃতি বোধহয় লজ্জা পায়। মুখ লুকোয় অন্ধকারে। তনুজা এতে মজা পায়। মজা পায় ঝোড়ো হাওয়া, অশান্ত পরিবেশ দেখে। তনুজার এমন নির্জীবতা দেখে আকাশ যখন বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে ওঠে, তনুজা তখনও আকাশের কর্ম দেখে রঙ্গ করে হাসে।

আজ দীর্ঘক্ষণ আকাশটা অন্ধকার হয়ে রইল। তনুজা নিষ্পলক ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষায়।
ক্ষণিকের মাঝেই বৃষ্টিরা দলবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ল। তনুজা নির্নিমেষ নেত্রে আরও এগিয়ে গিয়ে বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। দক্ষিণা হাওয়ায় জন্য বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা এমুখো হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে তনুজার সর্বাঙ্গ। মুখে শীতল স্পর্শ পেয়ে সে মুচকি হেসে বিরবির করে বলে উঠল, “আমি কাউকে বলব না—মানুষ দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়ে। কাউকে বলব না।”

তারপর থামল। আবার বলল, “প্রথম প্রেমে পড়ার পর মানুষ নব্য প্রেমী হয়। শিরশির করে কাঁপতে থাকা শরীর, উথাল-পাতাল ঢেউ খেলা হৃৎস্পন্দন, প্রিয়তমের শূন্যতায় বুকের হাহাকার, কাছাকাছিতে অবিশ্বাস্য ধরনের সুখ, চোখের ভাষার না-চাইতেও দিক পরিবর্তন, চারপাশে সুখ-প্রজাপতির ওড়াউড়ি, অনুভূতিদের সম্মিলিত সাক্ষাতকার—সবটাই তখন অচেনা। প্রেম পেরিয়ে সম্পর্কটা যখন অনেক দূর এগোয়, তখন তারা বুঝতে পারে যে, এখানটায় প্রেমপুষ্পের প্রস্ফুটন হয়েছে। তারা আগে বোঝে না.. বোঝে না কী করে প্রেয়সীর মান ভাঙাতে হয়, কী করলে প্রেমিকপুরুষও হুটহাট বুকে আগলে নেয় অকারণে! নতুন অনুভূতি তো! বুঝতে বুঝতেই প্রেমপুষ্প ঝরে পড়ে।
তাই, দ্বিতীয় প্রেমের সূচনাতে এই একই অনুভূতি চিনতে আমি ভুল করিনি। তার প্রেমে পড়তে আমার লেগেছিল পাক্কা সাঁইত্রিশ সেকেন্ড। প্রথম বারো সেকেন্ডের মাথাতেই আমি ধরে ফেলেছিলাম—নিজের ভেতরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলাপাকানো অনুভূতিদের একত্রিত হয়ে ডানা ঝাপটানো। আমি এরপরের বিশ সেকেন্ড নিজেকে আটকানোতে লাগিয়েছিলাম। খুব করে চেয়েছিলাম, অনুভূতিরা মরে যাক। অথচ তারা মরল না। শেষ পাঁচ সেকেন্ডে আমি নিজের চেয়ে আ-ট বছরের ছেলেটাতে গভীর থেকে গভীরভাবে ডুবে গেলাম.. তার ডোবার আগেই। সে আমার দিকে প্রেমময়ী নজরে তাকানোর আগেই আমার মনের গহীন থেকে তার জন্য প্রেম-প্রজাপতিরা দলবদ্ধ হয়ে ওড়া শুরু করল। অথচ, শিক্ষিকা তনুজার জন্য স্বীয় শিক্ষার্থীর তরে প্রেম-বিনিময় ছিল নিষিদ্ধ। ইশ, শুদ্ধ! আমি এই প্রফেশনে না থাকলে তোমায় ফেরাতাম না।”

তনুজা চুপ মেরে গেল। অনেকটা সময় লাগাল। বৃষ্টির তেজ বাড়ছে, আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে আস্তে-ধীরে। তনুজার মনে প্রশ্ন জাগে! ধরার আকাশে মেঘ জমে, বৃষ্টি হয়, আকাশ পরিষ্কারও হয়। অথচ, তার মনাকাশের মেঘ কেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে না? সে কি এতটাই পাষণ্ড?

জবাবে স্বকীয় মনও মনের অধিনস্থ দুই পুরুষের মতো বলে ওঠে, “তুই সত্যিই পাষণ্ডী। শুদ্ধর ভাষ্যমতে—সত্যি সত্যি সত্যি!”

তনুজা পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকায়। নতমুখী হয়ে মিনমিনে স্বরে বলতে লাগে, “আ..আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমা চাই। প্রিয় বর্ষন! তার কানে পৌঁছে দিয়ো—তার অলকানন্দা তাকে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না-পারার জন্য ধারা ঝরা ধরণীর মতো দুঃখিত। কেবল বোলো না যে—তার প্রেম এক তরফা ছিল না। বোলো না—প্রেমপুষ্প এই পাশেও ফুটেছিল।”

চলবে?
শব্দসংখ্যা-১৩১৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here