#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৬
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
নিস্তব্ধ রাত। জানালার বাইরের ঝিঁঝির একটানা ডাক ভেসে আসছে। এহসাস লাইটার জ্বালিয়ে হাতঘড়ি দেখল। পৌনে দশটা বাজে। অন্ধকার ঘরের বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চাঁদের আলো আজ বড্ড উজ্জ্বল। দিনের আলোর মতো ঘরের ভেতর দেখতে পাচ্ছে। শব্দহীন পায়ে পায়ে এই ঘরের ভেজানো দরজার দিকে এগিয়ে গেল। নিঃশব্দে খুললো দরজাটা। একটু ডানদিকেই ছোটো রুমটা। এই রুমের জানালা বন্ধ এবং তার ওপর মোটা পর্দা ফেলে দেওয়া। সামনেই রান্নাঘর। দরজা নেই। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে গলে আসা জ্যোৎস্নার আলো এ ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। তবে কিছু কোণায় এখনও অন্ধকার। এহসাস সেদিকে পা বাড়ায়। ছোট্ট এই রুমটার এককোণে একটা খাট পাতা। যার ওপর এখন নিরুপমা ও ওর মা ঘুমিয়ে আছে। খাটের বা’দিকে পুরোনো ফ্রিজটা রাখা, সামান্য দূরে একটা লোহার র্যাক ও একটা প্লাস্টিকের র্যাক। প্যাস্টিকের র্যাকটা ঠিক রান্নাঘরে ঢোকার দেওয়ালের সাথে। ডান দিকটাতে দুজন লোক একসাথে চলার জায়গাও হবে না এমন সংকীর্ণ। এই সংকীর্ণ পথটুকুর শেষ প্রান্তে সদর দরজা। এহসাসের উচিত এক্ষুনি দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়া। এখানে আর একদিন থাকা ওর জন্য বিপজ্জনক। তাই ভেবেই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কেন যেন পা’টা উলটো দিক এগোতে লাগল। থামল ঠিক নিরুপমার শিওরের পাশে। হাঁটুর ওপর বসল। সামনে শায়িত নিরুপমা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
এই মেয়ের চেয়ে ঢের সুন্দরী মেয়ে দেখেছে এহসাস। এই মেয়ের আর কী রূপ! গায়ের রঙ শ্যামলা। ঠোঁট রুক্ষ, গোলাপিও নয়। ওর ছোট্ট সরু নাকটা অবশ্য কিউট৷ এহসাস তর্জনী দিয়ে নাকটা আলতো করে স্পর্শ করতে নিরুপমা নড়েচড়ে ওঠে। চট করে হাত সরিয়ে নেয় এহসাস। করছে টা কী! ঘুমের সুযোগ নিয়ে একটা মেয়ের নাক স্পর্শ করছে! পাপ- পূন্য নিয়ে আর সবার মতো ভাবে না। কিন্তু বিবেক ওর আছে। তাছাড়া এসব ছোঁয়াছুয়িতে প্রচন্ড অ্যালার্জি। এই মেয়েটির নাকটা বোধহয় একটু বেশিই কিউট। কেবল এই নাকটা। এহসাস নিজের কথাতে নিজেই ঠাট্টা করে হাসে।
রান্নাঘরের জানালা গলে যে জ্যোৎস্নার আলো এ ঘরে এসে পড়ছে, তার কিছুটা নিরুপমার মুখের আঁধার ম্লান করেছে। আলো-আঁধারির এক চমৎকার পোট্রের্ট যেন ওর মুখ। এহসাস তাকায়। তাকিয়েই থাকে নিরুপমার ঘুমন্ত মুখের দিকে।
হঠাৎই নিরুপমার ঘুম পাতলা হয়ে গেল। তারপর মনে হলো কেউ সামনে বসে আছে। ভয় ভয়ও করল। কে জানে চোখ খুললেই দেখবে কোনো ভয়ংকর মূর্তি দাঁত কেলিয়ে হাসছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে রইল। মনের ভয় বলে উড়িয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে, ঘুমিয়েও যেত কিন্তু কারো হাঁপ ছাড়ার শব্দ শুনতে উড়ে গেল ঘুম। পিটপিট করে তাকায়। মুখ চিনতে পেরে চকিতে তাকাল। ধড়ফড়িয়ে বসল বিছানার ওপর।
“আপনি!” পরক্ষণেই মনে পড়ল পাশে মা ঘুমিয়ে আছে। সামলে নিলো নিজেকে। বুকের বা’পাশে একটা হাত। ভয়ে ওর বুক ফাটার উপক্রম।
“আপনি এখানে কী করছেন?” চাপা গলায় বলল ও। এহসাস উঠে দাঁড়ায়। ওর প্রশ্ন এড়িয়ে বলে,
“আমি চলে যাচ্ছি।”
“এখন?” নিরুপমা ভুরু কুঁচকায়। তারপর দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখল। দশটা বাজে। এহসাসের দিকে তাকিয়ে দেখে ওরই দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে। নিরুপমা অপ্রতিভ হয়ে যায়। ওড়না মাথায় টেনে বলল,
“ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে?”
নিরুপমা কপাল কুঁচকায়। এহসাস ওর দিকে একটু এগিয়ে এলো।
“এত সহজে ঠিক আছে? আমি গেলে খুশি হও?”
নিরুপমা সকাল থেকে খেয়াল করছে এই লোক আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন করছে। কী সহজে!
“আপনি তো আমার কুটুম বা জ্ঞাতিগোষ্ঠির কেউ নন। অচেনা একজন লোক যে জোর করে অ*/স্ত্রের মুখে আমার বাসায় আছেন। অবশ্যই আপনি গেলে আমি খুশি হব। এটাই তো স্বাভাবিক।”
কোনো এক কারণে এহসাসের এই কথা ভালো লাগল না। চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে। নিরুপমা বুঝতে পারছে ওর কথা শুনে এহসাস সন্তুষ্ট হয়নি। তাতে ওর বয়েই গেল। এমন না যে এই লোকের মুখের ওপর সোজাসাপ্টা জবাব দেওয়া সহজ। মোটেও না। কিন্তু লোকটার সামনে যতটা সম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করছে।
এহসাসের তীব্র চাহনি উপেক্ষা করে নিরুপমা অপাঙ্গে তাকালো।
“আপনি গেলে দরজাটা লাগিয়ে দিতাম। ঘুম আসছে খুব।”
নিরুপমা সংকোচ কাটিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। যেন সত্যি তাড়া। এহসাস তখনও চুপ। মিনিট খানেক কী ভেবে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। নিরুপমা একটু পর পিছু নেয়। এহসাস দরজা খুলে বাইরে বের হতে নিরুপমা দরজায় দাঁড়ালো। দেবে তখনই এহসাস ধরে ফেলল দরজাটা৷ ভয় পেল নিরুপমা।
“ছাঁদ পর্যন্ত এগিয়ে দেবে চলো।” শান্ত গলায় বলল এহসাস।
নিরুপমার বুক ঢিপঢিপ করছে। বলে কী এই লোক! সমস্ত জোর দিয়ে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করে বলে,
“না।”
“না?”
“আপনি প্লিজ চলে যান।”
“তাইতো যাচ্ছি। শুধু ছাঁদ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে অনুরোধ করছি।”
নিরুপমা একটু ভাবল। অনুরোধ! কিন্তু সাহস পাচ্ছে না৷ আবার না করে দেওয়া উচিত। করবে কী?
“ছাঁদ পর্যন্ত কিন্তু।”
“হুম, ছাঁদ পর্যন্ত।”
চাবির গোছা শক্ত মুঠে ধরে ছাঁদের কিনারে এসে দাঁড়ায় নিরুপমা। বুক কাঁপছে। এহসাস পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। ওই জিনিসের গন্ধে নিরুপমার পেট মুচরে ওঠে। রাগ হচ্ছে খুব। ইচ্ছে করছে চাবির গোছা দিয়ে লোকটার মাথায় এক বাড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দিতে। ছাঁদ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে ঘর তালাবন্ধ করতে হবে কেন? লোকটা জবাব দেয় না। বারবার পি*/স্তল দেখায়। নিরুপমার হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে করে এই পি*/স্তল যেভাবেই হোক কেড়ে লোকটাকে ঠিক একইভাবে ভয় দেখাতে৷ নিজের ওপরও ক্ষোভ কম না। কেন এলো? কেন না এর ওপর দৃঢ় থাকতে পারল না! দৃঢ় থাকলেই কী এই লোক ছেড়ে দিতো? নিরুপমা চায় যত তাড়াতাড়ি হয় লোকটা ওর জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে যাক। চিরতরে।
এহসাস এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে নিলো। রাত দশটার পর এই এলাকা সুনসান। রাস্তায় দু, একটা কুকুর ছাড়া মানুষ তেমন চোখে পড়ে না। তবুও সতর্কে পা ফেলতে হবে। গতদিন বাড়ির পেছন দিকের ছাঁদ সংলগ্ন যেই গাছটা বেয়ে উঠেছিল সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সিগারেট দু আঙুলে নিয়ে মুখ ও নাক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“গাছ বেয়ে নেমেছ কোনোদিন, নিরুপমা?”
চলবে,,,,
আজকের পর্ব ছোটো হয়ে গেল! পরের পর্ব বড়ো করে দেওয়ার খুব চেষ্টা করব এবং আগের পর্বগুলো থেকে ভিন্ন হবে সেটা।