অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -০৫

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৫
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

নিরুপমা রান্না ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতে অগ্নিশর্মা এহসাসের মুখোমুখি হয়। ওর সামনে দাঁড়িয়েই শার্ট পরল। হাতে এখনও ধাতব বস্তুটি। নিরুপমা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। ভয় যে পেয়েছে সেটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। মাকে এক নজর দেখে নিলো। এখনও ঘুমিয়ে আছেন। মনে মনে স্বস্তি পেল।

“ইচ্ছে করে করেছ, না?” কর্কশ গলায় বলল এহসাস। নিরুপমা কপাল কুঁচকায়।

“কী?”

“পর্তুগিজ ভাষা বলেছি যে বুঝতে পারো নি?” নিরুপমার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে,

“বলেছিলাম না আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করলে তুমিও বিপদে পড়বে। তারপরেও শব্দ করে লোক ডাকলে?”

নিরুপমা জোর করে হাত ছাড়িয়ে রেগে তাকায়। মানুষের ধৈর্যের সীমা থাকে! ঘুমন্ত মায়ের দিকে আরেকবার তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলে,

“আপনার মনে হচ্ছে না একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন। আল্লাহ পাক আমার মুখ দিয়েছেন তাতে শব্দও মাশাল্লাহ বের হয়। সেই মুখ দিয়ে যখন চিৎকার করে আপনার মতো খু* নির উপস্থিতি পুরো দুনিয়াকে জানাতে পারি, তখন ওইটুকু গ্লাস আর প্লেট ভাঙার শব্দ করে মানুষ জানাতে যাব কেন? কেবলমাত্র আমার মায়ের কথা ভেবে আপনার মতো একটা লোককে না চাইতেও বরদাস্ত করতে হচ্ছে। মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ লোক কোথাকার!”

এহসাসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। খু* নি! আপনার মতো লোক! মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ! আহ! কী বিশেষণ! আঙুল তুলে কিছু বলতেই যাচ্ছিল নিরুপমা হাত তুলে থামিয়ে দেয়,

“কিছু বলার আগে শুনে নিন দরজার বাইরে বাড়িওয়ালা চাচা দাঁড়িয়ে। ভাড়াটিয়ার খোঁজ খবর নিতে মাঝেমধ্যেই তিনি আসেন। আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

“আমি কাওকে ভয় পাই না।”

“তাহলে লাফ দিয়ে এসেছেন কেন এখানে। যান গিয়ে নাক ডেকে ঘুমান। আমি তাঁকে দরজা থেকেই বিদায় করে দেবো।” নিরুপমা পাশ কেটে দু’পা এগিয়ে আবার থামল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,

“এই শুনুন।”

এহসাস ফিরে তাকাতে বলে,

“যতদিন এখানে আছেন খবরদার আমাকে স্পর্শ করবেন না। মনে রাখবেন কথাটা। রুমে যান।”

নিরুপমা ঘুরে দরজার দিকে এগোলো। এহসাস নড়ল না। নিরুপমার গলার ঝাঁঝে এহসাসের রাগ বাড়ে বৈ কমেনি৷ সকাল বেলা কাঁচা ঘুম নষ্ট করে এমন ঝাঁঝ দেখালে কারই না মেজাজ চটে! আবার আদেশ দেয়, রুমে যান!

দরজা খুলতে গিয়েও থেমে যায় নিরুপমা। পেছন ফিরে রেগে তাকায়৷ ওর মন চাচ্ছে ওই একরোখা, বদরাগী ও মিথ্যাবাদি মানুষটার কান টেনে লাল করে দিতে। যদিও বাবরিছাঁটা চুলে কান দুটো দৃশ্যমান না। কে জানে কান আছে কি না। বাবরিচুল নিরুপমার পছন্দ না। ঠিক এই লোকটার মতো। দু’ একটা চড় দেওয়া কী খারাপ হবে? না, মানুষকে আঘাত করার পক্ষপাতি ও নয়। আবার লোকটার হাতের ধাতব বস্তুটিকেও ভয় পায়। লোকটাকও কি কম ভীতিকর! সাথে বিরক্তিকর ও অসহনীয়! আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও।

“গেলেন না?” ঠোঁট নাড়িয়ে আস্তে আস্তে বলে যেন দরজার ওপর পাশে শব্দটা না যায়। এহসাস উলটো কাজ করল। এগিয়ে এলো ওর দিকে। নিরুপমা ভয় পাচ্ছে। বাড়িওয়ালা লোকটার উপস্থিতি টের পেলে নিরুপমা কি বিপদে পড়বে না! অবশ্যই পড়বে। যে পাপ করে এবং পাপীর সাহায্য করে উভয়ই সমান অপরাধী। এই অপরাধী লোকটাকে নিজ ঘরে রেখেছে এটাই ওর পাপ। এটাই অপরাধ। সমাজের লোক ও আইন ওর অপরাধের পেছনের ইচ্ছে আর অনিচ্ছার ধার ধারবে না।

“কী করছেন?” নিরুপমা ওকে থামাতে অগ্রসর হয়। এহসাস থামল। তাকালো পাশের খাটে। নিরুপমার মা নড়েচড়ে উঠছেন। চোখ খুলবেন খুলবেন অবস্থা। নিরুপমার মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। মা জেগে এই লোককে দেখলে রক্ষা থাকবে না। এহসাসের ঠোঁটের কোণে ক্রুর কুটিল হাসি ফোটে। নিরুপমা দেখতে পাওয়ার আগেই মিলিয়ে গেল। এহসাস দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঝুঁকে এলো। ফিসফিস করে বলে,

“তোমার আনন্দের মুহূর্ত সন্নিকটে, অমাবস্যা। এই তো এখনই তোমার মা আমাকে দেখে চিৎকার জুড়ে দেবে, তারপর বাড়িওয়ালা জেনে যাবে তারপর এলাকা তারপর…”

“আ..আপনি রুমে যান প্লিজ!” নিরুপমা সত্যি ভয় পাচ্ছে। অতি ভীতি মাঝে মাঝে মানুষের বোধবুদ্ধি দুর্বল করে দেয়। এহসাস মজা পাচ্ছে ওকে এভাবে দেখে। মনে মনে বলছে,
“আমাকে ভীতু বলা? আমার ওপর ঝাঁঝ দেখানো? রুমে যান! সৈয়দ এহসাস আরমানকে আদেশ করা? এত স্পর্ধা! কই এখন সেই স্পর্ধা গেল কোথায়?”

“কেন? আমি চলেই গেলেই তো খুশি হও। আমি বরং যাই।”

“প্লিজ না।” নিরুপমার মুখ আর্ত হয়ে ওঠে। দুহাত মেলে ওর পথ রুদ্ধ করে। এহসাসের ভারি আনন্দ হয়। কিন্তু গম্ভীর হয়ে বলে,

“তাহলে আবার বলো।”

“হুঁ?”

“প্লিজ শব্দটা আবার বলো। গুনে গুনে তিনবার।”

নিরুপমা ওর মতলব বুঝতে পেরে ঠোঁট শক্ত করে। এহসাস চ্যালেঞ্জিং দৃষ্টিতে তাকায়,

“বলবে না? বেশ। বেশ।” ধাবত বস্তুটির নল চোয়ালের আগাছার ন্যায় বাড়ন্ত দাড়িতে চালিয়ে নিলুফা বেগমের পায়ের কাছে খাটের ওপর বসতে গেলে নিরুপমা ওর বাহু চেপে ধরে।

“প্লিজ, প্লিজ, প্লিজজ..।” মাথা নুয়ে অগত্যা মধুসূদন নিরুপমাকে পরাজয় স্বীকার করতে হলো। এহসাস তাকালো বাহুতে রাখা নিরুপমার হাতের দিকে। যেন আগুন ছুঁয়েছে তেমনি করে হাত সরিয়ে নিলো নিরুপমা। এহসাস হাসল। একটা স্বাভাবিক মানুষ ভীষণ আনন্দ পেলে যেভাবে হাসে সেভাবে। নিঃশব্দ হাসি। এই প্রথম কি ওর হাসি দেখল নিরুপমা? এই লোকের চেহারা সুন্দর, বডি সুন্দর আবার হাসিও সুন্দর কিন্তু সে মানুষ হিসেবে অসুন্দর। বড্ড বেশি অসুন্দর। নিরুপমার হাতে কোনো জাদুশক্তি থাকলে লোকটার সকল সৌন্দর্য হরণ করে পৃথিবীর সবচেয়ে কদাকার মানুষটি বানিয়ে দিতো।

নিলুফা বেগম চোখের পাতা খোলার আগেই এহসাস বিজেতার মতো হাসতে হাসতে রুমে ফিরে গেল। দরজা ভেজানোর আগে নিরুপমার রাগত মুখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মাথাটা দুপাশে নাড়িয়ে খাটে শুয়ে পড়ল।

বাড়িওয়ালা চাচাকে নিয়ে বিপাকে পড়তে হলো না নিরুপমাকে। আজ তিনি দরজার মুখে দাঁড়িয়েই খোঁজ খবর নিলেন। কথায় কথায় নিরুপমা গু* লিবিদ্ধ ছেলেটার অবস্থা জানতে চাইল। ছেলেটা এখনও আইসিইউতে। অবস্থা তেমন সুবিধার না। নিরুপমা ছেলেটার গু* লিবিদ্ধ হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করবে তখনই নিচ থেকে বাড়িওয়ালাকে কেউ ডাকল। নিরুপমার আর জানা হলো না কারণ। রুমে ফিরতেই মা চেঁচিয়ে উঠলেন,

“বাড়িওয়ালা ব্যাডার লগে এত কীসের কথা রে তোর? সকাল হইতে না হইতেই ব্যাডা দুয়ারের সামনে নিরুপমা, নিরুপমা করতে করতে ডাক ছাড়ে।”

নিরুপমা জবাব না দিয়ে মায়ের বিছানার চাদর ঠিক করতে লাগল। কথা বললে কথা বাড়বে। মায়ের মুখে আরও অশ্রাব্য ভাষার যোগান হবে। একা হলে নিরুপমার শুধু গা ঘিনঘিন করত কিন্তু, এখন ওই ঘরে অচেনা এক পুরুষ। লজ্জা থেকে বাঁচতে নিরুপমা চুপ রইল। বেশি ভালো হয় এখন মায়ের সামনে থেকে অদৃশ্য হতে পারলে। তা কি আর সম্ভব! শিওরের দিকের চাদর গুঁজতে গেলে নিলুফা বেগম ওর চুলের মুঠি চেপে ধরে,

“কথা কস না ক্যান? সত্যি কইতে শরম করে? টাকাওয়ালা দেখে বুইড়ার সাথে শুইতে চাস না তুই? না কি শুইছোস, জবাব দে?”

ব্যথার চেয়ে লজ্জায় মরে বেশি নিরুপমা।

“তোমার মুখে কিছু বাধে না মা? নিজের পেটের মেয়েকে এমন নোংরা অপবাদও কেউ দিতে পারে?”

মেয়ের ভর্ৎসনা ও টলমল চোখ নিলুফা বেগমের হুঁশ ফেরায়। চুল ছেড়ে দিয়ে মুখ নামিয়ে নিলেন। নিরুপমা অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলে,

“আমাকে আতুরঘরে মেরে ফেলতে পারলে না কেন? তাহলে তো তুমিও শান্তি পেতে আমিও মরে বেঁচে যেতাম।”

নিরুপমা এক মুহূর্ত সেখানে থাকে না। মুখে ওড়না গুঁজে চলে গেল রান্নাঘরে। নিলুফা বেগম মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পান না। কিন্তু তিনি জানেন নিরুপমা কাঁদছে। জানালার বাইরে শূন্যে তাকিয়ে হাঁপ ছাড়েন আর বিড়বিড় করেন,

“তুই আর আমি এক না। কত তফাৎ আমাদের মধ্যে। হঠাৎ হঠাৎ কথাগুলো আমি ভুলে যাই। বড্ড ভুল হয় আমার। সাথে ভয়।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here