#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-২০
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
টিউশনির সময়টুকু উদ্বেগে কাটে নিরুপমার। কখন বাসায় ফিরবে সেই চিন্তায় থাকে সর্বক্ষণ। ওর মায়ের শরীরটা আরও খারাপ হয়েছে। স্যালাইন দিতে হয়েছিল গতরাতে। সকালে একটু ভালো দেখেছিল। এখন কেমন আছে সেই ভাবনায় ভাবিত হলো। এসি কেনার সামর্থ্য নেই। একটা চার্জার ফ্যান কিনবে সে টাকাটাও নেই হাতে। কেন নেই এই সামর্থ্যহীনতায় জর্জরিত হয়। নিরুপমা শিক্ষিত মেয়ে। এই বছরই পোষ্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে৷ কিন্তু ভালো জব খোঁজা বা করার উপায় ওর নেই। এমন না যে চেষ্টা করেনি। কিন্তু ভালো মাইনের জব জোটেনি। তাছাড়া অসুস্থ মা’কে কার ভরসায় রেখে যাবে? মা বোঝা নয়। মাই তো একমাত্র আপনজন ওর। সেই মা’কে সঙ্গ দিতে পারলেও সুখ দেওয়া হচ্ছে না। এই ব্যর্থতার দহনে অঙ্গার হয়ে যায় মাঝে মাঝে। মনে মনে তখন খুব ভাবে, বাবা না মরে ও মরলে বেশ হতো। অন্তত মা তো সুখে থাকত।
নিরুপমা সুখ চায় না। চায় না কথাটা হয়তো ভুল। সুখ কে না চায়? কিন্তু যাদের কপালে নেই তারা নিজেদেরকে প্রবোধ দেয় এই বলে যে, ‘ সুখ চাই না। শুধু শান্তি চাই, স্বস্তি চাই।’ নিরুপমাও সেই দলের মানুষ। এইটুকু জীবনের রূঢ়তায় সুখ নামক বৃহৎ বিলাসিতার লোভ করার সাহস পায় না। শুধু শান্তি ও স্বস্তি হলেও চলবে বা যে কোনো একটি। আশেপাশে অনেক মানুষকে দেখে ও, যারা জীবনভর দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে মহাকালের পথে ধাবিত হয়েছে। মৃত্যুই ওদের জন্য শেষমেশ শান্তি হয়েছে, স্বস্তি হয়েছে। হয়তো সুখও। মৃত্যুর কথা ভাবলে নিরুপমার ভেতরটা শিউরে ওঠে। সত্যি বলতে মরতে চায় না ও। তবে মাঝে মাঝে যখন চায় সেটা নিছক রাগে বা অভিমানে। কত আকাঙ্খা অপূরনীয় রয়েছে। আটাশ বছরের জীবনটা প্রেমহীন কেটে গেল। বিয়েটা পর্যন্ত করা হয়ে ওঠেনি। বাসা থেকে ওর বিয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল। উঠতি বয়সে অনেক জায়গা থেকে প্রস্তাবও আসত। নিরুপমা বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এখনও ঠিক নেই। বিয়ের প্রতি কেন যেন ওর অনীহা। মানুষ সেটাকে ভেবেছে অহংকার। গায়ের রংটা একটু শ্যামলা হলেও দেখতে ও খারাপ না। মেয়েমানুষ যতটা লম্বা হলে আজকাল চলে ও ততটাই। ছিপছিপে সুন্দর গড়ন। যেন গোধূলির আলো-আঁধারি রঙ তুলিতে আঁকা নিখুঁত এক পোট্রের্ট। যার সৌন্দর্য রঙে নয়, রূপে নয় আরও গভীরে৷ এই গভীরতা দেখার বা বোঝার দৃষ্টি সকলের থাকে না৷
“নিরুপমা?” থেমে পেছন ফিরল। বাড়িওয়ালা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
“টিউশন থেকে ফিরলে?”
“জি, চাচা।” বাড়িওয়ালার হাতে বাজারের ব্যাগ। নিরুপমা প্রশ্ন করল না। তার পাশে হাঁটতে লাগল।
“জেবিনের শরীর এখন কেমন চাচা?”
“আগের তুলনায় ভালো। তোমার মাকে শুনলাম কাল স্যালাইন দিতে হয়েছে।”
“জি, এখন একটু ভালো।”
হাঁটতে হাঁটতে নিরুপমা টের পেল বাড়িওয়ালা বার বার ওর গা ঘেঁষে চলছে। ভেবেছিল অনিচ্ছাকৃত। সরে যায়। কিন্তু ও যত সরে বাড়িওয়ালা ততই ওর দিকে ঘেঁষে হাঁটে। রুক্ষ আঙুলটা ওর হাতে ছুঁয়ে দেয়। নিরুপমা চোখ তুলে তাকাতে সাহস পায় না। কিন্তু পৈশাচিক এক চাহনি অনুভব করে। ওর ভেতরটা ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। একটা মানুষকে ও ভালো ভেবেছিল। হঠাৎ আজ তার এমন নীচ রূপে বিহ্বলিত। নিরুপমা কাকে বিশ্বাস করবে?
“দাঁড়িয়ে পড়লে যে?” নিরুপমার কানে এই স্বর বিষাক্ত, পঙ্কিল লাগল। দাঁত কামড়ে রাগ সংবরণ করে। সহজ হওয়ার ভান করে বলল,
“মুদি দোকানে আমার একটু কাজ আছে।” আর অপেক্ষা করল না। মুদি দোকানে ওর কোনো কাজ ছিল না। এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখল। বাড়িওয়ালা বাড়ির ভেতর ঢুকতে রাস্তায় নামল আবার। রূদ্ধশ্বাসে বাসায় এলো।
“নিরু এলি?”
ভেতরটা তিতকুটে হয়ে আছে। নিরুপমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। গুম ধরে বলল,
“হুম।” বোরকা খুলে হাত-মুখ ধুয়ে এক গ্লাস পানি পান করল। রান্নাঘরে গেল। ফজর আদায় করেই রান্নার পাট চুকিয়ে ফেলে। সকালে মা’কে খাইয়ে আবার দুপুরে এসে খেতে দেয়।
“তোমাকে খেতে দিই?”
“এইতো একটু আগে খেলাম।”
নিরুপমা ভুরু কুঁচকে রান্নাঘরের বাইরে এলো।
“একটু আগে খেলে মানে?”
“খুব খিদে পেয়েছিল। খালেদাকে ডাকতে ডাকতে মেয়েটা এসে খেতে দিলো। বড়ো ভালো মেয়েটা। একটু লাজুক। একটু না বেশিই।” বললেন নিলুফা বেগম।
“তুমি ওকে দেখেছ!”
নিরুপমার বুক কাঁপছে৷ নিলুফা বেগম মুখ গোমড়া করে বললেন,” ওই যে বললাম মেয়েটা লাজুক। মুখ ঢেকে নুয়ে ছিল। বোরকা পরা। তা বললাম, আমি কি মর্দা বেডা যে শরম পাইতাছো। কয়, ওর না কি লজ্জা লাগে কারো সামনে বেপর্দা যেতে। ছোটো থেকেই না কি এমন। কী কথা ক তো। আজকাল কার যুগে এমন মাইয়্যা আছেনি? হ্যাঁ, রে স্কুল, কলেজেও এমন ছিল?”
“অ্যা? হ্যাঁ, হ্যাঁ। এমনই ছিল ও। পারিবারিক অনুশাসনের কারণে ছোটো থেকেই এমন। এটা তো ভালো তাই না মা?” নিরুপমার হাত কাঁপছে। মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই। অপরাধবোধে ভোগে। নিলুফা বেগম বিছানায় গা দিয়ে বললেন,
“হ, ভালোই। কিন্তু আমার কাছে কেমন জানি লাগে। তবে মাইয়্যাডা এমনিতে ভালোই। আচ্ছা বাদ দে। থাক ও ওর মতো।”
নিরুপমা সরে যাবে তখনই আবার ডাকলেন,
“ও নিরু, একটা চার্জার ফ্যান কিনে দে আমারে। কারেন্ট গেলে যে শরীলডা জ্বলে। কষ্ট হয় মেলা।”
“কিনে দেবো। এই মাসটা কষ্ট করো। আগামী মাসে যেভাবে পারি কিনে দেবো।”
“আগামী মাস! সে তো মেলা দেরি রে। এই মাসেই যেমনে পারস কিনে দে। এক কাজ কর না। নয়নরে একটা কল দে। কিছু টাকা দিতে বলি।”
“না, নয়ন ভাইয়ের কাছে একটা টাকাও চাবে না তুমি। তার মতলব কি অজানা তোমার? দুই টাকা সাহায্য করে ভাগের জমিটুকু লিখে নেবে। এই মাসটা কষ্ট করো।”
নিরুপমা রান্নাঘরে ফিরে গেল। নিলুফা বেগম রাগে ফুঁসে উঠলেন,
“এই মাসটা শেষ হইতে এহনও বিশদিন বাকি। আমার কষ্ট তুই কী বুঝবি? আজ যদি একটা পোলা পেডে ধরতাম তাইলে কী আর এই দিন দেখতে হইতো। পোড়া কপাল আমার। হইছে মাইয়্যা। মায়েরে একটা চার্জার ফ্যান কিনে দেওয়ার মুরোদ নাই। বসে বসে মরা বাপের টাকা গিলতাছে। আবিয়াত্তা থাইকা গেল। আগে কত ভালো ভালো সমন্ধ আইতো। না উনি বিয়ে করবে না। পইড়া জজ বেরিষ্টার হইব। হইসোস? এহন তোরে কেডা বিয়া করব? একে তো বাপ মরা তার ওপর হইসোস কাইল্লা। কে বিয়ে করব তোরে, হ্যাঁ? মাইনষে তো দুদিন পরে কলঙ্ক দিবো। আমারে দুষাইবো। আমি মরলে তোরে তো ছিঁইড়া খাইব শিয়াল, কুকুরে….” নিরুপমা মুখ বুঝে সব কথা শুনলো। একটা জবাবও দেবে না আজ। কী জবাবই বা দেওয়ার আছে। নিলুফা বেগম মেয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে বকে বকে থেমে কান্না জুড়ে দিলেন। অসুস্থ শরীরটা ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে যায়। কান্নার শব্দ আস্তে আস্তে কমে আসে। তাঁর ভেতর এইটুকু বোধ নেই ঘরে শুধু তারা দুজনই না আরও একজন রয়েছে। যত বোধ, যত লজ্জা একা নিরুপমার। ভালো লাগছে না ওর। মেয়ে হয়ে যেন পাপই করেছে। এর প্রায়শ্চিত্ত যদি করা যেত!
লোকটার দুপুরের খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে।
“আপনার খাবার।” বিছানার ওপর রাখল খাবারগুলো নিরুপমা। লোকটা সিগারেট জানালার বাইরে ফেললো। মাত্রই ধরিয়েছিল বোধহয়! ফেললো কেন? নিরুপমাকে দেখে? আজকাল এ ঘরে সিগারেটের ছাই বা গন্ধ আগের মতো পায় না। লোকটার ফুসফুস ও হার্ট দুটোর জন্যই ভালো। নিরুপমা আড়চোখে দেখে। আগে এত দেখত না। বেশি দেখে বলেই কি ইদানীং মুখটা চেনা মনে হয়? দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। জগটাতে পানি নেই। রান্না ঘরে গিয়ে পানি এনে জগটা রেখে চলে যাবে এহসাস বলল,
“আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ইচ্ছে কি ছিল জানো? যে মেয়ে আমার মতো ডাহা মিথ্যা বলতে পারে তার সাথে প্রেম করা। প্রেম করবে আমার সাথে নিরুপমা?”
নিরুপমা চোখ রাঙিয়ে তাকায়। এহসাস মুচকি হেসে জানালার পাশ ছেড়ে বিছানার ওপর বসল।
“তোমার মা এখন খালেদা বলে বিশ্বাস করে আমাকে। একটু পরিশ্রম করতে হয়েছে। মেয়েদের মতো গলায় কথা বলা, হাবভাব করা উফ! তবে বলতেই হয় কৃতিত্ব কিন্তু সবটাই তোমার। এত সুন্দর করে মিথ্যা বলেছ তাঁকে যে আমার এইটুকু নাটকে বিশ্বাস করে নিয়েছে আমিই খালেদা। তোমার আমার জুটি কিন্তু দারুন হবে। দুজনে মিথ্যা বলেই পৃথিবী জয় করে নেবো। তাই তো ভাবছি, এত সুন্দর করে মিথ্যা বলা মেয়ের সাথে প্রেম না করলে মানব জনম সার্থক হবে না আমার।”
লজ্জায় নিরুপমার কান লাল হয়ে উঠল। রাগও হলো। মিথ্যাবাদী হওয়াটা নিশ্চয় সুনামের না।
“আপনার মানব জনম সার্থক করার ঠেকা নিইনি আমি। অভদ্রের মতো কথাবার্তা বলবেন না। মিথ্যা বলা আমার স্বভাবে নেই। বাধ্য হয়েছি আপনার কারণে। লজ্জা বলতে কিছু তো নেই আপনার। তাই যা মুখে আসে বলে ফেলেন।” বেশ ঝাঁঝিয়ে বলল কথাগুলো। এহসাস হাসল। নিরুপমার রাগ আরো বাড়ে। ভাবে এই লোক সত্যি সীমা ছাড়া নির্লজ্জ।
“প্রেম করবে না তাহলে?” এহসাস মুখ ভার করার অভিনয় করল। নিরুপমার অসহ্য লাগছে। এই লোক কেন গায়ে পড়ে এসব কথা বলে!
“আপনি পৃথিবীর শেষ মানুষটা হলেও না।” বলল ও। এহসাস ব্যথা পেল এমন একটা ভাব করে বলল,
“ইশ! কিছু ভাঙল, শুনলে?”
নিরুপমা ভুরু কুচকায়। কী ভাঙল? এহসাস উঠে দাঁড়ায়। বিষণ্ণ মুখে ওর কাছে এসে থামল। বুকের বা’পাশে হাত রেখে ঝুঁকে বলে,
“আমার হৃদয় ভাঙল, অমাবস্যা। সে এত নির্দয়ভাবে কোনোদিন প্রত্যাখ্যাত হয়নি।”
নিরুপমার রাগ হালকা হয়। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
“এভাবেই মেয়ে পটান? সরি, পটলাম না।”
“কী পাষাণ তুমি!” এহসাস বিছানা দিকে গেল। নিরুপমা দরজার দিকে যেতে যেতে ব্যাঙ্গ করে বলে,
“পাষাণ! আমি? তাহলে আপনি কী?”
“ব্যর্থ প্রেমিক।”
নিরুপমা থামে। কথাটার মধ্যে বিদ্রুপ খোঁজে। পায় আবার পায় না। দরজার কাছে গিয়ে ঘাড়ের ওপর থেকে তাকালো। লোকটা চুপচাপ খাচ্ছে। ভাবলেশহীন মুখটা। কথাটা ফাজলামি ছাড়া কিছু না। তাহলে ওর কেন তখন সন্দেহ হলো? এই লোকটাকে আজকাল এত মিস্ট্রিয়াস কেন লাগে!
চলবে,,,