অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -১৯

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১৯
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

চার দেওয়ালের মাঝে হাত পা গুটিয়ে আর বসে থাকলে চলবে না এহসাসের। কত কাজ বাকি! এক নারীর পিছু নিয়ে ওর সকল কাজ এলোমেলো হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?

“একদিনও না।” এহসাস জানে ওর মতোই ওর মনটা মিথ্যাবাদী। একদিনও না বলে বলে এই ঘরে দিনের পর দিন আঁটকে রেখেছে নিজেকে। যা করছে সব ভাবনা চিন্তার বাইরে। এখান থেকে ওকে বেরোতে হবে। যদি বের হয়ে ফিরে ফিরে আসতে হয় হোক। তবুও আজ বেরোবে।

মশারি তুলে বিছানা ছেড়ে নামল। আলো নিভানো। খোলা জানালা, ব্যালকনি দিয়ে বাইরের জ্যোৎস্নার আলো এ ঘরে পড়েছে। শার্টটা হ্যাঙ্গারে ঝুলানো ছিল। এহসাস নামিয়ে গায়ে পরল। তারপর নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে এলো সদরের রুমটায়। দেওয়াল ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দে তাকালো সেদিকে। ১:১০ মিনিট। মধ্যরাত। একদম পারফেক্ট টাইম বাইরে বেরোনোর। নিরুপমা মায়ের পাশে ঘুমাচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে এই ঘুম গভীর। খাটের অপর পাশে দাঁড়িয়ে ঘোলা আলোয় ওর মুখটা এহসাস দেখতে পাচ্ছে না ঠিকমতো। একটু এগোলেই তো দেখা যেত। এগোবে কী? এহসাস এগিয়ে আবার পিছিয়ে গেল। আবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। যাবে না সামনে। এ যেন নিজের সাথে নিজের লড়াই। পঁচিশ বছর তো ছেলেমানুষী করার বয়স না। যথেষ্ট ম্যাচুরিটি এসেছে। কিন্তু আচরণ করছে আট বছর আগের সেই সতেরো বছরের কিশোরের ন্যায়। সময় যেন ওকে আবার সেই সময়ে, সেই দুর্দমনীয় অনুভূতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ তো রীতিমতো অনাচার করছে সময় ওর সাথে! কিন্তু এহসাস লড়বে। এই অনাচার মানবে না। হারবে না আর। সতেরো বছরের আবেগে ভেসে যাওয়া কিশোরটি নয় ও। নিজের ওপর হওয়া সকল অনাচারের বিচার করবে। যেই জ্যোৎস্না বিচ্ছুরিত মুখশ্রীতে তাকিয়ে দিশা হারিয়েছিল, এখন তাই ওর দৃষ্টিকে নিস্পৃহ করে। জ্যোৎস্নার রূপ মোহিত করে না। বড়ো অরূপ লাগে চোখে সে জ্যোৎস্না।

রাত দুপুরে ছদ্মবেশ নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু সতর্ক থাকারও বিকল্প নেই। যতদিন লক্ষ্যে না পৌঁছাচ্ছে ততদিন গা বাঁচিয়ে চলতে হবে। মাস্ক আর পাতলা হুডিটা এক্ষেত্রে যথাযথ। রাতের এই সময় গরমের আঁচ কম। দ্রুত হাঁটা এবং স্নায়ুর চাপে গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়বে। ঘাম ছুটবে। তার ওপর যদি হুডি পরা থাকে তবে নরকের আগুনে গা সেঁকার মতো অবস্থা। এহসাস নরকে গা সেঁকে চললো। গন্তব্য বেশ দূরে। লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত হাঁটলে ঘণ্টা খানেক লাগবে। সেখানে মিনিট দশেক বা বেশি সময়ও থাকতে হতে পারে। আবার ফিরতে আরেক ঘণ্টা। হিসেব করে পা ফেলতে হচ্ছে। নিরুপমা ফজরের আজান দিতে জেগে যাবে। এহসাসকে তার আগেই ফিরতে হবে৷ চাবির গোছাটা পকেটে সাবধানে রাখল।
আকাশে জ্বলজ্বল করছে রূপোলী চাঁদ। দিনের আলোর মতো চারপাশ জ্যোৎস্না বিধৌত। শ্মশানের নীরবতা নেমেছে রাস্তায়। দু একটা ঝিম ধরা কুকুর ছাড়া জনমানব দেখতে পেল না এহসাস। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও থমথমে ঘোলা আলোয় জমে যাওয়া নিস্তব্ধতা ভেঙে হুইসেল বাজিয়ে ওঠে পাহারাদার। তাকে ফাকি দিয়ে খুব সহজেই নিরুপমার এলাকা ছাড়ল। নিরুপমার এলাকা! তীর্যক ব্যাঙ্গে মনে মনে হাসল এহসাস।

প্রধান সড়কের পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। হঠাৎ হঠাৎ শো করে ট্রাক বা মালবাহী লড়ি পাশ দিয়ে চলে গেল। এহসাসকে দেখলেও ওরা গুরুত্ব দেবে না, থামবে না। একা একা জনমানবশূন্য রাস্তায় সাহসী ব্যক্তিটিরও বুক কাঁপে। কত নেগেটিভ চিন্তা ঘোরে মাথায়। এহসাস সেসব চাপ থেকে মস্তিষ্ককে ভুলাতে সিগারেট ধরায়। ভুরুর ওপর নেমে আসা কালো হুডি, ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেটে এই নির্জন পথে ওকে প্রেতাত্মার মতো লাগছে। রক্ত-মাংসের দেহখানা সমেত কিছু মানুষ প্রেতাত্মা হয়ে বেঁচে রয়।

হাসপাতালের সামনে পৌঁছাতে ওর সারা গায়ের কাপড় ঘামে জবজবে। ভীষণ অস্বস্তি আর অসহ্য লাগছে। মানুষ আর প্রেতাত্মার মাঝে এখানেই বুঝি তফাৎ। ওদের কোনো অনুভূতি নেই। ষড়ঋতু বা বারো মাসের বদলের প্রভাব পড়ে না। এহসাস নাক ফুলিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে।

“জেলাস!” পরিচিত গলাটি কুটিল হাসল পাশ থেকে। এহসাস কপাল ও ভুরু কুঁচকে তাকায়। আপাদমস্তক সাদা আলখেল্লা পরনে রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ, কিন্তু নির্জীব চাহনি। ওর সমস্ত শরীর দিয়ে হিমাগারের মতো ধোঁয়া উড়ছে। অপার্থিবরা কী এমনই নজর কাড়া হয়?

“জেলাস? কে?”

“আর তো কেউ নেই আশেপাশে তুই ছাড়া।”

“আমার ভেতরে কোনো জেলাসি টেলাসি নেই। ওই শব্দ এহসাসের সাথে যায় না।”

“যা বললে তোর সুখ হয়।”

“রাহাত রহমান!”

“এহসাস আরমান!”

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। এহসাস মেকি রাগে আর রাহাত মুচকি হাসিতে।

“এখানে অনেক ঠাণ্ডা বুঝলি? আহা! শান্তি, শান্তি। প্রেতাত্মা হওয়ার এত ফায়দা জানলে এতদিন মানুষ হয়ে থাকতাম?”

“গো টু হেল।”

“সরি দোস্ত, আই ফিল হেভেন হেভেন নাউ। হেলে তো তুই যাবি। নিরুপমার অভিশাপে।”

এহসাস দাঁত কটমট করে চোখ উলটে তাকালো। তারপর শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।

“তোর কী আর কোনো কাজ নেই? মানুষকে ভয় দেখিয়ে প্রেতাত্মা জনম সার্থক কর যা। সু, সু।”

এহসাস হাসপাতালে গেটের দিকে ফিরে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ায়। রাহাত বলে,

“অবশ্যই অনেক কাজ আছে। তোর মতো না কি? তোর কথা ধরে তাহলে বলাই যেতে পারে তুই মানুষরূপি প্রেতাত্মা। না কি শুধুমাত্র নিরুপমার প্রেতাত্মা?”

“রাহাত!”

“বেচারি নিরুপমা! ভয় দেখানো ও কষ্ট দেওয়া বন্ধ কর ওকে এহসাস। এটা অন্যায়, জুলুম।”

“অন্যায়! ওহ! রিয়েলি?”

“আ’ম সিরিয়াস, এহসাস!”

“সরি ব্রো, আ’ম নট দ্যাট সিরিয়াস পার্সন। সো শাট আপ। নাউ গেট…” এহসাসের গলা জড়িয়ে যায় হঠাৎ। চকিতে ফেরে পেছনে। প্রাণের চিহ্নহীন রাস্তাটা শূন্যতায় খা খা করছে। কী বিদঘুটে এই জ্যোৎস্না! বিমূঢ়। এহসাসের চোখে সয় না।

“রা..রাহাত, রা..রাহাত, কাম অন ইয়ার, ডোন্ট গেট লস্ট। কথাটি ওভাবে বলতে চাইনি। সামনে আয় না প্লিজ!”

রাহাত শুনলো না ওর অনুনয়। দৃশ্যমান হলো না। এমনই তো লুকোচুরি খেলে এহসাসের সাথে ও। এহসাস বিমর্ষ মুখে ধীর পদে হেঁটে হাসপাতালের গেটের বেশ দূরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই। যখন হুঁশ এলো সোজা হলো। টের পেল চোখের নিচে অশ্রু জমেছে। আঙুলে মুছে নেয়। আর কালক্ষেপণ করলে চলবে না। হাসপাতালের গেটে দারোয়ান ঢুলছে। সুতরাং ওকে দেওয়াল টপকে ভেতরে যেতে হবে।

হাসপাতালে ঢুকে বেশ সুচতুরতার সাথে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌছে গেল। কিন্তু কেবিনের সামনে দুজন রক্ষী পাহাড়ায়। ওদের সরাতে কিছু করতে হবে এহসাসকে। কী করবে? হঠাৎ ওর মুভির সেই নার্স বা ডাক্তারের ছদ্মবেশ ধরে রোগির কেবিনে ঢোকার দৃশ্য মনে পড়ে যায়। এখন কোনো ডাক্তার বা নার্সকে ফাঁদে ফেলতে পারলেই কাজ কেল্লাফতে।

মধ্য রাত প্রায় শেষ। রক্ষীদের ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু এখান থেকে এক পা নড়ার অনুমতি নেই। সিগারেট খাওয়া মানা। চা টা না পান করলে চোখের পাতার নিয়ন্ত্রণ রাখা যাচ্ছে না। একজন বলল,

“তাহলে আমি চট করে দু’কাপ চা নিয়ে আসি। তুই বরং পাহারা দে।”

“দেরি যেন না হয়। উস্তাদ জানলে খবর করে দেবে।”

“আরে ধুর! উস্তাদ জানবে কী করে? এই গেলাম আর এলাম।”

একজন চলে যেতে অন্যজন চেয়ারে বসল। তখনই হনহনিয়ে এদিকে এলো ডাক্তারটি। পরনে সাদা এপ্রোন, মুখে মাস্ক আর গলায় ঝুলানো স্টেথোস্কোপ। প্রতিদিন আসছে ডাক্তার। সন্দেহের কিছু নেই। নির্ঘুম রাত, সিগারেটের নেশার আকাঙ্খার ব্যাকুলতা রক্ষীটির সজাগ দৃষ্টিতে আলস্য ধরায়। এক পলক তাকিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।

এহসাস কেবিনে ঢুকেই আঁটকে রাখা শ্বাস ছাড়ল যেন। সামনে তাকালো। নিস্তেজ পড়ে আছে শয়তানটা। লাইফ সাপোর্টের মেশিন ছাড়া ও অস্তিত্বহীন। এই অবস্থায় কোন মানুষকে দেখে না করুণা হয়? কিন্তু ওকে দেখে এহসাসের বিন্দুমাত্র করুণার জন্ম হলো না। তাতে যদি পৃথিবীসুদ্ধ লোক ওকে নিষ্ঠুর, নির্দয় বলে বলুক। এহসাস কাওকে পরোয়া করে না। নিস্পন্দ ওই জীবিত লাশটাকে দেখে ওর মধ্যে কেবল ক্রোধের বিস্ফোরণ হয়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। এগিয়ে থামল শিওরে। হাতটা বড্ড নিশপিশ করছে। শ্বাসনালি থেকে অক্সিজেনের পাইপটা কী খুলে ফেলবে? না কি পি*স্তলটা বুকের বা’পাশে ধরে ট্রিগার চেপে দেবে? কী সহজ মৃত্যু!

“হ্যালো, পিয়াস। মিস মি? আমি কিন্তু ভীষণ মিস করেছি তোকে। ভীষণ, ভীষণ, ভী.ষ.ণ।” এহসাস দাঁত বের হাসল। ক্রুর হাসি। ওর নিদ্রিত মুখের দিকে ঝুঁকে বলল,

“তোর জন্য ভারী কষ্ট হয় জানিস! অকেজো শরীরটা নিয়ে কেমন পড়ে আছিস। এভাবে দিনরাত শুয়ে থাকতে কারই বা ভালো লাগে। শোন না, জেগে ওঠ। আমার ধৈর্যে আর কুলাচ্ছে না। জেগে ওঠ প্লিজ!” দু’হাতে ওর শিওরের বেড খামচে ধরল এহসাস।

“তোর প্রাপ্য কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে না দিয়ে তোকে তো সহজে যেতে দেবো না পিয়াস। কোথাও না। কবরেও না, শুনছিস না? অবশ্যই শুনছিস। তোর শরীর এতদিন কুকুর, শকুনের পেটে পরিপাক হয়ে যাওয়ার কথা। সেই শরীর এসি কেবিনের নরম গদিতে শুয়ে শ্বাস টানছে! কতটা কন্ট্রোল করছি চিন্তা করতে পারিস? এহসাস হিসাবে বড্ড পাকা বুঝেছিস, নয়ত এখনই তোর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতো। ব্যাপার না, আমি অপেক্ষা করব। এক মাস, এক বছর…প্রয়োজনে আরও বেশি। তবুও তোকে হিসাব মিলিয়েই যেতে হবে৷ আবার দেখা হবে আমাদের পিয়াস। শীঘ্রই। গেট ওয়েল সুন, কনটেম্পটিবল হেল ওয়ার্ম।”

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here