#অশ্রুমালা
part–25
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
মাথার পাশে রোদেলাকে বসে মুখ চেপে কাদতে দেখল আবেগ। বাইরে থেকে বৃষ্টির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের পোকার ডাকার শব্দ। আবেগ খেয়াল করে রোদেলা বেশ শব্দ করেই কাদছে৷ কেন কাদছে তা সম্পর্কে অবগত না আবেগ। সে বোঝার চেষ্টা করছে সে এখন কোথায়। কিন্তু সেটাতেও সক্ষম হচ্ছে না৷ কিছু মনেই পড়ছে না তার৷ কি হয়েছিল কিছু ই মনে পড়ছে না এই মূহুর্তে তার।
আবেগকে চোখ খুলতে দেখে রোদেলা কান্না থামিয়ে দিল এবং তার মাথার কাছ থেকে সরে মুখের কাছে এসে বলে, এখন কেমন লাগছে?
আবেগের কানে রোদেলার বলা কথাগুলো ঝনঝন করে বাজলো। তখনি আবেগ উপলব্ধি করে তার মাথার পেছনে ভীষণ ব্যথা৷ সে মাথায় হাত রাখতে ই বুঝল মাথার পেছনে ব্যান্ডেজ৷
সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকালো।
রোদেলা কান্না মিশ্রিত গলায় বলে, তুমি অজ্ঞান হয়ে মাটতে পড়ে গিয়েছিলে তখন মাথায় আঘাত পেয়েছো। ডাক্তার চাচা এসে দেখে গেছে তোমাকে। উনিই ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। তোমার নাকি সুগার লেভেল লো৷
–সম্ভবত।
রোদেলা কান্না করতে লাগলো।
এতে বিরক্ত হয় আবেগ৷ সে কঠিন গলায় বলে, কান্না থামাও তো। কাদার কি আছে? অসহ্য লাগে এই ম্যা ম্যা করে কান্নার আওয়াজ।
রোদেলা কান্না থামিয়ে অবাক নয়নে কিছুক্ষন আবেগের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে, এই অবস্থায় ও কাকের মতা করে কথা বলাটা কি খুব জরুরি আবেগ?
আবেগ চমকে উঠে। এই প্রথম রোদেলা তার নাম ধরে ডাকছে। নাকি এর আগেও ডেকেছে। ডেকেছে হয়তোবা কিন্তু সে খেয়াল করেনি।
যাইহোক আবেগের রোদেলার কথা শুনে খুব করে বলতে মন চাচ্ছে, কথা বলতে তো চাই অত্যন্ত মিস্টি গলায় কিন্তু কথা বলতে গেলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলার স্বর কাকের মতো কর্কষ হয়ে উঠে। এখানে আমি কি করতে পারি?
রোদেলা আবেগের কপালে হাত রেখে বলে, একটু গা গরম করেছে। ডাক্তার চাচা বলল, নতুন জায়গা জন্য এমনটা হয়েছে৷
আবেগ জিজ্ঞেস করল।,এই ডাক্তার চাচা কি হাতুড়ে ডাক্তার? নাকি এমবিবিএস?
–এমবিবিএস। আমাদের গ্রামের প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার।
–ও।
–তোমার জন্য বাবা খেজুরের রস এনেছে। আমি এনে দিচ্ছি। অপেক্ষা করো।
আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। ঘন সন্ধ্যার আধারে রোদেলার নাক ফুল ঝিলিক মেরে উঠছে। আবেগের আবারো জানতে মন চাইলো, রোদেলা কবে নাকি ফুরিয়েছ?
রোদেলা উঠে যাওয়ার সাথে সাথে আবেগের ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। সে আশেপাশে তাকালো। কোথায় এক ফোটা আলো নেই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে৷ ঝুমঝুম শব্দ তার কানে এসে বাজছে। সে চোখ বুজে ফেলে। গা থেকে থেকে কাপুনি দিয়ে উঠছে৷ এই মূহুর্তে যদি একটা কাথা বা কম্বল গায়ে জড়ানো যেত খুব আরাম পেত। উঠে গিয়ে কি কম্বলের খোজ করবে? এই বিছানায় ই তো একটা কম্বল ছিল । সেটা কোথায় গেল? আর এই অবেলায় বৃষ্টি কেন হচ্ছে? ষড়ঋতু রচনায় তো পড়েছে আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস বৃষ্টির মাস। তো এখন কেন বৃষ্টি হচ্ছে? আচ্ছা এটা বাংলা কি মাস? নভেম্বর এর ২৪ তারিখে বাংলা কোন মাসের অন্তর্ভুক্ত তা জানা নেই আবেগের! রোদেলা কে জিজ্ঞেস করবে। যদি সে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে তবে তাকে একটা চমৎকার উপহার দিবে। এবং উপহারে রোদেলা যা চাইবে তাই দেওয়া হবে৷।
রোদেলা রুমে আসল। সঙ্গে কোলে সমুদ্র কে নিয়ে। আর আরেক হাতে গ্লাস।
আবেগ উঠে বসল। রোদেলা তার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিল। অন্ধকার থাকায় খেজুরের রস কি রঙের তা দেখতে পারেনা আবেগ।
সে চুমুক দিল। মিস্টি খেতে। যদিও বা সে জানত খেজুরের রস খেতে মিস্টি। কিছুটা ডাবের পানির মতো লাগছে তার কাছে৷ কিন্তু ডাবের পানির চেয়ে বেশি মিস্টি আর ঘনত্ব ও বেশি৷
সে ছোট ছোট চুমুক দিতে লাগে৷ জ্বর মুখে খেজুরের রস খেতে দারুণ লাগছে। আবেগের মনে হচ্ছে তার জ্বর এসে ভালোই হয়েছে৷ খেজুরের রসের ফ্লেভারটা বেশি উপভোগ করতে পারছে৷ অন্য সময় হলে এতোটা মজা পেত না।
সে রোদেলা কে এক নজরে দেখে নিয়ে বলে, তোমাকে দুইটা প্রশ্ন করব। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই দিব৷
রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, যা চাব তাই দিবে?
–ইয়েস।
–সত্যি তো?
–ইশরাক রহমান মিথ্যা বলে না৷
–প্রশ্ন করো। দেখি পারি কিনা।
আবেগ নির্লিপ্ত গলায় বলে, নাক কবে ফুরিয়েছো?
রোদেলা এক দন্ড ভেবে বলে, অনেক আগেই।
–সেই অনেক আগেটা কবে?
–আ,,,আ,ভার্সিটি সেকেন্ড ইয়ারে মেবি। হুট করে ঝোক উঠল নাক ফুটা করব। আমি আর আমার ফ্রেন্ড দিলে রুপসি পার্লার থেকে নাক ফুটা করে আসি। তারপর রাতে কি ব্যথা উঠল৷ লাল হয়ে গেল। পুচ জমে গিয়েছিল। তুমিই না মেডিসিন লিখে দিয়েছিলে। ভুলে গেছো?
আবেগ ভ্রু কুচকে বলে, আমি ঔষধ প্রেস্ক্রাইব করেছিলাম?
রোদেলা মাথা নেড়ে বলে, হু। সেফ থ্রি৷ ২০০ এমজি। চব্বিশ ঘন্টায় একটা করে তিন দিন খেয়েই ব্যথা চলে গিয়েছিল।
–ভালো।
–এবার সেকেন্ড কোয়েস্টেনটা করো?
–আজকে কয় তারিখ?
এটা ছিল প্রশ্ন? ২৪ তারিখ।
–মাস?
–নভেম্বর৷
–উহু। বাংলা কত তারিখ আর কি মাস?
–ও। ৯ই অগ্রহায়ন, ১৪২৭। হেমন্তকাল।
–ওহ৷
–উত্তর টা কিন্তু পেরেছি।
–বল কি চাও?
রোদেলা এক দন্ড ভেবে বলে, খাওয়া হয়েছে তোমার?
–হু৷
— কেমন লাগলো?
–খুব মজা। ভাবছি যাওয়ার সময় দুই লিটারের দুটা বোতলে ভরে ঢাকা নিয়ে যাব৷
রোদেলা জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো এবং জানালা খুলে দিল। সাথে সাথে রুমে হিম শীতল হাওয়া বইতে লাগলো। পুরো রুম বরফ ঠান্ডা হতে লাগলো। আবেগের মনে হতে লাগে সে নরওয়েতে প্রবেশ করে ফেলেছে৷
রোদেলা এই ঠান্ডা হাওয়ায় মধ্যে ই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ঝাপ্টা লাগছে তার। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা। চারপাশে থেকে ঝিঝি পোকা ডাকছে৷
রোদেলা নিরবতা ঠেলে কনকনে আওয়াজে বলে, ঢাকায় নিয়ে গেলে খেজুরের রসের স্বাদ বিদঘুটে লাগবে। ওইখানে বসে যদি খেজুরের রস খাও মনে হবে তিতা করলার রস খাচ্ছো। ঢাকা শহরে খেজুরের রস মানায় না। ওখানে ওরিও শেক বা নিউট্রেলা শেক মানায়।
রোদেলার কণ্ঠে এক অদ্ভুত মাদকতা খুজে পায় আবেগ৷ রোদেলার কথা শতভাগ ঠিক। এই মেয়েটা বুদ্ধিমতী। বেশ সুক্ষ্ম চিন্তা-ভাবনা তার।
সমুদ্রের গায়ে কম্বল দিতে দিতে বলে, জানালা বন্ধ করে দাও শীত লাগছে তো।
বোধহয় রোদেলা আবেগের কথা শুনতে পেল না। সে জানালার শিক ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
এতে আবেগের মেজাজ কিছুটা হলেও খারাপ হয়। মেয়েটা এতো অবাধ্য কেন? একে তো শীতের রাত। সে আর সমুদ্র তো কম্বলের নিচে। তাদের ঠান্ডা লাগবে না। কিন্তু রোদেলা? তার তো পরনে পাতলা একটা সুতির শাড়ি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। শীতের রাতে বৃষ্টি গায়ে লাগলে আবার জ্বর-ঠান্ডা লাগবে৷ অসুস্থ হয়ে যাবে৷ এম্নিতেই দুই দিন আগেই জ্বর থেকে উঠলো।
সে আবারো রোদেলাকে ডাকল কিন্তু নাহ সাড়া দেয় না রোদেলা।
আবেগ জানালার দিকে তাকালো। কুটকুটে অন্ধকার। কোন কিছু দেখার জো নেই। গ্রামে কারেন্ট থাকে না এই সময়। আজকে বৃষ্টি জন্য নাকি সারা রাত কারেন্ট আসবে না। একটা মোমবাতি জ্বলছে রুমের মধ্যখানের টেবিলে। যেটা মাত্র খেয়াল করে আবেগ৷
সেই জলন্ত মোমবাতির আলোয় কিঞ্চিৎ রোদেলাকে দেখা যাচ্ছে। চুল গুলো কোমড় পর্যন্ত ছাড়ানো। শাড়ির আচল বাতাসে একটু একটু করে নড়ছে। কেমন অশরীরী ব্যাপার-স্যাপার!
আবেগ ঘাবড়ে গেল। রোদেলাকে ভুতে ধরে নি তো? পরক্ষনে নিজেই নিজেকে গালি দিল। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এসব কি ভাবছে সে?
আবেগ উঠে দাড়ালো। তার নিজের ও শরীর খারাপ। জ্বর বেড়ে গেছে আগের তুলনায়। গা বেশ গরম। সম্ভবত ১০০° এর বেশি জ্বর।
তাও সে জানালার কাছে গিয়ে জোড় করে রোদেলা কে সরিয়ে নেয় এবং জানালা শটাং করে বন্ধ করে৷
রোদেলা বলল, জানালা বন্ধ কেন করলে?
–ফাইযলামি পেয়েছো তুমি? এখানে কতো ঠান্ডা! সেই খেয়াল আছে তোমার? তাও দাঁড়ায় আছো?
তারপর রোদেলার হাতে হাত দিয়ে কড়া গলায় বলে, তোমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। চুপচাপ খাটে এসে কম্বলের নিচে শুয়ে গা গরম করো৷ নাহলে এক্ষুনি জ্বর-নিউমোনিয়া বাধাবে তুমি।
তারপর জোড় করে রোদেলাকে বিছানায় শোয়ালো আবেগ৷ মাঝে খানে শুয়ে পড়ে রোদেলা।
রোদেলার বাম পাশে সমুদ্র। সে সমুদ্রের দিকে ফিরে সমুদ্র কে আদর করতে লাগলো । সমুদ্র নিশ্চিত মনে ঘুম। রোদেলা তার ছেলের কপালে চুমু খেয়ে আবেগের দিকে ঘুরে বলে, খুব ঠান্ডা লাগছে এখন।
–আরো দাঁড়ায় থাকো জানালার সামনে৷
–আবেগ?
আবেগ আবারো চমকে উঠে। তার হাসফাস লাগতে শুরু করে। তাও মুখে বলে, কি?
–তুমি বললে না আমি যা চাইব তা দিবে আমাকে?
–হু। বল কি চাও?
–এখন বলব না। অন্য কোন দিন বলব৷ তবে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না কিন্তু তখন।
–আচ্ছা৷
আচ্ছা বললেও আবেগ ভেতরে ভেতরে টেনশন করতে লাগে৷ এমন কি বলতে পারে রোদেলা তাকে? এখনি জানার জন্য মনটা আকুপাকু করছে৷
রোদেলা কাপা কাপা স্বরে বলে, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারবে? খুব ঠান্ডা লাগছে। কম্বলেও হচ্ছে না। গা থরথর করে কাপছে।
আবেগ জড়িয়ে ধরবে না ধরবে না ভেবেও মনের অজান্তেই রোদেলা কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।
আবেগের গা তখনো উষ্ণ গরম আর এদিকে রোদেলার গা যেন বরফ।
পর্দাথ বিজ্ঞানের ক্যালোরিমিতির মূলনীতি বলে, বেশি তাপমাত্রার বস্তু কম তাপমাত্রার বস্তুর কাছে তাপ দিতে থাকবে যতক্ষন পর্যন্ত দুই বস্তুর তাপমাত্রা সমান হয়! উত্তপ্ত বস্তু ঠিক যতটুকু তাপ পরিত্যাগ করবে শীতল বস্তু ঠিক ততোটুকু তাপ গ্রহণ করবে।
এই শীতল বৃষ্টিময় অগ্রহায়ণের মাসে আবেগের গায়ের উষ্ণতা রোদেলাকে উত্তপ করে দেয়। ঠিক ততোক্ষন পর্যন্ত রোদেলা উষ্ণতা নিতে থাকে যতক্ষন পর্যন্ত তাদের দুজনের দেহের তাপমাত্রায় সমতা আসে নি।
★★★
ইভানা বসে বসে ফোন চালাচ্ছিল। এমন সময় ইমতিয়াজ সাহেব এসে বলে, মারে? তোর কোন কাজ আছে?
–না। কি কাজ থাকবে? কলেজ বন্ধ তো৷
–চল আমাদের সাথে। ঘুরে আয় কোয়ান্টামে।
–আমি গিয়ে কি করব ওখানে?
–আরে। তোর ভালো লাগবে৷ চল না। বাসায় একা থাকবি নাকি তুই?
ইভানা এক দন্ড ভেবে বলে, তাহলে কিছু খাওয়া তে হবে৷
ইমতিয়াজ সাহেব বলে, আচ্ছা একটা ম্যাংগো জুস খাওয়াব। আয় তুই।
ইভানা মৃদ্যু হাসল। বাবাও না এখনো ম্যাংগো জুসেই পড়ে আছেন! সেই ক্লাস ওয়ান থেকে স্কুল থেকে বের হয়ে ম্যাংগো জুস কিনে দিতেন৷ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার দিন ও কিনে দিয়েছিলেন। এতো বড় মেয়ে হয়েও ইভানা সেদিন হলের বাইরে স্ট্রতে চুমুক দিয়ে সোসো করে জুস খেয়েছিল। কি অসাধারণ দৃশ্য ছিল!
ইভানা কালো রঙের একট সালোয়ার কামিজ পড়ে বের হলো৷
আধ ঘন্টা পর তারা পৌছে গেল কোয়ান্টামে। জায়গা টা বেশ পছন্দ হয় ইভানার। সে একটা সিটে বসে পড়ে৷
কিছুক্ষন পর একটা ছেলে আসে। সাদা শার্ট পড়া৷ তাকে দেখে সবাই এক গাল হাসি দেয়৷ ছেলেটাও মুচকি হেসে ডায়াসের উপরে উঠে।
কিন্তু ইভানা! সাদা শার্ট পড়া ছেলেটাকে দেখেই হার্টবিট মিস হয়ে যায় তার। নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় সে।
কি একটা অবস্থা! প্রেমে পড়লে কি মানুষ নিশ্বাস নেওয়ার কথাটাও ভুলে-টুলে যায় নাকি?
#অশ্রুমালা
part–26
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
শৌখিন ডায়াসে মুচকি হেসে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল, জয় ভাই আজকে আসে নি তাই ওনার পরিবর্তে আজকে আমি সেশন নিব। এতে কারো সমস্যা আছে?
অনেকেই বলল যে তাদের কোন সমস্যা নেই৷
শৌখিনের মনে হলো সে আসায় বেশিরভাগ সদস্য খুশিই হয়েছে৷ তখনো শৌখিন ইভানাকে খেয়াল করে নি৷ আসলে ইভানা মাথা নিচু করে রেখেছে। তাও মাথায় কালো ওড়না দেওয়া। সে লজ্জায় মাথা উঠাতে পারছে না। হুট করে এক রাশ লাজুকলতা তার মধ্যে বিরাজ করতে লাগলো। কেন হঠাৎ তার এতো লজ্জা লাগছে? পেটের মধ্যে সুরসুরি লাগছে ইভানার৷
ছেলেটা হুয়াইট বোর্ডের দিকে মুখ করে। তখন টুপ করে ইভানা মাথা তুলে তাকালো ছেলেটার দিকে।
ইশ! কতো লম্বা ছেলেটা! চুলে গোছা গোছা চুল! ঝকঝকে শার্ট।পরীর মেল ভার্সন যদি কিছু থেকে থাকে তবে এই ছেলেটাই সেটা!
শৌখিন দুইটা হাড়ির ছবি আকলো। আজকেও সবাই উৎসাহ নিয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।
একটা হাড়ির নিচে লিখলো দুই দানা ভাত আর আরেকটা হাড়ির নিচে লিখে দামি দামি মিস্টি৷
তারপর বলতে লাগলো,
Always Remember! Life is not a race! Not A Competition that you have to win!
It’s a journey! Just a beautiful journey!
দিনশেষে তোমার হাঁড়িতে যা আছে সেইটাই তোমার! দুটো চাল থাকলেও সেটা একান্তই তোমার!
ঠিক তেমনই অন্যের হাঁড়ির দামি জিনিস খানাটাও তোমার না। তুমি চাইলেই তার হাঁড়ি থেকে মিস্টি নিজের পাতে তুলে নিতে পারবে না!
বেলাশেষে অন্যের হাড়ির দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। নিজের যেই দুটো চাল আছে না? সেটা সেদ্ধ করেই খেতে হবে! অন্যের পাতের দিকে নজর না দিয়ে নিজের চাল ভেঙে পিঠা বানানোর একটা ক্ষীণ সম্ভবনা থেকে যায় কিন্তু! কি যায় না?
তাই অন্যের কি আছে -কি নেই তা জানতে গিয়ে নিজের যা আছে আমরা সেইটা ভুলতে বসি!
কার বাড়ি আছে কার গাড়ি আছে কার কতো ব্যাংক ব্যালেন্স আছে তা দেখতে গিয়ে ভুলেই যাই আমার যে একটা বিছানা আছে! সেই বিছানায় নরম একটা তুলার বালিশ আছে। আমি চাইলেই কিন্তু সেই নরম বালিশে মাথা রেখে নিশ্চিতে এক ঘুম ঘুমাতে পারি। কি পারি না?
–নূর।
কথার ফাকে ইভানা আর শৌখিনের চোখাচোখি হয়ে গেল। আসলে ইভানা যে তখন মাথা তুলেছিল এর পর আর মাথা নিচু করে নি৷ ইভানা শৌখনের কথার ভীড়ে এতোটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে, সে হা করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তখনি চোখাচোখি হয় দুজনের। বিনিময়ে শৌখিন একটা হাসি দেয়৷
এই হাসির অর্থ হলো আমি তোমাকে চিনেছি কিংবা চিনি!
ইভানার এই মূহুর্তে মাটির নিচে সাবমেরিন নিয়ে চলে যেতে মন চাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখলে তার বুক ব্যথা করে। আচ্ছ তার কি হার্টে ব্লক ধরা পড়ল নাকি? কি জানি?
শৌখিন আরো কিছু কথা বলে ডায়াসের নিচে নেমে সদস্যের সামনে দাড়িয়ে জাবেদা খাতুন কে উদ্দেশ্য করে বলে, আন্টি ভালো আছেন?
জাবেদা খাতুন একটা মুচকি হাসি হেসে বলে, হ্যা, বাবা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
শৌখিন বলে, আলহামদুলিল্লাহ।
তখনি ইভানাদের উপর তলার আংকেল বলল, আজকে আমাদেরকে সঙ্গ দিতে একজন ডাক্তার এসেছে।
শৌখিন মুখ ফসকে বলে দেয়, হুম। মিস ইভানা।
ইভানা চোখ বড় করে তাকায় শৌখিনের দিকে। ছেলেটা তার নাম জানে? ও আল্লাহ! কত লাকি সে! নিশ্চয়ই শায়েরী তার নাম বলেছে।
কিন্তু রহমান সাহেব ভ্রু কুচকে ফেলেন। যতোই উনি মজার মানুষ হন না কেন, তার মেয়ের নাম অন্য কোন ছেলে জানবে আর তিনি চুপ তো থাকতে পারেন না। তাই বলে উঠে, তুমি কিভাবে আমার মেয়ের নাম জানলে?
শৌখিন বিষম খায়। রহমান সাহেবের মেয়ে ইভানা? জানা ছিল না! কিন্তু এখন কি বলবে?কিভাবে রহমান সাহেব কে বলবে কালকে সারা দিন তার মেয়ের গল্প শুনেই পার করেছে সে।
সে আমতাআমতা করে বলে, এন্ট্রির সময় নাম লিখেছিল সেটা আমি দেখেছি। যেহুতু সবাইকে চিনি। ওনার নামটা নিউ ছিল,আননোন লেগেছে আমার সো নামটা মনে রেখেছি আমি। আর আমার জানা মতে এখানে কেউ ডাক্তার না। যেহেতু উনি নিউ এসেছে তাহলে সে ব্যতিত অন্য কারো ডাক্তার হওয়ায় চান্স নেই৷
সবাই মাথা ঝাকালো। রহমান সাহেব ও ব্যাপার টা বুঝলেন। ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান তোর তো।
একজন শৌখিনকে তার নাম ধরে ডাক দেয় যার দরুন ইভানা জানতে পারল সাদস শার্ট পড়া শায়েরীর ছোটদার নাম হলো শৌখিন।
“ইভানার শৌখিন” এটা বিড়বিড় করে বলে সে নিজেই লজ্জায় লাল হতে লাগলো। এসব কি ভাবছে সে? শৌখিন তার কেন হতে যাবে?
আচ্ছা যদি হয়েও যায় কোন ভাবে তবে কি খুব ক্ষতি হবে?, না মানে তার আর এই সাদা শার্ট পড়া ছেলেটার মিল হলে কি নিউটনের সূত্র ভুল প্রমানিত হবে?
★★★
আবেগ ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে লাগলো। কালকে রাতে অনেক শান্তি তে ঘুমিয়েছে সে। একবারো জাগনা পায় নি রাতে৷ নিদ্রা ভাব যেতেই সে উপলব্ধি করে তার বুকটা ভারী হয়ে আছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে রোদেলা গুটিসুটি মেরে তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে৷
আবেগ ভ্রু কুচকে ফেলে। রোদেলা কেন তার বুকে মাথা রাখবে?
পর মূহুর্তে কালকে রাতের কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটার শীত ভাব দূর করার জন্য সে নিজেই রোদেলাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তবে একান্তই রোদেলার অনুরোধে!।
আবেগ উঠে পড়ে। সময় জানান দিচ্ছে এখন পাঁচটা পাচঁ বাজে। আবেগ জানে না ফযরের ওয়াক্ত আছে কিনা? তবুও উঠে রুমের বাইরে গেল।
রুমের বাইরে গিয়ে ই দেখতে পেল ঘন কুয়াশায় সারা জমিন ছেয়ে গেছে৷ সে এই শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানি দিয়েই ওযু করে নিল৷ রোদেলা জেগে থাকলে তাকে গরম পানি করতে বলা যেত। সে ওযু করে নামাজ পড়ে নিল। এরপর বারান্দায় গেল।
বারান্দা থেকে সে গুটগাট শব্দ পেতে লাগল। আবেগের ভ্রু কুচকে গেল। এতো সকালে কোথা থেকে শব্দ আসছে? বাসায় চোর ঢোকেনি তো আবার? কারেন্ট এখনো আসে নি৷
আবেগ নিজের সন্দেহ দূর করার জন্য আওয়াজ অনুসরণ করে উঠানে গেল এবং দেখল তালুকদার সাহেব ঝুকে কি যেন করছেন।
আবেগ তালুকদার সাহেবকে আওয়াজ দেন। উনি পেচন ঘুরে আবেগকে দেখে একটা হাসি দেন৷
আবেগ ও বিনিময়ে হেসে বলে, এতো সকালে কি করছেন এখানে?
–উঠান ঝাড় দিই আব্বা৷ প্রতিদিন সকালে ঝাড় দিই আমি। পাতা দিয়ে উঠান ভরে যায়।
আবেগ দেখল উঠানের এক সাইডে এক গুচ্ছ পাতা জমিয়ে রাখা হয়েছে।
আবেগ বলল, ঠান্ডা লাগবে না আপনার?
–না৷ তুমি উঠেছো কেন এতো জলদি?
–ঘুম ভেঙে গেল।
নামাজে পড়েছে এই কথাটা আগ বাড়িয়ে বলে রিয়া করতে চায় না আবেগ৷
তালুকদার সাহেব বলে, নামাজ পড়েছো আব্বা?
–জি৷ আপনি?
–আমি মসজিদে গিয়ে পড়ি৷ আমাদের এখানে বিশাল মসজিদ। দুই তলা করা হবে আগামী বছর। এছাড়া টাইলস দিয়ে মেঝে বাধানো। বাথরুমের ব্যবস্থা। সব আছে।
–ও।
–আব্বা শুনো?
–বলেন।
তালুকদার সাহেব অনুরোধের গলায় বলল, আমি আর তোমার ফুফু আর ঢাকা ফিরব না। শেষ বয়সটায় এখানেই থাকব। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। খুব খাটুনি খেটে চাকরি করেছি আর পারি না। শরীরে কুলায় না। মেয়েটার কোন শখ-আল্লাদ আমি পূরণ করতে পারি নি। সেই সার্মথ্য আল্লাহ পাক আমাক্ব দেন নি।যদিও বা আমার মেয়েটার কোন শখ কোন দিন ছিল না। একটা আবদার করেছিল,,,,,,,
তারপর উনি বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে, সেটা পূরণ হলো ঠিকই কিন্তু,,,,
–বাদ দেন এসব কথা। শুনতে ভালো লাগছে না।
উনি জোড় করে একটা শ্বাস নিয়ে করুন গলায় বলে, মেয়েটা আমার খুব আদরের। ওকে সুখে রেখো। আমার মেয়েটা তো তোমার কাছে বেশি কিছু চায় নি। না চেয়েছে সোনা-দানা, কাড়ি কাড়ি টাকা। শুধু একটু ভালোবাসাই চেয়েছিল আমার মেয়েটা। তুমি ওকে হতাশ করোনা। এই ছোট্ট জীবনে বহুত কষ্ট সয়েছে মেয়েটা আমার ।
বলতে বলতে তালুকদার সাহেব কেদে দিলেন। আবেগ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কেউ কাদলে তাকে কি বলে সান্ত্বনা দিতে হয় জানা নেই আবেগের। এই মূহুর্তে সে করবে?
তালুকদার সাহেবের সাথে তাল মিলিয়ে কাদবে? ইশ কি ফালতু চিন্তা-ধারা!
আবেগ বলল, আমি চেষ্টা করব৷
তালুকদার সাহেব বলল, মানুষ চেষ্টা করলে সবই পারে আব্বা।
–হু। আচ্ছা শুনেন ভাবছি আজ রাতের বাসেই ফিরে যাব ঢাকা।
–আজকেই যেতে হবে? কাল-পরশু গেলে হয় না?
–না। কাজ আছে। অন্য কোন সময় এসে লং টাইম থাকব৷ আপনি ও ফুফুকে নিয়ে আসবেন আমাদের বাসায়।
–তা তো অবশ্যই।
আবেগ চলে যাব ওমনি তালুকদার সাহেব আবেগের হাত ধরে বলে, আব্বা! কথা দাও আমার মেয়েটাকে কোন দিন কষ্ট দিবে না?
আবেগ কথা দিল। এতে তালুকদার সাহেবের মুখে প্রশান্তির ছাপ বিরাজ করে।
আবেগ কথা দিল তালুকদার সাহেবকে যে রোদেলাকে কষ্টে রাখবে না কারন সে জানে রোদেলা কে কষ্ট সে দিবে না। এমনি কি যন্ত্রণা-কষ্টে রাখবে ও না।
কষ্টে রাখা আর সুখে রাখার মাঝে বেশ তফাত আছে! কাউকে খুব সহজেই কষ্টে রাখা যায় কিন্তু সুখে রাখা খুব ডিফিকাল্ট! আবার অপরুপ ভাবে কাউকে কষ্টে না রাখা যত সহজ তার চেয়ে হাজার গুন কঠিন কাউকে সুখে রাখা!
রুমে ঢুকে পড়ে আবেগ। রুমের মধ্যে শীত কম। দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় রুম উষ্ণ।আবেগ গিয়ে রোদেলার পাশে শুয়ে পড়ল।
আগে না বুঝলেও এখন বুঝে রোদেলা মেয়েটা বেশ ঘুম কাতুরে। এই যে আবেগ উঠে গেল কিন্তু টের পায় নি রোদেলা।
আবেগ শুয়ে পড়লেও তার চোখে ঘুম নেই। সে ভাবল সমুদ্র জেগে গেল তার সাথে কিছুক্ষন সময় কাটাবে কিন্তু সমুদ্র ও মায়ের মতো গভীরে ঘুমে আচ্ছন্ন। এখন সমুদ্র মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে শিখে যাচ্ছে।ঘুম থেকে উঠেই কান্না করে।
আবেগ ঘাড় উঠিয়ে সমুদ্র কে দেখে নিয়ে রোদেলার দিকে তাকালো।
তালুকদার সাহেব সঠিক বলেছেন৷ তার একমাত্র কন্যা তার কাছে কিছুই চায় নি শুধু চেয়েছিল ভালোবাসা! যেটা দিতে নারাজ ছিল আবেগ। মেয়েটা তার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিল কিন্তু দয়া হয় নি আবেগের।
আজো মনে পড়ে আবেগের সেই দিনটার কথা। তখন মাত্র পড়াশোনা শেষ রোদেলার। অর্নাস পাশ করে বের হলো ভার্সিটি থেকে। ব্যস পরিবারের সবাই উঠে-পড়ে লেগে গেল রোদেলার বিয়ে দেওয়ার জন্য। মেয়ের যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে! আরো দেরি করলে দুই বাচ্চার বাপ ছাড়া কেউ নাকি বিয়ে করবে না। এ দেশে অর্নাস পাশ করা মেয়ে নাকি মেয়ে না বরং মহিলা!
যাইহোক তিন-চারটা পাত্র দেখার পর রোদেলা সবার সামনে মুখ ফুটে বলে ফেলে সে আবেগকে বিয়ে করবে চায়।
আবগের বাবা রা দুই ভাই- এক বোন। সবার চেয়ে আবেগদের অবস্থা সবচেয়ে ভালো।
আবেগের মা তো রেগে গেলেন। সে ভাবতে লাগলো রোদেলাকে তাদের বাসায় থাকতে দিয়ে ই ভুল হয়েছিল। রোদেলা তার সহজ-সরল ছেলেকে ফাসাচ্ছে টাকার লোভে পড়ে।
আবেগের মতো কোয়ালিফাইট ছেলের সামনে রোদেলা মানায় না। তার উপর রোদেলার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না। খুব অশোচনীয়। কোন মতে আছে আর কি!
এমন মেয়েকে ঘরে বউ হিসেবে আনবে না জাবেদা খাতুন। তার খানদানি বংশের মেয়ে চাই। তার এক কথা ই ফাইনাল কথা। রোদেলাও কম না। আবেগকেই বিয়ে করবে৷ সে আবেগকে ভালোবেসে ফেলেছে। বারবার মুরুব্বি দের সামনে একই কথা রিপিট করতে থাকায় রোদেলাকে নিজের নামের আগে বেহায়া তকমা লাগাতে হয়।
তারপর ও ইমতিয়াজ রহমান রাজি ছিলেন৷ কিন্তু বাধা দিল আবেগ৷
সে রোদেলা কে ভালোবাসে না স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ব্যাপার টা। ব্যস, জাবেদা খাতুনের পাল্লা ভারি হয়ে যায়। তাকে আর থামায় কে? যাকে রোদেলা বিয়ে করতে চায় সে নিজেই রাজি না। কাহিনি এখানেই ডিসমিস।
এমন না যে তখন আবেগের নেহার সাথে খুব জম-জমাট প্রেম-প্রনয় —এ ধারণা ভুল।
আবেগ কোন দিন নেহাকে ভালোবাসি বলেছে কিনা সন্দেহ। নেহার সাথেও রিলেশনে জড়াতে চায় নি আবেগ।জোড়-জবরদস্তি করে নেহা আবেগের সাথে রিলেশনে যায়।
নেহা ভার্সিটি লাইফে থাকতেই আবেগকে প্রোপজ করে কিন্তু আবেগ রিজেক্ট করে দেয়৷ এই ঘটনার পর নেহা সুসাইড এটেম করে বসে।ব্যস আবেগ ভয় পেয়ে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেহার প্রোপোজাল এক্সেপ্ট করে। তবে এখানে একটা কথা বলা উচিত, যেদিন টা থেকে নেহার সাথে আবেগের দেখা হয় সেদিন থেকে রোদেলার সাথে মিস্টি সম্পর্ক টা নষ্ট হতে থাকে। আবেগ কিছুটা হলেও মুগ্ধ হয়েছিল নেহার চাকচিক্যময় রুপের প্রতি! কিন্তু সেটা খনিকের জন্য! তা প্রথমে ই বুঝে যায় আবেগ কিন্তু নেহা সেটা বুঝতে নারাজ!
রোদেলা জানত না আবেগ আর নেহার ব্যাপার টা। যখন রোদেলা আবেগকে বিয়ে করতে চাইল, সে সময় আবেগ খুব বিজি ছিল। ওয়ার্কশপ চলছিল তার। এই ওয়ার্কশপ তার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক জরুরি তাই সে এসব থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছিল।ওয়ার্কশপ সিলেটে হচ্ছিল। তাই ঢাকায় থাকত না আবেগ। কিন্তু রোদেলা নাছোড়বান্দা।তাকে ঢাকায় আনিয়ে ছাড়ে –মেয়েটা তবেই বুঝি স্বস্তি পায়!
আবেগ ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না রোদেলা। একথা শুনে আবেগের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। রোদেলার বান্ধবী তার সাথে প্রেম করার জন্য সুসাইড করতে চায় আর এদিকে রোদেলা তাকে বিয়ে করতে চাওয়ার জন্য পাগল!
আবেগ সাফ জানিয়ে দেয় সে রোদেলাকে বিয়ে করতে পারবে না। ঠিক সেই সময় রিশাদ প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাব জাবেদা খাতুন এনেছিল। সবাই রাজি হয়ে যায় রোদেলাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। রিশাদের মতো ছেলে নাকি হয় না। অনেক টাকা-পয়সা তাদের।
আবেগ ও রোদেলা কে বুঝায় সে নেহাকে ভালোবাসে। এদিকে নেহা ও রোদেলা কে হুমকি-ধমকি দেয় যদিও আবেগের কাছ থেকে সরে না আসে তবে সে রোদেলার লাইফ স্পয়েল করে দিবে। সে নিজের ও ক্ষতি করে বসবে। জাবেদা খাতুন বারবার রোদেলা কে অনুরোধ করে তার সোনার টুকরা ছেলের থেকে দূরে থাকার জন্য আর রিশাসকে বিয়ে করতে।
বেচারা রোদেলারই বা কি করার? বাধ্য হলো রিশাদকে বিয়ে করতে।রোদেলা সবার কথা শুনে, নেহার কথা ভেবে নিজের ভালোবাসা বলি দিয়ে বিয়ের পীড়িতে বসে এক বুক অভিমান আর হাজার -কোটি দুঃখ নিয়ে।
বিয়ের আগের রাতে সে আবেগের পা ধরে বলেছিল, আরেকবার ভাব্বার জন্য।
বাট ভাবে নি আবেগ। রোদেলা কে সেই ভাবে কাদিয়ে রেখেই যাত্রা শুরু করে সিলেটের উদ্দেশ্য। তার কাছে রোদেলার চোখের অশ্রুমালার চেয়ে ক্যারিয়ারের সার্টিফিকেট বেশি মূল্যবান লেগেছিল! এখানে দোষের কিছু দেখে নি আবেগ।
হুট করে সেই রাতের কান্না মাখা রোদেলার মুখটা ভেসে উঠে আবেগের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছ্যাত করে উঠে।
সে রোদেলার দিকে তাকালো। নাহ আজকের এই চেহারার সাথে সেদিন কার সেই অসহায় চেহারার কোন মিল নেই। বরং আজ রোদেলাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ শান্তি তে আছে।
হুট করে রোদেলা তার একটা হাত আবেগের বুকে দিয়ে দেয় ঘুমের মধ্যেই। আবেগ মুচকি হেসে আরেকটু রোদেলাকে ঘেষে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষন পর রোদেলা ঠিক ভোর বেলার মতো আবেগের বুকে এসে মাথা রাখে। আবেগ ও পরম যত্নে রোদেলাকে তার বুকে ঠায় দেয়।
আবেগের মনে প্রশ্ন জাগে, রিশাদের বুকেও কি এভাবে মাথা রাখত রোদেলা? একথা ভাবতে ই মাথা ধরে এলো তার। কিন্তু উত্তর জানার জন্য মন ছটফট করছে। ভালোবেসে কি রোদেলা কোন দিন রিশাদকে আলিঙ্গন করেছে?
রোদেলার যেদিন বিয়ে হয় সেদিন সিলেট গিয়ে পৌছে আবেগ। প্রায় পাচ মাস সেখানে অবস্থান করে যার কারনে রোদেলার বিবাহিত লাইফ সম্পর্কে কোন ধারণা তার নেই। ফিরে আসার কিছু দিন পর ই তো রোদেলা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বাপের বাড়ি ফিরল। রিশাদের চরিত্র সম্পর্কে আবেগ তো সমুদ্র হওয়ার দিন জেনেছে। আসলে সে চাইলে বহু আগেই সব জানতে পারত। সে কি পারত না? রোদেলাকে ভালো দেখে একটা বিয়ে দিতে? আচ্ছা সে এসব কি ভাবছে?নিজের বউয়ের বিয়ের কথা সে কেন ভাববে? আচ্ছা এই মূহুর্তে যদি আবেগ মারা যায় রোদেলা কি করবে? তৃতীয় বিয়ে করবে? আর যদি করেও সে কি কষ্ট পাবে? কিন্তু কথা হচ্ছে মরে গেলে কষ্ট পাবে কিভাবে?
★★★
সারা রিসোর্ট জুড়ে হৈ-হোল্লা, গান-বাজনার আওয়াজ। ফুলের গন্ধ তে সারা রিসোর্ট ই যেন মো মো করছে। আজকে শেখ বাড়ির বড়ই আদরের কন্যা মিতুর গায়ে হলুদ। প্রাচুর্যের ব্যস্ততার সীমা নেই। চারিদিকে তার তদারকি! কোথায় কি করতে হবে সব মুখস্ত তার! ডেকোরেশনে সামান্য তম ভুল হতে দিবে না সে।
এসব মাত্রার বাইরের বাড়াবাড়িতে নেহা বিরক্ত। কি দরকার এতো আলগা ভালোবাসা দেখানোর! প্রাচুর্যকে তার জাস্ট অসহ্য লাগে। সেই ক্লাস নাইন থেকে তার পিছনে জোকের মতো লেগে আছে। ছ্যাচড়া ছেলে কোথাকার৷ কিছু বলle দাত বের করে হাসে। এতে আরো রাগ উঠে নেহার। ভর দুপুর এখন। ওইপাশটায় খাওয়া -দাওয়া চলছে। খাওয়ার গন্ধ নাকে আসছে।
যেহুতু সম্পূর্ণ রিসোর্ট বুক করা হয়েছে তাই নেহা নিশ্চিত মনে দোলনায় দোল খাচ্ছে আর কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনছে৷ পরনে তার কাচা হলুদ রঙের ওয়ান পিজ। সবাই শাড়ি পড়েছে। অথচ সে একটা ওড়না পর্যন্ত গায়ে জড়ায় নি।
নেহা ইউব টিউবে গিয়ে তু মিলা নামে একটা গান সার্চ দিল। এই গান সে আগে শোনে নি। তার এক খুবই ক্লোস ফ্রেন্ড তাকে সাজেস্ট করেছে তাই শুনতে লাগে সে। অদ্ভুত সুন্দর গানটা।
নেহা তাল মিলিয়ে গাইতে লাগে,
তু মিলা আইসে
যেইসে বারিস কো মিলা জামিন। [হিন্দি গান শোনা হয় না তাই ভুল লিরিক লিখে থাকলে ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দিবেন কিংবা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]
হুট করে পেছন থেকে কেউ ভাউ করে শব্দ করে উঠে। আকষ্মিক এমন আওয়াজে নেহা ভয় পেয়ে যায় এবং তার হাত থেকে ফোন ধপ করে নিচে পড়ে গেল৷
তখনি নেহা প্রাচুর্যের হোহো হাসির শব্দ শুনে৷এবং সেদিকে তাকিয়ে দেখে প্রাচুর্য তার দিকে ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
নেহা ভর্য়াত চেহারা নিয়েই পালাতে যাবে ওমনি প্রাচুর্য নেহার হাত ধরে ফেলে।
নেহা নিজেকে ছাড়াতে চাইলে, প্রাচুর্য এক হ্যাচকা টন মেরে নেহাকে তার কাছে এনে বলে, এখানে কি করিস?
–তোর জানা লাগবে না। লিভ মি।
–খাইতে আয়।
—খাব না।
–ও আল্লাহ কেন? কাচ্চি মিস করবি নাকি? কাচ্চি, নান রোস্ট, গ্রিল ও আছে। তাও বুফ্যে। নেহা রে না খাইলে গ্রেট লস। এই লস তুই জীবনে ও পূরণ করতে পারবি না৷
–তুই খা না। আমাকে ছাড়।
–আমি ফাস্ট ব্যাচে একবার খাইছি৷ এখন আবার খাব।
–খাদক একটা!
–চল! তোর প্রিয় জর্দা পোলাও ও আছে।
–আমার জর্দা পছন্দ না।
–আমার তো পছন্দ জদা! আর আমার পছন্দ মানে আজ থেকে তোর ও পছন্দ।
–যত্তোসব! ডিসগাস্টিং!
–আই লাভ ইউ নেহা!
–সাট আপ।
–কিছু কথা কে সাট আপ করা যায় না রে!
নেহা প্রাচুর্যের দিকে তাকালো। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে। সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। চুল স্পাইক করা। হাতে ব্রান্ডের ঘড়ি। তাও নেহার মন জয় করতে পারল না প্রাচুর্য।
★★★
আয়নার সামনে বসে চুল আছড়াচ্ছে অথৈ। এমন সময় বাবার ডাক পড়ে। সে গুটি পায়ে বাবার রুমে যায়৷
অথৈয়ের বাবা পেপার পড়ছিলেন। মেয়েকে দেখে থমথমে গলায় বলে, তুমি নাকি জব পেয়েছো?
অথৈ একথা শুনেই কেদে দিল এবং বলল, বাবা প্লিজ! আমি চাকরি করতে চাই। প্লিজ!
–আমাকে জানাও নি কেন আগে?
–ভুল হয়ে গেছে?
অথৈয়ের বাবা বলল, পজিশন কি?
–জেনারেল এমপ্লয়ি। (মাথা নিচু করে বলে অথৈ)
অথৈয়ের বাবা হতাশ হয়ে বলে, কত শখ ছিল আমার তুমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবার নাম উজ্জ্বল করবে।আচ্ছা থাক বাদ দাও৷ এইসব চাকরি করতে হবে না। ফয়সাল মানা করে দিয়েছে।
–বাবা! এইটুকু বলে বাকি কথা আর বলে না অথৈ। রুম ছেড়ে বের হয়ে আসে গোমরা মুখ করে । চোখে অজস্র কান্না দলা পাকিয়ে আসছে৷
★★★
মেঘ অফিসে বসে কাজ করছে। হুট করে ফোনে মেমোরি আসল। আজকে ২৫ শে নভেম্বর!
তাদের প্রেমের এনিভারসিরি! আজকে সম্ভবত ছয় বছর হত যদি তাদের মাঝে সব ঠিক থাকত!
মেঘ মেমোরি দেখতে লাগলো। তার আর অথৈয়ের দুইটা ছবি।
ধানমণ্ডির রেস্টুরেন্ট চেরি ড্রপসে এ তোলা।অথৈকে খুব সুন্দর লাগছে। চেরি ড্রপস এ একটা সাইড আছে যেখানে উচু উচু টেবিল এবং পাশে সাদা কাজ করা দেয়াল। সেই দেয়ালের সামনে হাত ধরাধরি করে তোলা দুইটা ছবি। চমৎকার লাগছে অথৈকে সেই ছবি তে৷
চলবে।
[বেশ বড় করেই পর্বটা দিয়েছি কারন আগামীকাল দিব না। ]
চলবে৷
[আবেগের মতো আমিও অসুস্থ।গত কাল থেকেই অসুস্থ। আগামী পর্ব দিব কিন্তু খুব একটা বড় হবে না। ধন্যবাদ সবাইকে৷ ]